পাখিস্বর্গ রাজশাহী

এই ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশেও প্রায় সাতশো প্রজাতির পাখিদের বাস, ভাবা যায়! প্রজাতি এবং উপপ্রজাতির বিভিন্নতা এতোটাই ব্যাপক যা অনেক দেশ কল্পনাও করতে পারে না, বিশেষ করে ইউরোপীয়দেশগুলো। তবে, প্রতিবেশী ভারতও পাখি সম্পদে অত্যন্ত বিত্তশালী।

পেরেগ্রিন শাহিন। ছবি: কাজী সানজীদ

এদেশে দু’ধরনের পাখি আছে, আবাসিক ও পরিযায়ী। পাখিদের মৌসুমও দু’টো, শুকনো এবং ভিজে। অক্টোবর থেকে মার্চ হলো শুকনো মৌসুম, এপ্রিল–সেপ্টেম্বর ভিজে মৌসুম। দু’মৌসুমে ভিন্নভিন্ন পাখি পরিযায়ন করে। তবে শুকনো মৌসুমের পাখিগুলো প্রকাশ্যে বেশী দেখা যায় বলে সাধারনভাবে সেগুলোকেই পরিযায়ী বলে ভাবা হয়। এই পাখিগুলো প্রধানত বিচরণ করে নদীতে, নদীর চরে, হাওড় এবং উপকূলে। খুঁজলে দেশের প্রতিটি প্রশস্ত নদীতেই সেসব জলচর পাখিদের দেখা যায়। বেশ কিছু পরিযায়ী পাখি বনেও বসবাস করে।

সৈকতপাখি। ছবি: কাজী সানজীদ

শুকনো মৌসুমে আগত পরিযায়ী পাখিদের উপস্থিতির দিক দিয়ে, সিলেট এবং উপকূলের পরেই রাজশাহী বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এ মৌসুমে পানি কমে গেলেও প্রশস্ত নদী হওয়াতে পদ্মা তার চরগুলোর কারণে বৈচিত্রময় পরিযায়ী পাখিদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম। সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মনুষ্যবসতি কম যা পাখিদের নিরুপদ্রব বসবাসের পূর্বশর্ত। চলাচল দেখে বোঝা যায়, কিছু পাখি ভারত থেকেও আসে। তারা দিনের বেলায় এদেশে আহার শেষে সন্ধ্যায় আবার ভারতে তাদের নীড়ে ফিরে যায়। এক্ষেত্রে কিছুটা হতাশা থেকে যায়, এদেশকে ওরা নীড় রচনার জন্য নিরাপদ মনে করলো না! দোষটি ওদের নয়।

রাঙা মাণিকজোড়। ছবি: কাজী সানজীদ

রাজশাহী পদ্মার চরগুলোতে পরিযায়ী পাখি নিশ্চয় আগেও আসতো কিন্তু, মানুষ পাখিকে ভালোবেসে নিয়মিত ছবি তোলা শুরু করেছে এক দশকের মতো হলো। তাই, এখন এদের উপস্থিতি আমরা জানতে পারছি।

মেটেমাথা-টিটি ও সৈকতপাখি। ছবি: কাজী সানজীদ

বার্ড-ওয়াচিংযে একটি নির্মল এবং নির্দোষ হবি তা এ’দেশের মানুষ জেনেছে খুব বেশী দিন হয়নি।

পাকরা-মাছরাঙা। ছবি: কাজী সানজীদ

আমি গত ছয় বছর ধরে শুকনো মৌসুমে রাজশাহীতে তৃপ্তির সঙ্গে পরিযায়ী পাখি দেখে আসছি। হাঁস, কিছু সৈকত প্রজাতি এবং মাণিকজোড় পাখিগুলো বেশ নিয়মিত দেখতে পাওয়া যায়। বিশাল আকৃতির মাণিকজোড়গুলো অন্যত্র এভাবে দেখা যায় না। কালা মাণিকজোড়, রাঙামাণিকজোড়, কালাগলা ও ধলা গলা মাণিকজোড় বলতে গেলে প্রতি বছরই আসে। তবে সবগুলো যে প্রতি শীতেই দেখতে পাওয়া যাবে তার নিশ্চয়তা নেই। এছাড়াও কালে-ভদ্রে আসে, ইউরেশীয় চামচ ঠুঁটি। সারস এবং গগনবেড়ও দেখা গেছে কয়েক বছর আগে। আরো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল দু’বছর আগে আগত গভীর সমুদ্রের পাখি। মোদ্দাকথা, রাজশাহী বিরল পাখি দেখার জন্য আগ্রহীদের কাছে বিশেষ স্থান দখল করে আছে।

নগর ও প্রকৃতি। ছবি: কাজী সানজীদ

এবার আমি ১-৫ নভেম্বর রাজশাহীর পদ্মা নদীতে পাখি দেখার সিদ্ধান্ত নেই। খেয়াল করে দেখেছি নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই বিরল পাখিগুলো ঐ অঞ্চলটি ভ্রমণ করে। অবসরপ্রাপ্ত হিসেবে আমার ছুটির দিন বা রাতে ভ্রমণ করার চাপ নেই বিধায়, আশপাশের প্রকৃতি দেখার উদ্দেশ্যে সাধারনত দিনের ট্রেনে যেতেই ভালোলাগে। ৩১ অক্টোবর দুপুর দেড়টার ট্রেনে ঢাকা থেকে রওনা হয়ে সন্ধ্যে সাতটায় পৌঁছে গেলাম রাজশাহী। রাত ছোট ভাই’র বাসায় কাটিয়ে ভোরে চলে গেলাম পদ্মা পাড়ে যেখানে নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন আমাদের দক্ষ এবং অভিজ্ঞ গাইড নুরু। ০১ নভেম্বর সকাল ৭ টায় শুরু হয়ে গেলো এ মৌসুমের প্রথম বার্ড-ওয়াচিং ট্যুর। নগরীর কাছাকাছি খান পুর, মাঝার দিয়া, নবগঙ্গা এবং দশ নাম্বার চরেই মূলত ভ্রমণ করা হয়েছে। আমার অনুরোধে স্থানীয় দুর্দান্ত ছবিয়াল জনাব শামিম রিজওয়ান যিনি পেশায় চিকিৎসক, আমাকে চারদিন সঙ্গ দিয়েছেন। তাঁর এই সহৃদয় সহযোগীতায় আমার কাজ অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। এ’ছাড়াও শেষের দু’দিন ঢাকা থেকে গিয়ে দলে যোগ দিয়েছিলেন আরেক পাখি পর্যবেক্ষক প্রখ্যাত চক্ষু চিকিৎসক ডাক্তার নিয়াজ রহমান। তিন জনের দলই হচ্ছে বন্য প্রাণী দর্শনের জন্য আদর্শ আকৃতির।  

ধুপনি-বক। ছবি: কাজী সানজীদ

প্রথমেই সাক্ষাত হয়েছে বিখ্যাত শিকারী পাখি পেরে গ্রিন শাহিনের সঙ্গে। আয়েশে চরের উপর ভেসে আসা একটি কলা গাছের উপর বসেছিল। এরপর একে একে দেখা দিল ছোট বাবু বাটানের সুবিশাল ঝাঁক, চখাচখি এবং ধুপনি বক। তারপর কিছুক্ষণ বিরতি, ওদিকে নুরু বাইনোকুলারে চোখ লাগিয়ে খুঁজে চলেছেন আমার প্রিয় পাখি কালা মাণিক জোড়। পেয়েও গেলেন, আমিও বাইনোতে দেখলাম পাখিটি। আকৃতিতে বড় হওয়াতে (উচ্চতা প্রায় চার ফুট) দূর থেকে দেখতে অসুবিধা হয় না। নৌকা নিয়ে আমরা ধীরে ধীরে কাছে যেতে থাকলাম, একেবারে কাছে গিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়া হলো, তারপর বাঁশ দিয়ে ঠেলে আরো কাছে যাওয়া হলো। ভালো করে দেখলে বোঝা যায়, পাখিটির গায়ের রঙ কালচের মধ্যে বেগুনি-সবুজ আভা। বুক সাদা, লম্বা ঠোঁট এবং পালাল। কাছাকাছি তিনটি ধুপনি বকওকে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু, সে পাত্তা দেয়নি। ফলে পাখিটিকে অনেক কাছে গিয়ে দেখা সম্ভব হয়েছিল। এদের খাদ্য হলো, মাছ, কাঁকড়া, ইঁদুর, ব্যাঙ ও গিরগিটি। এ পাখিটি ইউরোপ, আফ্রিকা, দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়াসহ পৃথিবীতে বিশাল অঞ্চল নিয়ে বসবাস করছে এবং আশু বিলুপ্তির সম্ভাবনা নেই। তাই, আইইউসিএন পাখিটিকে হুমকি মুক্ত তালিকায় রেখেছে।

ছোট ও উদয়ী বাবুবাটান। ছবি: কাজী সানজীদ

নুরু জানেন আমার অপর প্রিয় পাখি হচ্ছে রাঙা-মাণিকজোড়। কদিন আগেও বিশাল ঝাঁক এসেছিল কিন্তু, আজ দেখা মিলছে না। বিকেলে চলে গেলাম ভিন্ন দিকের একটি চরে। সেখানে দেখা মিলল পাকরা-উল্টোঠুঁটির একটি ছোট ঝাঁকের। নিশ্চিন্তে বসে আছে, কেউ নিজকে সাজাচ্ছে আবার কেউ পিঠে মুখ গুঁজে দিয়ে ঘুমোচ্ছে। এছাড়াও দেখা দিল দেশি-মেটেহাঁস, ধুপনি বক ও চখাচখি।

চখাচখি। ছবি: কাজী সানজীদ

পড়ন্ত বিকেলে ফিরে আসার কিছু পূর্বে নুরু চেঁচিয়ে উঠলেন পেইন্টেট স্টর্ক (রাঙা-মাণিকজোড়)। আমরা সবাই আকাশে তাকিয়ে দেখলাম এক ঝাঁক রাঙা-মাণিকজোড় মালার মতো হৃদয়হরা ফর্মেশনে উড়ে চলেছে। সে দৃশ্য কোনোদিন ভুলে যাবার নয়। এই সুদর্শন পাখিটিকে সফরের চতুর্থ দিনে আবারো পাওয়া গেলো সন্ধ্যার দিকে। ছোট জলাশয়ের পাশে কয়েকটি ধুপনি বকের সঙ্গে একাকী বসে ছিল। দূর থেকে দেখলাম, আবছা আলোতে যতটুকু সম্ভব সৌন্দর্যও উপভোগ করলাম। এদের খাদ্য ছোট মাছ। এরাপানির মধ্যে আধখোলা ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়ে সেটিকে ডানেবামে ঘুরিয়ে মাছের উপস্থিতি বুঝতে পারে। এই এশিয় মাণিকজোড়টি সংখ্যায় পর্যাপ্ত হলেও, আইইউসিএন একে হুমকির কাছাকাছি মনে করে। শিকার, জলাশয় শুকিয়ে যাওয়া এবং দূষণের কারণে তাদের জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে।

কালা-মাণিকজোড়। ছবি: কাজী সানজীদ

এই দুটি প্রিয় বৃহদাকার পাখি দেখতে পাওয়াই আমার পরিপূর্ণ তৃপ্তির জন্য যথেষ্ট ছিল। তবে, ভাগ্য এবার বেশ সুপ্রসন্ন। ছোট বাবুবাটানের ঝাঁক মাঝে মাঝেই চোখে পড়ছিল। নুরু জানালেন এগুলোর মধ্যেই দু’চারটে উদয়ী-বাবুবাটান বসে থাকে। খুঁজে পাওয়াও গেলো সেই অপরূপ পাখিটিকে। ছোটগুলো থেকে আকৃতিতে কিছুটা বড় এবং বাড়তি রূপ লাবন্যের অধিকারী। গায়ের উপরের রঙ গাঢ় খয়েরী-সবুজ এবং চোখের নীচ থেকে কালো ডোরা গলা পর্যন্ত চলে গেছে, লেজ কালো। এছাড়াও দেখা গেলো বেশ কিছু সৈকত পাখি। সেগুলোর মধ্যে পেয়ে গেলাম আমার কাছ থেকে না-দেখা পাখি মেটে মাথা টিটি। এই প্রজাতির পাখিগুলো কিছুটা বাড়তি সৌন্দর্যের অধিকারী হয়ে থাকে। পদ্মা পাড়ে পা করা মাছরাঙা একটি নিয়মিত দৃশ্য, এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। 

কালা-মাণিকজোড়। ছবি: কাজী সানজীদ

সম্প্রতি একটি নতুন আবিষ্কৃত পেঁচা পাখিপ্রেমীদের মধ্যে বেশ শোরগোল ফেলেছে। সেটির ইংরেজী নাম Jungle Owlet. পাখিটি আগে দেখা যায়নি বিধায় বাংলা নামও নেই। এটি প্রথম দেখেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জনাব সালেহ রেজা। ক্যাম্পাসে গিয়ে সেটিও দেখা হলো।

উদয়ী-বাবুবাটান। ছবি: কাজী সানজীদ

বলা হয় যার শেষ ভালো তার সব ভালো। সমাপ্তির দিনে অর্থাৎ ০৫ নভেম্বর ২০২১, পদ্মার আকাশে দেখা পাওয়া গেলো বাহারি রঙের একটি বিরল শিকারী পাখি নাম Short-toed Snake Eagle. এটিও অনিয়মিত পাখি হওয়াতে বাংলা নাম নেই।

Short-toed Snake Eagle। ছবি: কাজী সানজীদ

এবারে রাজশাহীতে একটি বেশ সমৃদ্ধশালী বার্ড-ওয়াচিং ট্যুর হয়েছে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। কামনা করি পাখিরা নিরাপদে বেঁচে থাক তাদের আবাস স্থলে, বজায় থাক প্রকৃতির ভারসাম্য। তাহলে, আমরাও তাদের দেখে অনাবিল তৃপ্তি পেতে এবং সুস্থ থাকতে পারবো।

Short-toed Snake Eagle। ছবি: কাজী সানজীদ
Jungle Owlet। ছবি: কাজী সানজীদ

লেখক : পাখি পর্যবেক্ষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //