ঘাসান কানাফানি

‘আমি ফিলিস্তিনের সন্তান’

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের অন্যতম প্রধান আরব্য উপন্যাসিক ও প্রগতিবাদী নাট্যকার ঘাসান ফায়িজ কানাফানি ফিলিস্তিনের আক্কা শহরে এক মধ্যবিত্ত সুন্নি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন ঘাসান কানাফানি। মুহাম্মদ ফায়িজ আব্দ আল রাজ্জাক ও আইশা আল-সালিমের তৃতীয় সন্তান কানাফানি। তার পিতা ছিলেন একজন আইনজীবী, যিনি ব্রিটিশ দখলদারিত্ববিরোধী জাতীয় আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে ভূমিকা পালন করেছিলেন। ঘাসান যখন ছোট তখন তার পিতা রাজ্জাক অনেকবার জেলও খাটেন। ড্যানিশ নাগরিক অ্যানি হুভারের সঙ্গে কানাফানির বিবাহ হয়েছিল।

জাফার একটি ফরাসি ক্যাথলিক মিশনারি স্কুলে কানাফানি তার প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। ১৯৪৮ সালে যখন আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধ শুরু হয় এবং তা আক্কাতেও ছড়িয়ে পড়ে, তখন মাত্র বারো বছর বয়সে কানাফানি ও তার পরিবারকে জাফা ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। নিজের দেশ ছেড়ে পালিয়ে লেবাননের উত্তরের দিকে যাবার পর সিরিয়ার দামেস্কে তারা ফিলিস্তিনি শরণার্থী হিসেবে স্থায়ী হন। তারা তুলনামূলকভাবে দরিদ্র ছিলেন, কানাফানির পিতা ছোট পরিসরে সেখানে আইন ব্যবসা শুরু করেন। কানাফানি একটি ছাপাখানায় কাজ নেন। পরে তিনি সংবাদপত্র বিতরণের কাজ করেন এবং রেস্তোরাঁতেও কাজ করেন। তিনি দিনে কাজ করতেন এবং রাতে লেখাপড়া করতেন। এভাবে তিনি তার মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন এবং ১৯৫২ সালে ফিলিস্তিন শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্ম সংস্থার শিক্ষাবিষয়ক সনদপত্র গ্রহণ করেন। শরণার্থী ক্যাম্পে প্রায় শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য তিনি আর্টের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান, যেখানে তিনি ছাত্রছাত্রীদের তাদের পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলতে সাহায্য করার জন্য ছোট গল্প লিখতে শুরু করেন।

১৯৫২ সালে কানাফানি দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে তার আরব ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা ড. জর্জ হাবাশের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, তিনি তাকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করেন এবং তাঁর প্রথম দিকের কাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেন। এই পরিচয়ের পর থেকে কানাফানি সাপ্তাহিক আল-রা’ই ম্যাগাজিনের জন্য লেখা শুরু করেন। ১৯৫৫ সালে ‘জায়নবাদী সাহিত্যে বর্ণ ও ধর্ম’ শীর্ষক একটি থিসিস দিয়ে তাঁর ডিগ্রি সম্পন্ন করার আগে, কানাফানিকে আরব ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্টের আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।

এরপর ১৯৫৬ সালে কানাফানি কুয়েত চলে যান এবং শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৫৭ সালে আল রাই-র সম্পাদক হন এবং সেই বছরই তার প্রথম গল্প ‘এ নিউ সান’ প্রকাশিত হয়। তিনি সে সময় আরব ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্টের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক আল-ফাজর ম্যাগাজিনের জন্যও লিখছিলেন। ১৯৬০ সালে কানাফানি কুয়েত থেকে বৈরুত চলে যান। সেখানে তিনি মুভমেন্টে প্রকাশিত ম্যাগাজিন আল-হুররিয়ার সম্পাদকীয় পর্ষদে যোগ দেন এবং মাসিক ক্রোড়পত্র ফিলাস্টিনের দায়িত্বও পান। ১৯৬৩ সালে তিনি দৈনিক আল-মুহাররির সম্পাদক হন। ১৯৬৭ সালে তিনি দৈনিক আল-আনোয়ারের সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্রের সম্পাদক হন এবং ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত এই পদে কাজ করেন।

কানাফানি ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পপুলার ফ্রন্ট ফর দি লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন এবং তার রাজনৈতিক ব্যুরো নির্বাচিত হন। এরপরে তিনি এই আন্দোলনের মুখপাত্র হন এবং এর মিডিয়া কার্যক্রমের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৬৯ সালে এই আন্দোলনের আল-হাদাফ ম্যাগাজিনের সম্পাদক হন। ১৯৭২ সালে তাকে হত্যার আগ পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন।

ঘাসান কানাফানি একজন মৌলিকতা ও বহুপ্রতিভার অধিকারী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ছোট গল্প, উপন্যাস এবং নাটক পাশাপাশি সাংবাদিকতা সংক্রান্ত নিবন্ধ এবং বিশ্লেষণমূলক লেখা লিখেছেন; আরব প্রকাশনা সংস্থাগুলো (দার আল-তালিয়া, মুআসাসসাত আল-আবহাত আল-আরবিয়া এবং মনসুরাত আল-রিমাল) তার সংগৃহীত রচনাগুলোর বহু সংস্করণ প্রকাশ করেছে। তাঁর অনেক রচনা অনুবাদ হয়েছে এবং ১৬টি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি একজন প্রতিভাবান চিত্রশিল্পীও ছিলেন। তাকে হত্যার পরে তাঁর কিছু উপন্যাস এবং গল্পগুলো থেকে ফিচার ফিল্ম বা শর্ট ফিল্ম হয়েছে, যেমন তার প্রথম উপন্যাস মেন ইন দ্য সান, যা ১৯৭৩ সালে দ্য ড্রেসিড নামে একটি ফিচার ফিল্ম হয়েছে। এই চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন মিসরীয় তৌফিক সালিহ এবং প্রযোজনা করেছেন দামেস্কের জেনারেল ফিল্ম ইনস্টিটিউশন। ছবিটি ১৯৭৩ সালে আরব এবং আফ্রিকান সিনেমার কার্থেজ ফেস্টিভ্যালে গোল্ডেন প্রাইজ লাভ করেছিল। অনেক সমালোচক আরব সিনেমার ১০০ গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রের তালিকায় দশম স্থান অধিকার করে এই চলচ্চিত্রটিকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম বিশিষ্ট রাজনৈতিক চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচনা করে। এই তালিকাটি কয়েকশ’ সমালোচকের সমীক্ষার পরে সংকলিত হয়েছিল এবং ২০১৩ সালে দুবাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ঘোষণা করা হয়েছিল।

১৯৬৬ সালে, বৈরুতের ফ্রেন্ডস অব দ্য বুক সোসাইটি কানাফানিকে তার ‘অল দ্যাটস লেফট টু ইউ’ উপন্যাসের জন্য বার্ষিক পুরস্কার প্রদান করে। ১৯৭৪ সালে তিনি মরণোত্তরভাবে ওয়ার্ল্ড ইউনিয়ন অব ডেমোক্রেটিক জার্নালিস্টস পুরস্কার এবং ১৯৭৫ সালে এশিয়ান ও আফ্রিকান লেখকদের ইউনিয়ন কর্তৃক সাহিত্যের জন্য বার্ষিক লোটাস পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। ১৯৯০ সালে পিএলও তাঁকে সংস্কৃতি, কলা ও সাহিত্যের জন্য জেরুজালেম পদক প্রদান করে।

মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ১৯৭২ সালের ৮ জুলাই বৈরুতে কানাফানিকে হত্যা করা হয়। তার অস্টিন ১১০০ মডেলের গাড়ির পেছনের বাম্পারে ৩ কেজি ওজনের প্লাস্টিক বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার পর দেখা যায় তিনি এবং তার ১৭ বছরের ভ্রাতষ্পুত্র লামিস নাজিম পুড়ে ভস্মীভূত হয়েছেন। ইসরায়েলের প্রধান ও জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ শেষ পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে। লড বিমানবন্দর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কানাফানিকে হত্যা করা হয়েছিল, যা জাপানি রেড আর্মির তিন সদস্য কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছিল। এ সময় কানাফানি পিএফএলপির মুখপাত্র ছিলেন, এবং দলটি হামলার দায় স্বীকার করেছিল। লেবাননের দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকা কানাফানির মৃত্যু সংবাদে লিখেছিল, ‘তিনি এমন যোদ্ধা ছিলেন যে, কখনো বন্দুক চালাতেন না, যার অস্ত্র ছিল বল-পয়েন্ট কলম, এবং তার রণক্ষেত্র ছিল তার পত্রিকার পাতাগুলো।’

ঘাসান কানাফানি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যিনি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন প্রথিতযশা লেখক, একজন দক্ষ শিল্পী, একজন আধুনিকতার সংমিশ্রণের উদার মানসিকতার অধিকারী মানুষ। তাঁর প্রাথমিক সাহিত্যকর্মে ফিলিস্তিনকেই এর অবনমিতার কারণ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। পরবর্তীতে তিনি ফিলিস্তিনকে একটি সম্পূর্ণ মানবতার প্রতীক দেখতে পেয়েছিলেন, যে জন্য তিনি তাঁর গল্প ও উপন্যাসগুলোতে কেবল ফিলিস্তিনি এবং তাদের সমস্যার কথাই নয়, ফিলিস্তিনিদের যন্ত্রণা ও বঞ্চনার মানবিক দুর্দশার বিষয়গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলে ধরেছেন। ঘাসান কানাফানি তার গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আমরা রক্ত দিয়ে ফিলিস্তিনের জন্য লিখি।‘ সত্যিই ঘর ছাড়া দেশ ছাড়া হবার পরও ফিলিস্তিনের জন্যই তিনি তার শেষ বিন্দু রক্ত দিয়েই লিখে গিয়েছেন আমি ফিলিস্তিনের সন্তান।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //