ভালোবাসো, মৃত্যুশয্যায়ও, মৃত্যুশয্যাকেও

নামাজি নামাজ পড়ছিলেন। মজনু (কয়েস) নামাজির সামনেই হাঁটাহাঁটি করছিল। নামাজ ভেঙে লোকটি মজনুকে পাকড়াও করে দু-এক ঘা লাগাল। বলল, নামাজির সামনে হাঁটাহাঁটি করলে গুনাহ হয়, জানিস না। মজনু বলল, অপদার্থ, ভণ্ড নামাজি! আমি তো প্রতি নিঃশ্বাসে-ভাবনায়-অস্তিত্বে লাইলি ছাড়া আর কিছুই দেখি না! যদি আল্লাহতেই তোর মন পড়ে থাকবে, অভিনিবেশ থাকবে, তবে আমাকে হাঁটাহাঁটি করতে দেখলি কীভাবে? 

বোস্তামি, মনসুর হাল্লাজ, নেজামি, রুমি ও তাবরিজির চিন্তা ছিল এই যে, নিবিষ্ট সমর্পণই প্রেমীর ‘ভালোবাসা’ এবং বান্দার ‘ইবাদত’-এর চাবিকাঠি। তাদের দৃষ্টিতে ভালোবাসা এক গভীর ইবাদত, ইবাদতও গভীরতম ভালোবাসা মাত্র। ‘ভালোবাসা’ এবং ‘ইবাদত’ শব্দ দুটি সমার্থক। দুটিই নিবিষ্ট সমর্পণ ও আত্মার একাত্মতা।

শিশু কায়েসকে তার নাম জিজ্ঞেস করা হলো। সে উত্তরে বলল ‘লাইলি’। পেন্সিল কাটতে নামল কায়েস। ছুরিতে কেটে চলছিল নিজ আঙুল। তবু ব্যাথার অনুভব নেই কায়েসের। লাইলি যেন কায়েসের ইবাদত।

মসনবি ঘরানার দ্বৈতছন্দপ্রধান এসব কাব্য-রূপকল্পগুলো কেন শক্তিশালী? কেনই বা হাজারটি বছর পরও ভোলা যায় না? কারণ প্রতিরূপের মাঝে নিজের অস্তিত্ব লীন করে নিজেকে চেনার দর্শনটি গল্পচ্ছলে এমন সহজ করে শুধুমাত্র সুফি দার্শনিকরাই বলতে পারেন।


তাবরিজি বলতেন, ‘প্রতিরূপের মাঝে নিজের অস্তিত্ব লীন করে দিয়ে নিজেকে চেনো।’ সক্রেটিস যেমন বলেছিলেন, ‘নো দাই সেলফ’- নিজেকে জানো। ‘প্রতিরূপ’কে ‘অপর’ বা ‘অন্য’ ভাবা ভুল। আয়না দেখার পদ্ধতির মতো। তবে আয়নায় ভেসে উঠবে ভিন্ন প্রতিচ্ছবি। সেই প্রতিচ্ছবিতে বিলীন হয়ে নিজেকে চেনার তরিকাও ‘নো দাই সেলফ’! যে কারণে শিশু কায়েস নিজের নামও বলল ‘লাইলি’। পেন্সিল ছাঁটতে বসে নিজের আঙুলটিই ছেঁটে চলছিল সে। 

‘মগজমস্তিষ্ক হতে যদি কাউকে বা কোনো ভাবনাকে তাড়াতেই না পারো, বুঝে নিও ওখানেই আসলে মানুষটির বা ভাবনাটির থাকার কথা। ওইটিই তার আসল আবাস। আসল ঠিকানা।’ নোবেলজয়ী সাহিত্যিক ডরিস লেসিংয়ের সুফি লেখক হয়ে ওঠার পেছনে এ সুফি দর্শনটি ছিল বড় অনুপ্রেরণা। অগ্রবর্তী কবি ওয়াল্ট হুইটম্যানও আত্মস্থ অন্তর্গত করেছিলেন ‘প্যাশন’- সুফি দর্শনের শেকড় প্রপঞ্চটি। 

লায়লি-মজনু সুফি কাব্য। সে কারণেই প্যাশন-রূপকল্পের এত ছড়াছড়ি। ‘পাঞ্জ’ বা পাঁচটি প্রেমগাথা, শাহনামা, ইউসুফ-জুলেখা কাব্য বা কারবালা সংক্রান্ত কাব্যগুলোর সহজ-অকপট হৃদয়াবেগের ও দর্শনের সীমাহীন শক্তির আকর্ষণেই ডরিস লেসিং সুফিবাদী সাহিত্যচিন্তা ও সাহিত্যকর্মে ঝুঁকেছিলেন বলে জানাতেন।


সুফি দর্শনে ‘ভালোবাসা’ কামজ অনুভূতি নয়, বরং হৃদয় ও আত্মার মিথস্ক্রিয়ার অনিশেষ আকুতি। প্রতিরূপের মঙ্গল কামনায় প্রেমীর হৃদয়-আত্মায় সদা-সর্বদা জপতে থাকা অন্তর্গত ইবাদত। যে ইবাদত শুধু নিজেকেই চেনায় না, বরং আত্মাকে ও অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে, কালিমামুক্ত করে। বোস্তামির দর্শনসূত্রটিই নিলেন রুমি ও তাবরিজি। বোস্তামির দর্শনসূত্রের একটি মূল উদ্দীপক ছিল মহানবীর অবিস্মরণীয় উক্তিটি, ‘নিজের অন্তরের ক্লেদ-কালো কুটিল শয়তানটিকে পরাস্ত করার যুদ্ধই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জেহাদ।’

বায়েজিদ বোস্তামির দৃষ্টিতে ‘ভালোবাসা’ উম্মুক্ত-উদার সীমা-পরিসীমাহীন! এ নিয়ে তাবরিজি ও রুমির হৃদয়গ্রাহী আলাপচারিতা হয়। তাবরিজি বললেন, ‘ভালোবাসা যেন মুখোমুখি দুটি কপাটহীন খোলা দরজা।’ (যাতে আশেক-মাশুকের নিত্য আসা-যাওয়া চলতেই থাকে)। রুমি বললেন, ‘না জনাব, যেখানে কোনো দেয়ালই নেই, সেখানে দরোজার দরকারই বা কী!’

বোস্তামির দর্শনে ‘ভালোবাসা’ আসলে ‘কৃতজ্ঞতা’ স্বীকার! মায়ের তৃষ্ণা মেটাতে বোস্তামি কী করেছিলেন? গভীর অন্ধকারে লম্বা সময় হেঁটে বহুদূরের কুয়া হতে পানি তুললেন। তারপর সারারাত মায়ের সিথানের কাছে পানি হাতে নিয়েই জেগে দাঁড়িয়ে থাকলেন। মা কখন জেগে উঠবেন, পানি চাইবেন সেজন্য। রুমি ও তাবরিজি বোস্তামির এ দর্শনটিই নিলেন। মানব-মানবীর ভালোবাসা তো বটেই, স্রষ্টা ও সব সৃষ্টির ভালোবাসাটুকুও কৃতজ্ঞতা স্বীকারেই বেঁচে থাকে। একাগ্র অন্তর সমর্পণ, এর নামই ‘ভালোবাসা’। আসলে কৃতজ্ঞতা স্বীকারের অন্য নাম! এখনো বেঁচে আছি, মুহূর্তমাত্র আগে নিঃশ্বাসটি নিলাম। শ্বাসটি নেয়ার আগেই তো মরে যেতে পারতাম! কিন্তু মরিনি! এই যে মুহূর্তটি, সেও তো একটি উপহারই। সেই উপহারের শোকর গোজারই ‘ভালোবাসা’। ইবাদত।


রুমি ও শামস তাবরিজির মধ্যে কেউ কারো গুরু ছিলেন না, কেউ কারো শিষ্যও ছিলেন না। কোলম্যান বার্কসেরও একই সিদ্ধান্ত। দুজন ছিলেন যেন পরস্পর সংলাপরত একই আত্মার দুটি খণ্ড। সক্রেটিস যেরকম সংলাপ করতেন সেরকম সংলাপই চলত দুজনের। সার্ত্রে ও ব্যুভোয়াঁ যেমন বাহাস-বিশ্লেষণে বসতেন সেরকম। [আমরা ভুল করে বলি প্লেটো শিষ্য ছিলেন, অ্যারিস্টটল প্লেটোর শিষ্য ছিল ইত্যাদি।] সুফি দর্শনে স্রষ্টা প্রেমী। তিনি নিজেই সৃষ্টির প্রেমে কাতর। সব সৃষ্টিকেই প্রাণ উজাড় করে শর্তহীনভাবে ভালোবাসেন। সমান প্রাণ উজাড় করা নিঃস্বার্থ প্রতি-ভালোবাসাটিই প্রত্যাশা করেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানব-মানবী, প্রাণিজগত, ফুল-পাখি-লতাপাতা, আকাশ-বাতাস সব সৃষ্টিকে ভালোবাসলেই স্রষ্টাকে ভালোবাসা হয়, কৃতজ্ঞতা জানানো হয়, ইবাদত হয়!

ইবাদতের একাগ্রচিত্ততা নিয়ে তাবরিজি-রুমির একটি ঘটনা আছে। কেউ একজন কোনোভাবেই ইবাদতে একাগ্রচিত্ত হতে পারছিল না। অস্থির মন এদিক-সেদিক ছুটে যাচ্ছিল। রুমি বললেন, ‘কারণ, মহামহিমকে তুমি ভালোবাসো না। ভীষণ ভয় পাও। পরকালের কঠিন শাস্তির ভয়ে বাধ্যবাধকতার ইবাদত করছ। তোমার একাগ্রতা কখনই আসবে না। যিনি নিঃশ্বাস দেন, প্রাণ বাঁচানোর পানি দেন, বাতাস দেন, কণ্ঠে সুমধুর সংগীত-সুর দেন, পাখির কুহু কুঞ্জন, বনের মর্মর শোনার শক্তি দেন, বায়ু-ফুল-পাখি-লতাপাতা-আকাশ সমুদ্র সব তোমার সেবায় উজাড় করে দিয়ে রেখেছেন- বলো তো, তিনি এত সব উপহার কেন দিয়ে রেখেছেন? অসীম ভালোবাসায় তোমাকে আঁকড়ে রেখেছেন বলেই করেছেন। তুমি কৃতজ্ঞ হও, তাকেও ভালোবাসো। যিনি এমনই ভালোবাসার আধার তিনি তোমাকে শাস্তি দেয়ার জন্য একাট্টা হয়ে আছেন- এমনটি তুমি ভাবলে কীভাবে?’ 

লোকটিকে আরও বললেন, ‘একটি সহজ উদাহরণ নাও। তোমার মনিব, যার খামারে কাজ করো, তিনি যদি তোমাকে শেকলে আটকে রাখেন, ভয়-ভীতি-হুমকিতে তটস্থ রাখেন, তাহলে তুমি তার খামারে আনন্দ-উচ্ছ্বাস ভরে নিজের অন্তর-মন উজাড় করে ফসল ফলাতে পারবে কি? নাকি বাধ্যবাধকতার চাপে দায় সারতে এবড়োখেবড়ো কিছু একটা করতে হয় বলেই করবে? আতঙ্কই তোমার শান্তি কেড়ে নিচ্ছে। অস্থির-অমনোযোগী করে তুলছে।’ 

লোকটি যখন তাবরিজির কাছে গেল, একই কথা শোনালেন তাবরিজি। যেন রুমির কথাগুলোই কোনো এক অদৃশ্য শক্তি হুবহু তার কণ্ঠে তুলে দিয়ে গেছে। রুমি আর তাবরিজির ভাবনাজগতের একাত্মতা ছিল এমনই অবিচ্ছেদ্য! 


তাবরিজি আরো বললেন, ‘একজন স্বৈরশাসক ভয় দেখিয়ে তোমাকে দিয়ে অনেক কিছুই করিয়ে নিতে পারেন। তুমি তাকে ঘৃণা করো বলে কাজগুলো করবে। ভালোবেসে তো করবে না। ধরো, সেই শাসকটি প্রজাদের ভালোবাসতেন। যুদ্ধের মাঠে তিনি আহত হলে তুমিই দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পানির সন্ধানে ছুটবে। আর তিনি নিষ্ঠুর শাসক হলে পানি পানি বলে চিৎকার করলেও তুমি এড়িয়ে যাবে। কারণ তার জন্য তোমার মন আর্দ্র হবে না। ঘরও রাজ্যই। তোমার প্রাণাধিকার যদি কর্তৃত্ববাদী হন, তোমাকে দখল করে রাখাই তার উদ্দেশ্য হয়, তার জন্যও তোমার মন আর্দ্র হবে না। তুমি কৃতজ্ঞ থাকতে পারবে না। সম্মানের বিপরীতে সম্মান, কৃতজ্ঞতার বিপরীতে কৃতজ্ঞতার নামই ভালোবাসা।’

সুফিরা অনন্তের প্রেমী, অনন্ত প্রেমী। তাদের প্রেমের ব্যাপ্তি মানবপ্রেম হতে প্রকৃতিপ্রেমে। প্রকৃতিপ্রেম হতে স্রষ্টাপ্রেমে। সুফি দর্শনের মূলে-শেকড়ে ভালোবাসার ফল্গুধারা। তারা জানান দেন, ভালোবাসায় আকণ্ঠ ডুবে থাকতে পারা সৃষ্টিজগতের এক চিরন্তন তৃষ্ণা। ভালোবাসায় আকণ্ঠ ডুবিয়ে রাখতে পারাও সৃষ্টিজগতের আরেক অনিঃশেষ তৃষ্ণা। 

রুমির একটি অমিয় কবিতাছত্র ইংরেজিতে অনুদিত হয়েছে এভাবে-  

Not only the thirsty seek the water

the water as well seeks the thirsty

এই লেখকের অনুবাদে-

কেবল তৃষ্ণাকাতর জল খোঁজে না ওরে

জলও সমান খুঁজছে তৃষিতরে!

সুফি দর্শনের সারসংক্ষেপ হিসেবে একবার এক এলোমেলো অসমাপ্ত লেখায় নোট লিখেছিলাম- 

পথিক, জেনে কাজ নেই- জানতেও চেও না এ পথ কোথা হতে এসে কোথায় মিশেছে! পথের জন্মবৃত্তান্ত জানে এমন বিজ্ঞান নেই, যুক্তিবিজ্ঞানও নেই। বনগভীরে পথ হারিয়েছো, পথিক? ক্লিষ্ট ঘাস-মরা পাতায় সরু রেখা পথও পেয়েছ একটি? বুঝে নিও পথ হারিয়েছিল কোনো কাঠুরেও! কিংবা অন্য কোনো পথিক! তুমি পা রাখবে বলে পথরেখা এঁকে দিতেই হয়তোবা! পথ পথিকের সৃষ্টি করে না- এ অভিজ্ঞান মানি না! পথই বুকে টেনে নেয় পথিকের পথচলা। পথিক পথকেও ভালোবাসো। পথও যে তোমায় ভালোবাসে। 

সুফি দর্শনমতে, প্রতিরূপের ভালোবাসায় বিলীন হয়ে নিজেকে চেনা, আত্মাকে পরিশুদ্ধ করাই ইবাদত। তাবরিজি ও রুমি, বোস্তামি হতেই ধারণাটি নিয়েছিলেন। গূঢ় দর্শনটি ধরতে লিখেছিলাম-  

I love the messenger- the mailman,
alike the letter of my beloved
All of us made this family!
I loved God, 
loved his messenger of death too, verily!
ভালোবাসি প্রিয়ার চিঠি, যে পত্রবাহক, ভালোবাসি তাকেও 
ভালোবাসি। ভালোবাসি মৃত্যুশয্যায়ও, ভালোবাসি মৃত্যুশয্যাকেও!


-লেখক: শিক্ষক, নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //