সংগ্রামী কামরুল

বাংলাদেশের আধুনিক চারুশিল্পের এক পুরোধা চিত্রকর কামরুল হাসান। অসাধারণ কর্মঠ সৃজনশীল এই মানুষটির জীবদ্দশায় সদা সচল ছিল অংকনঋদ্ধ তাঁর দুটো হাত আর হার্ডডিস্ক মস্তিষ্কসহ টইটম্বুর ছিল তাঁর সৃজন ভান্ডার। জীবনভর অসংখ্য ছবি এঁকেছেন। এতো ছবি বোধ করি তাঁর সমসাময়িক তো বটেই, এখনো পর্যন্ত এদেশে কোনো শিল্পী এঁকেছেন কি না সন্দেহ। স্বকীয়তায় অনন্য, ঐতিহ্যে অনুরাগী, আধুনিকতায় নিবেদিত, অংকনে শক্তিধর, বর্ণ প্রয়োগে স্বতঃস্ফূর্ত, গঠনে সাবলীল, বিন্যাসে অনন্য- সব মিলিয়ে আমাদের চারুশিল্পের প্রাণ-ভোমরা পটুয়া কামরুল হাসান। 

কামরুল হাসানের পূর্বপুরুষরা বর্ধমানে সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার হিসেবে খ্যাত ছিলেন। তাঁদের পূর্বপুরুষেরা ইসলাম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষে এসেছিলেন বোখারা থেকে। ১৯২১ সালের ২ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম কলকাতার শহরতলির তিলজালা গোরস্থানের এক ঘরে। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ হাশিম এবং মায়ের নাম আলিয়া খাতুন। তাঁরা দু’জনেই ছিলেন বর্ধমান জেলার কালনা থানার নরেঙ্গা গ্রামের খান বাহাদুর আবদুল আজিজ ও খান বাহাদুর আবদুল মজিদের দৌহিত্র-দুহিতা। কামরুলের বাবা ছিলেন শ্বশুর জিল্লুর রহিম প্রতিষ্ঠিত তিলজালা গোরস্থানের তত্ত্বাবধায়ক। কামরুলের পুরো নাম ছিল আবু শরাফ মোহাম্মদ কামরুল হাসান আর ডাকনাম ছিল সাতন। ১৯২১ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত প্রায় সাতাশ বছর তাঁর প্রথম জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে কলকাতায়।

১৯৩৮ সালের জুলাই মাসে তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। ৬ বছরের কোর্স ৯ বছরে পাস করতে হয়েছে। পরিবারের আর্থিক সংগতির অভাবে নিজের পড়াশোনায় ব্যয় নির্বাহের জন্য নানা রকম কাজকর্ম করতে হয়েছিল তাঁকে। ১৯৪৭ সালে তিনি আর্ট স্কুল থেকে পাস করে বের হন। ভারত বিভক্তির পর তাঁর ঢাকায় আগমন ১৯৪৮ সালে। ঢাকায় আসার পর একদিকে জীবন সংগ্রাম আর অন্যদিকে ঢাকা শিল্প আন্দোলনের ধারাকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে  কামরুল হাসান অবদান রাখেন। ঢাকায় সরকারি আর্ট ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তিনি শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হন। সেকালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত গ্রন্থের অনেকগুলোর প্রচ্ছদ এঁকেছেন তিনি। পত্রিকার জন্য কার্টুন এঁকেছেন। অঙ্গসজ্জার কাজও করেছেন।

১৯৬০ সালে শিল্পী তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থায় যোগ দেন। স্বাধীনতার পর এটিই বিসিক নামে সুপরিচিত। বিসিকে কাজ করার ফলে কামরুল হাসান লোকশিল্প ও হস্তশিল্পের জগতে সরাসরি প্রবেশের সুযোগ পান। যুবক বয়সে ব্রতচারী আন্দোলনে দীর্ঘ দিন সংযুক্ত থাকায় দেশের লোক-ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর যে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জন্মে, তাকে আরো সযত্নে লালন করার সুযোগ এলো বিসিক নকশা কেন্দ্রে তাঁর যুক্ত হওয়ায়। এতে একদিকে বিসিকের নকশা কেন্দ্র সমৃদ্ধ হয় বাংলার লোকশিল্পের নানা বৈশিষ্ট্য দ্বারা, অন্যদিকে কামরুল হাসানের চিত্রপটে লোকশিল্পের নকশা নানাভাবে ফুটে ওঠে তাঁর কাজকে আরো মৃত্তিকাসংলগ্ন করে। আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটে। 

আজীবন তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি সচেতন একজন মানুষ। দ্বিজাতিতত্ত্বের মাধ্যমে পাকিস্তানের জন্ম হওয়ার শুরু থেকেই এ অঞ্চলে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল। এমনকি সরকারি সমর্থনে ঢাকায় আর্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পরও এ নিয়ে প্রচুর বাঁধা-বিপত্তি পোহাতে হয়েছে জয়নুলসতীর্থ শিল্পীদের। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এ দেশের শিল্প- সংস্কৃতি অঙ্গনে নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দিলেও এটি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি পাকিস্তানী ষড়যন্ত্রভরা রাজনীতির কবলে পড়ে। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে কামরুল হাসানকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে জাতিগত নিপীড়ন ও পাকিস্তানী সামরিকচক্র, শোষকদের নিমর্ম অত্যাচার। একুশে ফেব্রুয়ারি স্মরণে তাঁর আঁকা অক্ষরবৃক্ষের পোস্টার একটি অসাধারণ কাজ। বাঙালির স্বকীয়তা উপলব্ধির, স্বাজাত্যাবোধের এক উজ্জল দৃষ্টান্ত।

১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের দিনগুলোয় কামরুল হাসান ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের’ সদস্য হিসেবে সর্বদা সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭০ সালে গোর্কির আঘাতে ছিন্নভিন্ন দক্ষিণাঞ্চলে অসহায় মানুষের পাশে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চের সন্ধ্যায় তাঁর আঁকা ইয়াহিয়া খানের পোস্টার শহীদ মিনারে টাঙিয়ে দেওয়া হলে সামরিকজান্তার প্রতি মানুষের মনে প্রবল ঘৃণার উদ্রেক করে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে কামরুল হাসান হাতীরপুল এলাকায় প্রতিরোধ কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আক্রমণ ও নির্মমতায় আক্রান্ত হয়ে তাঁকে অনেকের সঙ্গে ঢাকা ত্যাগ করতে হয়। ১৯৭১ সালের মুজিব নগরের তৎকালীন সরকারের তথ্য  ও বেতার মন্ত্রণালয়ের অধীনে তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ডিজাইন ও আর্ট ডিভিশন। শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, প্রাণেশ মন্ডল, নিতুন কুন্ডু, বীরেন সোম, নাসির বিশ্বাস প্রমুখ শিল্পীদের নিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণাদায়ী পোস্টার আঁকলেন। তাঁর আঁকা ইয়াহিয়ার মুখ ঘৃণার প্রতীক হয়ে উঠেছিল।   

স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে কামরুল হাসান ঢাকায় ফিরে বিসিক নকশা কেন্দ্রে যোগ দেন এবং এ কেন্দ্রটিকে বাংলার লোকশিল্পের অন্যতম ধারক ও বাহক হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি ব্রতী হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যকাণ্ডের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে তাঁর সে প্রয়াস স্বাভাবতই বাঁধাগ্রস্ত হয়। ১৯৯৮ সালে কামরুল হাসান বিসিক থেকে অবসর নেন। পরবর্তী সময়ে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও নকশা কেন্দ্র ধীরে ধীরে তাঁর ঔজ্জ্বল্য হারাতে থাকে। বাংলার লোক ও কারুশিল্পের যথাযথ লালন ও বিকাশ করার সরকারি উদ্যোগে ভাঁটা পড়েছে বিসিক নকশা কেন্দ্রের কার্যপরিধি হ্রাস হওয়ায়। কামরুল হাসানের নিজ হাতে গড়া এ প্রতিষ্ঠানের এই ক্ষয়িষ্ণু অবয়ব, এটির সম্ভাব্য মৃত্যুর কথাই মনে করিয়ে দেয়।

 কামরুল হাসান আমৃত্যু সংগ্রামী ছিলেন। মানুষের প্রতি দেশের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল প্রেম। দেশের সব ক্রান্তিকালে, সংকটে তিনি বিবেকের মতো ছুটে আসতেন। অসহনীয়ের বিরুদ্ধে অসহায়ের পক্ষ নিয়ে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতেন। ছবি এঁকে পোস্টার এঁকে তিনি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন, আবার প্রত্যক্ষ সংগ্রামে সশরীরে অংশ নিতেও তিনি কখনো পিছপা হতেন না। আশির দশকে এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে সংস্কৃতিকর্মীদের সামনের কাতারে তিনি সক্রিয় ছিলেন। 

বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ। ঝড়- জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় মাঝে-মধ্যেই আমাদের ভোগায়, সাধারণ মানুষের জন্য অবর্ণনীয় দুঃখ বয়ে আনে। ১৯৮১ সালের শেষার্ধে বন্যায় দেশের মধ্যাঞ্চলের বেশ ক’টি জেলা ডুবে গিয়েছিল। বিপন্ন মানুষদের সহায়তায় অনেকেই এগিয়ে আসছিলেন। আমরা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আমরা ঈষিকা শিল্পী সংগঠন নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলাম চারুকলার শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুস্থধারার সাংস্কৃতিকবোধ বির্নিমাণ ও মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার প্রয়াসে। আমরা তখন নিতান্তই অনুজ, আমাদের শক্তি আমাদের সংগঠন ও আমাদের উদ্যম। সেই উদ্যমকে পুঁজি ক’রে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ছবি এঁকে, ছবি বেচে বন্যাত্রাণে সহযোগিতা করবো। অগ্রজরা কেউ কেউ পরামর্শ দিলেন স্বনামধন্য ক’জন শিল্পীর কাছ থেকে তোমরা ছবি চেয়ে আনো। আমরা তখনকার নামজাদা ক’জন শিল্পীর চিত্রকর্ম জোগাড় করতে লেগে গেলাম। কামরুল হাসান আমাদের দুটি জলরঙ চিত্রকর্ম দিয়ে দিলেন। তাঁর এই উদারতায় আমরা মুগ্ধ, বিস্মিত! কাইয়ুম চৌধুরী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবী, আবুল বারক আলভী প্রমুখ  শিক্ষক এবং শেখ  আফজাল, নিসার হোসেন, শিশির ভট্টাচার্য, মাসুদুল হাসানসহ বেশ ক’জন অগ্রজ শিল্পী ও শিক্ষার্থীদের চিত্রকর্ম নিয়ে আমরা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ইসফেন্দিয়ার জাহেদ হাসান মিলনায়তনে একটি বিশেষ চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করি। 

শিল্পাচার্য কামরুল হাসান এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছিলেন, যা আমাদের জন্য এক পরম প্রাপ্তি। প্রথম দিনেই তাঁর দুটি চিত্রকর্মসহ বেশ কিছু কাজ বিক্রি হয়ে যাওয়ায় আমাদের আয়োজনে সাফল্য নিশ্চিত হয়। শিল্পকর্ম বিক্রিলব্ধ পুরো টাকা আমরা তুলে দিই সাহিত্যিক-সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কাছে। ওই অর্থ বন্যার্তদের পুনর্বাসনের জন্য ব্যয় করা হয়।

শিল্পী সমাজ ও সংস্কৃতিসেবীদের যে কোনো ভালো উদ্যোগ- আয়োজনের অগ্রভাগে থাকতেন তিনি। ১৯৮২ মালের ২৪ মার্চ হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সামরিক শাসন জারী করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নেন। তাঁর এই অবৈধ কর্মকাণ্ড অধিকাংশ রাজনীতিক বুদ্ধিজীবী সংস্কৃতিসেবীসহ ছাত্র জনতা সমর্থন করেনি একেবারে গোড়া থেকেই। আমরা শিল্প-শিক্ষার্থীরা উদ্যোগ নিয়েছিলাম চারুকলা প্রাঙ্গণে একটি সভা করে আমাদের করণীয় নির্ধারণ করতে। কামরুল হাসান চলে এসেছিলেন আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে। সরকারি গোয়েন্দা ও পুলিশের কঠোর নজরদারি ও বাঁধার ফলে আমাদের সে উদ্যোগ ভুল হয়ে যায়।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহকারী সংস্কৃতিসেবীদের সামনের কাতারে ছিলেন কামরুল হাসান। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত স্বৈরাচারের এক প্রতীকী অবয়ব এঁকে নিচে লিখেছিলেন-‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে’। দুঃখ এই, আমাদের আন্দোলন সফল হবার আগেই তিনি চলে গেলেন চিরতরে। গোরস্থানের পাশে জন্ম নেওয়া কামরুল হাসান শুয়ে আছেন তাঁর প্রিয় চারুকলা চত্বরের পাশেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁর প্রিয় মাস্টারমশাই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কাছাকাছি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //