ইসলামোফোবিয়া, ধর্ম ও রাজনীতি

ধর্মাচারের রাজনীতি
২০২০ সালে গার্সিয়া-আরেনাল ও গ্লেজার-এইতান নামের দুই ধর্মাচার-গবেষক একটি গবেষণা সংকলন সম্পাদনা করেন। বিষয় আইবেরীয় উপদ্বীপে আধুনিকতাপূর্ব সময়ে খ্রিস্টান, ইহুদি ও মুসলিমরা কীভাবে অন্য ধর্মাবলম্বীদের জোরপূর্বক নিজ নিজ ধর্মে ধর্মান্তরিত করেছিল। সব ধর্মেই একটি আপ্তবাক্যের বহুল ব্যবহার শোনা যায়- ‘ধর্মে জোরজবরদস্তি নাই’। এই উদারবাদী ধর্মদর্শন সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ ভাবনাকে একটি নৈতিক বৈধতা দিয়েছে। অনেক সময় ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র তাদের শাসনতন্ত্রেও এই যৌক্তিকতাকে অনুমোদন হিসেবে হাজির করেন। অনেকেই স্লোগান দেন ‘যার ধর্ম তার কাছে, রাষ্ট্রের কী বলার আছে?’ এই স্লোগান সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তাঁরাও যুক্তি দেন যে ধর্মচর্চাকারীদের প্রতি সেসব ধর্মগ্রন্থ-সমর্থিত বিধিবিধানও আছে যেন যার যার ধর্ম পালনকে অধিকার হিসেবে দেখা হয়। যেন ধর্মপ্রচারকরা পরমতসহিষ্ণু, উদার ও ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকেন। 

গার্সিয়া-আরেনাল ও গ্লেজার (Garcia-Arenal and Glazer-Eytan (2020)) এবং অন্যান্য গবেষক-প্রাবন্ধিকদের (Firth1981, Chazan1980, Bowering an Crone ed 2013) লেখাগুলোয় একটি ইংগিত আছে যে, এই শ্রেয়োভাষ্যটি নৈতিকতাবাদী একটি মুখরোচক কথার কথামাত্র। জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ আগে সরাসরি ছিল, এখন পরোক্ষভাবে আছে। ধর্মান্তরকারীদের কৌশল বদলে অনেক বেশি মানবিকদর্শনও হয়েছে। আগে জোর করা হতো। এখন অনেকে স্বেচ্ছায় জাগতিক সুবিধা পাবার আশায় ধর্ম বদলান। তলোয়ারের ভয়ে ধর্ম না পাল্টালেও রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ঘৃণা-বিদ্বেষের ভয়ে অনেকে নিজ ধর্ম ছাড়েন। অন্তত নামে হলেও নিজ ধর্মান্তর ঘটান। ভেদ-বিভেদ বৈষম্য ঘোচাতে নাম পাল্টান। উত্তর আমেরিকায় বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে ও কানাডায় চীনা অভিবাসীদের একটি বড় অংশই অভিবাসনের আগে আগে এফিডেভিট করে নাম ও ধর্ম পাল্টে অভিবাসন নেন। 

একই সত্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশের নাগরিকদের একাংশের বেলায়ও (Chao 2021) । থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্পুচিয়া ও মিয়ানমারের নাগরিকদের যারা ধর্ম পাল্টান না, তারা অন্তত নামধাম বদলে নেন। তাদের দৃঢ়বিশ্বাস চাকরির আবেদনে খ্রিস্টান ধর্মানুগ নাম না দিলে তারা চাকরি পাবেন না। চাকরির আবেদন বাছাইপর্বের শুরুতেই বাদ পড়ে যাবেন। অথচ নাম একটি সাংস্কৃতিক বিষয়। যেমন, তারিক আজিজ [ইরাকের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী] নাম শুনতে মুসলমান মনে হলেও তিনি আসলে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। যুক্তরাষ্ট্রে অসংখ্য মুসলিম আছেন যাদের নাম শুনলে এই তল্লাটের মানুষজন বুঝবেন না যে, তিনি মুসলমান। আবার মধ্যপ্রাচ্যের খ্রিস্টান ও ইহুদি নাগরিকদের বেশির ভাগেরই নামকরণ হয় সাংস্কৃতিক প্রথা অনুযায়ী (Richards, James 2002)|  কারও নাম যায়েদ বিন সালমান হলেই মুসলিম ভাবার উপায় নেই। তার অন্য ধর্মাবলম্বী হবার সমান সম্ভাবনাই থাকে। তবুও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের মনে কেন এই বোধটি জন্মায় যে, নাম পরিবর্তন করলে তারা বৈষম্যের শিকার হবেন না? এক-এগারোয় টুইন টাওয়ারে হামলা হবার পর মুসলমান নাম বদলে ভিন্ন নাম গ্রহণের হিড়িক পড়েছিল। কাণ্ডটি শুধু পশ্চিমে ঘটেনি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মুসলিমদের একাংশের মাঝেও এই প্রবণতাটি দেখা গিয়েছিল। যারা পশ্চিমে অভিবাসনের প্রতীক্ষায় ছিলেন, তারা এই দৌড়ে বেশি এগিয়ে ছিলেন। পশ্চিমে মুসলিম নারীদের অমুসলিম পুরুষদের বিবাহ করার ঘটনা বেড়ে গিয়েছিল। তারা অনায়াসে নিজ নিজ নামের শেষে অমুসলিম স্বামীর নামও যুক্ত করতে শুরু করেছিলেন (Rabasa et al. 2020) |

বিষয়টিকে যতটা ধর্ম-পরিবর্তন মনে করা হয়, আসলে সে রকম নয়। অনেকের বেলাতেই ‘সামাজিক নিরাপত্তাবোধ’ ‘ধর্মীয় পরিচিতি’ সংরক্ষণের চাইতে বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে ধরা পড়েছিল(Gillum 2018)| আরও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে কোনো ধর্মের অনুসারী হওয়া মানেই ‘ধার্মিক’ হয়ে পড়া নয়। ‘ধার্মিকতাতাড়িত’ বা ‘রিলিজিওসিটি-ড্রিভেন’ ধর্মানুসারীদের সংখ্যা কোনো ধর্মেই খুব বেশি নয়। ‘ধার্মিকতাতাড়িত’ ধর্মানুসারীদের বিপরীতে ‘প্র্যাকটিসিং মুসলিম’, ‘প্র্যাকটিসিং হিন্দু’ বা ‘প্র্যাকটিসিং খ্রিস্টান’ বিশেষণের ব্যবহার নিত্যই বাড়ছে। একদল অনায়াসে নিজেদের ‘নন-প্র্যাকটিসিং’ ঘোষণা দিয়ে জানান দিচ্ছেন যে ধর্ম তাদের কাছে শুধুই জন্মগত, ঐতিহ্যগত বা সংস্কৃতি গত প্রপঞ্চ। অর্থাৎ, ধর্ম-পরিচিতির এক ধরনের সাংস্কৃতিক রাজনীতি আছে, যা সমাজবিজ্ঞানীরা খুব গভীরভাবে তেমন একটা খেয়াল করেননি। ধর্মাচারীরাও ধর্মের কারণে বৈষম্যের শিকার হন। ধর্মাচারজনিত বৈষম্যের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা, বা সম্ভাব্য বৈষম্যের সম্ভাবনাও তাদের ধর্মাচারের ধরন নির্ণয় করে দেয়। এমনকি ধর্মাচারের স্বাধীনতা যে তাদের আসলে তেমন একটা নেই, সেই বঞ্চনাবোধ ও বিশ্বাসহীনতা তাদের মাঝে ‘অ-নিরাপদ’বোধ তৈরি করে। নিরাপত্তার প্রয়োজনে তারা ধর্মাচারেও এদিক-সেদিক করেন। প্রয়োজনে নিজ ধর্মের বিপক্ষেও দাঁড়ান। এভাবে দাঁড়ানোর কতটা আন্তরিক, কতটা কৌশল, সেটি এখনো অজানা। মানুষের জীবনধারণ-কৌশল এবং পরিকল্পনার অনেক কিছুই গুপ্ত থাকে। ধর্মের বেলায়ও তেমনই (Aziz and Haake 2021)| 

‘ক্রিপ্টো-মুসলিম’ অর্থ লুকিয়ে লুকিয়ে ঘরের ভেতরে বা অন্দরমহলে ইসলামের চর্চাকারী ব্যক্তি। বাইরে তিনি ধর্ম-পরিচয়ে ভিন্ন-ধর্মাবলম্বী। ‘ক্রিপ্টো-খ্রিস্টান’ বাইরে হয়তো মুসলমান নামে পরিচিত, ভেতরে ভেতরে খ্রিস্টধর্মাচারী অথবা বিশ্বাসী। একইভাবে ‘ক্রিপ্টো-জিউ’ বা ‘ক্রিপ্টো-হিন্দু’ও হতে পারেন (Robbins 2011)! তারা কেন মূল ধর্ম-পরিচয় লুকান? আধুনিক রাষ্ট্রেই তারা ‘ক্রিপ্টো’ থাকেন কেন? তাদের কীসের ভয়? আধুনিক রাষ্ট্র শাসনতন্ত্র দ্বারাই যেখানে তাদের ধর্ম পালন, ধর্ম গ্রহণ-বর্জন বা ধর্ম প্রচারের স্বাধীনতা ঘোষণা করে রেখছে, সেখানে তাদের ধর্ম-পরিচয় লুকানোর কীইবা আছে? ধর্ম পালনের স্বাধীনতায় বাধা পেয়েছেন মনে হলে তারা আইনের দ্বারস্থ হতে পারেন। সুবিচার পাবার সম্ভাবনাও যথেষ্টই। তবু তারা ‘ক্রিপ্টো’ থাকেন কেন? অর্থাৎ, সংবিধান ঘোষণা দিয়ে রাখলেই যে তারা রাষ্ট্রের ওপর আস্থা রাখবেন সে সম্ভাবনা কম। 

ভারত সাংবিধানিক এবং তাত্ত্বিক ঘোষণা মারফত একটি সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ভারতের মুসলমানরা কি দেশটিকে সেভাবে দেখেন? ধর্মকর্মের সাংবিধানিক অধিকার পালন করতে পারেন? অবশ্যই পারেন না। তারা কি আদৌ নিজেদের নিরাপদ মনে করেন? উত্তর, ‘না’। অসংখ্য প্রমাণ আছে যে ভারতে ইসলামবিদ্বেষ ও মুসলিমবিরোধী উত্তরোত্তর বিধ্বংসী মাত্রায় বাড়ছে, এবং মুসলমানরা মনে করেন ধর্ম-পরিচিতির কারণে দেশটিতে তারা নিজেদের জীবনকে মোটেই নিরাপদ ভাবেন না। নিরাপত্তার জন্য তারা কি পুলিশের দ্বারস্থ হতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন? না, উলটো তারা পুলিশি নৃশংসতাকেও ভয় করেন (Ellis-Petersen 2020)| এটি সুনিশ্চিত যে ভারতের আম-মুসলমানদের জীবন-জীবিকা ও জীবনযাত্রায় ব্যাপক হুমকি রয়েছে (Maizland 2020)| যেহেতু তাদের নিরাপত্তাহীনতাবোধের কমতি নেই, কেউ কেউ হয়তো হিন্দু ধর্মে না হোক, খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হচ্ছেন। বাইরে ধর্মত্যাগী, কিন্তু মনে মনে স্বধর্মপ্রেমী, এবং ভেতরে ভেতরে ধর্মাচারিও- এরকম ক্রিপ্টো-রিলিজিওসিটিকে আমলে না নিলে ধর্মাচরণের রাজনীতি বুঝতে পারা সহজ হবে না। 

রাজনৈতিক ধর্মাচারিতা বা ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার
ধর্ম রাজনীতিকদের দুষ্কর্মের একটি মোক্ষম হাতিয়ার। ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে হলে ধর্মকে ব্যবহার করতে হয়। রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে ধর্মকে ব্যবহার করতে হয়। এটি একটি পুরনো অভিজ্ঞান। আমাদের দীর্ঘদিনের চাক্ষুষ বাস্তবতা। ইসলামবিরোধিতা এবং মুসলিমবিরোধিতা নির্মাণই ভারতে বিজেপির রাজনীতির উত্থান, প্রতিষ্ঠা লাভ ও ক্ষমতার শীর্ষস্থান দখলের পেছনে মূল রসদ (Subramanian 2020)| ইসলাম-বিদ্বেষ ও ঘৃণা উৎপাদনের জন্য দেশটির রাষ্ট্র-সমর্থিত প্রকল্প আছে। সুব্রামানিয়ান রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং বা ‘র’ ছাড়াও উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের উগ্র দক্ষিণপন্থী ছাত্রযুবা সংঘ অখিল ভারতীয় বিদ্যা পরিষদবা এবিভিপির ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ ও সক্রিয়তার উল্লেখ করেছেন (ibid)।

ভারতের দিল্লিতে ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত দাঙ্গার ভয়াবহতা বিশ্ববাসীকে হতবাক করেছিল। সপ্তাহব্যাপী চলা দাঙ্গায় ৫৪ জনের হত্যাকাণ্ড এবং কয়েকশ মানুষের আহত হওয়া, এবং সম্পদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন চাইলেই ঠেকানো যেত। ক্ষমতাসীন দল চেয়েছিল দাঙ্গাটি চলুক। দাঙ্গাটি ঝাড়েমূলে বিজেপির রাজনীতির পক্ষেই সুফল বয়ে এনেছিল। মুকুল কেসভান গার্ডিয়ান পত্রিকায় তাই লিখেছিলেন- অ্যান্টি-মুসলিম ভায়োলেন্স ইন দিল্লি সার্ভস মোদি ওয়েল’। ‘দিল্লির মুসলিমবিরোধী সহিংসতা মোদির (রাজনীতিতে) ভালোই কাজে লেগেছে’। গার্ডিয়ান পুরো লেখাটির সারমর্ম করেছিল- ‘The riots have been driven by a ruling party intent on painting its largely peaceful opponents as seditious sectarians’ (Kesvan 2020)| সড়কের আন্দোলন শান্তিপূর্ণই ছিল; কিন্তু বিজেপি আমজনতার কাছে আন্দোলনকারীদের দেশদ্রোহী বিচ্ছিন্নতাবাদীরূপে চিত্রিত করার আয়োজনে নেমেছিল। 

ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের কাজে ব্যবহারের এই দৃশ্যটি নতুনও যেমন নয়, আমাদের অদেখাও নয়। জাফরাবাদ মেট্রোর সিলামপুর-জাফরাবাদ-মৌজপুর রোডে অবস্থান ধর্মঘটের প্রতিবাদ শুরু করেছিল নারীরা। এটিই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের প্রথম ইঙ্গিত। মুসলমানরা চাইছিল না সহিংস কিছু ঘটুক। ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন বা সিএএর প্রতিবাদ যে হবেই, সেটি কে না জানত? ভারতের মুসলমান নাগরিকরাই সেই আইনের একমাত্র ও প্রত্যক্ষ লক্ষ্য। আইনটি মৌলিক মানবাধিকারের লংঘন, এবং স্পষ্টই ঘৃণা-বিদ্বেষমূলক ও বৈষম্যমূলক। ফলে ভারতের শিক্ষিত, সচেতন ও আলোকপ্রাপ্ত নাগরিক সমাজের অমুসলমান সদস্যরাও আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন, অথবা সমর্থন দিয়েছিলেন। তারা বিক্ষোভের প্রেক্ষাপট এবং যৌক্তিক কারণও গণমাধ্যমে উল্লেখ করছিলেন। ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার বানিয়ে বিভাজনের রাজনীতি উস্কে দেওয়ার সরকারি চেষ্টার বিরূদ্ধেও সরব হচ্ছিলেন। সিএএ এবং এনআরসির বিপক্ষে জনমতও তৈরি হচ্ছিল। বোধগম্য যে বিজেপি চাইছিল না সিএএ এবং এনআরসির বিপক্ষে জনমত আরও বাড়ুক, অথবা মুসলমান নাগরিকদের প্রতি সহানুভূতি বাড়ুক। 

সিএএবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল প্রস্তাবিত জাতীয় নাগরিকত্ব তালিকাভুক্তি বা এনআরসি কার্যকর হবার আশঙ্কা। ফলে প্রতিবাদটি শক্তিশালী রূপ পেতে শুরু করেছিল। এ ধরনের প্রতিবাদী আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠার দৃশ্য ভারতীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে হরহামেশাই দেখা যায়। ইতিহাসেও উদাহরণের কমতি নেই। তবু প্রতিবাদটিকে দাঙ্গায় রূপ দেওয়া হলো। কারণটি ছিল বিজেপির রাজনৈতিক অবস্থান সুসংহতকরণের প্রয়োজন। দাঙ্গাটি শুরুর মাত্র দুই সপ্তাহ আগেই রাজ্যসভার নির্বাচনে আম-আদমি পার্টির কাছে বিজেপির হার হয়েছিল। নির্বাচনের ফলাফল বিজেপির কর্মী-সমর্থকদের উদ্যম-উদ্যোগ ও সক্রিয়তায় ভাটার টান তৈরি করেছিল। তাদের আবারও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সমান সক্রিয় রাখার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।

একই রকম দৃশ্যের দেখা মেলে ইসরায়েলে। দেখা মেলে বাংলাদেশে। ২০২১ সালের মে মাসে ইসরায়েলে নেতানিয়াহুও উগ্র ইহুদিবাদ এবং মুসলিমবিদ্বেষি ঘৃণা উস্কে দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চেয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা চলছিল। মামলা ও শাস্তি হতে বাঁচতে তিনি আবারও রাষ্ট্রের শীর্ষপদ আঁকড়ে থাকতে চাইলেন। প্রমাণ করতে চাইলেন ইসরায়েল নামের ইহুদি রাষ্ট্রটিকে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের হাত থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে তার চাইতে বেশি সক্ষম ও যোগ্য আর কেউই নেই । উদ্দেশ্যমূলকভাবে ফিলিস্তিনে আক্রমণ শুরু করলেন। আগেও দফায় দফায় একই কৌশল ব্যবহার করেছিলেন। সাফল্যও মিলেছিল। আমজনতার মাঝে ইসলামবিদ্বেষ ছড়ানো এবং ঘৃণা তৈরি করার প্রয়োজনে তিনি গোয়েবলীয় পদ্ধতিতে উদ্ভট গল্প আবিষ্কারেও পিছপা হতেন না। তার বানানো একটি গল্প মতে হিটলার ইহুদিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালাতে চাননি। আল-হুসেইনি নামের একজন মুসলিম নেতা কুমন্ত্রণা দিয়ে হিটলারকে ইহুদি নিধনে প্ররোচিত করে(Insider 2015). বাংলাদেশে কিছুদিন পরপর অমুসলমানরা আক্রান্ত হন। তাদের ঘরবাড়ি, জমিজিরেত ও সহায়-সম্পদের ওপর আঘাত আসে। ফলে মুসলমান-অমুসলমান সম্পর্ক তিক্ত হতে তিক্ততর হয়; কিন্তু দু-একটি বিচ্ছিন্ন উদাহরণ ছাড়া প্রায় সকল ক্ষেত্রেই দেখা যায় সংখ্যালঘুদের জমি-জিরেত বা সহায়-সম্পদ রাজনৈতিক কুচক্রিমহলের সদস্য কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির দখলে চলে গেছে। মাঝখানে বিবদমান মুসলমান-অমুসলমান নানারকম বিপদে পড়েছেন। 

দিল্লির দাঙ্গাও যে রাজনৈতিক লাভালাভের হিসাব-নিকাশের ফল ছিল, তার নানা প্রমাণ প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। দাঙ্গাকালে অরাজনৈতিক ধর্মানুরাগীদের দাঙ্গায় যোগ দিতে দেখা যায়নি। সাংবাদিকরা বরং উত্তর দিল্লিতে প্রতিবেশীদের মাঝে পরস্পরকে সুরক্ষা দেবার, এবং ধর্মশালাগুলোকে বাঁচানোর ও রক্ষার উদ্যোগ দেখেছেন (Kinkar Singh 2020, ABP News 2020, Sikander 2020, Kuchay 2020). বিভিন্ন ধর্মের মানুষজন এক হয়ে প্রতিরক্ষা বেষ্টনী তৈরি করে মুসলমানদের আক্রমণ হতে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। অনেক অমুসলিম প্রতিবেশী নিজগৃহে মুসলমানদের আশ্রয় দিয়েছিলেন, লুকিয়ে রেখেছিলেন (The Print 2020)| চাঁদবাগ এলাকায় হিন্দু প্রতিবেশীরা চারপাশে বেষ্টনী টেনে মুসলমান প্রতিবেশীদের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন যে তাদের আক্রমণ করতে আসা যে কোনো বহর বা দলকে প্রতিহত করা হবে। মুসলিমপ্রধান এলাকায় হিন্দুদের নিরাপত্তায় এবং হনুমান মন্দির রক্ষায় মুসলমানরা প্রতিরক্ষাবেষ্টনী গড়েছিলেন (Bhalla 2020, Alavi& Srinivasan 2020, Sharma 2020, Sikandar 2020, Gulf News 2020)| শিখ ধর্মাবলম্বীরা গুরুদুয়ারাগুলো খুলে দিয়েছিলেন, এবং চারপাশে কড়া প্রহরাবেষ্টনী তৈরি করেছিলেন। দু’জন শিখ পিতা-পুত্র অন্তত ৭০ জন মুসলমানকে নিশ্চিত হত্যাকাণ্ডের হাত হতে বাঁচিয়েছেন। একজন মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে দুটি-দুটি করে অনেক শিশুকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছিলেন (Ellis-Petersen 2020)| 

তাহলে দাঙ্গায় অংশ নেওয়া মানুষগুলো কারা? দ্যা প্রিন্ট-এর অনুসন্ধানী দলটির কাছে প্রতিবেশীরা এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাল যে তারা ‘বহিরাগত’। অনেকেরই মুখ ঢাকা ছিল। তার মাঝে যাদের চেনা গিয়েছিল তাদের সবাই বিজেপি ও অঙ্গসংগঠনগুলোর সক্রিয় কর্মী-সদস্য। সিএএর মতো অসম্মানমূলক ও অপমানজনক আইনটি পাসের আগের কয়েক বছরে গো-রক্ষার নামে, গো-মাংস বহনের অপরাধে, লাভ জিহাদের অভিযোগ তুলে, এবং আরও বিচিত্র ছুতানাতায় মুসলিম নির্যাতন বেড়েই চলছিল। সে সমস্ত ভয়াবহচিত্র বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমেরও নজরে এসেছিল। প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রমাণিত হয়েছিল যে, আক্রমণে নেতৃত্বদানকারী এবং উস্কানিদাতাদের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট। বিজেপির নানারকম অঙ্গসংগঠন বা ভাবধারার সমর্থক। বিবেকবুদ্ধিহীন উগ্র ধর্মাচারী মানুষদের ধর্মবিশ্বাস ও আবেগই তাদের পুঁজি। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারে আখেরে ক্ষতি হয় ধর্মের ও ধর্মাচারীদের। লাভের ধান গোলায় যায় ক্ষমতার রাজনীতিকদের। তাদের দলে সদস্যসংখ্যা বাড়ে, সমর্থন বাড়ে, ভোটদাতা বাড়ে। বিপন্ন হয় মানুষ- ধর্মপরিচিতির মানুষ! 

ইসলামোফবিয়া ও টেররিজম প্রতিরোধের প্রায়োগিক সমস্যা
পশ্চিমে ‘ইসলামোফোবিয়া’ একটি একাডেমিক পাঠ-এর মর্যাদা পেয়েছে। সাধারণ্যে শব্দটির অর্থ ‘ইসলামভীতি’। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইসলামভীতি’ বিষয়ে মিলিয়ন ডলারের মুল্যমানের গবেষণা প্রকল্পও রয়েছে। একদল মানুষ ‘ইসলামকে ভয় পাচ্ছে’ এবং ভীতসন্ত্রস্ত বলেই ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের আঘাত করছে- বিষয়টির ভাব-ভাবনা অনেকটাই এরকম। সাপ মানুষকে এমনি এমনি ছোবল দেয় না। সে ভয় পায় যে মানুষ তাকে আঘাত করবে। তাই সে ভয়ের চোটেই আসলে সে অগ্রিম ছোবল মেরে বসে। ‘ফোবিয়া’ প্রত্যয়টির মাঝে এই ধারণাটি বেশ ভালো রকমেই প্রচ্ছন্ন আছে। ‘ভীতি’ বা ‘ফোবিয়া’র এই বয়ানে মুসলমানদের আক্রমণ করতে পারার পেছনে যে খানিকটা যুক্তিও আছে সে রকম একটি যৌক্তিকতাদায়ী স্বরও (অ্যাপোলোজেটিক টোন) মেলে। 

জিউফোবিয়া, ক্রিসচিয়ানফোবিয়া, হিন্দুফোবিয়া, বুদ্ধিস্টফোবিয়া ধরনের কোনো প্রত্যয়ের সঙ্গে আমাদের পরিচয় নেই। অথচ স্থান-কাল-পাত্রভেদে মুসলমানদেরও তো অন্য ধর্ম-সংক্রান্ত আতংক বা ভীতি রয়েছে। রোহিঙ্গাদের জিজ্ঞেস করলেই জানা যায় তারা মিয়ানমারের বৌদ্ধদের কতটা ভয় পায়। ভারতের মুসলমানদের জিজ্ঞেস করলেই জানা যায় তারা হিন্দুদের কতটা ভয় পায়। চীনে উইঘুরদের জিজ্ঞেস করলে জানা যায় তারা ধর্মাচারমুক্ততাকে কতোটা ভয় পায়। আজারবাইজানে (Nuruzade 2016) বা বেলারুশে মুসলমানদের ভয় খ্রিস্টান মিশনারিদের। কারণ, এসব অঞ্চলে মুসলমানদের খ্রিস্টধর্মে ব্যাপক ধর্মান্তরণ চলছে। শ্রীলংকায়ও উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী এবং উগ্র হিন্দুদের হাতে বারেবারে নির্যাতিত হওয়া একদল মুসলমানের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হবার আশংকা অমূলক নয়। তাদের ধর্মান্তরণ বিষয়ে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অন্যান্য দেশের মুসলমানদের মধ্যেও অস্বস্তি রয়েছে। 

‘ভীতি’কার কতোটা সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ; কিন্তু পরধর্মের প্রতি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ‘ঘৃণা’ ও ‘বিদ্বেষ’একটি বাস্তবতা। অথচ এই সত্যটিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। এন্টি-সেমেটিজম যদি থাকে, এন্টি-ইসলামিজম বলতে-লিখতে অসুবিধা কোথায়? ‘এন্টি-হিন্দু’, ‘এন্টি-ক্রিশ্চিয়ান’, এন্টি-বুড্ডিস্ট প্রত্যয়গুলোর ব্যবহার কিন্তু যথেষ্টই আছে। ‘ইসলামোফোবিয়া’র সংজ্ঞায়ন যারা করেন, অথবা শব্দটি ব্যবহার করতেই বেশি পছন্দ করেন, তাদের একটি যুক্তি এই যে ‘ফোবিয়া’ শব্দটি বিদ্বেষের বিপজ্জনক মাত্রা নির্দেশ করে। ঘৃণাকারীর ইসলাম সম্পর্কে এক ধরনের বদ্ধমূল অপবিশ্বাস বা ভুল অনুধাবনকেও বুঝিয়ে থাকে। দিয়া কায়ালি (Kayyali 2021) দেখিয়েছেন যে এক ধরণের অনড় পূর্বসংস্কার ইসলামোফোবিয়ার বৈশিষ্ট্য। এ কারণে মুসলমানদের ঘৃণা করতে গিয়ে ইসলামোফোবসরা মুসলমান-অমুসলমান নির্বিশেষে সকল আরবকেই ঘৃণা করে বসে। এর প্রমাণ মিলেছিল টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর। মুসলমান ভেবে যাকে প্রথম হত্যা করা হয় তিনি ছিলেন একজন শিখ ধর্মাবলম্বী। এই ধর্মাবলম্বী গোষ্ঠীর অভিবাসীদের একটি বড় অংশই আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। অর্থাৎ, ইসলাম ধর্মানুসারীদের মতো পোশাক-আশাক-দেহসজ্জার যে কেউই ইসলামোফোবিয়ার শিকার হতে পারেন। 

প্রকৃতপক্ষে ইসলামোফোবিয়া শব্দের মাধ্যমে মুসলিম-বিদ্বেষের সাধারণীকরণ এবং ‘পলিটিক্যাল কারেক্টনেস’ দেখানোয় বিপদ রয়েছে। কারণ ‘ইসলামভীতি’ শব্দের আড়ালে বিদ্বেষ ও বৈষম্যের নানা মাত্রার বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাওয়া যায়। অথচ, মুসলমানরা শুধুই একটি প্রকরণে ঘৃণা বা বিদ্বেষের বলি হয় না। স্থান-কাল-পাত্রভেদে কখনো ভীতি, কখনো ঘৃণা, কখনো বিদ্বেষ, কখনো অসুয়া ক্রিয়াশীল থাকে। রিচার্ড সি মার্টিন (Martin 2012) সম্পাদিত Review of Middle East Studies নামের গবেষণাপত্র সংকলনে বিষয়টি সম্পর্কে খানিকটা আলোকপাত আছে। 

ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের আব্দুলকাদের সিনো (Sinnoh 2012) বইটির ভূমিকায় বলেন ‘ওয়েস্টার্ন মুসলিম’, ‘কালচারাল মুসলিম’, ‘মুসলিম মাইনরিটি’ ইত্যাদি লেবেল ব্যবহার করা যৌক্তিকই শুধু নয়, প্রয়োজনীয়ও বটে! তাতে করে বিভিন্ন বর্গের মুসলিমদের প্রতি অমুসলিমদের ঘৃণা-বিদ্বেষ অথবা ভীতির ধরণ-ধারণ বা মাত্রা বুঝতে পারা যায়। যেমন ফ্রান্সে হয়ত ‘রিফিউজি মুসলিমদের’ বিষয়ে, কানাডায় ইমিগ্রান্ট মুসলিমদের বিষয়ে, ইউরোপে তাবলিগি বা ধর্ম প্রচারকারী মুসলিমদের বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মনোভঙ্গির মানুষজনের দেখা মিলতে পারে। তাদের কারও মাঝে মুসলিমদের বিষয়ে খুঁতখুঁতে ভাব, কারও ঘৃণা, কারও অপছন্দ, কারও বিরক্তি, কারও বিদ্বেষ ইত্যাদি ভিন্নভিন্ন রকম আবেগের প্রতিফলন থাকতে পারে। নেদারল্যান্ডসবাসী এবং ডেনমার্কবাসীরা হয়তো ইসলামের নবীর কার্টুন আঁকা বিষয়ে মুসলমানদের তীব্র প্রতিক্রিয়ায় যতটা ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত হয়েছে; কিন্তু ততটা বিদ্বেষভাবাপন্ন হয়নি। 

এ কারণে মুসলমানদের বিপক্ষে সব নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াকে মোটাদাগে ‘ইসলামোফোবিয়া’র লেবেলে আঁটানো অযৌক্তিক। আরও সমস্যা এই যে সারাবিশ্বে অল্ট-রাইট বা উগ্র ডানপন্থী ঘৃণাবাদী ও সন্ত্রাসবাদী মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তাদের কেতাবি নাম ‘র‌্যা ডিক্যালস’। তাদের ম্নে-মগজে উগ্র ও ক্ষতিকর বিশ্বাস বদ্ধমূল করে তোলার প্রক্রিয়াকে বলা হচ্ছে ‘র‌্যা ডিক্যালাইজেশন’। র‌্যা ডিক্যালসরা কোনো একটি সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করতে চান। পরিবর্তনকে দ্রুত ও তাৎক্ষণিক হতে হয়। তাদের একটি বদ্ধমূল বিশ্বাস বা আদর্শ বা বোধ থাকে। এবং সেই বিশ্বাসকে বাস্তব রূপ দিতে তারা একাগ্র, একাট্টা, উগ্র এবং আপোসহীন হয়ে থাকে। বর্তমান সময়ে র‌্যা ডিক্যালসদের বাড় বাড়ছে। ক্লু-ক্লাক্স-ক্ল্যান এর পুনরাগমনের খবর মিলছে। ‘শ্বেতাঙ্গ-প্রাধান্যবাদী’ বা ‘হোয়াইট সুপ্রেম্যাসিস্ট’ গুপ্ত সংগঠন ঝাড়ে-বংশে শাখা-প্রশাখায় বাড়ছে। তাদের আক্রমণ বা ঘৃণার লক্ষ্য শুধুই মুসলিমরা নয়। অশ্বেতাঙ্গ, মুসলিম, অভিবাসী, সমকামী, ভবঘুরে, দেহোপজীবী অনেকেই। তাদের দ্বারা একটি মুসলিম আক্রান্তের ঘটনা ঘটলে তাদেরকে হয়তো শুধুই ‘ইসলামোফোবস’ হিসেবে দায়ী করা হবে। লঘু শাস্তির ব্যবস্থাও হতে পারে। পুলিশের খাতায়ও তাদের এই পরিচিতি নথিবদ্ধ হতে পারে; কিন্তু এই একমূখি লেবেলিং তাদের অন্য অনেক বিপজ্জনক খুনে পরিচিতিকে আড়াল করে দেয়। ক্ষেত্রবিশেষে আইন-শৃংখলা বাহিনীও তাদের ‘ইসলামোফোবস’ ছাড়া অন্য কিছু না-ও ভাবতে পারে। যে কারণে তারা অন্য অপরাধের বেলায় সহজ দায়মুক্তির বা অ্যামনেস্টির সুবিধাভোগী হয়ে ওঠতে পারে। 

‘টেররিজম’ বা ‘সন্ত্রাসবাদ’ শব্দটির একটি রাজনৈতিক ও ঘৃণাবাদী বিশ্বায়ন হয়েছে। ‘ইসলামিক টেররিজম’ প্রত্যয়টি এমনই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যে ‘ইসলামিক’ শব্দের পরেই ‘টেররিজম’ শব্দটি অনেকের ভাবনার গণ্ডিতে এসে পড়ে। এই ধারণা নির্মাণ ও বাজারজাতকরণের পেছনে পশ্চিমের রাজনীতি ছিল। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে আধিপত্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক অর্থনীতি ছিল। ফলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলে ও মার্কেটপ্লেসে নিত্যনিয়ত ঘটে চলা সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্মকা-কেও ‘টেররিজম’ না বলে ‘গান ভায়োলেন্স’ উল্লেখের ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে ২০১৯ সালে এক জুমার দিনে একক বন্দুকধারীর আক্রমণে ৫১ জন মুসলমান হত্যা এবং অসংখ্যজনকে আহত করার পর বিষয়টি নতুনভাবে আলোচনায় আসে। কথা ওঠে যে কোনো অপরাধমূলক কাজে কোনো মুসলমান নামীয় অপরাধীর সংযোগ দেখেই ‘ইসলামিক টেররিজম’ লেবেল এঁটে দেওয়ার অপচর্চাটি ‘ইসলামোফোবিয়া’ অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে।

নিউজিল্যান্ডের ‘ক্রাইস্টচার্চ কল অ্যাডভাইজরি নেটওয়ার্ক’ একটি বিদ্বেষ-ঘৃণা-সন্ত্রাসবিরোধী নেটওয়ার্ক। নিউজিল্যান্ড সরকারের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ও তত্ত্বাবধানে নেটওয়ার্কটি পরিচালিত হয়। এই বছরের শুরুর দিকে নেটওয়ার্কটি Anti-Muslim Hatred and Discrimination শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করে (Kayyali 2021)| প্রতিবেদনটি অকপট ও ছাঁচাছোলা ভঙ্গিতে কিছু সত্য প্রকাশ করে। যেমন, “Definitions of terrorism and extremism are flawed in myriad ways, and perhaps in theircurrent form UN and US lists can’t include far-right groups- but if that’s the case, socialmedia companies and others need to rethink reliance on these lists and explain howthey’re addressing these major gaps in definitions when searching for the dangerousspeech that can cost Muslim lives”.

দিয়া কায়ালি প্রতিবেদনটির রচয়িতা। তিনি দেখালেন যে জাতিসংঘের সংজ্ঞায়নেই ঘোরতর গলদ রয়েছে। দেশের বাইরের কোনো গোষ্ঠীর আক্রমণকে ‘টেররিজম’ মনে করার ফলে দেশের ভেতরের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে ‘সন্ত্রাস’ বলা চলে না। ইউটিউবে বা সামাজিক মাধ্যমে তাই কোনো মার্কিনী ইসলামবিদ্বেষী মারাত্মক উস্কানি ও বক্তব্য রাখলেও কর্তৃপক্ষ অনেক সময় সে সকল কন্টেন্ট সরিয়ে নিতে পারে না; কিন্তু ভিনদেশি কোনো মুসলমানের কোনো মতামতে ইসরায়েলের বা পশ্চিমাদের সমালোচনা থাকলে সেগুলোকেও ‘ঘৃণা-বিদ্বেষ’ বা ‘সন্ত্রাসবাদে উস্কানি’ বিবেচনায় সরিয়ে নেওয়া হয়। এই চর্চার ফল কী রকম হতে পারে, তা দিল্লির জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক হিন্দুত্ববাদী উগ্র সন্ত্রাসীর নির্বিচার গুলিবর্ষণ ঘটনাই স্পষ্ট। ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি ছিল মহাত্মা গান্ধীর হত্যা দিবস। সেদিনই ‘রামভক্ত’ নাম নেওয়া ১৭ বছরের এক তরুণ নির্বিচার গোলাগুলিতে জামিয়া মিলিয়ার ছাত্রছাত্রীদের সন্ত্রস্ত করে তোলে। সবচাইতে বড় কথা সে গোলাগুলির ঘটনাটি সামজিক মাধ্যমে ‘লাইভ’ প্রচার করে। তার মুখে ছিল মুসলিম নিধনের আহ্বান জানানো স্লোগান। অথচ পুলিশ প্রশাসন ছিল নির্বিকার। অন্তত কুড়িজন পুলিশ ‘লাইভ’ উপভোগ করছিল। সামাজিক মাধ্যমে তার সঙ্গে সংযুক্তদের বাহবা ও প্রশংসার খই ফুটছিল। তাকে পরিচিত করানো হয় ‘প্রটেস্টার’ বা ‘প্রতিবাদী’ হিসেবে(Leidig 2020, Basu 2020)| 

‘প্রটেস্টার’ বা ‘প্রতিবাদী’? সামাজিক মাধ্যম তার সন্ত্রাসযজ্ঞটি বন্ধও করেনি। এ রকম বৈষম্যমূলক ছক বিশ্বের প্রায় সব কমবেশি বিদ্যমান। এই ধারা টিকে থাকলে ইসলামোফোবিয়া বা অ্যান্টি-ইসলামিজম বাড়বে, কমবে না। টেররিজমও শক্তিমদমত্ত রূপ লাভ করবে। 

সহায়ক তথ্যসূত্র 
ABP News (2020) ‘When Hindus protected a Masjid, Muslims saved a temple in Noor-e-Ilah.’ 29 February. Retrieved 16 June 2021.

ABP News (2020) ‘Delhi’s Noor-E-Ilahi Area Setting Example of Ganga-Jamuni Tehzeeb’. 29 February. Retrieved 16 June 2021.

Alavi, Mariyam; Jain, Sreenivasan (2020). ‘At Epicentre of Delhi Riots, How A Mohalla Of Hindus And Muslims Kept Peace’. NDTV26 February. Retrieved 16 June 2021.

Aziz, Sahar and Braxton Haake (2020). No justice for post-9/11 discrimination: Nineteen years after 9/11, Muslim victims of discrimination still face unfriendly courts. Aljazeera. 11 September 2020. Retrieved 10 June 2021.

Basu, Soma (2020) Jamia Millia Shooting: Making of a Hindutva Terrorist, The Diplomat, 3 Feb.

Bhalla, Abhishek (2020). ‘Delhi violence: Hindus, Muslims join forces to guard their colonies from outside rioters’. India Today28 February. Retrieved 16 June 2021.

Bowering,Gerhard and Patricia Crone ed (2013). The Princeton Encyclopedia of Islamic Political Thought. Princeton University Press.

Chao, Mary (2021). What’s in a name? For Asian immigrants, a chance to ‘assimilate or vanish’ in NorthJersey.com. May 27. Retrieved 15 June 2021.

Chazan, Robert, ed. (1980)Church, State, and Jew in the Middle Ages, West Orange, NJ:Behrman House, 1980, p. 103.

Ellis-Petersen, Hanna (2020) ‘We are not safe: India’s Muslims ell of wave of police brutality’. The Guardian. 3 January 2020. Retrieved 17 June 2020.

Ellis-Petersen, Hannah (2020b). ‘Inside Delhi: beaten, lynched and burnt alive’. The Guardian. 1 March. Retrieved 16 June 2021.

Firth, Raymond (1981) Spiritual Aroma: Religion and Politics. American Anthropologist, New Series, Vol. 83, No. 3, pp. 582–601

Garcia-Arenal, Mercedes and Yonatan Glazer-Eytan (2020) Forced Conversion in Christianity, Judaism and Islam Coercion and Faith in Premodern Iberia and Beyond. Boston: BRILL

Gillum, Rachel M. 2018. Muslims in a Post-9/11 America: A Survey of Attitudes and Beliefs and Their Implications for U.S. National Security Policy. Michigan: University of Michigan Press.

Gulf News (2020).`Delhi riots: How Hindus saved lone Muslim family from rioters’. 28 February Retrieved 16 June 2021.

Hotstar (2020) `When Hindus protected a Masjid, Muslims saved a temple’. Retrieved 16 June 2021.

Insider (2015) Video document. `Netanyahu says Hitler didn’t want to kill the Jews, but a Muslim convinced him to do it’. 3 Octber. Retrieved 15 June 2021.

Kayyali, Dia (2021) Anti-Muslim Hatred and Discrimination. New Zealand:Christchurch Call Advisory Network.

Kinkar Singh, Ram (2020). `Delhi violence: Groups spread peace message in Jafrabad’. India Today. 2 March. Retrieved 16 June 2021.

Kuchay, Bilal (2020). `We lost a brother’: Hindu, Muslim families in Delhi share grief’. Al Jazeera. 27 February. Retrieved 16 June 2021.

Leidig, Eviane (2020), `Far-Right Terrorism is Global, but Coverage is Not’: Hindu Nationalist.

Maizland, Lindsay (2020) `India’s Muslims: Am Increasingly Marginalized Population’. In Council on Foreign Relations Bulletin. 20 August. New York: CFR. Retrieved on 20 June, 2021.

Martin, Richard C. (2012) In Review of Middle East Studies. Vol.46. No.2. Arizona: The Middle East Studies of North America.

Nuruzade, Shahla. (2016). `Religious Views in Modern Azerbaijan’. Journal of Socialomics. 05. 10.4172/2167-0358.1000187.

Rabasa, Angela M. et al., (2020). The Muslim World after 9/11. CA: RAND.

Richards, James (2002) Naming Conventions for Arabic, Russian, Chinese, Vietnamese, Western African, & Hispanic Cultures. American Taxpayer Identification Numbers.

Robbins, Joel. (2011). Crypto-Religion and the Studz of Cultural Mixtures: Anthropology, Value, and the Nature of Syncretism. Journal of the American Academy of Religion. 79. 408-424. 10.2307/23020432.

Sharma, Milan (2020). `Delhi violence: Hindu family which saved Sikhs in 1984 riots, now saves a Muslim family’. India Today3 March.

Sikander, Sana (2020). “Hindu saves 6 Muslims in Delhi riots, gets critically burned”. The Siasat Daily28 February. 16 June 2021.

Sinno, Abdelkader H (2012) Introduction to Researching Western Muslim. In Review of Middle East Studies. Vol.46. No.2. Arizona: The Middle East Studies of North America.

Subramanian, Samanth (2020) `How Hindu Spremacists are Tearing India Apart’ in The Guardian 20 February 2020. Retrieved on 19 June, 2021.

The Indian Telegraph (2020)”At Epicentre Of Delhi Riots, How A Mohalla Of Hindus And Muslims Kept Peace”. 26 February. Retrieved 16 June 2021.

The Print 2020. “Why Delhi riots are different– What The Print’s 13 reporters, photojournalists saw on ground’. The Print. 27 February 2020. Retrieved 16 June 2021.

Violence in India’. Global Network on Extremism and Technology, G Net Research. 24 February.

লেখক : অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //