জীবন শীতের দৃশ্যগুলো

জীবনে কতভাবেই না আসে শীত। পরিশ্রান্ত ট্রেনের মতো কুয়াশায়, কিংবা জ্‌বলে ওঠা উত্তাপের আকাঙ্ক্ষায়; কিন্তু শতাব্দীর ক্রমাগত বেদনার জীবনবাস্তবতায় আমরা কি শীতের হাওয়ায় আমলকির ডালে ডালে নাচন লাগা টের পাচ্ছি আজকাল? নাকি বৈশ্বিক উষ্ণতার ক্রমবর্ধমান চিৎকার সত্যি শীতের আবহমানতাকে ভেঙে দিচ্ছে বছর বছর। শীত কি কেবল একটা রূপকথা হয়ে যাবে? নাকি প্রকৃতির মাতৃরূপ কুয়াশার সংসারকে বাঁচিয়ে রাখবে এই বাংলায়? 

এইসব ভাবনায় জীবনের শীতের দৃশ্যেরা ইন্ধন জোগায়। কারণ ঝুপ করে নামা শীত ঠান্ডা আলমারিতে রাখা পুরনো মাংসের মতোনই জীবনকে জমিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে। বিপন্ন সময়ের দাবি নিয়ে এই ঋতু চক্রের আবির্ভাব মানুষকে ভাবায়, তারপর গায়ে আদর জড়িয়ে যেন ছেড়ে দেয় মহাকালের বুকে। আর সেই বুকে ভর করে পাখিরা উড়ে আসে আশ্রয়ে, অপেক্ষাকৃত স্বল্প শীতের আশ্রয়। মৃত্যুর হানা যে তাদের ছুঁয়ে যায় না বিষয়টা কিন্তু একেবারেই তা নয়। তবুও দুস্থ চলনে, কাগুজি লেবুর ফুলে ডাল ভেঙে পড়া জ্যোৎস্নায় এরা শীতকে মাড়িয়ে বেঁচে থাকে।

একটা সহস্র বছরের পুরনো শীতরাত একবার এসে নেমেছিল আমার জানালায়, বেশ কিছু বছর আগে। ঘুম মাখানো ঢুলু ঢুলু চোখে সেদিনই প্রথম দেখি শীতের আর্তনাদ। ঘরের মেঝেতে বাবার লাশ, হুমড়ি খেয়ে লাশের উপর গড়িয়ে পড়ে লুটোপুটি খাচ্ছে মা-ভাই-বোনেরা। গা থেকে ঘুমের গরম সরিয়ে আমিও যেতে চাইলাম সেই ভিড়ে। মেঝেতে পা রাখতেই উফ্ অসহ্য! হঠাৎ চামড়ার নিচে চিনচিন করে উঠল, পৌষের শীতে পুরো চামড়া জ্বলে যাচ্ছে। বহু কষ্টে বিছানা ছেড়ে নেমে আসার চেষ্টা করতেই হাত টেনে ধরলো কেউ, বলল তুমি ঘুমাও। 

বটের ঝুরির মতোন রাতের গা বেয়ে শীত নামছে। আমি শীত মেপে চলেছি, অথচ হাজার চেষ্টা করেও কাঁদতে পারছি না। আজানের পরপরই মাইকে মৃত্যুর সংবাদ আমাকে আশ্বস্ত করল বাবা মারা গেছেন আসলেই। বোধহীন ১১ বছর বয়সী আমি বসে বসে গুনতে থাকি বাসা ভর্তি মানুষের আনাগোনা, পিঁপড়ার সারি ধরে মানুষ এগোতে থাকে বাবার লাশ দেখার উন্মাদনায়। আর আমি ভাবতে থাকি এই শীতেই বাবা কেন মরে গেল? ইশ আর কয়েকটা দিন পরে মারা গেলে এই শীতটাতে তাকে কষ্ট পেতে হতো না।

পরদিন দুপুরে শীত কমে যায় ভস্মের তাপে। উত্তপ্ত চিতার আগুন নিভে যায় সন্ধ্যায়। বাবার গন্ধ উবে গেলে, তারপর আবার শীত বাড়তে থাকে, একটা কনকনে শীত তীক্ষ্ণ ছুরির ফলার মতন আমার বুকে গেঁথে যায়। আমি ঝুলে যাই আপোষহীন সর্বনেশে সমকালে। কারো জীবনে পৌষ মাস আবার কারও জীবনে সর্বনাশ। সেদিনের সর্বনাশ বুঝতে আমাকে পার করতে হয়েছিল আরও  কিছু কটমটে শীত। 

তারপরে জীবনে শীত আসে অন্যভাবে। কলেজে যেতাম শীতের ষড়যন্ত্র মাখানো পথে যেখানে কুয়াশা ছড়িয়ে থাকে তাকে ভেদ করে। সেই উঠতি বয়সের উন্মাদনার কোনো এক শীতে নানুয়া দীঘির পাড় ধরে হেঁটে চলেছি, ঘন কুয়াশা, এক দুই হাত দূরেও দেখা যায় না। হঠাৎ একটা সিএনজি অটোরিকশা এসে থেমে গেল। গাড়িটা হলুদ ছাপা শাড়িতে মোড়ানো, যেন শীতে ধরেছে তাকেও। কৌতূহলী চোখ আমার পা জোড়াকে থেমে যেতে বাধ্য করল। দু’জন পৌঢ়া গাড়ির ভেতর থেকে সদ্য জন্ম নেওয়া একটা সাদা চামড়ার মোটা তাজা নবজাতক শিশুকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। নাভি থেকে গর্ভফুল ঝুলে পড়ে আছে তাদের হাত গলে। রক্তে মাখানো তাদের হাত। সেইদিন সেই তীব্র কুয়াশার ভেতর প্রথম আমি কোন সদ্যজাত বাচ্চার চিৎকার শুনলাম। মহিলারা তড়িঘড়ি করে শিশুটিকে দীঘির জলে স্নান করাল। তারপর আবার সেই সিএনজি করে কুয়াশার ধোঁয়ায় মিশে গেলো। কেন যেন একবার মনে হয়েছিল এই শীতের কবল থেকে বাঁচতে শিশুটা আমাকে ডাকছিল। আমি পা চালালাম কলেজের পথে। প্রচণ্ড শীত, ছেলেরা সিগারেট ফুঁকছে, তাদের দিকে তাকিয়ে আমার আফসোস হয়, এমন ধোঁয়াশা ছড়ানো কুয়াশায় নিজে একটা সিগারেট ফুঁকতে না পারাটা আমার কাছে কেন যেন মানুষ হিসেবে অপমানজনক মনে হতে লাগল। আমি হেঁটে সামনে চলে গেলাম। এমন শীতে ছেলেরা সিগারেট টেনে শরীর গরম রাখে আর মেয়েরা খায় ধোঁয়া ওঠা চটপটি। 

সেই বিকেলে বাসায় ফিরে জানতে পারি সকালে হলুদ শাড়িতে ঘেরা সিএনজিতে যে নবজাতককে আমি দেখেছিলাম তা আমাদের পাশের বাসার আত্মীয়ার। হাসপাতালে নেওয়ার পর নাকি শিশুটা মারা গেছে। আমার মায়ের কষ্ট প্রকাশ দেখে আমি চেচিয়ে বললাম তুমি কি জানো ওই মহিলারাই এমন শীতে বাচ্চাটাকে দীঘির ঠাণ্ডা জলে চুবিয়ে মেরেছে। মা রক্ত চক্ষু নিয়ে তেড়ে এলো আমার দিকে। আমি শান্ত গলায় মাকে সব বলে দিলাম। মা কিছুটা নিশ্চুপ থেকে আমায় বলল আর একটা কথাও বলবি না। একটা চাপা অপরাধ বোধ নিয়ে ঘুমাতে গেলাম। হঠাৎ উঠে বসে মাকে বললাম, মা সকালে আমার মনে হচ্ছিল বাচ্চাটা আমাকে ডাকছে। মা আমার প্রতি বিরক্ত, আমি মাকে বললাম এই দেখো তোমার পা ছুঁয়ে বলছি কথাটা এক বিন্দুও মিথ্যা না। খেয়াল করলাম এই শীত মায়ের পায়ের গোড়ালিতে প্রচন্ড কুপিয়েছে, ফেটে হা হয়ে আছে। 

সেসব যন্ত্রনার রাত অনেক ঘন। কুয়াশায় ঢাকা পূর্ণিমার রাতের মতন রক্ত লালাভ আকাশের অনুভূতি দেয়। ভয়ানক সব আবেশ প্রবেশ করিয়ে দেয় মনের গহ্বরে। 

তারপর বহু বছর পরে শীত নামতে থাকল শহরের মোড়ে মোড়ে গরম জামার পুঁটলিতে করে। এরা বিদেশ থেকে আগত, লোকেরা বহু আনন্দ নিয়ে সেসব শীতবন্ধনী কিনতো। একবার আমিও কিনেছিলাম মাত্র দশ টাকায় সাদা রঙয়ের সোয়েটার; কিন্তু কখনো পরা হয়নি। তার কিছুদিন পর মায়ের গায়ে সেটা দেখে আমার সে কি হাসি! অথচ অদ্ভুত বিষয় হলো মা এখনো সেটা প্রতি শীতে যত্ন করে গায়ে জড়ায়।

সেবার এমনই এক শীতের শুরুতে প্রেমিকের হাত চেপে রিকশায় করে যাচ্ছি। একটা মোড় পাড় হবার সময় হঠাৎ কি একটা গন্ধ এলো ভেসে। ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ! সেদিনই প্রথম ছাতিমের সঙ্গে পরিচয় হলো। যে কিনা এই কর্কশ শহরে এখনও নির্বিঘ্নে শীতকে আলোড়িত করে ভেসে বেড়ায়। জানান দেয় এ ঋতুর কাছে তার আদিম অঙ্গিকার। 

আজকাল ধোঁয়া ওঠা গরম খাবার, পিঠা-পুলি কিংবা রহস্যময়তায় মাখানো সকাল সন্ধ্যার অনুভূতিই আমার কাছে শীতের আভাস। এই বাংলায় প্রত্যেক ঋতুর আগমনের নিজস্ব গতি বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। এই যে শরতের শেষে হেমন্তের আগমন, সবুজকে মাড়িয়ে প্রকৃতিতে সোনালির আগ্রাসন। মাঠে মাঠে পাকা ধান তারপর হঠাৎ একদিন খেঁজুর গাছের গা বেয়ে শীত নেমে আসে ধরাধামে। রাস্তায় ইদানীং বিলবোর্ডেও শীত লেগে থাকে- ঠোঁট না ফাঁটার প্রলেপ কিংবা গরম পোশাকি বিজ্ঞাপনে। খুব শীত নামুক এই নগর প্রাসাদে আমি সূর্যাস্ত গলে যাবার অপেক্ষা করবো, তারপরে আবার নতুন করে শীত লিখতে থাকবো ধোঁয়া ওঠা উষ্ণ তরলের চুমুকে। আমাদের জীবন শীতের এইসব দৃশ্যগুলো এভাবেই যার যার হিমেল আয়নায় ভেসে ওঠে সহস্র বৈচিত্র্যের কুয়াশায়। সব মিলে একটা শীতের চলচ্চিত্র হতেই পারে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //