এস এম সুলতান বাংলার শিল্পী

এস এম সুলতান, বাংলার চারণ চিত্রকর। তিনি আধুনিকতা মনস্ক এক রঙ তুলির জাদুকর। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ধরাবাঁধা নিয়মের বাইরের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য, তাঁর মধ্যে লুক্কায়িত ছিল- যে জন্য তিনি নিজেকে আলাদা করতে পেরেছিলেন অন্যসব শিল্পীদের থেকে। সুলতান বরাবরই ভবঘুরে জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন। ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসতেন, পাহাড়, নদী, পর্বত- সবই যেন তাঁর বন্ধু।

ছেলেবেলাটা ছিল দারুণ উদ্যোমের। বাবার পেছনে ঘুরে ঘুরে সময় কাটাত। বাবা ভালো ঘর বানাতে পারতেন, রাজমিস্ত্রির কাজ ভালো জানতেন তিনি। দালানের গায়ে নকশা করতে ওস্তাদ ছিলেন সুলতানের বাবা। লোকে তাকে এ জন্য কদর করত। বাবার এই নকশা করা দেখে দেখে ছেলেবেলায় সুলতানেরও নকশা করার, ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। যেহেতু সুলতান স্কুল পছন্দ করতেন না তাই বাবার কাজেই সাহায্য করতেন। এভাবেই একদিন জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মন জয় করে নেন সুলতান। তাঁর আঁকা কাজে তিনি খুশি হন, জানতে পারেন সুলতানের ছবি আঁকার শখ আছে। জমিদার দত্ত সুলতানকে নিয়ে গেলেন কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তির জন্য; কিন্তু ওখানে ভর্তির জন্য যে শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন তা সুলতানের ছিল না।

শেষমেশ সেই স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য শিল্পাচার্য শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর বিশেষ বিবেচনায় সুলতানকে আর্ট স্কুলে ভর্তি করা হয়। আর সুলতানের থাকবার জায়গা হয় জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের কলকাতার বাড়িতে; কিন্তু সুলতান ধরাবাঁধা নিয়মে থাকা মানুষ নন। তিনি সেখানে তিন বছর শিক্ষা লাভ করে অসমাপ্ত অবস্থায় বেরিয়ে পড়েন, চলে যান নিজ গ্রাম নড়াইলের মাসিমদিয়া গ্রামে, চিত্রা নদীর পাড়ে; যে গ্রামে তিনি ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সুলতান নিজের গ্রামে বেশিদিন থাকেননি, ১৯৪৩ সালে চলে যান সিমলায়, এরপর সেখান থেকে পাকিস্তানের লাহোরে। সেখানে আর্ট স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তখন তাঁকে কেউ জানত না। পাকিস্তানে দুটি আর্ট এক্সিবিশনে তিনি অংশগ্রহণ করেন।

এরপর ১৯৫০ সাল সুলতান পাকিস্তানের লাহোর থেকে একটি শিল্প সম্মেলনে যোগ দিতে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানেই সুলতানের একে একে কুড়িটির মতো প্রদর্শনী হয় ইউরোপজুড়ে। আমরা জানতে পারিনি তখনও সুলতান এদেশের শিল্পকলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, যাঁর ছবি পাবলো পিকাসো, সালভাদর দালির মতো বিখ্যাত চিত্রকরদের আঁকা ছবির সঙ্গে প্রদর্শিত হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে শিল্পী এত সুনাম পেলেন, তাঁর দেশের মাটিতে পরিচয় নেই তখনও। প্রথাগত, প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পী সমাজে সুলতানের স্থান মেলেনি। এসবের একটি বড় কারণ হয়ত সুলতান নিজেই, কেননা তিনি শহুরে জীবনের বাইরের মানুষ। এ ছাড়া শহরে তিনি থাকতে চাইতেন না। আর শহরের সঙ্গে গ্রামের যে যোগাযোগহীনতা সেকালে ছিল, সেটি একটা বড় কারণও বটে। অবশেষে ১৯৭৬ সালে ঢাকার শিল্পসমাজে এস এম সুলতানের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মেলে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি তাঁর আঁকা ছবি নিয়ে একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করে সে বছর। এরপর থেকেই দেশব্যাপী এই মহান শিল্পী ব্যাপক পরিচিতি পান।

এদেশের মাটি ও মানুষের এই শিল্পীর শিল্পকে নিয়ে লেখক আহমদ ছফা দীর্ঘ গবেষণা শেষে একটি ৪৬ পৃষ্ঠার প্রবন্ধ লেখেন এবং সেটি ছফা তাঁর প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক পন্ডিত আব্দুর রাজ্জাকেও পাঠ করতে দেন। কারণ রাজ্জাক সাহেব মনে করতেন তাঁর বন্ধু- শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন-ই সেরা আর্টিস্ট। সে প্রবন্ধে ছফা লেখেন- ‘সকলে চিত্রকলার মর্ম বোঝে না, সূক্ষ্ম বোধ এবং উপলব্ধি অনেকের না থাকতে পারে; কিন্তু ইতিহাসকে তো কেউ অস্বীকার করতে পারে না। বিশেষত সেই ইতিহাস গাজন-উৎসবের নটরাজের মত অট্টরোলে যখন নেচে ওঠে। সুলতান বছর তিনেক আগে শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত তার সর্বশেষ প্রদর্শনীটিতে বাংলার আবহমানকালের ইতিহাসকে নাচিয়ে দিয়েছেন। যারাই এ চিত্রগুলো দেখেছেন, তাদের উপলব্ধিতে একটি কথা ভ্রমরের মত গুঞ্জরণ করেছে। আমাদের সভ্যতার প্রাণ কৃষি আর কিষাণ হলো সভ্যতার নাটমঞ্চের একক কুশীলব। যখন মানুষের কানে মহাকাশ আর মহাপৃথিবীর শ্যামের বেণু অপূর্ব সুরলহরী বিস্তার করে তাকে ক্রমাগত মর্তলোকের সীমানা থেকে ঊর্ধ্ব, ঊর্ধ্বতর লোকে আকর্ষণ করে নিয়ে যাচ্ছে, তখনো এই প্রাচীন ভূখণ্ডটিতে আদলে এবং অবয়বে মানুষ সেই সনাতন মানুষই রয়ে গেছে। তাই সুলতানের আঁকা এই মানুষেরা বাংলাদেশের হয়েও সমস্ত পৃথিবীর মানুষ।’ 

শিল্পী সুলতান ছবি আঁকতেন জলরং ও তেলরঙে; কিন্তু তাঁর কাগজ আর রঙের মান ছিল বেশ নিম্নমানের, যে কারণে তাঁর অনেক ছবিই নষ্ট হয়ে গেছে। সুলতান ধ্যানী শিল্পী হওয়ার কারণে যেটি হয়েছে তা হলো- সুলতান আঁকতেন; কিন্তু তা কীভাবে রক্ষা করা যাবে, তা নিয়ে কোনো ধারণা তাঁর ছিল না। সুলতানের প্রিয় বিষয় ছিল বাঁশি বাজানো। সুলতান আঁকার ফাঁকে ফাঁকে নিজেকে ছড়িয়ে দিতেন বাঁশির সুরে, নড়াইলের চিত্রা নদীর পাড়ে প্রকৃতির মাঝে।

গুণী এই শিল্পীকে ১৯৮১ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ‘ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট’ সম্মাননা প্রদান করে এবং বাংলাদেশ সরকার তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদকে ভূষিত করে। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি তাঁকে ‘আর্টিস্ট অব রেসিডেন্ট’ ঘোষণা করে। সুলতানের সুপরিচিত চিত্রকর্ম- ‘প্রথম বৃক্ষরোপন’, ‘হত্যাযজ্ঞ’, ‘চরদখল’। সকলের প্রিয় এই শিল্পী ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোরে মৃত্যুবরণ করেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //