বাঙ্কসি- রাস্তাই যার ক্যানভাস

আমরা যখন বাজারে যাই, তখন একজন ক্রেতা এবং বিক্রেতা দেখতে পাই। ক্রেতা টাকা নিয়ে যায় পণ্য কেনার জন্য, বিক্রেতা পণ্য নিয়ে আসে বিক্রির জন্য। ক্রেতা এবং বিক্রেতার বেচাকেনার এই নিরীহ কাজের মধ্যে আমরা বাইরে থেকে শুধু ক্রেতা, বিক্রেতা, পণ্য এবং টাকা দেখতে পাই; কিন্তু প্রকৃত ক্রয়-বিক্রয় হয় টাকা এবং পণ্যের মাঝে। বলাই বাহুল্য টাকাও একটা পণ্য। অর্থাৎ বাজারের এই কেনা-বেচা মূলত হয় দুটি পণ্যের মাঝে। এভাবে বিষয় (টাকা ও পণ্য) রূপান্তরিত হয় বিষয়ীতে (ক্রেতা-বিক্রেতা) এবং বিষয়ী রূপান্তরিত হয় বিষয়ে। বিষয়ী নিষ্কর্ম বা দমিত হয় এবং বিষয় সকর্ম বা দমনকারীতে পরিণত হয়। এভাবে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় বিষয়ী ক্রেতা-বিক্রেতা অদৃশ্য হয়ে যায়, দৃশ্যমান থাকে শুধু বিষয় নামক দুটি পণ্য। এই দৃশ্যমান পণ্য নিয়েই পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার কারবার, অদৃশ্য ক্রেতা-বিক্রেতা নিয়ে নয়। এই দুই পণ্যের মধ্যে দালাল বা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে উপস্থিত হয় ইমেজ বা ভাবমূর্তি। ১৯৬৭ সালে ফরাসি তাত্ত্বিক গি দ্যবোর চমৎকার একটি বই লেখেন, ‘দ্য সোসাইটি অব দ্য স্পেকটেকাল’ নামে।পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার অপর নাম কনজুমার কালচার বা ভোক্তা সংস্কৃতি।

ভোগের বাইরে ভোক্তা কিছুই দেখতে পায় না। ভোগ হলো তার অস্তিত্ব প্রমাণের একমাত্র হাতিয়ার। এই ভোক্তাকে আকর্ষণ এবং চলমান রাখার জন্য সমাজে নানারকম ইমেজ বা ভাবমূর্তি জারি রাখা হয়। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় এই ইমেজ বা ভাবমূর্তিগুলো আমাদের প্রতি দিনের ঘটমান বিষয়গুলো বিজ্ঞাপন, টেলিভিশন, সিনেমা, সেলিব্রিটি ইত্যাদির মধ্য দিয়ে কীভাবে প্রকাশিত হয়, উপস্থাপন করা হয় দ্যবোর তার বইয়ে চমৎকার করে ব্যাখ্যা করেন। দ্যবোরের মতে, জনগণের সেবা নামে এসব ভাবমূর্তি পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে স্বৈরাচারের রাজত্ব কায়েম করে। বিজ্ঞাপন, টেলিভিশন ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে যা দেখানো হয়, আমাদের সেটাই দেখতে হয়, যা বিশ্বাস করানো হয়, সেটাই বিশ্বাস করতে হয়। এসব একতরফা দর্শন, বিশ্বাসের মধ্যে জনগণের কোনো অংশ থাকে না। অর্থাৎ জনগণের কোনো মতামত থাকে না। দূরদর্শন, সিনেমা, বর্তমান সময়ের গুগল, ইন্টারনেট ইত্যাদি যে মতামত বা ব্যাখ্যা দেয় সেটাই জনগণকে গ্রহণ বা বর্জন করতে হয়। কেনিয়ার বিখ্যাত লেখক গুগি ওয়া টি ওঙ্গো তার ‘শিল্পী ও রাষ্ট্র : সম্পর্কের টানাপড়েন’ প্রবন্ধের কিছু চৌম্বক অংশ এখানে তুলে ধরছি, ‘রাষ্ট্রের চরিত্র রক্ষণশীল। শিল্প চরিত্রই বিপ্লবী। রাষ্ট্র গতিকে থামাতে চায়, মুহূর্তের পুনরাবৃত্তি চায়। শিল্প চিন্তা, প্রকৃতি এবং জীবনের মূলধারা, গতি ইত্যাদির পরিবর্তন চায়। একজন শিল্পী তার নিজের মতে বিশ্বাসী হয়, রাষ্ট্রের তৈরি মতে নয়। সে নিজের বিবেক থেকে তৈরি হওয়া প্রশ্ন করে, কোথাও স্থিত হয় না, উত্তেজিত হয়, অন্যকে বোঝায়, প্রত্যেককে প্রমাণ করতে বলে, প্রশ্ন করে। রাষ্ট্র এসবকে হত্যা করে। শিল্পের কাছে উত্তরের চেয়ে প্রশ্নের সংখ্যাই বেশি। রাষ্ট্রের কাছে অনেক উত্তর এবং প্রশ্ন প্রায় নেই বললেই চলে। রাষ্ট্র যত স্বেচ্ছাচারী হবে, তত নিজেকে কম প্রশ্ন করবে। অন্যের প্রশ্ন তত কম শুনতে চাইবে। যারা রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করে, তারা বিদ্রোহী, ধ্বংসকারী, তারা উন্মাদ। এত সত্ত্বেও প্রশ্নের কাজ কিন্তু কখনো থেমে থাকে না। শিল্পী নামের উন্মাদেরা যুগ যুগ ধরে রাষ্ট্রকে তাদের আঁকার তুলি অথবা লেখার কলম বা কি-বোর্ডের অক্ষরে প্রশ্নের বানে জর্জরিত রেখেছে। তথাকথিত বিদ্রোহী, ধ্বংসকারী শিল্পসত্তার প্রকাশ ও বিকাশ ঘটিয়েছে।

ইংরেজি এপিগ্রাম বা শ্লেষ শব্দটি এসেছে প্রাচীন গ্রিক শব্দ এপিগ্রাম অর্থাৎ শিলালিপি থেকে, যেখানে লেখা খোদাই করা হয়। প্রাচীন গ্রিসে বিভিন্ন ধরনের শ্লেষ মেশানো বিদ্রুপাত্মক শব্দ বা বাক্য সংক্ষিপ্ত আকারে খোদাই করা হতো। যেমন থারমোপ্যালি যুদ্ধের পর একটা সমাধি স্তম্ভে লেখা ছিল, ‘এখানে যদি কেউ আমাদের শায়িত দেখতে পায়, স্পার্টার আগন্তুকদের বলে দিও, আমরা আমাদের পিতৃভূমির সকল ধরনের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলাম।’ রোমান এপিগ্রাম বা শ্লেষগুলো গ্রিকদের থেকে নিলেও, রোমানদের শ্লেষগুলো গ্রিকদের থেকেও ধারালো ছিল। পম্পেই নগরীতে গ্রাফিতি আকারে লাতিন ভাষায় লেখা এপিগ্রাম, দুই লাইনের একটা কবিতা, যা স্বল্প শিক্ষিত মানুষের দ্বারা লেখা, অথচ আজও বিখ্যাত হয়ে আছে- 

‘আমি অবাক হচ্ছি দেয়ালটি এখনো ভেঙে পড়ে নাই, 

সেই থেকে এতগুলো কবির ক্লান্তিকর কবিতা এখনো ধরে রেখেছ।’

এভাবেই প্রাচীন গ্রিস, রোমান যুগ থেকে আমরা গ্রাফিতির উদ্ভব এবং বিকাশ দেখতে পাই। তারও আগে গুহাচিত্রের কথা আমরা সবাই জানি। শিল্পকর্মে ব্যাঙ্গ বা শ্লেষের উদ্ভব ঘটে বিদ্রোহী মনোভাব থেকে। প্রতিবাদ থেকে। ফ্রান্সে ১৯৬৮ সালের মে মাসের ছাত্র আন্দোলনের সময়ে প্রধানত আর্ট স্কুলের ছাত্ররা এরকম কিছু প্রতিবাদী পোস্টার, গ্রাফিতি নির্মাণ করে। যার ভাষাগুলো ছিল- ‘বাঁচার অধিকার চাইতে যেওনা, ছিনিয়ে নাও’, ‘আমার মুক্তি আমার হাতে, তুমি কে?’, ‘চিন্তা থেমে গেলে, পচে’, ‘স্বর্ণযুগ হলো সেই যুগ, সোনা যখন শাসাতো না’, ‘ব্যারিকেড রাস্তা আটকায়, কিন্তু পথ খুলে দেয়’। 

এরকমই একজন প্রতিবাদী শিল্পী বর্তমান সময়ে দেয়ালে গ্রাফিতি, মুরাল এঁকে পথ খুলেছেন, যার নাম বাঙ্কসি। বাঙ্কসি প্রধানত স্ট্রিট আর্টিস্ট নামে বেশি পরিচিত হলেও, তাকে গ্রাফিতি শিল্পীও বলা হয়। ব্যঙ্গাত্মক স্ট্রিট আর্ট এবং বিপর্যয়কর এপিগ্রাম গ্রাফিতির মধ্যে দিয়ে দর্শকের কাছে গম্ভীর হাস্যরসের এক অনবদ্য প্রকাশ ঘটেছে বিগত বিশ-পঁচিশ বছর ধরে। বাঙ্কসির পরিচয় নিয়ে বিতর্ক আছে। আমরা সেদিকে যাব না। মূলত তার কাজ নিয়ে আমরা আলোচনা করব। এখানে শুধু এটুকু বলে রাখা দরকার, বাঙ্কসির জন্ম ১৯৭৩ সালের ২৮ জুলাই, ব্রিস্টলে। সেখানেই লেখাপড়া এবং বেড়ে ওঠা। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়স থেকে তার আঁকার কাজ শুরু হয়। স্কুল থেকে তাকে শুধু বহিষ্কার করা হয় নাই, ছোটখাটো অপরাধে কয়েকবার জেলও খাটতে হয়; কিন্তু আজ তার কাজ ভিয়েনা থেকে স্যান ফ্রান্সিসকো, বার্সেলোনা থেকে প্যারিস, ডেট্রয়েট, নিউইয়র্ক থেকে প্যালেস্টাইনের দেয়ালে ছড়িয়ে গেছে। মোটামুটি নব্বইয়ের দশক থেকেই বাঙ্কসি দৃশ্যমান হতে শুরু করে; কিন্তু বাঙ্কসি নিজেকে রাখেন অদৃশ্যমান। এই অদৃশ্যমান থাকার পেছনে, প্রধান যে দর্শন বা চিন্তাটা কাজ করে বলে আমাদের কাছে মনে হয়, সেটা হলো, বাঙ্কসির কাছে হয়তো, শিল্পীর চাইতে শিল্পকর্ম অর্থাৎ কাজটাই প্রধান। চিত্রের চাইতে চিত্রকর্মের মেসেজ পৌঁছানোই আসল কথা। তাছাড়া গ্রাফিতির প্রতিবাদী চরিত্রের কারণে গ্রাফিতি শিল্পকে এক রকম অবৈধ শিল্প হিসেবে দেখা হয়। অবৈধ শিল্পের মধ্যে দিয়ে যদি বৈধ কাজের প্রকাশ ঘটানো যায়, তবে অবৈধ শিল্পই গড়ে তোলা দরকার।

গ্রাফিতি বা স্ট্রিট আর্ট যে নামেই ডাকা হোক না কেন, নামের মধ্যে দিয়েই বোঝা যায়, এসব শিল্পকর্ম এমন এক শিল্প, যা গ্যালারিতে প্রদর্শনীর জন্য নয়। উন্মুক্ত জায়গায় প্রদর্শনের জন্য এসব শিল্পকর্ম নির্মাণ করা হয়। থিয়েটারের ক্ষেত্রে আমরা যেমন থার্ড থিয়েটার বা পথনাটক দেখতে পাই তার সঙ্গে স্ট্রিট আর্টের বেশ মিল পাওয়া যায়। তবে কোনো শিল্পীর শিল্পকর্ম যখন খুব বেশি জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়, সেসব ক্ষেত্রে গ্যালারিতে কিছু কিছু প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতেও দেখা যায়। বাঙ্কসির ক্ষেত্রেও সেসব কিছু করতে দেখা যায়। তবে তার সব কাজ মূলত দেয়ালেই আঁকা হয়েছে। নব্বইয়ের দশক থেকে বাঙ্কসি যখন দৃশ্যমান হতে শুরু করেন, সেই সময়ে ১৯৯৯ সালে তার একটি ম্যুরাল ‘দ্য মাইল্ড মাইল্ড ওয়েস্ট’ শুধু দৃশ্যমান হয়নি, রীতিমতো পুলিশের নজরে চলে আসে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ব্রিস্টলের পরিত্যক্ত কিছু পণ্যগুদামে ‘র‌্যাভস’ নামে পরিচিত নাচ-গানের কিছু অবৈধ গোষ্ঠী সেসব পণ্যগুদামে নাচ-গানের আসর বসাত। বিষয়টি তখন পুলিশি নজরদারিতে চলে আসে এবং যখনই কেউ নাচের জন্য সেসব গুদামের দিকে যেত পুলিশ তখনই তাদের বাধা দিত। এই বিষয়টিকে সামনে রেখে বাঙ্কসি তার দ্য মাইল্ড মাইল্ড ওয়েস্টে আঁকলেন। তার সেই চিত্রকর্মে দেখা যায়, একটি টেডি বিয়ারের হাতে পেট্রল বোমা এবং তার সামনে তিনজন পুলিশ দাঁড়ানো। আসলে সেসব নাচগান ছিল ব্রিস্টলের সংস্কৃতির একটা অংশ। এই সংস্কৃতি রক্ষা করার জন্য, হিপ্পিরা কত দৃঢ় মনোবল নিয়ে সরকার এবং বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে এই চিত্রের মধ্যে দিয়ে বাঙ্কসি সেটাই দেখাতে চেয়েছেন।

২০০৪ সালে বাঙ্কসির আরেকটি কাজ ‘কিসিং কোপার্স’ ও বেশ সাড়া জাগায়। স্প্রে আর্টের এই ছবিতে আমরা দেখি দুই পুলিশ চুমুরত অবস্থায় দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে আছে। একজনের হাতে হাতকড়াও আছে। প্রশ্ন হলো কেন পুলিশকে ছবির চরিত্র হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে? এর দুটি কারণ থাকতে পারে। এক. সমকামিতা, যা ইউরোপে বিষয়টির অধিকার নিয়ে বহুদিন ধরে আন্দোলন চলছে, সেটিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সমাজের অন্যসব মানুষ রেখে, পুলিশকে বেছে নেওয়া হয়েছে, যাতে সবার নজর কাড়া যায়। অথবা দুই. পুলিশ যেহেতু রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিফলিত, কাজেই রাষ্ট্রীয় নির্যাতনকে ব্যঙ্গ করার জন্য পুলিশকে বেছে নেওয়া হয়েছে। বাঙ্কসির আরেকটি কাজেও আমরা অনেকটা এরকম আভাস পাই। যেখানে, রানী ভিক্টোরিয়াকে লেসবিয়ান হিসেবে হাজির করা হয়। সাধারণত অ্যান্টি স্ট্যাবলিশমেন্ট শিল্পীরা এই ধরনের কাজ করে থাকেন। মজার বিষয় হলো এই স্প্রে আর্টের কাজটা যখন প্রিন্স অ্যালবার্ট পাবে, পাবের মালিকের অনুমতি নিয়ে আঁকা হয়, তখন পাবের মালিক আঁকাটি দেখে বেশ ঘাবড়ে গেলেও, পরবর্তীতে দেখা যায়, অনেক পুলিশ সেই চিত্রকর্মের ছবি হাসিমুখে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।

লিওনার্দো ভিঞ্চির বিখ্যাত ‘মোনালিসা’ কে নিয়ে প্রচুর কাজ হয়েছে এবং হচ্ছে। বাঙ্কসিও মোনালিসা থেকে বাদ পড়েননি। খুব স্বাভাবিকভাবে, বাঙ্কসির মোনালিসা অন্য সাধারণ মোনালিসা থেকে অবশ্যই ভিন্ন এবং আরও অর্থপূর্ণ হবে। ২০০৭ সালে লন্ডনের সোহো এলাকায় স্টেনসিলে আঁকলেন রকেট নিক্ষেপ হাতে মোনালিসাকে। মোনালিসার মুখটিকে অবিকল একরকম রেখে তার হাতে ধরিয়ে দিলেন এই মারাত্মক অস্ত্রটি। তবে লিওনার্দো ভিঞ্চির সেই রোমান্টিক মোনালিসার মুখ নয়। বাঙ্কসির মোনালিসা ভয়ংকর চেহারার। ভয়ংকর এই কারণে, বিগত এবং বর্তমান শতাব্দীর বিরামহীন যুদ্ধ দেখেও, পুঁজিবাদী অর্থনীতির ভোগবাদী সমাজ তাদের ভোগ নিয়ে এতটাই মত্ত যে, কোনো যুদ্ধের ঘটনা এখন আর তাদের স্পর্শ করে না। যুদ্ধ যেন তাদের কাছে একটি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়।

১৯৭২ সালের ৮ জুন দক্ষিণ ভিয়েতনামে যখন নাপাম বোমা ফেলা হয়, তখন ট্র্যাঙ্গ ব্যাঙ্গের কাছে রাস্তার ওপর আতঙ্কগ্রস্ত, অসহায় কিছু শিশু এবং ভিয়েতনামী সেনাদের পলায়নরত ছবিটির কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। প্রেস চিত্রগ্রাহক নিক উটের তোলা সেই ছবিটি যুদ্ধ আইকনে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ৯ বছর বয়সী উলঙ্গ শিশুটির কথা, যার নাম ফ্যান থি কিম ফুক হলেও যাকে নাপাম মেয়ে নামেই ডাকা হতো, তার সেই ভয়, ত্রাস এবং কান্না মেশানো মুখটা যারা একবার দেখেছেন, কেউ কখনো ভুলতে পারে নাই, পারবে না। পুঁজিবাদবিরোধী, যুদ্ধবিরোধী বাঙ্কসি অসাধারণ দক্ষতায় সেই ছবিটিও এঁকেছেন ভিন্ন আঙ্গিকে ২০০৪ সালে। তার সেই চিত্রকর্মে আশপাশের সব শিশু এবং সেনাদের সরিয়ে দিয়ে শুধু নাপাম মেয়েটিকে রাখা হয়েছে। মেয়েটির একপাশে মিকি মাউস এবং অন্যপাশে রোনাল্ড ম্যাকডোনাল্ড হাসিমুখে মেয়েটির দুটি হাত দুই পাশ থেকে ধরে রেখেছে। মিকি মাউস এবং রোনাল্ড ম্যাকডোনাল্ড- দুটিই আমেরিকান পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রতিনিধিত্ব করে। যে অর্থনীতি জানে শুধু বোমা ফেলতে। সাহিত্যের ভাষায় ছবিটিকে ‘ডার্ক কমেডি’ বলা যায়। ছবিটি প্রসঙ্গে বাঙ্কসির নিজের একটি কথা উদ্ধৃত না করলেই নয় - ‘পৃথিবীর সব থেকে বড় অপরাধ নিয়ম ভঙ্গ করা নয়, নিয়ম মেনে চলা। এই নিয়ম মেনেই মানুষ বোমা ফেলে, গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করে’ - (theartstory.org)।

জর্জ ওরওয়েল তার ‘নাইনটিন এইটিফোর’ উপন্যাসে লিখেছিলেন, ‘তুমি যদি কিছু গোপন করতে চাও, তবে সেটা নিজের থেকেও গোপন রাখো’। পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় নজরদারি এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে যে, মানুষ কোনো কিছুই আর গোপন রাখতে পারছে না। এই নজরদারির কারণে মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, চলাফেরা, মতামত, ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা ইত্যাদি ক্ষয়ে যেতে যেতে এখন শূন্যের পর্যায়ে। ২০০৭ সালে বাঙ্কসি সেটিই দেখালেন, ‘ওয়ান নেশান আন্ডার সিসিটিভি’ ম্যুরালে। দেয়ালে শুধু লিখেই দিলেন না, সঙ্গে রাখলেন লাল জামা পরা এক শিশু, পুলিশের নজরদারি এবং কুকুর। শুধু পুলিশ নয়, কুকুরকেও নজরদারির কাজে রাষ্ট্র যে খুব ভালোভাবে ব্যবহার করে সেটিও দেখালেন। রাষ্ট্র নিজের সবকিছু গোপন রাখার অধিকার রাখে, কিন্তু নাগরিক তার নিজস্ব কোনোকিছু গোপন রাখার অধিকার রাখে না। এভাবেই নজরদারির এক অসাধারণ ব্যঙ্গ করেন বাঙ্কসি। 

২০০৮ সালে, ‘পাউয়ার ওয়াশার’ নামে যে ম্যুরালটি আমরা দেখতে পাই, সেই আপাত নিরীহ ম্যুরালে, দেখা যায়, একজন পরিচ্ছন্নকর্মী পানি ছিটিয়ে দেয়াল পরিষ্কার করছে। দেয়ালে প্রাচীন গুহাচিত্রের ছবিগুলো আঁকা। পানি দিয়ে সেই ছবিগুলো মুছে ফেলা হচ্ছে। আমাদের এই সময়ে, প্রাচীন গুহাচিত্রের অবদানের কথা একরকম স্মরণ করি না বললেই চলে। অথচ চিত্রকর্মের ইতিহাসে এই চিত্রগুলোর অবদান কোন অংশে কম নয়। এগুলো সেই সময়ের ম্যুরাল বা গ্রাফিতি। বাঙ্কসি এই চিত্রের মধ্যে দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন তার এবং তাদের সময়ে আঁকা স্ট্রিট আর্টগুলো এভাবেই হয়তো কালের গর্ভে বিলীন করে বা মুছে ফেলা হবে। অথচ এসব স্ট্রিট আর্ট, গ্রাফিতি, মুরাল শিল্পের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ফরাসি ইম্প্রেশিয়ানিস্ট চিত্রকর অ্যাডওয়ার্ড মোনের (১৮৪০-১৯২৬) প্রকৃতির প্রতি ছিল এক অকৃত্রিম ভালোবাসা। বিশেষ করে গাছপালার প্রতি। ১৮৯৯ সালে আঁকলেন তার বিখ্যাত তেলচিত্র ‘ব্রিজ ওভার এ পণ্ড অব ওয়াটার লিলিজ’। মোনের সময় থেকে আমাদের সময় অনেক দূরে চলে গেছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মানুষের সময় নেই প্রকৃতির দিকে তাকাবার। মানুষের পৃথিবী এখন শুধু পণ্যময়। তাই বাঙ্কসি ২০০৫ সালে ব্যঙ্গ করে আঁকলেন, ‘শো মি দ্য মোনে’। মোনের একই চিত্রকর্মের ওপর বাঙ্কসি মোনের সরবরের ওপর ফেলে দিলেন দুটি শপিং কার্ট এবং ট্রাফিক কোন। শপিং কার্ট বর্তমান দুনিয়ার ভোক্তা সমাজের এক দুর্দান্ত প্রতীক বহন করে। আমরা প্রতিদিন দেখি এসব শপিং কার্টে ভরে ভরে মানুষ শুধু পণ্য কিনে নিয়ে যায়। ট্রাফিক কোনোগুলো ভোক্তা সমাজের চলাচলের সুবিধা করার জন্য শপিং মলগুলোতে শৃঙ্খলা এনে দাঁড়িয়ে থাকে। পণ্য পূজার এই দুনিয়ায় পণ্যের বাইরে মানুষ আর কিচ্ছু ভাবতে পারে না। ছবিটা সম্পর্কে বাঙ্কসির তাই তীর্যক মন্তব্য- মোনের ওপর মানি এখন খেলা করে। 

বাঙ্কসির যে চিত্রকর্মটি সব থেকে দামে (৯.৯ মিলিয়ান পাউন্ড) বিক্রি হয়েছে সেটা হলো - ‘ডিভলভড পার্লামেন্ট’ নামের তৈলচিত্র। ছবিতে বাঙ্কসি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট বা সংসদে, সাংসদদের জায়গায় শিম্পাঞ্জিদের বসিয়েছেন। সেই শিম্পাঞ্জিদের মুখ খিচিয়ে ঝগড়া-ফ্যাসাদে লিপ্ত হতে তাদের দেখা যায়। বর্তমান সময়ে গণতন্ত্র যে কতটা হুমকির সম্মুখীন সেটা ফুটিয়ে তোলাই এর উদ্দেশ্য। তার এই বাস্তবচিত্র শুধু ব্রিটিশ পার্লামেন্টেই নয়, দুনিয়ার প্রায় সব সংসদ ভবনেই দেখা যায়। বর্তমান সভ্য সমাজের অসভ্যতা ফুটিয়ে তোলার জন্য এই চিত্রকর্মের কোনো তুলনা হয় না।

যে স্ট্রিট আর্টটি বাঙ্কসিকে আন্তর্জাতিক আইকনে পরিণত করেছে, তাকে একটা ব্রান্ডের পর্যায়ে নিয়ে গেছে, সেটা হলো, ‘বাঙ্কসি ইন বেথেলহ্যাম’, একজন প্রতিবাদকারীর ফুলের তোড়া হাতে ছুড়ে দেওয়ার চিত্রকর্ম। প্রতিবাদকারীরা সাধারণত ইট-পাটকেল বা বোমা ছুড়ে দিয়ে প্রতিবাদের ভাষা ব্যবহার করে, কিন্তু বাঙ্কসি এই ক্ষেত্রে ফুলের তোড়া ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ হিংসাত্মক নয় প্রতিবাদের শরীরী ভাষা হোক সুন্দর। চিত্রকর্মটি প্যালেস্টাইনের বিভাজিত দেয়ালে সেটা আঁকা হয়েছে। প্যালেস্টাইনের সীমানা ঘিরে পশ্চিম তীরে ইসরায়েল যে বিশাল দেয়াল তুলেছে, সেখানে প্রচুর কাজ করার মধ্যে দিয়ে এই দেয়ালকে ব্যঙ্গ করাই বাঙ্কসির প্রধান উদ্দেশ্য। তাই দেয়ালের গ্রাফিতিতে লেখা থাকে, ‘হামাস বা হুমাস (মধ্যপ্রাচ্যের বিখ্যাত একটি চাটনি জাতীয় খাদ্য) বানাও, দেয়াল নয়’, ‘আমরা আবার ফিরে আসবো’ ‘সবার হাতে পাঁচটাই আঙ্গুল’, ‘আমরা যদি শক্তিশালী এবং শক্তিহীনের দ্বন্দ্বের মাঝে হাত ধুতে চাই, তাহলে আমরা শক্তিশালীর পক্ষেই থাকব, তবু নিরপেক্ষ থাকবো না’ ইত্যাদি। সেই দেয়ালজুড়ে দেখা যায় উড়ে যাওয়া হৃদয় আকৃতির বেলুনের দিকে ছোট একটি মেয়ে তাকিয়ে আছে হাত উঁচু করে। পৃথিবী থেকে ভালোবাসা নামের অনুভূতি বিলীন হয়ে যাওয়া নাকি ফিরে আসা কোনোটাই স্পষ্ট হয় না ছবিতে। দেয়ালের আরেকটি ম্যুরালে দেখা যায়, দুটি শিশু বালতি এবং বেলচা হাতে খেলাধুলা করছে। দেখে মনে হয়, কোনো সমুদ্রতীরে বালুর তৈরি ঘর বানাচ্ছে। শিশু দুটির ঠিক মাথার ওপরে সুদৃশ্য সমুদ্র সৈকতের ছবি। ছবির নাম, ‘অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ’। যে জায়গায় সবুজ অরণ্য আর নীল সমুদ্র থাকার কথা সেখানে কংক্রিটের দেয়াল যেন সেই অরণ্য আর সমুদ্রকে ব্যঙ্গ করছে। এভাবে দেখা যায়, প্যালেস্টাইনের দেয়ালে বাঙ্কসি প্রচুর কাজ করেছেন। বাঙ্কসির বিশাল সংখ্যার সব কাজের বিবরণ এই ছোট পরিসরে বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। তার কাজের কিছু বাছাইকৃত অংশ এখানে তুলে ধরা হয়েছে।

চিত্রশিল্পে স্ট্রিট আর্ট, গ্রাফিতি হলো প্রতিবাদী চিত্রকর্ম। এসব কাজে মনোরঞ্জনের চেয়ে মনের গভীরে, আনন্দের চেয়ে আঘাত দেওয়া হয় বেশি। যাতে করে সমাজ সচেতন হয়ে উঠতে পারে। সমাজের ঘুমন্ত চোখ জেগে থাকতে পারে। গুগির ভাষায় রক্ষণশীল নয় বিপ্লবী। বাঙ্কসি সেই ধরনের শিল্পী। গি দ্যবোর বর্ণিত ‘স্পেকটেকাল সমাজ’ নয়। বাঙ্কসির প্রতীকিচিত্রের সমাজ ভিন্ন এক সমাজ। যে সমাজ মানুষকে অর্থহীন নয় অর্থপূর্ণ করে তোলে। অচেতন নয় সচেতন করে তোলে। অথচ বাঙ্কসি নিজে থাকেন আড়ালে। শেষে বাঙ্কসি সম্পর্কে হলিউডের নায়ক ব্র্যাড পিটের একটি মন্তব্য দিয়ে শেষ করব- ‘সে সব কাজ করে, অথচ নিজেকে রাখে আড়ালে। আমি মনে করি এটি এক বিশাল কাজ। বর্তমানে সবাই নিজেকে শো-অফ বা দেখানোর মধ্যে দিয়ে যেখানে বিখ্যাত হতে চায়, বাঙ্কসি থাকেন অদৃশ্যমান।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //