দ্য প্রমিজ : মুখের অন্তরালে মুখশ্রীর বয়ান

একটি মৃত্যুর সংবাদ দিয়ে শুরু করি- দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বশেষ শ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট ‘ফ্রেডেরিক উইলিয়াম ডি ক্লার্ক’ আর নেই। তার জন্ম জোহানেসবার্গে ১৯৩৬ সালে আর মৃত্যু ১১ নভেম্বর ২০২১ কেপটাউনে। ‘ফ্রেডেরিক উইলিয়াম ডি ক্লার্ক’ ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। শ্বেতাঙ্গ এই প্রেসিডেন্ট ১০৯০ সালে নেলসন ম্যান্ডেলাকে দীর্ঘ কারাবাস থেকে মুক্তির ঘোষণা দেন এবং একই সঙ্গে তিনি নির্বাচনের ঘোষণাও দেন। ১৯৯৭ সালে ‘ফ্রেডেরিক উইলিয়াম ডি ক্লার্ক’ আনুষ্ঠানিকভাবে দক্ষিণ আফ্রিকান রাজনীতি থেকে অবসর নেন এবং তিনি বলেন, ‘আমি অবসরে যাচ্ছি। কারণ, আমার মনে হচ্ছে এতে আমার দল ও দেশ দুইয়ের জন্যই ভালো।’

‘ফ্রেডেরিক উইলিয়াম ডি ক্লার্ক’ এর জন্ম কিংবা মৃত্যুর সংবাদটি এই লেখায় প্রসঙ্গ কথা নয়; কিন্তু প্রসঙ্গ কথা এই কারণে যে, ‘ফ্রেডেরিক উইলিয়াম ডি ক্লার্ক’ ১৯৯০ সালে নেলসন ম্যান্ডেলাকে মুক্তির ঘোষণাই দেন-না সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বর্ণবাদ অবসানের ঘোষণা দেন এবং তারও পূর্ব থেকে বর্ণবাদ অবসানে প্রভূত ভূমিকা রাখেন। ‘ফ্রেডেরিক উইলিয়াম ডি ক্লার্ক’ এর প্রভূত ভূমিকা, রাজনীতি থেকে অবসর, ক্ষমতার পতন কিংবা পালাবদল অথবা ম্যান্ডেলা যুগ, জ্যাকব জুমার কাল কি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেক্ষাপট থেকে মুছে দিতে পেরেছে শ্বেতাঙ্গের কৃষ্ণাঙ্গ বিদ্বেষ? ‘ফ্রেডেরিক উইলিয়াম ডি ক্লার্ক’ এর উদার কণ্ঠস্বর বর্ণবৈষম্য আইনে আঁচড় কেটেছে, পেরেছে কি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে নিপাত করতে সেই স্রোত, যে বর্ণবিদ্বেষের স্রোত শ্বেতাঙ্গের রক্তে প্রবাহিত যুগ যুগ ধরে? রাজার রাজমহলে, আইনে-আদলতে, অফিসে-অন্দরে, খাতায়-কলমে বর্ণবৈষম্য বেআইনি হয়েছে, অলিতে-গলিতে আইনের পাহারা বেড়েছে, সে তুল্যে কমেছে কি মন-মনন-মগজ থেকে বর্ণের সঙ্গে তুল্যমূল্যের অমানবিক মানসিকতার হীন-দূরত্ব? 

বুকার-২০২১ পুরস্কার বিজয়ী ‘ড্যামন গ্যালগুট’ এর বিখ্যাত ‘দ্য প্রমিজ (The Promise)’ উপন্যাসটিতে যুগ বদল, কাল বদলের নির্যাসে- একটি দেশ, একটি জাতির শেকড়ে প্রোথিত বর্ণবাদের মনোধারা ও মানসিকতার সেই কৃষ্ণ কূহকের বদল হতে না-পারার কথাই বলা হয়েছে প্রায় চার দশক ধরে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ার বাইরে ছোটখাটো এক এলাকায় বসবাস করা মধ্যবিত্ত একটি পরিবারের কয়েকটি চরিত্রের জীবনযাপন ও একটি প্রতিশ্রুতিকে কেন্দ্র করে। পার্শ্ব চরিত্র, আবহ ও সংলাপে উপন্যাসটিতে ছোটখাটো এলাকাটি ভেদ করে পুরো দক্ষিণ আফ্রিকার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের চার দশকের ক্ষতিয়ানও বোনা হয়েছে বাস্তবতার ভাতঘর হয়ে সত্যদৃষ্টি চেখে দেখার মাধ্যম। ‘দ্য প্রমিজ (The Promise)’ উপন্যাসটির সময়-উপজীব্য ১৯৮৬ থেকে। রাজনৈতিক পটে নেলসন ম্যান্ডেলার সিংহাসন গ্রহণ এবং পরবর্তী সময়। 

এ উপন্যাসটির মূল পটভূমি : দক্ষিণ আফ্রিকা যখন বর্ণবৈষম্য থেকে বেরিয়ে ক্রমে-উত্তরণের দিকে ধাবিত তখন একটি সামান্য পরিবারের কারও কারও মুখের অতলে মুখশ্রীতে এই উত্তরাধুনিক যুগেও পুষে রাখা বর্ণবিভেদের বিবদমান দৃশ্যপট। যার বর্ণনা মাধ্যমে ঔপন্যাসিক বর্ণবৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার ভঙ্গুর দশাকেও অভঙ্গুরভাবে তুলে ধরেছেন আপন ভাষায়। 

ইংরেজিতে লেখা উপন্যাসটির ভেতরে আর দশটি সংসারের মতোই একটি সংসার। কয়েকজন সদস্য। প্রেম-ভালোবাসা, আশা-নিরাশা, হতাশা-ব্যঞ্জনার দোলাচল। আনন্দ-উচ্ছ্বাস, শোক-শ্রদ্ধার সংমিশ্রণ। খাওয়া-দাওয়া, স্নান-সৎকার সব মিলিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার অন্য মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো প্রায় যেরকম, এই পরিবারটিও তার ব্যতিক্রম না। তাদের চালচলনে রাষ্ট্রদ্রোহের ভাব নেই, দ্রোহের ভাষাও নেই উচ্চারণে। আইন ও আদেশ মেনেই তারা সামাজিক রীতির মধ্যদিয়ে অতিবাহিত করে তাদের প্রাত্যহিক চালচলন; কিন্তু ব্যত্যয় ঘটে তখন, যখন শ্বেতাঙ্গ পরিবারটির ভেতর এক কৃষ্ণাঙ্গের অধিকারের জন্য মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়; যখন পরিবারটির জ্যেষ্ঠ নারী, তিন সন্তানের মা, চল্লিশ বছর বয়সী ইহুদি রাহেল তার স্বামীর কাছ থেকে প্রাপ্ত কিছু সম্পত্তির একটি অংশ বা একটি বাড়ি তাদের যাপিত কালের সঙ্গে সম্পৃক্ত পরিচায়িকা কৃষ্ণাঙ্গ সালোমকে দান করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূরণ করার আগেই মরে যান এবং তৃতীয় সন্তান আমোর দ্বারা বাকি ভাই-বোনকে সালোমের প্রতি তাদের মায়ের ওয়াদা পূরণ করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। বছরের পর বছর চলে যায় প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করা হয় না। কখনো তারা ভুলে যায়, কখনো ভুলে যাবার মতো ভান করে থাকে, যেন দাসী সালোমকে একটি ওয়াদা থেকে বঞ্চিত করা যায় কৌশলে। আমোরের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় ভাই- অ্যান্টন, বোন- অ্যাস্ট্রিড। তর্কে লিপ্ত হয় তারা। মনোমালিন্যে জড়ায়, ঝগড়ায় পর্যবসিত হয়। দাসী সালোম এসবে জড়ায় না। দাবি করে না জোর করে। কেননা, দক্ষিণ আফ্রিকার আইনও কৃষ্ণাঙ্গ নারীর সম্পত্তির অধিকার পরিষ্কার করে না। মৌখিক প্রাপ্তি হলে কেবল ভোগ করা যায় ততদিন, যতদিন দানকারী ছিনিয়ে না নেয়। 

বয়সে ছোট, একগুঁয়ে কনিষ্ঠ আমোর মনে করে মায়ের কথা দেওয়া মতে দাসীকে তার পাওনা বুঝিয়ে দিতে পারলে ঋণ যেমন শোধ হবে, তেমনি মায়ের আত্মায় বিরাজ করবে শান্তি। তাই সে উদ্যত হয় আইনের দ্বারস্থ হতে, সমাজকে জানাতে; কিন্তু আইন ততটুকু পারে না যতটুকু পারা উচিত ছিল। সমাজকেও নাড়তে গেলে আমোরের নাকে আসে সেই গন্ধ, যে গন্ধটা বহু যুগ ধরে চলে আসছে প্রকাশ্যে ও আড়ালে। যে গন্ধটার জন্য যুদ্ধ লেগে আছে যুদ্ধের অন্দরে। ‘দ্য প্রমিজ (The Promise)’ উপন্যাসে অ্যান্টন সামরিক শিক্ষার মানুষ। শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনের পরিবৃত্তে তার বিচরণ। ব্যর্থ হলেও একজন লেখক। তারপরও অ্যান্টন ৮০’র দশকে দক্ষিণ আফ্রিকার ভয়ানক সহিংসতার সময় কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে নিয়োজিত হয়ে শ্বেতাঙ্গ মতবাদ জাহিরে নিয়োগপ্রাপ্তের মতো পরিভ্রমণ করতে থাকে। অ্যান্টন প্রকাশ্যে আসে না, অপ্রকাশ্যে সাদাদের পক্ষে কালো ঝাণ্ডা ওড়ায়। মুখে আর মনে ভিন্ন রঙ এঁকে আতঙ্কিত করে কৃষ্ণাঙ্গ অধিকারের বহর। আর অ্যাস্ট্রিড যমজ সন্তানের সঙ্গে অসুখী বিবাহিত এক নারী, যে সামাজিক ক্ষমতার পর্বতারহণে অবস্থিত। উপন্যাসে এও উদ্ধৃত হয় যে, রাহেল যখন মারা যায় তখন তার মৃত্যু পরবর্তী কার্যে ওই সন্তানরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে যাতে সালোম কোনো প্রকার দাবি নিয়ে সামনে না দাঁড়ায়। আমোর কথকের কাছে বর্ণনা করে যে, তখন তার বয়স যখন কিশোরীদের ঋতু শুরু হয়। 

সময় পেরিয়ে যায়। মায়ের দেওয়া প্রতিশ্রুতিটি পূরণ হয় না। কয়েক দশক চলে গিয়ে আরও কয়েকটি সমাধি রচিত হয়; কিন্তু সালোম বাড়িটির অধিকারী হতে পারে না। দৃশ্যত উদার অথচ মস্তিষ্কে গেঁথে থাকা বর্ণবিদ্বেষের কাঁটা প্রবাহিত হতে থাকে দৃশ্যের বাহিরে অদৃশ্য আকারে। পারিপার্শ্বও অচেতনের মতো অবতার যে, সালোম বলতে পারে না- আমার প্রতি রাহেলের কথা রাখো। সে তার নিত্যকর্মে ব্যস্ত থাকে বেঁচে থাকার তাগিদে। বেঁচেও থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকা মৃতের মতো অথর্ব অগ্রসর হয়। শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গ আলাদা কৌটায়। যে যার মতো তাদের কাছে, যারা মানসিকতায় বিকলাঙ্গ, যারা আদিম যুগের আদিম এখনো বর্ণহীন-চিন্তার অনগ্রসরতার কারণে। 

ঔপন্যাসিক ড্যামন গ্যালগুট অতিরঞ্জিত করেননি একটুও। উপন্যাসে খাটোও করেনটি দক্ষিণ আফ্রিকাকে। সাহিত্যের আঙ্গিকে একটি রাষ্ট্রের, একটি আপামর জাতির সেই চিত্রটি দেখিয়েছেন যে-চিত্রটি আপাত খালি চোখে দেখা যায় না, স্পষ্ট দেখা যায় দৃষ্টির প্রখরতায়। গ্যালগুট দেখিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বর্ণবাদ মুছে যায়নি। কত কত যুগ পরে মুছবে তা’ও তিনি ইঙ্গিত করেননি। করতে পারেননি। করাটা যে সহজ নয় বা করতে হলে যে কতজন ‘ফ্রেডেরিক উইলিয়াম ডি ক্লার্ক’ প্রয়োজন তা অবশ্য বর্ণিত আছে উপন্যাসটির বয়ান ভেতরে। উদ্দেশ্য- শ্বেতাঙ্গের অন্ধকার অধ্যায়ের লালন-পালন কিংবা কৃষ্ণাঙ্গের প্রতি সেই আদিম অভ্যয় অবতারণের মুখ উন্মোচন, তা নয়।

সভ্যতার সুসভ্য আমলেও দক্ষিণ আফ্রিকার হাড়ে-মাংসে আদি-কালের কালি লেপ্টে থাকা, তথা পৃথিবীর কোনো কোনো অংশে সে কালিমার অক্ষর জিইয়ে রাখার নগ্ন নির্লজ্জ মানসিক বৈকল্যকে উজিয়ে ধরেছেন অসাধারণ শৈল্পিক ভাবনার শিল্পিত বর্ণনা ভঙ্গিতে; যার জন্য উপন্যাসটি বিখ্যাত সব সাহিত্য সমালোচকদের ভাষায়ও মুখের অন্তরালে কুশ্রী মুখের রূপ অঙ্কনে ‘দ্য প্রমিজ (The Promise)’ খণ্ড ও অনন্য এক সৃষ্টি। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //