শিল্পের রাজনীতি ও শ্রেষ্ঠত্ব নির্মাণ প্রকল্প

খালি চোখে দেখতে গেলে শিল্পকলা বিষয়টি আলাভোলা একটি মানবিক ক্রিয়াকলাপের অংশ। নির্দোষ আনন্দ দান অথবা কোনো বিষয়বস্তুকে নান্দনিক প্রক্রিয়ায় উপস্থাপনেই তার ভূমিকা সীমিত মনে করা হয়। কখনো কখনো এই গণ্ডির বাইরে গিয়ে শিল্পকর্ম সমাজের কোনো অসঙ্গতিকেও সামনে নিয়ে আসতে পারে, সেটিও খুব উচ্চকণ্ঠ নয়, নান্দনিক অভিক্ষেপের মাধ্যমে শিল্প তার নিজস্ব চালে কিছু বক্তব্য রেখে যায়, অনেকটা ঘরেরও নয় ঘাটেরও নয় এমন। শিল্পকলা কী আদতেই এমন ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার? যদি তাই হতো তাহলে পৃথিবীজুড়েই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের দখলকৃত অঞ্চলে শিল্পকলাকে বদলে দেবার সচেতন প্রয়াস চালাতো না। কেননা তারা জানে মানুষের আত্মশক্তি সম্পর্কে সচেতন করে তোলার একটি প্রধান মাধ্যম হলো শিল্পকলা। আর শিল্পকলার ভূমিকাও আন্দোলন সংগ্রামের মতো প্রত্যক্ষ নয়, তাই খুব সহজেই এর প্রভাব ও প্রতিপত্তিকে চিহ্নিত করা যায় না। এ কারণেই সামাজ্যবাদী শক্তি তাদের ক্ষমতা কাঠামোকে টিকিয়ে রাখতে এবং ভবিষ্যতকে নিরাপদ করার জন্য শিল্পকলাকে নিজেদের স্বার্থে পরিচালিত করা একটি অন্যতম জরুরি প্রকল্প হিসেবেই দেখেছে। স্থানীয় শিল্পকলাকে পর্যুদস্ত করে নিজেদের শিল্পকে অধিকৃত অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত করা তাই তাদের মহাপরিকল্পনারই অংশ। ‘ই বি হ্যাভেলও বলেছিলেন যে ক্লাইভ থেকে মেকলে এ দেশের অধিবাসীকে এটা বোঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন যে এ দেশের নিজস্ব কোনো শিল্পপরম্পরা নেই।

জর্জ বার্ডউড বলেছিলেন, Sculpture and painting are unknown as Fine Arts in India.এই নির্বৈধীকরণের ফলে শিক্ষিত মানসে আত্মসম্পদ বিষয়ে অজ্ঞানতা ও অবিশ্বাস থেকে হীনম্মন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল এবং ইউরোপীয় সংস্কৃতির নিরিখকে একমাত্র মাপকাঠি মনে করা শুরু হয়েছিল। (শোভন সোম, ২০০৪ : ৭১)। সাংস্কৃতিক অভিমুখের বদল বা প্যারাডাইম শিফটের বিষয় নিয়ে উত্তর-আধুনিক তাত্ত্বিকদের বহুবিধ আলোচনা থেকে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে জাতির মানস-সম্পদ, জ্ঞান-সম্পদ ও ভাব-সম্পদকে ঘুরিয়ে দিতে পারলে একটি পুরো জাতি উল্টো পথে হাঁটতে থাকবে। ভারতীয় বাস্তবতায় প্যারাডাইম শিফটের কাজে সবচেয়ে বড় প্রকল্প হিসেবে কাজ করেছে এশিয়াটিক সোসাইটি। তারা জ্ঞানের সকল শাখায় অজস্র গবেষণা গ্রন্থ উৎপাদন করে ভারতবাসীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব যুক্তির নিরীখে উত্তীর্ণ। তাই তারা যে বিষয়ে যেমন সিদ্ধান্ত নেবে তাকেই সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা অন্যদের কাজ। পশ্চিমা জ্ঞান জগতে ওরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যতত্ত্বের মূল বক্তব্য হলো, ‘(পৃথিবীতে)... পশ্চিমের মানুষ আছে, আর আছে প্রাচ্যবাসী। প্রথমোক্তরা আধিপত্য করবে। সেই আধিপত্যের শিকার হতে হবে, অবশ্যই, দ্বিতীয়োক্তদের : যা সচরাচর বোঝায় তারা তাদের ভূমি দখল করে নিতে দেবে, তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়সমূহ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে দেবে, তারা তাদের রক্ত ও সম্পদ তুলে দেবে কোনো-না-কোনো পশ্চিমা শক্তির হাতে’ (এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ ২০১৫ :১৩)। তাই শিল্পকলাকে পশ্চিমা দৃষ্টিতে দেখার যে রাজনীতি সেটি বুঝতে না পারলে আমরা নিজেদের শিল্পের অন্দরে পৌঁছাতে পারবো না। তবে পশ্চিমাদের ভেতরেও অনেকেই ছিলেন প্রকৃত সমঝদার এবং সচেতনভাবে ষড়যন্ত্রকারীদের দলভুক্ত নয়, যাদের গবেষণা থেকে আমাদের সামনে অনেক কিছুই পরিষ্কার হতে পারে। ই.বি. হ্যাভেল ইন্ডিয়ান আর্ট নিয়ে কাজ করার সময় যেটি খুব ভালোভাবেই টের পেয়েছিলেন, এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন :‘It is difficult to argue with those who are so steeped in Western academic prejudice.’(E. B. Havell, 1911: xviii.) হ্যাভেল ও অবনীন্দ্রনাথ কিছুটা চেষ্টা করেছিলেন নব্যবঙ্গীয় শিল্পকলার উদ্বোধনের মাধ্যমে, কিন্তু সেই চেষ্টাও ফলপ্রসূ হতে পারেনি নানাবিধ জটিলতায়। জাতির আত্মবিশ্বাসকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্পটি ছিল বহুমুখী এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী। তারা জ্ঞানকা-ের পরিকল্পিত উপনিবেশায়নের মাধ্যমে স্থানীয় মানুষের সামর্থ্য, বিশ্বাস ও ঐতিহ্যকে একেবারে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। 

আমরা বাংলাদেশি, বাঙালি বা ভারতীয় জনগণ শিল্প বলতে তাকেই বুঝি যাকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেয় পশ্চিম, বর্তমান বাস্তবতায় পশ্চিমের স্বীকৃতি ছাড়া এখানে কোনো শিল্পকর্ম বা শিল্পী মূল্যায়িত হতে সক্ষম নন। তার অর্থ হলো আমাদের শিল্পসত্ত্বা অথবা শিল্পবিষয়ক ভাবনা চিন্তাগুলো স্বাধীন নয়। এই স্বাধীনতাকে পরিকল্পিতভাবেই নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে। বাইরের কারও না কারও হস্তক্ষেপ ছাড়া আমরা যেন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। কার্ল মার্কস যেমন বলেছিলেন, ‘ওরা নিজেদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না, (আমাদের) অবশ্যই ওদের প্রতিনিধিত্ব করতে হবে। ’ মহান সমতাবাদী কার্ল মার্কসের এমন ভাষ্য সত্য-মিথ্যার চেয়েও বেশি প্রভাবশালী। মার্কস ওরিয়েন্টাল তাত্ত্বিক চশমার বাইরে যেতে পারেননি। পশ্চিমের প্রাচ্য বিষয়ে সার্বিক ধারণারই তিনি প্রতিধ্বনি করেছেন। কেন তারা প্রাচ্যকে এমনভাবে দেখতে চাইল? এর সহজ উত্তর হলো দখল ও শাসনের অধিকারকে যৌক্তিক ভিত্তিতে দাঁড় করিয়ে যাবতীয় সম্পদ লুটপাটের ক্ষেত্র তৈরি করার প্রয়োজনে। এই লুটপাটের ভিত্তি তৈরির জন্য পশ্চিম নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেছে, আর সঙ্গে সঙ্গে প্রাচ্য যে নিকৃষ্ট এবং তাদের নিজেদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা নেই এই ধারণা বদ্ধমূল করে দিয়েছে প্রাচ্যবাসীর মন-মগজে। ফলত পশ্চিমের অনুকরণ ভিন্ন আমাদের কোনো শিল্প নাই। আছে হয়তো কিছু একটা যাকে আমরা শিল্প বলি না, বলি লোকশিল্প (লোকশিল্প অভিধাটিও তাদেরই শেখানো)। শিল্পের আগে লোক বিশেষণ জুড়ে দিয়ে কিছু একটা পাওয়া যায়, যাকে আমরা আমাদের নিজস্ব শিল্প বলে মেনে নিয়েছি। (লোকশিল্পের বৈশিষ্ট্য হিসেবে যে সকল গুণাবলীকে চিহ্নিত করা হয় সেসবও যথেষ্ট অবমাননাকর) শিল্প তাই দুই প্রকার (ক) শিল্প (পশ্চিমের অনুকৃতি) এবং (খ) লোকশিল্প (স্থানীয় ধারা)। লোক শব্দটি দিয়ে যাদের বোঝানো হয় তারা সমাজের পশ্চাদপদ অবহেলিত অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী। কাজেই শিক্ষিত অভিজাত শ্রেণির কাছে এই শিল্প এবং শিল্পী উভয়ই হাস্যরস অথবা করুণার পাত্র। ইংরেজি শিক্ষিত শহুরে বিনোদন পিয়াসি নাগরিকরা তাদের আস্বাদ বৈচিত্র্যের সন্ধানে কখনো কখনো লোকশিল্পের দ্বারস্থ হন। গ্রামের গরিব আত্মীয়ের সঙ্গে যতটুকু শোভন ব্যবহার না করলেই নয় ততটুকু আতিথেয়তাও জোটে লোকশিল্পের ভাগ্যে, যদিও লোকশিল্প এই আদরনীয় ব্যবহারের জন্য লালায়িত নয়; কিন্তু তারা মহানুভব হবার সুযোগটুকু ছাড়বেন কেন!

বাংলাদেশের শিল্পকলা বললেই আমরা একটা অন্ধকারে পড়ে যাই, মূলধারার শিল্পীদের কাজ হলো বিদেশিদের অনুকরণ, আর দেশজ ধারার লোকশিল্প বলতে পশ্চাদপদ এক ধরনের মৃতপ্রায় পুনরাবৃত্তির চক্রে খাবি খাওয়া পটচিত্র-ঘটচিত্র-খটমট-ঠনঠনানি শিল্পকে সামনে নিয়ে আসা হয়। শিল্পের প্রথম রাজনীতি এবং কূটনীতি এই সন্দেহ, অবিশ্বাস ও অবজ্ঞার মানস তৈরির কারখানায়; দ্বিতীয় রাজনীতি, নান্দনিক প্রতারণার গভীরে। প্রথমটি তৈরির জন্য দ্বিতীয়টি বাধ্যতামূলকভাবে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। দ্বিতীয় বিষয়টি অনেকটাই ব্যক্তির ঈর্ষা, বিদ্বেষ ও হীনম্মন্যতাজাত। প্রাতিষ্ঠানিক ঘরানার শিল্প এবং শিল্পীর অধিকাংশই পাশ্চাত্যের বশীকরণে অন্বেষাবিমুখ অন্ধ মনোজগতের অধিকারী। স্যার আলফ্রেড সি. লয়ালের ‘Asiatic Studies religious and social গ্রন্থভুক্ত বক্তব্য থেকে তার কিছুটা আঁচ করা যেতে পারে, In India we have to give reason for our doings to rigid Brahmans and to iconoclastic Mohamedans- ‘Such as do build their faith upon The holy text of pike and gun;’ (Alfred C. Lyall 1882 : 259).শাস্ত্রের দোহাই আর বন্দুকের ভাষা দুটির সম্মিলিত প্রয়োগেই তারা তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তৎপরতা চালিয়েছে। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর তাদের এই শিক্ষা আরো বদ্ধমূল আকার ধারণ করে। ব্রিটিশ শাসনকে টিকিয়ে রাখতে হলে হিন্দু-মুসলিম এবং আন্তঃসম্প্রদায়গত বিভক্তিগুলোকে আরো উসকে দিতে হবে, অন্যথায় যে কোনো সময়ে বিপজ্জনক অবস্থা ধারণ করতে পারে। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক রজার ওয়েনকে উদ্ধৃত করে বলা যায়: India’s numerous political and religious divisions were a source of British strength. If the Mutiny and taught them one lesson it was that anything which allowed the Indians to combine was dangerous, while anything which kept them apart was to Britain’s benefit. (Roger Owen1975 :235)। শুধুই সম্প্রদায়গত বিভাজন নয়, জ্ঞানতাত্ত্বিক এলাকায়ও তারা একই সূত্র কাজে লাগিয়েছে। পশ্চিম তাদের মনোভাব নানাভাবে স্পষ্ট করার পরেও আমাদের সমাজের স্থানীয় চিন্তাদর্শের নীতি নির্ধারকগণ পশ্চিমের দিকেই ঝুঁকে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার নিজের চিত্রকর্ম সম্পর্কে বলেছিলেন- ‘আমার ছবিগুলো আমি ইউরোপকে দিয়ে গেলাম।’ কারণ তাঁর অপটু হাতের আঁকিবুকি প্রথম দিকে এই অঞ্চলের শিল্পী-দর্শকেরা ঠিক হজম করতে পারছিলেন না; কিন্তু ইউরোপ তার চিত্রকলার প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করল এবং তিনি সেখানে ব্যাপক প্রশংসিত হলেন, ইউরোপীয় গ্রহণযোগ্যতায় ধীরে ধীরে এই দেশীয় পরিস্থিতি পাল্টে গেল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিত্রকলারও পুরোহিত হয়ে উঠলেন, তাঁকে দেওয়া হলো আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার জনক অভিধা। এখন রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই আনন্দের সঙ্গে তার চিত্রকলা বাংলায় রেখে যেতেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার ‘আর্য্যজাতির সূক্ষ্ম শিল্প’-এ অনেকটা খেদের সুরেই লিখেছেন, ‘বাঙ্গালি নকলনবিশ ভালো, নকলে শৈথিল্য নাই; কিন্তু তাহাদিগের ভাস্কর্য এবং চিত্রসংগ্রহ দেখিলে বোধ হয় যে, অনুকরণ-স্পৃহাতেই ঐ সকল সংগ্রহ ঘটিয়াছে-নচেৎ সৌন্দর্য্যে তাঁহাদিগের আন্তরিক অনুরাগ নাই। এখানে ভাল মন্দের বিচার নাই, মহার্ঘ্য হইলেই হইল, সন্নিবেশনের পরিপাট্য নাই, সংখ্যায় অধিক হইলেই হইল। ভাস্কর্য চিত্র দূরে থাকুক, কাব্য সম্বন্ধেও বাঙ্গালির উত্তমাধম বিচারশক্তি দেখা যায় না। এ বিষয়ে সুশিক্ষিত অশিক্ষিত সমান-প্রভেদ অতি অল্প। নৃত্য গীত-সে সকল বুঝি বাঙ্গালা হইতে উঠিয়া গেল। সৌন্দর্য্যবিচারশক্তি, সৌন্দর্য্যসাস্বদনসুখ, বুঝি বিধাতা বাঙ্গালির কপালে লিখেন নাই। ’(বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, আর্য্যজাতির সূক্ষ্ম শিল্প)। এসব কথা ঔপনিবেশিক বাঙালির ক্ষেত্রে যথেষ্টই মানানসই। বঙ্কিমের আক্ষেপ এবং ক্ষোভের বাস্তব ভিত্তিও সেই বাঙালি মানস। প্রকৃত বাঙালি মানুষের সঙ্গে এসবের দূরতম কোনো যোগ নেই। তাঁর এমন ভাবনা উপনিবেশিক বিকৃতির পরের বিবেচনা হিসেবে সঠিক হতে পারে কিন্তু তাঁর মতো একজন বিদ্যান মানুষ কী করে এমন ভুলো মনের হতে পারেন! যেখানে বিষ্ণু ধর্মোত্তরসহ নানাবিধ শিল্পশাস্ত্র এবং অলংকার শাস্ত্রে শিল্প বিষয়ক সকল বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণিত রয়েছে; এবং তার বাস্তব প্রমাণেরও (স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলায়) কোনো ঘাটতি নাই। বিষ্ণুধর্মোত্তরে মার্কণ্ডেয়কে প্রতিমা শিল্প সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে উত্তরে একটি চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়। মার্কন্ডেয় বলেন, যে চিত্রকলার নিয়ম জানে না সে প্রতিমা বানাতে পারবে না; কিন্তু নৃত্যের নিয়মাবলি না বুঝে চিত্রকর্ম বোঝাটা তার পক্ষে দুরূহ ব্যাপার, আবার সুরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ না থাকলে নৃত্যকে বোঝা যাবে না, সুর ছাড়া নৃত্য একেবারেই অস্তিত্বহীন; সঙ্গীতে যার দখল নেই তার পক্ষে সুরকে হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব নয়। ’ (Stella Kramrish, 1928 : 32-33) এই বক্তব্য থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার হয় যে, শিল্পকলা একটি সামগ্রিক বিষয়, চিত্র, ভাস্কর্য, নৃত্য, সুর ও সংগীত এগুলো পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই শিল্পের জগতকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই। 

গোলাম তৈরির রাজনীতিতে শিল্পকলা হলো সবচেয়ে সংবেদনশীল মাধ্যম। সাংস্কৃতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে পারলে ওই জাতিকে ভিক্ষুক বানানোর আলাদা কোনো কৌশল প্রয়োজন হয় না। ইউরোপ-আমেরিকার একচেটিয়া পণ্যের বাজারে আমরা এক বৃহৎ ভোক্তা শ্রেণিমাত্র। তাছাড়া তাদের স্বল্পমূল্যের শ্রমিকের প্রয়োজনেও আমাদের নিচু সারিতে রেখে দেয়া জরুরি। এই হায়ারার্কি বা শ্রেষ্ঠত্ব নির্মাণ প্রকল্পটি প্রধানত জ্ঞানতাত্ত্বিক জায়গায় তার ভিত্তি তৈরি করে। জ্ঞানজগতের একেবারে গোড়ায় থাকে শিল্প ও দর্শন। কাজেই শিল্প ও দর্শনকে বিকৃত করে নিকৃষ্ট ও অসভ্য হিসেবে চিহ্নিত করার সক্রিয় প্রয়াস তাদের সার্বক্ষণিক। শিল্পকে বুঝতে হলে নন্দনতত্ত্ব ও দর্শনের দ্বারস্থ হতে হয় আর আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে পশ্চিম তাদের নন্দনতত্ত্ব ও দর্শনের পাঠ্যসূচি তৈরি করে রেখেছে, ওসব গলদকরণের মাধ্যমে চিত্রশিল্পী বলতেই আমরা ভিঞ্চি-পিকাসো-ভ্যানগগ বুঝি, ভুলেও ধীমান, বীতপাল, জয়নুল-কামরুল-সুলতান বুঝি না। কেন ভিঞ্চি-পিকাসো-ভ্যানগগ? এই প্রশ্ন তৈরি হওয়াও আমাদের ধৃষ্টতা মনে হয়। কেন? তাদের যোগ্যতা না প্রচার না অন্য কিছু? আর যোগ্যতার মানদণ্ড কি? কারা সেই মানদণ্ডের মালিক? আমাদের প্রাচ্যবাসীর সেই মালিকানায় কোনো অংশীদারিত্ব আছে? (নিশ্চয়ই নেই), তাহলে এই নিরঙ্কুশ শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করানোর একটা রাজনীতি আছে। নিজেদের প্রভু সেজে থাকার মাধ্যমে অপরকে দাস বানিয়ে রাখার পদ্ধতি উত্তর-আধুনিক সময়ে নানাদিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে একটু একটু করে তাদের জায়গা ছাড়তে শুরু করেছে। উত্তর-আধুনিকতার ধারণাসমূহ এক্ষেত্রে আমাদের জন্য বেশ কার্যকর হয়ে উঠতে পারে। যার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে নিৎসের মাধ্যমে, যিনি ঈশ্বরের মৃত্যু ঘোষণা করেছিলেন, (যদিও ভারতীয় দর্শনে এই চিন্তা-চেতনাগুলো নতুন নয়, চার্বাক কিংবা বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনে এসব মতবাদ বেশ পুরনো হলেও আমাদের ঐতিহাসিক বিচ্ছিন্নতা তাকে সামনে আসতে দেয়নি। ) যার ফলে পরবর্তী তাত্ত্বিকদের ভেতরে জাগতিক সব ঈশ্বরকে সরিয়ে দিয়ে সেখানে সাধারণ মানুষের প্রতিস্থাপন দেখতে পাওয়া যায়। উত্তর-আধুনিকতার অন্যতম তাত্ত্বিক গিলেজ দল্যুজ নিৎসের দর্শন প্রসঙ্গে বলেন, it synthesizes the idea of God with time, becoming, history and man. It says at one and the same time: God existed and he is dead and he will rise from the dead, God has become Man and Man has become God. (Gilles Deleuze 1986 :152)। সামাজিক প্রভুদের মৃত্যুতে সাধারণ মানুষের উত্থানের মাধ্যমে সূচনা হয় নতুন দৃষ্টিভঙ্গির। উত্তর-আধুনিক তাত্ত্বিকদের ভেতরে নীৎসের পরে দেখা যাবে অনেক মতবাদেরই মৃত্যু সূচিত হচ্ছে অথবা ঘোষণা করা হচ্ছে সমাপ্তি। হায়ারার্কির একরৈখিক ভাবনা পদ্ধতি ইতোমধ্যেই তাদের খুঁটির জোর হারিয়ে ফেলেছে। বঙ্গীয় ঘরানার তান্ত্রিক প্রথা-পদ্ধতির মৌলিক জ্ঞানও অদৃশ্য ঈশ্বরের ওপর আস্থাশীল নয়। যদিও সেই একই বিচ্ছিন্নতা এবং নিকৃষ্ট ও অসভ্য পন্থা হিসেবে চিহ্নিত করার রাজনীতি এখানে আরও ভয়ানকভাবে ক্রিয়াশীল রয়েছে। পরিতাপের বিষয় হলো বাংলার চিত্রকলা এখনো সাবেকি পন্থার ষড়যন্ত্রে মাথা তুলে দাঁড়াবার কথা ভাবতেই পারছে না। এই অপরাজনীতির আসল চেহারা সম্পর্কে ধারণা না থাকলে প্রচারের চোরাবালিতে ডুবেই মরতে হবে। আর সৌভাগ্যবান (!) কারও সুযোগ থাকলে পশ্চিমা বুলি আওড়াতে আওড়াতে নিজেকে ধন্য করে নেবেন। সাংস্কৃতিক সম্প্রসারণবাদেও রাজনীতিটুকু অল্প বিস্তর সচেতন হলেই বোঝা যায়, কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি এতটাই প্রতিকূলে যে, এই অবস্থানে নিজেকে স্থির রাখতে হলে রীতিমতো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতে হবে আশপাশের বাস্তুহারা, চিন্তাহারা, চৈতন্যহারা শিল্পী-রসিক মহলের সঙ্গে। সপ্তম বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছিলেন- ‘ইতিহাসের অনেক তত্ত্ব মাটির ওপরিভাগে পড়িয়া আছে। অনায়াসেই খুঁজিয়া লইতে পারা যায়; কিন্তু খুঁজিবার লোক কই? অনেকের আগ্রহ আছে শক্তি নাই, অনেকের শক্তি আছে আগ্রহ নাই; অনেকে ঘরে বসিয়া কাজ করেন, বাইরে ঘুরিতে পারেন না; অনেকে বাইরে ঘুরিতে পারেন কিন্তু তাঁহাদের চোখ পরিস্ফুট হয় নাই’ (হরপ্রসাদ-রচনাবলি ১৩৬৩ বঙ্গাব্দ :২৪৩-২৪৪)। এই যুদ্ধটা কেউ করতে রাজি নয়, যার ফলে বাংলার চিত্রকলার মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর সম্ভাবনাও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। 

প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময়ে বাংলার চিত্রকলায় আমরা কোনো ধারাবাহিকতা খুঁজে পাই না। এই না পাওয়ার হতাশাজনিত হীনম্মন্যতা থেকে আমরা সহজেই চিত্রকলাকে দুই ভাগ করে ভাবতে শিখেছি, শিল্প এবং লোকশিল্প। আসলেই কি ধারাবাহিকতা নেই, নাকি আমরা ধরতে পারছি না? এই সূত্রগুলো গায়েব হয়ে গেলো কোন মন্ত্রবলে? মন্ত্রটি আমাদের জানতেই হবে, না হয় এই মর্মান্তিক আত্মগ্লানি থেকে আমাদের উত্তরণের কোন পথ নেই। চিত্রকলার ইতিহাস কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বাঙলার সকল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও আদর্শিক ইতিহাসের সঙ্গেই চিত্রকলার ইতিহাসটি একই সঙ্গে গায়েব হয়ে গিয়েছে। তাই সামগ্রিক বিবেচনা থেকেই শিল্পকে দেখতে হবে, শিল্পের সঙ্গে তন্ত্র-যোগ-সাংখ্য-চার্বাক ইত্যাদি দর্শন প্রস্থান ছাড়াও যুক্ত আছে বহুবিধ সামাজিক সংস্কার। আনন্দ কুমার স্বামী যেমন মনে করেন, ‘Indian art stands related to yoga in three ways : In respect of Divine Ideal, characteristic methods, and ultimate purpose.’ (Ananda K. Coomarswamy 1909 : 51) এমন গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত রয়েছে অনেক পণ্ডিতের রচনায়, যেসব উপাদান থেকে পুনর্গঠিত হতে পারে বাঙলা তথা ভারতীয় শিল্পের প্রকৃত ইতিহাস। এই লেখার ক্ষুদ্র পরিসরে তার তেমন কিছুই প্রকাশ করা যাবে না। তবে কিছু ইঙ্গিত রেখে যাওয়া যায়। প্রথমত আমাদের দেখা উচিত বাঙলার ভৌগোলিক অঞ্চলে মানবমণ্ডলীর বিস্তারের বিকল্প ইতিহাস। বিকল্প বলতে হচ্ছে কেননা প্রচলিত ইতিহাসের পরতে পরতে ভুল, মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর তথ্যের চাপে আসল তথ্যকে খুঁজে পাবার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। তাহলে আসল তথ্য কোথায় পাওয়া যেতে পারে? আসল তথ্য পেতে হলে কিছু প্রশ্নকে সামনে রেখে তাদের উত্তর খুঁজে খুঁজে অগ্রসর হতে হবে। 

(ক) প্রথম প্রশ্ন হলো বাঙলার আদি অধিবাসী কারা? (বাঙলা বলতে আমাদের বৃহৎবঙ্গই বুঝতে হবে, কেননা ইতিহাসের প্রাচীনকালে সমধর্মী ভৌগোলিক পরিবেশটাই গুরুত্বপূর্ণ, রাজনৈতিক মানচিত্র নয়) তারা এখন কোথায়, কোন অবস্থায় আছে?তারা কি বহিরাগত? যদি বহিরাগত হয় তাহলে প্রথম বসতি স্থাপন করেছিল কোন জনগোষ্ঠী? 

(গ) দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো প্রায় সকল পণ্ডিতের মতে বাঙালি একটি সংকর জাতি, পৃথিবীর কোন জাতি মিশ্র বা সংকর নয়? এই সংকরত্বের প্রচারের উদ্যোক্তা এবং তাদের অনুসারীদের উদ্দেশ্য কী ছিল?

(খ) তৃতীয় একটি প্রশ্ন আমরা সামনে আনতে চাই সেটি হলো কথিত বাঙলা ভাষার প্রথম নিদর্শন গ্রন্থ চর্যাপদ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক উদ্ধার প্রাপ্ত হয় নেপালের রাজ দরবারের গ্রন্থাগার থেকে। এখানে প্রশ্ন হলো নিদর্শন বাংলা ভাষার, নেপালে গেলো কী করে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে অনেক কিছুই আমাদের সামনে আসতে পারে। বাংলা ভাষা কী নির্বাসিত হয়েছিল? ভাষা নির্বাসিত হলে ভাষিকদের তখন কোন অবস্থান? কারা নির্বাসনে পাঠিয়েছেন?

(ঘ) চতুর্থ প্রশ্ন হলো বাঙালির প্রায় সকল জীবনাচরণে, ওষুধপত্রে, আহার-নিদ্রায় একট তান্ত্রিক প্রভাব রয়েছে? কিন্তু তন্ত্র বিষয়ে সর্বত্র একটি ঘৃণা ও বিদ্বেষের মনোভাব রয়েছে, একে নানা ধর্মীয় সম্প্রদায় তাদের মতো করে নিজেদের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছে। তন্ত্রকে মনে করা হচ্ছে যাদু-মন্ত্র, বান-উচাটন, ডাকিনী-যোগিনী বিদ্যা, বশীকরণ ইত্যাদি অতি গোপন এবং রহস্যময় বিষয়। তন্ত্র কি আসলেই তাই? যদি না হয় তাহলে তন্ত্রের আসল রূপ কেমন ? এবং তন্ত্রের বর্তমান পরিণতির কারণ কি?

(ঙ) পঞ্চম প্রশ্ন হলো বাঙালী জনগোষ্ঠীর একটি বিপুল অংশই কৃষিজীবী, তাই কৃষির আবিষ্কারে এই অঞ্চলের ভূমিকা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা থেকে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপান্তরের ইতিহাস ও এর সঙ্গে যুক্ত সামাজিক সংস্কারসমূহ বর্তমানে কীরূপ অবস্থায় বিরাজমান রয়েছে? বিশেষ বিশেষ পরিবর্তনের কারণগুলোই বা কী?

(ঙ) ষষ্ঠ প্রশ্ন হলো বঙ্গীয় বা ভারতীয় দর্শনে চার্বাক বা লোকায়ত নামে একটি বস্তুবাদী দর্শন অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানে ছিল, সেটি প্রায় মুছে গিয়ে বাঙালি বা ভারতীয় দর্শনকে কেবলি আধ্যাত্মিকতার মোড়কে দেখতে শেখার শুরু কখন থেকে এবং এর সূচনাপর্বে সামাজিক পরিবেশে কোন প্রক্রিয়ায় শক্তির প্রয়োগ হয়েছিল? 

(চ) সপ্তম প্রশ্ন হলো একটি জাতি তার অতীত থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কী কী ঘটতে পারে এবং সেইসব ঘটনায় কারা লাভবান হন?

কথিত আছে সাত একটি শুভ সংখ্যা, তাই এই সাতটি প্রশ্নকে সামনে রেখেই আমরা সামনে যেতে চাই। উল্লেখিত প্রশ্নাবলীর কিছুটা সন্তোষজনক উত্তর যদি না পাওয়া যায় তাহলে আমাদের পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনাই তৈরি হবে না। কেননা রোগ নির্ণয় না করে ওষুধ সেবন আমরা অনেক করে ফেলেছি, তাতে রোগের উপসর্গ ও ধরন বদল হওয়া ছাড়া আর কিছুই হয়নি। আমরা কেন নিজেদের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা পাই না? আমরা তাহলে কোনো ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ? (হায় ইতিহাস! হায় ধারাবাহিকতার যাদুকাঠি, তোমাদের ছোঁয়ায় আমাদের ঘুম আরো গভীর হচ্ছে) ইতিহাস এবং তার ধারাবাহিকতার সংকট একটি কৃত্রিম বানোয়াট সংকট, বাঙলার ধারাবাহিকতা শুধু লিখিত গ্রন্থ, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে খুঁজতে যাওয়ার বোকামিটুকু আমরা শিখেছি পাথুরে এবং বরফাচ্ছাদিত পরিবেশের বহিরাগত জ্ঞানের প্রবল প্রতাপে, এখন মগজে শুধু বরফ ও পাথর। বাঙলার উর্বর পলিমাটির কোনো ছোঁয়া কিংবা আবেশ অবশিষ্ট নেই, পলি-দোআঁশ মাটির ইতিহাস আর পাথর-বরফের ইতিহাস একই পদ্ধতিতে খুঁজে ফেরার ভ্রান্তি থেকে বের হতে না পারলে আমরা শিল্পের রাজনীতিতে মার খেতে থাকব। গুরুসদয় দত্ত বলেছিলেন- ‘চিত্র-রসকলায় বাঙ্গালী প্রাচীনযুগে যে কেবলমাত্র ভারতবর্ষকে নয়, সমগ্র এশিয়াকে অনুপ্রাণনা বিতরণ করিয়াছে, তাহার উপলব্ধি আজকালকার শিক্ষিত বাঙ্গালীর নাই। নিজস্ব সম্পদ-বিহীনতার ভ্রান্ত বিশ্বাসের দৈন্যে প্রপীড়িত শিক্ষিত বাঙ্গালী আজ বিশ্বের চিত্র রসকলার হাটে, দীন ভিখারীর বেশে-অজন্তার ভগ্ন গুহাদ্বারে-মোগল ও রাজপুত প্রাসাদ-প্রাঙ্গনে, চীন, জাপান, ইত্যাদি ও ফ্রান্সের বস্তু-বেরঙের বিপণির দ্বারদেশে-ভিক্ষুক’ (গুরুসদয় দত্ত ২০০৮ :১৮১)। দ্বারে দ্বারে ভিক্ষুকের দশা ঘোচানোর কোনো প্রচেষ্টাও আমাদের মাঝে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যদি পুনর্গঠনের একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়, তাহলে এই অঞ্চলের শিল্পকে প্রকৃত অর্থেই বুঝতে হলে এর দার্শনিক বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে উপলব্ধি করতে হবে। ‘It is only in the East art still has a philosophy and still remains the great exponent of national faith and race traditions.’ (E. B. Havell 1911 :5)কিন্তু সেই উদ্যোগ কিংবা গভীর অনুসন্ধানী গবেষণা আদৌ হবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। 

উপনিবেশিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের নিজস্ব শিল্প-সমৃদ্ধির বয়ান। চিত্রকলার রাজনীতি তাই এক পাক্ষিক, অসম প্রতিযোগিতায় বাঙলার চিত্রকলা নামটি ক্রমাগত দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। যার সঙ্গে যুদ্ধ; তার অস্ত্র, তার কলাকৌশল, তার ময়দান এবং তারই পদ্ধতির উচ্ছিষ্টাংশ নিয়ে তার সঙ্গে জয়ের স্বপ্ন দেখার মতো বেবোধ অবস্থা আমাদের। কাজেই আগে বুঝতে হবে আমরা কি চাই? আসলেই চাই কিনা? আমাদের সমস্যার গোড়াতে প্রবেশ না করতে পারলে বেহুদা বিতর্কের অবকাশ নেই। আমরা কোন হাতের পুতুল হয়ে নেচে বেড়াচ্ছি, তাদের রাজনীতির মুখোশ উন্মোচন না করতে পারলে প্রভুর সন্তুষ্টিই আমাদের সন্তুষ্টি অর্জনের একমাত্র পন্থা হিসেবে চলমান থাকবে। 

তথ্যসূত্র :
এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ (২০১৫), অরিয়েন্টালিজম, (ভূমিকা ও ভাষান্তর : ফয়েজ আলম), প্রথম সংবেদ সংস্করণ, ঢাকা
গুরুসদয় দত্ত (২০০৮) বাংলার লোকশিল্প ও লোকনৃত্য, ছাতিম বুক্স্, কলকাতা
শোভন সোম, (২০০৪) শিল্প সংস্কৃতি সমাজ, মনচাষা, উত্তর-পশ্চিমবঙ্গ, কলকাতা
হরপ্রসাদ-রচনাবলি (১৩৬৩ বঙ্গাব্দ), প্রথম সম্ভার, (সম্পাদক : শ্রী সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়), ঈস্টার্ন ট্রেডিং কোম্পানি, কলকাতা 
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ‘আর্য্যজাতির সূক্ষ্ম শিল্প’ (রচনাবলি প্রথম খণ্ড)

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //