দস্তয়েভস্কির দ্বিশতবর্ষ প্রণাম

১৮২১ এ জন্মান তিনি। দ্বিশতবর্ষ আগে। কিন্তু ফুরোন না, অশেষরূপে রয়ে যান। ফিকশন তো শুধু সমাজ-আখ্যান নয়, নয় নির্ধারিত কোনো জীবনবেদ, বিভিন্নরকমে একে পঠিতব্য করলে যা দাঁড়ায়, এমনকি সমালোচনার ক্ষেত্রেও- সেটি যিনি বুঝিয়ে দেন- যার পাঠ্য পাঠককে এগিয়ে দেয়- নিরন্তর এক ভাঙ্গাগড়ার মধ্য দিয়ে, গভীর- গভীরতর করে বুঝিয়ে চলে, বাস্তবতাকে বানিয়ে সময়ের ক্রনোটপে এঁটে অনিবার্য করে চলে, সে ফিওদর দস্তয়েভস্কি।

জীবনের জটিল পাটাতন কী, মন ও মসস্তত্ত্বর কী কোনো কিনারা আছে? দস্তয়েভস্কি ঠাঁইনাড়াকে জাগিয়ে দেন, সেটি সহজ নয়, সহজাতও নয়, নির্মম সত্যে, যেন বিপরীত দিক থেকে দেখতে থাকেন- পরে অথেনটিক হয়ে ওঠেন। এই যে পরিণত পরিবর্তন, সেটি দ্রুত নয়, বেশ গুণে গুণে সবটুকু নিংড়ে, কাঠখড় পুড়িয়ে, ঘষে ঘষে নবায়ণ করেন। নির্মেদ করে, ধুয়ে দেন, একেবারে খাঁটি করে। তাঁর কোন গ্রন্থটি নিয়ে বলি, এসব কথার সমর্থনে? কারমাজভ ভ্রাতৃদ্বয়, নাকি রাসকলনিকভ! নাকি তাঁর নিজের জীবনই? যখন শুনি ওঁর জীবনটা : ‘FYODOR MIKHAILOVICH DOSTOEVSKY’s life was as dark and dramatic as the great novels he wrote’- এতেই ধরা পড়ে ওঁর রচনার ও জীবনের সামর্থ্য। এবং এই সত্য বুঝে যাওয়া যায়, প্রত্যেক লেখকই যেন একটি দিনপঞ্জিই লেখেন, একটি অভিজ্ঞতার কথাই বলেন- ‘dark and dramatic’| 

তবে নিশ্চয়ই তা স্ট্যান্ট নয়! একদমই বুনে দেন সবটুকু শুষে হরণ করে, আহরণের চূড়ায় উঠে। কথাগুলো ভূমিকাস্বরূপ, এ লেখাটিও ভূমিকা- তবে স্রেফ ভূমিকাও বলা নয়, স্মরণের পরিচয়ে কিছুটা গ্রাহ্য করার চেষ্টা। তাতে পুরো দস্তয়েভস্কি কী মেলে? না। সে এক বিরাট মহাকাব্য। বিচিত্র ইন্টারপ্রেটেশান! কিছু ছাড়া তো চলে না। তবে এটা মানি এতো বেশি- মানে কম লিখে খুব বেশি, গভীর, মনের অন্তঃস্তলে পৌঁছে ডুবরির মতো সবটুকু খোঁজা, গ্রহণ করা, আর নির্বাচনে রাখা ‘উৎসব’, ‘সময়’, দূরকে কাছে করা, নিকট করা, সেজন্য অধিক করে মনকে চেনা, অন্ধকার-আলোর পর্বে পাশ ফেরান, দ্বন্দ্ব-দ্বিধা রচনা করা, সর্বরকম সম্ভাব্যকে যতো মূল্য-অমূল্য, তুচ্ছ-অতুচ্ছ, হেলা-অবহেলা, নিষ্ঠুর-লালচক্ষু ডাকাত, চোর, ঘৃণা-নিন্দা, দুমড়ানো মূল্যবোধ, গুঁড়িয়ে দেওয়া নীতিবোধ- আর সবটা রসের ছোপে, রংয়ের তুলিতে টানে টানে পৌঁছে দেওয়া- ও একদম শেষ কিনারা পর্যন্ত, সে হোক নিকৃষ্ট হোক কপর্দকশূন্য, গ্রাম্য, বা নিবিষ্ট নৈমিত্তিক নিরাকরণের কেউ! আশ্চর্য! কি নেই দস্তয়েভস্কিতে? আমরা খুব ব্যক্তিগত করে পঠিত উদাহরণে পেতে পারি  ‘অপরাধ ও শাস্তি’- এটি নিমিষে পড়ে ফেলি, আবার পড়ি আর ভাবি ওই রাসকলনিকভকে নিয়ে। পড়তে গিয়ে হোঁচট, উঁচু-নিচু, ঠান্ডা-শীতল, গড় গড়ানো বা অরণ্যেও ঢুকে বাঘের ভয়ে কলিজাকাঁপা ঠান্ডা কিংবা দিগ্‌বিজয়ের ঠাণ্ডা আনন্দ সবই মেলে- মেলে বৈকি- উৎসবের উতরোল কলকাকলিও তো কম নয়, কান্না-হাসির দোলদোলানো অপার্থিব সুখ অমলিন চমকিত ভবিষ্যতের ঝলকানি- কী নেই সব! অপরাধ তো হলোই অতঃপর শাস্তি, নিজের কাছে নিজের শাস্তি, নিষ্কণ্টক, শাস্তি। অতঃপর পুনরুদ্ধার।

নিজের আয়নায় নিজেকে দেখে। নিবিড়রূপে তাড়িয়ে দেখা। ভেতর থেকে অবমুক্ত করে দেখা। এমন সব ঘটতে ঘটতেই চোখে পড়ে ক্লিন্ন রাষ্ট্র, বিচারালয়, কোর্ট-কাছারি, পুঁজি, ক্ষমতা, অকুপাই, হেজিমনি, সেখানে অগণ্য জনতার স্রোত থেকে উঠে আসা পজেটিভ কলোধ্বনি, জীবনের সত্যই সেখানে বড় হয়ে ওঠে। খুব শান্তরূপে- বিশেষ জঙ্গমে হাহাকারের পীঠে জুড়ে বসেছে অনন্ত জীবন, প্রভূত জীবনের স্বাদ, লেলিহান স্বাদই শুধু নয়, বাঁচার সংগ্রামের গূঢ় তাৎপর্য- এই মিলে দস্তয়েভস্কি। সেকালের, তবে একালেও। ততোধিক দিনের তিনি- ‘he left his legacy of masterworks that influenced the great thinkers and writers of the Western world and immortalized him as a giant among writers of world literature.’  

২.

‘you may find that out of yourself from the novel’-তাহলে কী? এতো নতুন রকমের উপন্যাস পড়া! কারণ: ‘Man is a mystery if you spend your entire life trying to puzzle it out, then do not say that you have wasted your time. I occupy myself with this mystery, because I want to be a man.’ 

এই ‘ম্যান’ যখন একজন লেখকের সমস্ত অনুভব ও চিন্তার কাঙ্ক্ষিত বিন্দু তখন বিদ্যমান ব্যবস্থার কাঠামোটি একপ্রকার জরুরি প্রস্তাব গ্রহণ করে। এ প্রস্তাবের লক্ষ্য ‘মানুষ’। ফলত, রাষ্ট্রব্যবস্থা, ক্ষমতা-কাঠামো, পুঁজির পরিপ্রেক্ষিত আলোচ্য হয়ে ওঠে। দস্তয়েভস্কি ইত্যাকার বস্তুসাপেক্ষে সবকিছু ততোধিক যুক্ত করে নেন, আইন-শাসন-বিচার ব্যবস্থার উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের বিষয়টিতে। ফলে তাঁর কথাসাহিত্যে পূর্ণায়ত রাষ্ট্র ও বিবেচ্য আইনব্যবস্থার চালচিত্র নিয়ে নির্বিবাদে তুমুল ব্যবহৃত। এবং এর কেন্দ্রে বিস্তাররূপে থাকে ওই মানুষ। রাসকলনিকভ আত্মশ্লাঘা পুড়ে ফেলেন। তার পূর্বজ বিদ্যমান মন ও মননের ভাঙচুরে; দ্বৈরথ-দ্বিধা ও সংশয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে। তাৎপর্যপূর্ণ কথাটা এখানে গ্রহণ করি রসোপভোগের শর্তে। দ্রুতলয়ে রাসকলনিকভ-সত্তার অন্তর্নিহিত জারিজুরি সমস্ত পুরনো ঐতিহ্য, সংস্কার, রক্তনেশামত্ত জান্তব-ভিত অবমুক্ত হতে চায়। তবে এসব তো সহজ নয়! একটা আঘাত তো চাই-ই! সেই আঘাত বাইরের এবং অধিক ভেতরের। সেটিও ক্রমাগত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভেতর দিয়ে পাল্টানোর পথ রচনা করে। অপরাধ ও শাস্তির ভেতরে তুমুল মনোযুদ্ধ শুরু। চেতন-অবচেতন প্রক্রিয়ায় এ মনের দহন ও দাহ দ্যুতি ছড়ায়। বর্ণনার গূঢ় অবকাশে উইট-হিউমার আর শ্লেষ তীরবিদ্ধতায় তীব্র হলে মনের বসতে টান ফেলে। তবে দস্তয়েভস্কি কী মনের কারিগর! মন নিয়ে বৃত্তান্তই শুধু নয়, সংঘাত-সংশ্লেষ-বিশ্লেষ-ক্রিয়ার পটচিত্র সাজিয়ে তোলেন। তাতে ক্রমাগত রাষ্ট্রকাঠামোর স্বরূপ, বিচার ব্যবস্থার কড়িবর্গা বিবৃত হতে থাকে।

বিস্তর বর্ণনায় ক্ষুদ্র আরশোলা, টিকটিকি, কীটপতঙ্গ রাসকলনিকভের মনোজাগতিক প্রতিক্রিয়ার অংশীদার হয়। বিচারকের কাঠগড়া, জনতার পদচিহ্ন, এজলাস, নীতিবুদ্ধির দণ্ড, রাষ্ট্রের প্রতীকী রেপ্লিকা, বিচারকের ঘরে সাজানো মিমেন্টো, কার্পেট, চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চ, ঝুলন্ত ফ্যান, কালো পর্দা, বিচারকের বেশ, উকিলের পোশাক, দীর্ঘ বারান্দায় উদ্বিগ্ন বাদী-বিবাদীর শলা-পরামর্শ, ইস্পাতের গ্রিল, লাল সামিয়ানা, ছায়াপর্দা, উঁচু জানালার মরচেপড়া শিক, গোথিক সিঁড়ি, নকশা করা বর্গায় মাকড়শার বসতি, শতাব্দী প্রাচীন পুরনো শ্যাওলায় আগাছার কম্প্রমান শিস, শ্যাওলার কন্দরে গুটিপোকার বসতি, ছোট্ট ছোট্ট তাঁবুতে মহুরি আর দালালদের কূটবুদ্ধি, লোভ আর অর্থের শূন্য হাহাকার ছড়ানো মুখর আর্দালি বিরলরূপে রাসকলনিকভকে ধরে প্লটের কিনারায় পুঁজির আগ্রাসী প্রতিবেদন রচনা করে চলে। সবটুকুই টুকরো টুকরো হলেও মুখ্যত তা পূর্ণ রাষ্ট্র-ব্যবস্থাকেই তুলে আনে। রাষ্ট্র তো ব্যবস্থার উপর দাঁড়িয়ে থাকে। সেই ব্যবস্থার নানারকম বিস্তারও আছে। তাতে প্রস্তুতকৃত যে কাঠামো সেখানেই মানুষের অপরাধ, শাস্তি, পুনরুদ্ধার, পরিমার্জনা সর্বোপরি বিকশিত আত্মা তৈরি করে। কিন্তু এসবের ভেতর-কাঠামো তো ‘পুঁজি’! পুঁজির স্বতশ্চলতাই অনেকাংশে দায়ি।

মার্কসের জীবদ্দশাতেই দস্তয়েভস্কি তার লেখনী চালু রাখেন। মার্কসের মৃত্যু ১৮৮৩, ঠিক দুবছর আগে দস্তয়েভস্কি প্রয়াত হন। তাঁর জন্মও হয় মার্কসের তিনবছর পরে। ১৮৮৫ তে পুঁজি লিখিত। ব্রাদার্স কার্মাজভ লেখা হয় ১৮৮০। সমসময়ের গ্রন্থিতে আটকানো দস্তয়েভস্কির অন্য সব রচনাও। সমকালের এইসব প্রযোজনার মাঝে দস্তয়েভস্কির জীবনপঞ্জিও আটকানো ছিল। যেমনটা আগেই বলেছি, তাঁর রচনা চলমান সময়ের ভেতর দিয়েই সম্মুখমান এগিয়েছে। সেখানেই তিনি ‘জীবনের পান্থ’ খুঁজেছেন। আটমোস্ট মানুষরূপ অনুসন্ধানের জৌলুসে ছিলেন তিনি মত্ত। মত্ততার ভেতরেই একপ্রকার মানবসৃজন প্রচেষ্টার কৃত্য করেছেন। শিল্পসত্তার ভেতরেই সেটি দানা বেঁধেছে। ফলে অপরাধ ও শাস্তির যে পরিবেশ বা প্রস্তুতি তা দস্তয়েভস্কির সত্তার মধ্যেই ছিল এবং পরিস্রুত সমাজ-কাঠামোর মধ্যেই তা বর্তমান বলা যায়।

৩.                                   

দস্তয়েভস্কি বড় শিল্পী, পূর্ণাঙ্গ দার্শনিক। জীবনের অভিঘাতেই তিনি নিজেকে পেরিয়ে নিয়েছেন। তাঁর সবরকম রচনাই বিশ্বসাহিত্যের অংশীদার, সেটি রুশসমাজের হলেও এ পৃথিবীর, কোনো এক সময়ের হলেও কাল-অতিক্রমী। এমনকি, সমকালের শর্তে পেরুনোর ভেতরেও তিনি অনিবার্য হয়ে উঠছেন, ক্রমশ- অন্য সক্কলকে ছাপিয়ে।

উপন্যাসের যে বৃহত্তর জীবন, ছায়া ও আলোর যে পরিমণ্ডল, লড়াই ও সংগ্রামের ভেতরে যে মানব-উত্তরণ সেটি একমাত্র দস্তয়েভস্কিরই শৈলিগুণ। মিখাইল বাখতিন তাত্ত্বিক ও সৃষ্টিশীল হিসেবেও তাঁকেই সমালোচনার কেন্দ্র করেছেন, মুখ্য করেছেন। আর প্রতিটি সৃষ্টির পরতেই তাঁকে নিয়ে হতে পারে কাজ- গবেষণা, চলতে পারে নবায়ণের নিরীক্ষা; সেটি সময়ের প্রয়োজনেই। আমরা উপন্যাস পড়ি, তবে তিনিই ওই স্বরূপের  ‘মডেল’- বাখতিনের সমালোচনাতেও তার প্রতুল ব্যাখ্যা আছে। কার্নিভাত্ত্বসমেত সে আলোচনার সুযোগ এখানে কম। তবে পাঠ ও পাঠান্তরে তিনি শ্রেষ্ঠরূপে চিরজীবীত। অন্তত, এই দ্বিশতবর্ষ পরেও। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //