দ্বিশতবর্ষ পেরিয়ে ফিওদর দস্তয়েভস্কি

ফিরে আসা স্মৃতির পথে

এক

খুব খারাপ একটা সময় পার করছি, যখন মানুষই মানুষকে বিশ্বাস করার জায়গাটিকে নিজের পাপ বলে মনে করছে। মানবতার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সভ্যতার সংকট রচনায় বলছেন, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।’ আবার এ-তো ঠিক যে মানুষমাত্রই কতগুলো সীমাবদ্ধতা নিয়ে সে পৃথিবীতে আসে। সেই সীমাবদ্ধতা ডিঙিয়েই সে পশুত্ব থেকে উত্তীর্ণ হয়। পুরোপুরি সফল হতে পারে না। যতটুকু পারে ততটুকুই তার মনুষ্যত্ব। যারা অসাধারণ তাদের চেতনার বলয়ে থাকে অন্যরকম আলো- সেই আলোতে দেখতে পায় বস্তুজগৎ, সমাজজগৎ, মনোজগৎ। শুধু দেখেই ক্ষান্ত হন না, বিচার-বিশ্লেষণ করে উত্তরণের চেষ্টা চালান। বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে যে অবাধ্য আলোক রেখাটুকু ভেতরে আসে সেটুকুই তার সম্বল হয়। ‘স্বার্থ আমাদের যে সব প্রয়াসের দিকে ঠেলে নিয়ে যায় তার মূল প্রেরণা দেখি জীবপ্রকৃতিতে; যা আমাদের ত্যাগের দিকে, তপস্যার দিকে নিয়ে যায় তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম।’

কতকিছুই তো ধুলোয় গড়াগড়ি যায়, কত রকমের বাতাসই তো কতভাবেই না দুলিয়ে দিয়ে যায় আমাদের মন; কিন্তু তার কতটুকুই বা আমাদের লোমকূপে শিরশিরানি ধরায়। উচ্চ মাধ্যমিকের ইংরেজি ক্লাসের শিক্ষকের এই সব কথায় মাথার ভেতরে জট লেগে যেত। তখনো পৃথিবীর মানুষ ইন্টারনেটের কারেন্ট জালে ধরা পড়েনি। তাই হয়তো রমণীর দীঘল কালো চুলের জটিল জট খুলবার মতো এইসব কথা-চিন্তার জট খুলবার নেশায় স্যারের ক্লাসে সেই রকম কিছু হাবা-গোবারা বসে থাকত। আলম স্যারের সিলেবাস কখনো শেষ হতো না। বদনাম ছিল। ক্লাস লেকচারের বাইরের লেকচারই ছিল বেশি। যাতে আমাদের মন-ঘরের দরজা খোলার চাবি-কাঠি থাকত।

স্যারের বিশ্বাস ছিল বোর্ড থেকে দেয়া সিলেবাসে যে দু-দশখানা গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ অলঙ্কারের মতো সাজিয়ে রাখা হয়েছে সে আমরা নিজেরাই পড়ে ফেলার ক্ষমতা রাখি। সুতরাং ওদিকে সময় খরচ না করে রেনেসাঁর সন্তান গ্যোতে- সেই ইতিহাসের পথ দেখাতে বেশি পছন্দ করতেন। হোমার, নিকোলাই গোগোল, ইভান তুর্গেনেভ, সেক্সপিয়র, ডিকেন্স, ইয়েটস, আলেকজেন্ডার পুশকিন, ল্যেভ তলস্তয়, দয়স্তয়েভস্কি নামগুলো তাঁর কছেই বিশেষভাবে শোনা। এই সব নামের সঙ্গে ‘বিশ্ব সাহিত্য’ শব্দটিরও তিনিই আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। পাঠে উদ্বুদ্ধ করতেন। পছন্দ করতেন গ্রিক পুরাণের যে অসংখ্য চরিত্রের ভিড়- তার গহীন জঙ্গলের মধ্যে আলো ফেলতে। তখনো যেমন আমার কাছে বিষয়গুলো অসম্ভব মনে হতো, এখনো তেমনি; কিন্তু সেই যে আমাদের মতো অবোধদের কারো কারো মনে অনুভূতির দাহিকা শক্তি জ্বালাতে পেরে ছিলেন তাতে কোনো মিথ্যে ছিল না।

ফিওদর দস্তয়েভস্কি প্রসঙ্গ এলেই তিনি বলতেন, যারা খুন-খারাবি করে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে নানাভাবে মানুষকে অত্যাচার নির্যাতন করে আনন্দ পায়; তারা কি সত্যিকার আনন্দ পায়? ‘মানুষের গায়ে আঘাত করে যে রাতে ঘুমানো যায় না।’ দস্তয়েভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ উপন্যাস থেকে এই ম্যাসেজ যখন তিনি আমাদের কাছে দেন সে সময়ে তার অবয়বজুড়ে ফুটে উঠত এক অন্য-মানবের ছবি যা ব্যাখ্যাতীত। প্রসঙ্গের আড়ালে তিনি যে সময়, যে মানুষদের কথা বলতে চাইতেন- স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ তরুণদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি বলেই তারা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে কেন্দ্র করে; কিন্তু সেখানেও তরুণদের স্বপ্ন নির্বিচারে লুট হয়ে যায়। তাদের বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা ও নেতৃত্বের হঠকারিতার দায় শোধ করতে যে দেশের হাজার হাজার তরুণ নিগ্রহের শিকার হলেন, ঘর ছাড়া হলেন, কারাগারে পচে মরলেন, সরকারের সন্ত্রাসীদের হাতে কুকুর-বিড়ালের মতো রাস্তায় গুলিতে জীবন দিলেন। তারপরও সোনার হরিণ বিপ্লবটি অধরাই রয়ে গেল। এ জন্য দায়ী রাষ্ট্র শক্তি ও দলের হঠকারী নেতৃত্ব। যারা সেই সময়ে বিপুলসংখ্যক তরুণ সমাজ বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক- পতাকা তলে সমবেত হয়েছিলেন আলম স্যার ছিলেন তাদেরই একজন। 

ক্লাসের শেষে তিনি খোলা মাঠে বসে থাকতেন একা। তাঁর অন্য কোনো আড্ডা ছিল না। সবুজ মাঠে মৌমাছির মতো তাঁকে ঘিরে ধরতো স্বপ্ন দেখা শিক্ষার্থীরা নতুন কথা শুনবার জন্য। তিনি হয়তো সে সময়ের বিপ্লবী দস্তয়েভস্কির জীবন-ছবিটি দেখার চেষ্টা করতেন। বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ফরাসি ও ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক চর্চায় মন দিয়ে ছিলেন তিনি। প্রথম উপন্যাস প্রকাশের পরই রুশ সাহিত্যের স্বর্ণযুগের লেখক দস্তয়েভস্কি বুঝতে পেরেছিলেন লেখক হওয়াই তাঁর নিয়তি। লেখালেখির পাশাপাশি বাড়তে থাকে পড়াশোনার পরিধিও। সে পড়াশোনা ছিল দলবদ্ধ, রাশিয়ার জার বিরোধী। যদিও তিনি শৈশব থেকেই পারিবারিক আবহে সাহিত্যের বই পড়েই বেড়ে উঠেছেন।

একদিন পুলিশের নজর পড়ল সেই সব দলের ওপর। ১৯৪৯ সালে দস্তয়েভস্কি গ্রেফতার হলেন অন্যান্য লেখকদের সঙ্গে। শুধু পড়াশোনা করা এদের সম্পর্কে পুলিশের দাবি এরা বিপ্লবী। বিপ্লবীরা সবসময়ই সব দেশে সরকারের আতঙ্কের বিষয়। বিপ্লবী লেখকদের অপরাধ অমার্জনীয়। কারণ এরা বিপ্লবকে উসকে দেওয়ার জন্য আরও বই লিখবে, আরও বিপ্লবী তৈরি করবে। রাজার শান্তি নষ্ট হবে। অতএব, এদের সমূলে উৎপাটন করাই বুদ্ধিমানের কাজ। মৃত্যুদণ্ডই হবে এদের সর্বোচ্চ শাস্তি। রাজা নিকোলাসের আদেশ- সে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে ফায়ারিং স্কোয়াডে। নিজের দোষ স্বীকার করার মহৎ গুণ ছিল ফিওদরের। তিনি কি শেষ মুহূর্তে সেই সুযোগ পেয়ে ছিলেন! মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে দস্তয়েভস্কিকে মাফ করে দেওয়া হলো। বাস্তবেও যে রূপকথার মতো ঘটনা ঘটে, কোনো ভালো মানুষের পরামর্শে তা দেখা গেল, দূর থেকে প্রথম নিকোলাইয়ের দূত ঘোড়া ছুটিয়ে হাজির।

অবধারিত মৃত্যুদণ্ড রদ হলো, তবে আদেশ হলো সশ্রম কারাদণ্ডের। সে শাস্তি ভোগ করতে তাকে পাঠানো হলো সাইবেরিয়ার প্রিজন ক্যম্পে। সে শাস্তি এমন ভয়াবহ ছিল- দাসের জীবন, খাঁচায় রেখে শূকরকে খুঁচিয়ে মারা; কিন্তু মৃত্যু নেই। এর চেয়ে একটি গুলি-ই শ্রেয়। সাইবেরিয়ার প্রিজন ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা তাঁর লেখা উপন্যাসে নানাভাবে এসেছে যা ছিল নরকতুল্য। ক্ষমতাবানরা ক্ষমতাহীনদের যেভাবে দেখে, শোষণ করে- কারাগার যেন সমাজের এই সকল দৃশ্যের আরেক নির্মম চিত্র। ভূলুণ্ঠিত মানবতার বীভৎস রূপ তিনি দেখেছেন জেলখানায়। প্রিজন ক্যাম্প থেকে ফিরে তিনি সেই স্মৃতি নিয়ে লিখেছিলেন ‘দ্য হাউস অব দ্য ডেড’। এটা তিনি লিখেছেন জীবনের চরম সংকট পেরিয়ে। এই উপন্যাসটি রাশিয়ার ইতিহাসে কারাগার নিয়ে লেখা প্রথম উপন্যাস। এরপর তিনি বিপ্লবীদের সাথী ছিলেন এমন দেখা যায়নি; কিন্তু ছিলেন সাধারণ মানুষের সঙ্গেই।

ইতিহাসকে নির্মোহভাবে উপস্থাপন করার মতো কে আর ছিল তখন এই সব মফস্বলের তরুণদের সামনে? ইতিহাসনির্ভর আদর্শ-চর্চা থেকে জন্ম নেওয়া দুটি দল মুখোমুখি। সন্ত্রস্ত, ভয়, রক্তের খেলা-এর ভেতর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিভীষিকা তৈরি হয় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে। একই দেশের ক্ষমতাশালীদের ভেতর একদিকে শোক, অন্যদিকে গর্বের দিবস। কে যে তখন নায়ক আর কে যে ভিলেন? গোটা দেশ কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল সেই দ্বন্দ্বে। এ শুধু দ্বন্দ্বই নয়জটিল রহস্যও বটে।

‘মানুষ একটা রহস্য। এর জট খোলা জরুরি, তুমি যদি তোমার পুরো জীবন এই জট খোলার পিছনে খরচ করে ফেল তবে এই কথা বলো না যে তুমি সময় নষ্ট করেছ। আমি সে রহস্য পাঠ করছি, কারণ আমি একজন মানুষ হতে চাই।’ সবুজ মাঠ ছেড়ে আলম স্যার হঠাৎ উঠে দাঁড়াতেন। ছিপছিপে ঋজু দেহ। এ যেন সেই তার প্রিয় লেখক দস্তয়েভস্কির মানুষ হবার মতোই তিনি ওভাবে উঠে দাঁড়াতেন। চোখের দৃষ্টি কি যেন খুঁজতো। সে অন্য এক আখ্যান।

দস্তয়েভস্কির জীবনী পড়তে গিয়ে এমন একজনের কথা মনে পড়ে, চোখ ধাঁধানো দীপ্তিতে ভাস্বর, ভিন্নতর গতিপ্রকৃতি, স্বতন্ত্র এক কক্ষপথের নক্ষত্র মাইকেল মধুসূদন দত্তকে। নশ্বর দেহটি ধূমকেতুর মতোই দেখা দিয়ে অচিরেই মিলিয়ে গেছে; কিন্তু রেখে গেছে এক চিরস্থায়ী ঔজ্‌বল্য- কীর্তিতে, জীবনে। সৃষ্টির মতোই আশ্চর্য এক বর্ণময় জীবন তাঁর। যে জীবন ছিল বেহিসেবের। যা আয় করতেন তার চাইতে খরচ করতেন বেশি। ধার-দেনা তো লেগেই ছিল। চারদিকে পাওনাদারদের উৎপাত। প্রবাসে দৈবের বশে বাধ্য হয়ে উদ্ধার পেতে চিঠি লিখেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে। 

দস্তয়েভস্কির জীবনে কোনো বিদ্যাসাগর ছিল না, ছিল তস্কর প্রকাশক মিখাইল কাতকোভক। যাকে তিনি টাকা ধার চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন একটি উপন্যাস লিখে দেওয়ার শর্তে। সে কঠিন শর্ত। আর ছিল ত্রাণকর্তী স্ত্রী আন্না গ্রিগরিয়েভনা স্নিৎকিনা। 

জুয়ার নেশায় তাঁর টাকার প্রয়োজন কখনো শেষ হতো না। 

 দুই

বাড়িতে দেশের বই-পত্রিকার সঙ্গে রাশিয়ান পত্র-পত্রিকাও আসতো, সবই প্রায় ছোটদের। বড়দের বিদেশি বই বলতে যা তা প্রথম পেলাম বড় ক্লাসে উঠে স্যারের কাছ থেকে। সর্বকালের স্মরণীয় লেখকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ফিওদর দস্তয়েভস্কি। রুশ ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক ফিওদর দস্তয়েভস্কিকে চিনিয়ে ছিলেন তিনিই। সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত তাঁর লেখা বই ১৭০টির অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এসব বই রাশিয়া এবং রাশিয়ার বাইরে ব্যাপকহারে পঠিত এবং অনেক বিখ্যাত লেখককে সেসব বই প্রভাবিত করেছে। তিনিও এসেছেন একাধিক দার্শনিক-লেখকদের লেখার সংস্পর্শে, হয়েছেন প্রভাবিত। তাঁকে বসচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিলেন গোগল ও পুশকিন। যদিও এ প্রভাব এক সময় কেটে যায়।

দস্তয়েভস্কি একটি স্মৃতি কথা লিখে ছিলেন- দ্য হাউস অব দ্য ডেড। এখান থেকেই শোলঝিনিৎসিন ‘দ্য গুলাগ আর্কিপেলাগু’-এর মতো বই লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। জাঁ পল সাঁত্রের এক্সিসটেনশিয়ালিজম, সেটির জন্ম হয়েছিল দস্তয়েভস্কির হাত ধরে। শোলজিনিৎসিন এবং চেখভ দু’জনই প্রভাবিত হয়েছিলেন দস্তয়েভস্কি দ্বারা। বাংলা সাহিত্যের কোনো কোনো দিকপালখ্যাত লেখকও প্রভাতি হয়েছেন বে স্পষ্টভাবেই। এতে দোষের কিছু নেই। লেখকরা তো লেখকদের লেখা পড়েই উৎসাহিত হবেন এটাই স্বাভাবিক। সাহিত্য তো এভাবেই এগিয়ে যায়।

ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কি জন্মে ছিলেন ১৮২১ সালের ১১ নভেম্বর রাশিয়ার মস্কোতে। মৃত্যু- ১৮৮১ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে রুক্ষ, কড়া মেজাজি বাবার মিলিটারি নিয়মানুবর্তিতার কঠোরতার জন্য তাদের সংসারে শান্তি না থাকলেও বাবা-মার হাত ধরেই তাঁর প্রবেশ সাহিত্যের বিশাল জগতে। একে একে পরিচয় হয় নক্ষত্রসম পুশকিন, কারামযিন,অ্যান র‌্যাডক্লিফ, শিলার, গ্যেটে, ওয়াল্টার, স্কট, হোমারের সঙ্গে। মিলিটারি ইনস্টিটিউটের পড়াশোনা তাকে আকর্ষণ করতে না পারলেও তিনি সেখান থেকে শিখে ছিলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমালোচনা করতে, সাহসিকতা, ন্যায়পরায়ণতা, অসহায়কে রক্ষা প্রভৃতি গুণ তাকে অন্যদের চোখে শ্রদ্ধেয় করে তুলেছিল। সর্বপরি তাঁর বিবেচনা বোধ ছিল উন্নত। 

১৮৪৩ সালে ইউজিন গ্র্যান্ডের ‘অনার ডি বালজাক’ এর অনুবাদ করে সাহিত্যকর্ম শুরু করেন। একটি মানসম্মত চাকরি করা সত্ত্বেও দস্তয়েভস্কি আর্থিক সমস্যার চাপে পড়ে যান। অমিতব্যয়ী দস্তয়েভস্কি সেই সমস্যা থেকে উঠে দাঁড়তেই চাকরি ছেড়ে বড় কিছু লেখায় হাত দেন। লিখলেন প্রথম উপন্যাস ‘পুওর ফোক’। সামাজিক বাস্তবতা এবং মনোবিকলনের বিভিন্ন স্বরকে অত্যন্ত সাবলীলতায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তিনি পাঠক ও বুদ্ধিজীবী মহলে অল্প সময়ে পরিচিতি লাভ করেন। প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক ভিসারিয়ন বেলিনস্কি উপন্যাসটিকে রুশ সাহিত্যের প্রথম সামাজিক উপন্যাস বলে আখ্যায়িত করেন। সময়টা জার-শাসনের প্রতি সচেতন মানুষদের বিদ্রোহের আগুন ধূমায়িত হচ্ছে। তিনি বিদ্রোহীদের সংস্পর্শে আসেন। 

তরুণ পাঠকদের দস্তয়েভস্কির সাহিত্যের কাছে ফিরে যেতে হয় এ জন্যই যে সেখানে আধুনিকতাবাদ, অস্তিত্ববাদ, মনস্তত্ব এই সব দর্শনে তাঁর নিজস্ব অবদান রয়েছে। এ কারণে জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোও সাধারণ পাঠকের কাছাকাছি এনে দিয়েছে তাঁকে। আসল ফিওদর দস্তয়েভস্কি উঠে এসেছেন সেই সব সাধারণ মানুষের মাঝ থেকেই অতি সাধারণ জীবন দেখতে দেখতে। তাই রচনার মধ্যেই লেখককেও খুঁজে পাওয়া যায় বললে ভুল হবে না। রচনারীতির সরল ভঙ্গি এবং ঋজু বক্তব্যের মতো মানবিক আবেগের স্ফুরণের মাঝে প্রকাশ পেয়ে যায়, সে সাহিত্য যারা পড়ছেন তাদেরই একজন তিনি। জীবনঘেঁষা ভাবনাগুলো আলাদা করে ছেঁকে সঠিক ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা ছিল বলেই দস্তয়েভস্কি মানুষের মনে একটা স্থায়ী আসন করে নিতে পেরেছেন খুব সহজেই। লোকমনোরঞ্জনের অভিপ্রায়ে তিনি লেখক হয়ে ওঠেননি, বলা চলে জীবনের তাগিদেই লেখক হয়ে উঠেছেন। সন্দেহ প্রবণতার কারণে নানাভাবে ব্যথিত হয়েছেন, অশান্তি পেয়েছেন; কিন্তু ধৈর্য হারিয়েছেন খুব কম সময়। পছন্দ অপছন্দের সীমানাও টেনেছেন নিজস্ব ভঙ্গীতে। একই সঙ্গে খ্রিস্টধমের্র প্রতি নিরঙ্কুশ আস্থা, আবার ভেতরের স্বেচ্ছাচারী শক্তি নিজের পথ কেটে প্রবাহিত হয়। এই দ্বিমুখী সত্তা আত্মগোপন করে না। তিনি জগৎকে দেখেন, বোঝেন, বিচার করেন ব্যাখ্যা করেন নিজস্ব একটা ভঙ্গিতে- প্রকাশ করেন সাহিত্যের ভাষায়। একাডেমিক জীবনে অঙ্ক, জ্যামিতি, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন এসব কিছুর প্রতি বিরক্তি বিতৃষ্ণা জন্মেছিল। জীবনের আরও সব হতাশায় মনোযোগ না দিয়ে তিনি কেবল সহিত্য রচনায় মন দিয়েছিলেন। সেই সময় থেকেই তাঁর সাহিত্যের পড়াশোনাও ছিল গভীর, যা তিনি আত্মস্থ করেছিলেন খুব মনোযোগী ছাত্রের মতো। তবে সে সবের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে তিনি নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিকে 

প্রাকৃতিক সত্যের মতো করে বিকশিত করেছিলেন লেখার মধ্যে। সে কারণেই তিনি যা লিখেছেন, তা হয়ে উঠেছে সাহিত্যের একেকটি হিরক খণ্ড।

মানুষ ভেতরে ভেতরে যতই জটিল হোক না কেন সে- অন্যের কাছে সহজিয়া পন্থাই পছন্দ করে। মানুষ কোনো অপরাধ করে যে মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয় এটা তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের মধ্যে তুলে ধরতে পেরেছেন সফলভাবে। আবেগের চিন্তা যতো প্যাঁচালো-ই হোক না কেন মানুষের জানা প্রয়োজন ইচ্ছে করলেই সে সত্যকে গ্রহণ করতে পারে এই ধারণা লেখক তাঁর চরিত্রদের মধ্যে সাজিয়ে দেখাতে পেরেছেন। বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে, মানব সমাজ গ্রহণ করেছে যা পাঠকের চিন্তার শিকড়কে প্রসারিতও করেছে দূর পাহাড়ের নিটল ঝর্ণার আওয়াজের মতো। সে ধ্বনি এখন পর্যন্ত লোকালয়ে, নগরে, জনপদে মানুষের হৃদয়ে পৌঁছাচ্ছে বলেই দস্তয়েভস্কি কালোত্তীর্ণ। সাহিত্যের এই উপাদানগুলো তাঁর চিন্তাধারায় হয়েছে আরও সমৃদ্ধ। মানুষ নিয়েই তিনি জীবন চর্চা করেছেন। লেখার উপজীব্যও মানুষ, মানুষের কুটিল তমসাচ্ছন্ন দিকটি যেমন সাহিত্যে প্রকাশ পেয়েছে তেমনি মানুষের উদার ঝলমলে মানবিক দিকটিও। যা পাঠককে অভিভূত করে। সমগ্র মানুষকে তিনি যত ভালোবেসেছেন ততটাই দূরে থেকেছেন ব্যক্তিমানুষের কাছ থেকে। তবু মানুষের চিরন্তন সম্ভাবনায় আস্থা রেখেছেন। মানুষই ছিল তাঁর প্রিয়। জীবনের খুব সঙ্কটময় অবস্থায় কারাবাসে যাবার সময়ে দস্তয়েভস্কি তাঁর ভাইকে লিখছেন-‘আমি হতাশ হইনি, ভেঙে পড়িনি। জীবন সর্বত্রই জীবন। আমার আশপাশে মানুষ জন থাকবে, মানুষের মাঝখানে মানুষ হয়ে থাকা, যতবড় সংকটই দেখা দিক না কেন, চিরকাল মানুষ হয়ে থাকা, হতাশ না হওয়া, ভেঙে না পড়া- এই হলো জীবন, এই হলো জীবনের লক্ষ্য।’ 

দস্তয়েভস্কি প্রতিটি লেখায় এই জীবনের কথাই লিখে গেছেন বলেই তিনি আন্তর্জাতিকময় হয়ে উঠেছেন। বেঁচে ছিলেন মাত্র ঊনষাট বছর। এই স্বল্প পরিসর জীবনে আপন দেশকাল পরিমণ্ডলে যথার্থ অর্থেই একজন মহান লেখক হয়ে উঠেছিলেন দস্তয়েভস্কি। তাঁর সাহিত্যের গুরুত্ব যেমন সমসাময়িকীতে, দু’শো বছর অতিক্রম করেও তেমনি গুরুত্ব বহন করে। কাল অতিক্রম করা সাহিত্যই তাকে এখন পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য এবং জীবন্ত রেখেছে। 

বর্তমানে দেশে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি- সে ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়াই হোক অথবা ভেতর থেকে বিষ ফোঁড়ার মতো ঠেলে উঠে আকাশ-বাতাস আচ্ছন্ন করেছে এর কোনো সমাধান দেখি না। সত্য সে যতই অপ্রিয় হোক না কেন একমাত্র সত্যই মানুষকে সাহায্য করতে পারে। সাধারণ মানুষ অসহায়ের মতো দেখছে মিথ্যের আবরণ, শক্তিমানের দম্ভ, মূর্খের আস্ফালন, বলবানের বর্বর অট্টহাসি, লোভীর গ্রাস, প্রতারকের স্বীকৃতি, অবিশ্বাসের জোয়ার, শিক্ষা বাণিজ্য, হতাশার জায়গা- সব মিলিয়ে প্রশ্ন জাগে জীবনে বেঁচে থাকার সার্থকতা কোথায়? মানুষ যখন নিজের মেরুদণ্ডের ওপর থিতু হতে পারছে না এই সংকটময় সময়ে দস্তয়েভস্কির রচনায় প্রবাহিত চিন্ময় প্রবাহটি মানুষের প্রতি কিছুটা স্বস্তি-আস্থা আনতে পারে। দস্তয়েভস্কিকে বুঝবার এবং উপলব্ধি করবার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে অতীতে এবং এখনো হচ্ছে।  দ্বিশততম জন্মবাষিকীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে- এ প্রবাহ নিরন্তর হোক। এভাবেই হোক জানাজানি যুগ থেকে যুগান্তরে প্রিয় দস্তয়েভস্কি এবং তাঁর অমর রচনা। 

লেখক : জ্যেষ্ঠ শিক্ষক, ভারতেশ্বরী হোমস্, টাঙ্গাইল।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //