দস্যু বনহুরের খুপরি ও চঞ্চল মন

যে কোনো ধরনের বই পড়াপড়ি তো ছোটবেলায় খুবই ছিল। শীতের রৌদ্র উঠোনে, এক চিলতে ছায়ার ওপারে কিংবা বনের হাওয়ায় মেতে পাড়ি দেওয়া উদাস কোনো হামাগুঁড়ি দেওয়া সময়ে। আশির দশকটা এমন ধরনেরই ছিল।

মনে হয়, নিষেধের তর্জনী বেয়ে একটা আদেশও ছিল। খুব মুখরিত সে সময়গুলো। বড় ভাই কোথায় যেন যান, যাবার খুব তোড়জোড়। কী কী সব সিদ্ধ জিনিস নিয়ে তিনি রাতে ঢাকা যাবেন। উফ্ ঢাকা! এ-তো নিউইয়র্ক যাত্রার মতো ব্যাপার। আমরা নিউইয়র্কের নামই জানি না। চিনিও না। কী সব নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে দেখি চটি রোমেনা আফাজ। রোমেনা আফাজ তখন হাতে হাতে। এক চিলতে বইয়ের দোকান হলেও তা আছে। ওটা না থাকলে বইয়ের দোকান হয় না। আমরা এই যাত্রার তোড়জোড়ের পথে ওই চটি রোমেনা আফাজ ধরে কী সব রোমাঞ্চকর দুনিয়া পরিভ্রমণের সুযোগ পাই। তাতে থ্রিলিংটা এত মৌজমাখানো যে জরুরি অনেক কাজ সবই যেন ভুলে যাবার দশা। তারপর দস্যু-বনহুর হয়ে ওঠা। আমাদের কৈশোরের খেলার দিনে দস্যু বনহুর হয়ে নানারকম পার্ট নেওয়া।

এই চরিত্রটি সবকিছুই বাস্তব করতে পারে। সবচেয়ে বড় সে পরম পরোপকারী। এই পরোপকারী হওয়ার গুণ, সৎ-মানুষ হওয়ার স্বপ্ন, নিজেকে তুচ্ছ করে দিয়ে বৃহত্তর কিছু করা- এগুলো যতো সহজ বা মোটা দাগের নীতিশিক্ষা হোক, আমাদের চেতনায় তখন তা এক বিরাট মহৎ ও মহানুভব পরিবেশ তৈরি করে। আদর্শিক জীবনের ফ্রেমটা যে কত দামি- সেটা যে পরশ-পাথর- ওটা না থাকলে সে মানুষ নাকি? এ মানুষকে যে ‘ভালো’ হতেই হবে- ভালো না হলে, পরার্থে জীবন উৎসর্গ না করলে পড়াশোনারই বা দাম কী? ফলে দস্যু বনহুর এক বিরাট চেতনার আদর্শ। সে হোক দস্যু- কিন্তু সাধারণের জন্য তো সে সব করে, অসহায়দের পাশে দাঁড়ায়, দরিদ্রদের সহায়তা করে, ছোটদের স্বপ্ন দেখায়, তেপান্তরের পাথারে পাথারে কী কী সব করে তারপর দিগ্বিজয়ীর বেশে এক বিরাট ও মহান মহত্বে নিজেকে সমর্পিত করে। এই যে লোটানো জীবন, তাতে লুটিয়ে পড়া যাবতীয় প্রতিকূলতা অতিক্রম করে, জয়ী সে হবেই, কৌশল জানা আছে সে বনহুরের- একস্বরে সবাই বনহুরের পাশে থেকে জয়গান গায়, বনহুর সবাইকে কনভিন্স করে ফেলেছে- ফলে আর তাকে কে পরাস্ত করে! এই যে মনমতো তৈরি হওয়ার গল্প, মনের রসদ জোগানো গল্প, নীতিবানের গল্প, বহু দেশ বহু বন বহু জন্তু পেরিয়ে তার জয়রথে সে একাই প্রতিষ্ঠিত এবং এককভাবে সকলের হয়ে তাদের মনোবাসনা পূরণের গল্প- তাতে তো সে এক বিরাট ‘নায়ক’ হয়ে ওঠে। আর না-হয়ে উপায় কী? ছোট্ট রেলস্টেশনের দোকানে রোমেনা আফাজের আরও কিছু বই ছিল।

শুধু রেল স্টেশন কেন, লঞ্চে-জাহাজে, ট্রেনের কামরায় ওই মধুমতির প্রেম নিয়ে রগরগে মিষ্টি কাহিনীর গপ্পো, কতজনকে পড়তে দেখি। পরে তা আমরা সিনেমার শোতে গোগ্রাসে গিলি। এসব কাহিনীর ভেতরে আমাদের সুখ আর শান্তি সেঁধিয়ে থাকে। চোখ জাগা চুরি করা সব রাত্তিরে বই পড়া আর শহরতলির সিনেমা হলে ওই নায়িকাদের অভিনয় নিজেই তো তখন নৈর্ব্যক্তিক হয়ে যাওয়া, অসার আর হতভম্ব হয়ে কোনো এক দিগন্তের মনের পানে অশ্ব ছুটিয়ে চলা। মোটা দাগের এসব জীবনে কী কোনো জটিল আবর্ত ছিল? মনে হয় না। সাদাকালো, সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দে মেশানো যেন সব। রহস্য শুধু ওইটুকুকে ঘিরে। টগবগে ঘোড়া ছুটিয়ে একদম পেরিয়ে চলা, একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত- সেখানে সাদাকালোর জীবনের পুনর্গঠিত সব পারিবারিক মুহূর্ত আর সামাজিক সত্য যেন প্রত্যেকেই হয়ে ওঠা এক একটা দস্যু বনহুর। রোমেনা আফাজের মতো লেখক এতো জনপ্রিয় ও বাজারি হন যে লেখায় তাদের এত ঘটনার পুনরাবৃত্তি থাকে যে সেটি অসার লাগে না। আমাদের কোমল মনও ছিল ওইরকমই। চলতি পথের ট্রেনযাত্রার ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত সেসব আজগুবি ফাঁসানো গল্পের ভেতর দিয়ে, বহু ঘণ্টা। স্টিমারের করুণ রোদনে রাত্রি ফুঁসে উঠতো ভয়কাতুরে সেসব কাহিনীতে।

অফুরন্ত এক আলোর উৎসব যেন তা। নাচিয়ে চলে বহুদূর। সপ্তনদীসমুদ্র পেরিয়ে কতদূর সে পথ কেউ জানে না- বিরাম হারা টগবগ সে পথে নানান প্রতিকূলতা আছে; কিন্তু সেটি একাই এক বীর জখম হলেও সে জয় ছিনিয়ে আনবেই, তারপর তার সাফল্য সে বিকোয় অকাতরে সাধারণের তরে। অর্থ-প্রতিপত্তির মোহ নয়, অর্থকীর্তি আর বিপন্ন বিস্ময়ই ওসব কেচ্ছার মূল কথা। মূল আর মৌল নিবেদনের আলোহাওয়ায় ভর করে শিহরণের সুখ তো আলাদা! কোনোদিন হয়তো আমরা সিনেমা হল ছেড়ে পালিয়ে আসি, ধুম করে বই ফেলে ছুটে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য অন্যদিকে ছুটে চলি; কিন্তু জীবনের ফ্রেমটাই যেন শেষ পর্যন্ত সত্য হয়ে ওঠে। বহুদূর পেরিয়েও আমরা আবার নিজের গন্তব্যেই যেন স্থির থাকি। কেন এমন হতো তা আজকের এই ডিজিটাল সময়ের ব্যাপক জটিল ও উথালপাতাল সময়ের সঙ্গে কী মেলানো যাবে! ঠিক আজকের চলতি সময়ের পথে দাঁড়িয়ে তো মনে হয়, জীবন থেকে কী যেন ছিনতাই হয়ে গেছে।

আমাদের সবটুকু রোমেনা, দস্যু বনহুরের রোমেনাই শুধু নয়- ওর কাহিনী, ঘটনার রোমান্স, থ্রিলিং সব কোথায় পালিয়ে গেছে! তবে জীবন কি বদলেছে? পড়ার অভ্যাস কি পাল্টেছে? আদৌ কি কেউ পড়ে? সেসব থ্রিলিং, টনটাইট উত্তেজনায় ঠাসা আখ্যানের বুননির ভেতর তীব্র সন্দেহ আর পেরুনোর যে উস্কানি তা কি এখন নেই- উবে গেছে; না আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে! এর কারণ কী প্রযুক্তি? প্রযুক্তির নক্শা কী বিনাশী? এই তো আমাদের সবকিছু নিঃশেষ করেছে? সাদাকালোর বদলানো জীবন, রঙিন মুখরিত জীবনের চেয়ে তো কম নয়!

অভ্যাসটাই মরে যায়! পাওয়ার বেদনাটা নেই-রকম লুকিয়ে থাকে। নেই নেই- কোথাও কেউ নেই। নেটফ্লিক্সে ভেসে যায় সমস্ত থ্রিলিং। প্ল্যাটফর্মে পড়ার মুখ মরে যায়। জলঘাটের চরে আটকে যায় স্টিমার, স্টেশন থেকে বই নাই হয়ে যায়। রোমেনা আফাজও এখন নির্বাসিত। কেউ ছুঁয়ে দেখে না। পাঠক মাতানো এ কথক সময়ের বালুকাবেলায় যখন নিঃশেষিত তখনো; কিন্তু তা এক ছায়ার মতো আমাদের সাধারণ জীবনে, তিনিই থাকেন সুশীতল হয়ে। জীবনের রহস্য আর রোমান্স পয়দা করা দুর্মর জীবনের ভাষ্যে তিনি হয়ে থাকেন আমাদের সময়ের হিরো, বিরাট মহীরুহ চিরস্নিগ্ধ ছায়াস্বরূপ- কেউ তা অস্বীকার করবে না। তবে ফিরে তিনি আসবেনই, আমাদের স্মৃতির মতো, ষাট-সত্তর-আশি রাজত্ব করা সময়ের সাক্ষ্যরূপে। কারণ তিনিই নেশা আর শখের জীবন গড়ে দিয়েছিলেন, বিচিত্র সত্যে মেখে আমাদের পথ দেখিয়েছিলেন। জীবনই যে অনন্ত ও অনিন্দ্য সুখের আধার সেটা বোঝাবার জন্য। 

বাংলা ভাষার জীবন নৌকোর ধূসর পৃথিবীর রোমান্সধর্মী প্রিয় এই রোম্যান্টিক ম্যান রোমেনা আফাজ- আপনাকে জন্মদিনে জানাই চির শুভেচ্ছা।   

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //