ভার্জিলিওর মৃত্যু

গিলের্মো কাবরেরা ইনফান্তে

গিলের্মো কাবরেরা ইনফান্তে একজন কিউবান ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। জন্ম-১৯২৯, মৃত্যু-২০০৫। তিনি মূলত তার উপন্যাস ‘ত্রেস ত্রিসতে টিগ্রেস’ বা ‘থ্রি ট্র্যাপড টাইগার্স’-এর জন্য বিখ্যাত। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা- ইন পিস অ্যাস ইন ওয়ার, টুয়েন্টিন্থ সেঞ্চুরি জ্যাকব, এক্সরসিজম অব স্টাইল ইত্যাদি। ভাষান্তর করেছেন- মাইশা তাবাসসুম

‘জীবনী’ বললেই মনে হয় কোনো এক ঐতিহাসিক দশার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে বয়ে যাওয়া একজনের জীবনের গল্প; কিন্তু ভার্জিলিও পিনেরার জীবনী বললেই বুঝতে হবে তা মিথ, মানুষের মুখে মুখে রটে যাওয়া মিথ। একজন মৃত লেখকের জীবনী, বিশেষ করে তা যদি সংক্ষিপ্ত জীবনী হয়, তাহলে তা অবশ্যই বাস্তবতা কিংবা রটনার চাইতেও বেশি মিথ। বাস্তবতাকে যতই সত্য ভাবি না কেন, তা আসলে খুবই সন্দেহজনক, যেহেতু তা এক কালের যাপিত জীবন থেকে আসে। আসলে বাস্তবতা হলো- শিল্পে রাজনীতির ন্যায্য প্রবেশ, ফরাসি বিপ্লবের আগে যার কোনো অস্তিত্বই ছিল না।

ভার্জিলিও পিনেরা বা বন্ধুদের কাছে শুধুই ভার্জিলিও (কেননা শত্রুদের কাছে এবং স্বনামধন্য শত্রুদের কাছে তিনি ছিলেন ‘সমকামী পিনেরা’) এক খাঁটি অবাস্তব জীবনযাপন করে গেছেন। লেখালেখির বাইরেও ওর জীবন ছিল অদ্ভুত। আর লেখালেখির ক্ষেত্রে তো কেবল জীবনের প্রান্তিক নোটই ছিল ওর বিষয়। খুব কম মানুষই পিনেরার মতো করে বলতে পারত- ‘আমার জীবন একটি খোলা বই, আর আমার বই একটি খোলা জীবন’। ভার্জিলিও লেখার জন্য বেঁচেছিলেন এবং লিখেছিলেন বলেই টিকে ছিলেন। ওর মৃত্যু খুবই দুঃখজনক ঘটনা; কিন্তু কেইবা অমর? মানুষ ভার্জিলিওর মৃত্যু ঘটেছে; কিন্তু লেখক ভার্জিলিও এখনো বেঁচে আছেন, আর চারপাশে লাথি খেয়ে বেড়াচ্ছেন, ঠিক যেভাবে জীবদ্দশায় চে গুয়েভারার লাথি খেয়েছিলেন। 

মরার আগে ভার্জিলিও ওর বাবার মৃত্যু দেখে গেছেন, যেটাকে ও দেখতো এক ‘অ-ইদিপাসিয়’ বা টিপিক্যাল শাসন থেকে মুক্তির স্বরূপ। ওর বাবার কাছে ইদিপাস ছিল এক নির্মম বিপর্যয়ের মতো। বোন লুইসা ছিল ওর শ্রেষ্ঠ নাটক ‘এ কোল্ড ড্রাফ্ট’ এর একজন অভিনেত্রী, এক সংস্কৃতিমনা নারী। সে বিয়ে করেছিল এক অশিক্ষিত বাসচালককে, আর হানিমুন কাটিয়েছিল স্বামীর বাসে ঘুরে বেড়িয়ে। তাঁর মা যখন বাস চালককে বিয়ে করায় লুইসাকে ভর্ৎসনা করতেন, তখন ভার্জিলিও বোনের পক্ষ নিয়ে বলতো- ‘মা, বাসচালককে বিয়ে করার ভালো দিকগুলো তো দেখো। ভেবে দেখো তোমার জামাই এক অর্কেস্ট্রার খোঁজ করছে তার বাস চালিয়ে’। ওর নিজেরও শ্রমিক শ্রেণির প্রেমের প্রতি একটা বিশেষ ঝোঁক ছিল। বোনের পক্ষ নিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে লুইসাকে চোখ টিপে ‘এবার তোমার পালা’ বলে নিজের দায়িত্ব শেষ করত। ভার্জিলিও যখন দায়িত্ব সহকারে অন্ধ বাবার এক হাত ধরে বাড়ি ফিরত, তখন লুইসা তাদের দেখে বলতো, ‘চলে এসেছে ইদিপাস আর অ্যান্টিগন, স্বাগতম’। ইদিপাস ঠিকই বলেছিল, সবকিছু আসলে পরিবার থেকেই আসে।

ভার্জিলিও ছিলেন একজন স্বঘোষিত ও গর্বিত সমকামী, আর এর জন্য ওকে আর্জেন্টিনায় দেশান্তরী হতে হয়েছিল। সেখানে ও উইটোল্ড গ্যামব্রোইজের ‘ফার্ডিডার্ক’ এর অনুবাদ করেন, পলিশ ভাষা না জানা সত্ত্বেও। এর জন্য বোর্হেস ওকে ‘সত্যিকারের খাঁটি’ বলে স্বীকৃতি দেন। পঞ্চাশের শেষের দিকে কিউবায় ফিরে আসার সময় ও ছিল একই সঙ্গে একজন মাস্টার ও নো বডি। চল্লিশের প্রথম দিকে ও লিজামা লিমার সঙ্গে একটা ম্যাগাজিন প্রকাশ করতে শুরু করে আর কিউবায় ফিরে নিজেই আরেকটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করে লিজামা লিমাকে আক্রমণ করে। ও ছিল এক অদ্ভুত স্ববিরোধী চরিত্রের গোঁয়ার।

কিউবায় বিদ্রোহের সময় ও একই সঙ্গে ‘রেভল্যুশন’ ও ‘ল্যুনস’-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, যা সেই সময় প্রতি সপ্তাহে প্রায় আড়াই লাখ কপি করে ছাপা হতো। জনপ্রিয় লেখালেখিতে ভেসে যাওয়ার জন্য এটা একটা সুবর্ণ সুযোগ ছিল ভার্জিলিওর জন্য। তা সত্ত্বেও ওঁকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। নৈরাজ্যবাদী, সমকামী হওয়ায় ও তখন সরকারের কুনজরে পড়ে। ১৯৬১ সালের ১১ অক্টোবর ভোরে ওর বিচ হাউস থেকে ওকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার করা হয় মূলত সমকামী হওয়ার জন্য, নৈরাজ্যবাদী হওয়ার জন্য নয়। এই ক্ষণকাল জেলে থাকা ভার্জিলিওকে এমনভাবে ভেঙে দেয়, যা ওর অতীতের অনটনও কখনো পারেনি। আমাদের সবার আরাম গদি হবার বদলে ও হয়ে উঠল একদম বেমানান, এক খলনায়ক চরিত্র। ১৯৬৪ সালের দিকে দেশে খুব বাছ বিচার শুরু হলো, তখন চে গুয়েভারা একদিন কিউবান অ্যাম্বাসির ছোট একটা লাইব্রেরিতে পরিদর্শনের সময় ভার্জিলিওর ‘টেট্রো কমপ্লিটো’ বইটি পেল। তখন সেখানে স্প্যানিশ লেখক জোয়ান গেটিসোলো উপস্থিত ছিলেন।

তার ভাষ্য মতে, সেই সময় চে বইটি পেয়ে নিকটবর্তী দেয়ালে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, আর চিৎকার করে অ্যাম্বাসেডরকে বলে, ‘কত বড় স্পর্ধা, আমাদের অ্যাম্বাসিতে এসব ফাউল পায়ুকামীর বই রেখেছো!’ ভার্জিলিও শেষ পর্যন্ত অস্কার ওয়াইল্ডের ন্যায় কুখ্যাত হয়ে উঠল। সেই ঘটনা থেকে ভার্জিলিও একজন দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি, যদিও এরপর আর ওকে গ্রেফতার করা হয়নি। ১৯৬৫ সালের বসন্তে, প্যারিসে মিরিয়াম গমেজ ওর সঙ্গে দেখা করে। তার ভাষ্য মতে, তখন ও একদম পাখির পালকের মতো শুকনো, লক্ষ্যহীন হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। ওর এক কিউবান বন্ধু দেশে ফিরে যেতে নিষেধ করেছিল। কারণ তখন সেখানে সমকামীদের ধরে ধরে আপত্তিকর আচরণের দায়ে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হচ্ছিল; কিন্তু তারপরও ও হাভানায় ফিরে যায়, ও ফিরেই প্রথমে দেশপ্রেমিকের ফ্যাশনে মাটিতে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করে; কিন্তু ব্যর্থ হয়। চারদিকে সব পাকা রাস্তা, মাটির বদলে ওকে চুমু খেতে হয় আলকাতরা মেশানো রাস্তায়। কেউ কেউ বলে যে, যেই রাস্তায় ও চুমু খেয়েছিল সেটার তারপিনও নাকি ছিল রাশিয়ায় তৈরি।

বেলজিয়াম থেকে আমি যখন আমার মায়ের শেষকৃত্যে কিউবায় ফিরে এলাম, তখন আমার প্রবল দুঃখ বাস্তবতার সঙ্গে টেক্কা দিয়ে চলছে। তার কিছু দিন পরই ভার্জিলিও ওর বাবাকে কবর দিলো, বৃদ্ধের অন্ধত্ব শেষ পর্যন্ত অন্ধকারে পরিণত হলো; কিন্তু ভার্জিলিওর নিত্য ব্যবসায় কোনো ব্যাঘাত ঘটল না। ব্যবসা বলতে, ওর অবিরত লেখালেখি, প্রকাশ হবে না জেনেও প্রতি সকালে লিখে যাওয়া এবং এ বলেই বাকিটা দিন কাটিয়ে দেওয়া। দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার পরও লেখালেখি চালিয়ে যাওয়াটা ছিল এক সাহসী পদক্ষেপ। যদিও ওর অন্যান্য সমকামী বন্ধুদের মতো ওকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নেওয়া হয়নি, তবুও সেই আতঙ্ক ছিল এবং তা নিয়েই ও লিখে যেত। তারপর একদিন হঠাৎ করে ও মারা গেল। ভার্জিলিও কিন্তু ভেজিটেরিয়ান এবং অনেক রোগা ছিল, নিজস্ব কিছু ডিসিপ্লিনে অভ্যস্ত ছিল, ধূমপান ছেড়ে দিয়েছিল বেশ আগেই। তবুও সে মারা গেল হার্ট অ্যাটাকে। আমার একটা শঙ্কা যে, আসলে হার্ট অ্যাটাকে নয়, ওর মৃত্যু হয়েছিল ভয়ে। ও ভীতু ছিল না একদমই; কিন্তু পুলিশি রাষ্ট্রের ভয়ে জীবনযাপন করতে হয়েছে ওঁকে।

জীবিতকালেই ভার্জিলিওর বেশ কিছু ভালো কাজ ছিল, প্রায় দশটা নাটকসহ; কিন্তু জীবনের এক পর্যায়ে সে শুধু অদৃশ্য নয়, অশ্রুতও হয়ে গিয়েছিল। শেষ জীবনে ওর মনের আশা পূরণ হয়েছিল। একদম অদৃশ্য মানব হয়ে উঠেছিল সে। ভার্জিলিওর লেখা গল্পগুলোর সংকলনটি ওর মৃত্যু পরবর্তী নৈঃশব্দ্যকে ভেঙে ফেলার একটা ছোট্ট পদক্ষেপ। গল্পগুলোর মাধ্যমে ওর কুখ্যাতীকে আসল স্বীকৃতিও দেওয়া যেতে পারে। গল্পগুলোর প্রশংসা করেছেন বোর্হেস, বলেছেন, ইয়োনেস্কোর নাটক লেখার আগেই এগুলোকে ‘কুয়েন্তোস অ্যাবসার্ডোস’ বলা যেত, লেখকের নিরানন্দ জীবনের চেয়েও এখানে আছে ভয়ানক কৌতুক, গল্পগুলোর মিথ হলো- উপমা, দৈন্য, নিরাশা ও ভয়।

আমি বলি যে, গল্পগুলো পড়ে পাঠক এক ধরনের কিক পাবে, শ্যাম্পেন বা কোকেনের কিক না, এক ধরনের সত্যিকারের লাথি। হয়তো কুঁচকি বা পাকস্থলীতে; কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই সেটা থেকে যাবে পাঠকের আত্মায়, যেখানে সে এক আধ্যাত্মিক ব্যথা অনুভব করবে, যেখান থেকে অনন্তকাল রক্ত ঝরবে। একজন প্রসিদ্ধ পাঠক হয়ে আমি তখন লজ্জায় পড়ে যাই, যখন দেখি যে, ভার্জিলিওর রচনাসমগ্রে আমার কোনো একান্ত প্রিয় লেখা নেই। কারণ বইয়ের যে পাতা খুলেই পড়ি মনে হয়, ওর গল্পগুলো মোপাসাঁ থেকে কত অগ্রসর! কিন্তু আসলে ওর গল্পগুলো চিভারের ‘শিহরণ’ বা ‘ও কি ভয়!’ থেকেও অগ্রসর। এমনকি বর্তমানে সাউথ আমেরিকার খুবই জনপ্রিয় হেমিংওয়ের লেখা থেকেও অগ্রসর। আসলে এই গল্পগুলো বোর্হেস, এমনকি যে কোনো লেখকের গল্প থেকে অগ্রসর।

ভার্জিলিও পিনেরার ছোটগল্প সাহিত্যের যে কোনো শাখা, যে কোনো লেখা থেকে অগ্রসর, বহুদূরে। কেননা সেগুলো এসেছে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতা থেকে, যেখান থেকে নরকে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ পথ স্বর্গ নয়, বরং প্রায়শ্চিত্ত।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //