কাব্য ও খুনে যার প্রসিদ্ধি

দস্যুকবি শানফারা

রবিনহুডের গল্প শুনে অনেকেই বড় হয়েছি আমরা। গল্পটা পুরোটা ফ্যান্টাসি নয়। ধারণা করা হয় পুরনো দিনের আরবদের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এগুলো লেখা হয়েছিল। আরবের মরু আর পাহাড়ে, পঞ্চম শতাব্দীর শেষে এবং ষষ্ঠ শতাব্দীর শুরুর দিকে একদল কবির বিচরণ ছিল। এই কবিদের বলা হতো ছা’আলিক কবি। এরা ছিলেন ভবঘুরে। এদের বেশিরভাগকে কবিলা বা গোত্র থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। দস্যুতা ছিল এদের পেশা, আর অবকাশে লিখতেন কবিতা। মরু জীবনের কষ্ট-ক্লেদ ও বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি নিয়ে রচনা করেছেন কাব্যকলা। তারা তাদের কবিতার মাধ্যমে উপজাতীয় জীবনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক সংরক্ষণ করেন।

ঐতিহাসিক হান্না আল ফাখুরির মতে, ছা’আলিক কবিরা দস্যুবৃত্তির জন্য আরব উপত্যকায় প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তারা ছিনতাই, অপহরণ ও লুণ্ঠিত দ্রব্যের বিনিময়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এদের উত্তরসূরী উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগেও বিদ্যমান ছিল। 

সাহিত্যের ইতিহাসে এই কবিদের মধ্যে বিশেষভাবে খ্যাতিমান- শানফারা, তাব্বাত র্শারা, উরওয়াতু আল ওয়ারদ, ত্বরফা ইবনুল আবদ, সালিক ইবন সালাকা। এদের হাত দিয়ে অনেক ক্বাসিদা বা দীর্ঘ কবিতা রচিত হয়েছে। তবে এসবের  মধ্যে খ্যাতির চূড়ায় যে কবিতাটি স্থান পেয়েছে নিঃসন্দেহে সেটি হচ্ছে শানফারা রচিত ক্বাসিদা ‘লামিয়াতুল আরাব’। তার এই কবিতায় বেদুইনের আত্মমর্যাদাবোধ, জাহিলি রূঢ়তা ও বাস্তববোধ-এ সবই নিপুণভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। কাহতানী বংশোদ্ভূত দস্যুকবি শানফারা ইয়ামানের বনু আয্দ গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম ছাবিত ইবন আউস আল-আয্দি। শানফারা হচ্ছে কবির উপাধি। শানফারা শব্দের দুটি অর্থ রয়েছে-এক. মোটা অধরবিশিষ্ট, দুই প্রবল রাগী। যেহেতু কবির অধর মোটা ছিল, আর তার মধ্যে তীব্র ক্রোধের আগুন দেখা যেত সে কারণে এই নামে তাকে অভিহিত করা হয়। জাহিলি যুগে একদল দ্রুতগামী দস্যু কবির আবির্ভাব হয়েছিল; শানফারা ছিলেন তাদের অন্যতম। কথিত আছে দ্রুতগামী ঘোড়াও তাদের নাগাল পেত না। লুটের কাজে তার দোসর ছিলেন তাব্বাত র্শারান। তারা দু’জনে সম্পর্কে মামা ভাগ্নে ছিলেন।

কবি বনু আয্দ গোত্রে জন্মগ্রহণ করলেও অতি শৈশবে তাকে বনু ফাহ্ম কবিলা বা গোত্রের লোকেরা ধরে নিয়ে যায়। কথিত আছে একজন লোককে বনু সালামান কবিলা বন্দি করে নিয়ে গেলে তারা শানফারাকে মুক্তিপণ হিসেবে প্রদান করে ওই লোককে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। শানফারার কবিতাগুলি থেকে অনুমান করা হয় তিনি আত্মবিশ্বাসের সাথে এগুলো রচনা করেছিলেন। তিনি ইয়েমেনি আল-আয্দ গোত্রের অন্তর্গত বলে মনে হয়। সম্ভবত তিনি আল-খাজরাজ গোত্রের। তাকে কখনো কখনো আগরিবাত আল-আরব (আরব কাক) হিসাবে গণ্য করা হয়, এটা আফ্রিকান মায়েদের সাথে আরবদের সম্পর্কটা উল্লেখ করে। অন্যরা এই দলে তার অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। 

আবু আল-ফারাজ আল-ইসফাহানির কিতাব আল-আগানী বা মুহাম্মদ বিন আল-কাসিম আল-আনবারীর মুফাদ্দালিয়তের ভাষ্যের মতো পাঠগুলোতে বেশ কয়েকটি ছদ্ম-ঐতিহাসিক প্রতিবেদন আকর্ষণ করে। এর বেশিরভাগই ব্যাখ্যা করে যে কীভাবে শানফারা তার কবিলা থেকে নির্বাসিত হয়েছিলেন। এমনই একটি গল্পে বলা হয়েছে যে, তিনি যখন যুবক ছিলেন তখন তিনি ফাহম উপজাতির দ্বারা বন্দী হয়েছিলেন। তার নিজের গোত্রের একটি ভিন্ন গোষ্ঠী- আয্দ। পরে ফাহ্মের একজনকে বন্দি করে এবং তাকে শানফারার জন্য মুক্তিপণ দেয়। উপজাতির এক রমণির সাথে ঝগড়ার আগ পর্যন্ত তিনি ওই গোত্রের একজন হিসেবে বসবাস করতে থাকেন। গল্পের অন্য সংস্করণে বলা হচ্ছে, তিনি তার উপজাতির বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ান কারণ অন্য একজন উপজাতি তার পিতাকে হত্যা করেছিল এবং উপজাতির রক্তপণ-প্রতিশোধের আইন প্রয়োগ করতে অস্বীকার করেছিল। পণ্ডিতরা এই বিবরণগুলিকে তার গোত্রের প্রতি কবির ঘৃণা ব্যাখ্যা করার জন্য পরবর্তী পৌরাণিক কাহিনী হিসাবে বিবেচনা করেন। শানফারা এবং তার সঙ্গী তাব্বাত শাররানকে প্রাক-ইসলামী আরবের কিছু লোকের মধ্যে মনে করা হয়েছিল যারা একটি হরিণকে ছুঁড়ে ফেলতে পারে। শানফারা ৫২৫ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান। তার মৃত্যুর ঐতিহ্যগত বিবরণে বলা হয়েছে যে, হারাম ইবন জাবিরের হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। 

একদিন কবি তার জ্ঞাতি বোনের কাছে আর্তি জানান- “বোন হে আমাকে পানি ঢেলে গোসল করিয়ে দাও না!” কিন্তু জ্ঞাতি বোন তাকে ভাই হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে ও তাকে চড় মারে। পরে কবি তার জ্ঞাতি পিতার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে কী তার পরিচয়। পিতা বলেন, “তুমি আয্দ কবিলাভুক্ত আউস ইবন হাজার গোষ্ঠীর সন্তান।” এ তথ্যে শানফারা রেগে আগুন হয়ে যান। প্রতিজ্ঞা করে বলেন, “জেনে রাখুন, আপনারা যারা আমাকে এতদিন দাসে পরিণত করে রেখেছেন তাদের একশত লোককে হত্যা করা ব্যতীত আমি থামব না। তখন থেকেই কবি সুযোগ বুঝে বনু সালামানের  লোকদের হত্যা করতে প্রবৃত্ত হন। একে একে তার খুনের সংখ্যা ৯৮-তে ঠেকলো। তার সর্বশেষ আক্রমণে তারই দেহ থেকে আহত একটি হাত বিচ্ছিন্ন হয়। সেই হাত দিয়ে আঘাত করে বনু সালামানের আরো একজনকে হত্যা করে ৯৯ সংখ্যা পূর্ণ করেন তিনি। এরপর সালামান গোত্রের লোকেরা কবিকে বন্দি করে হত্যা করার পর রাস্তায় ফেলে রাখে। গোত্রের এক ব্যক্তি ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় অজ্ঞতাবশত কবির লাশে লাথি মারলে মাথার খুলির একটি হাড় ওই লোকের পায়ে বিদ্ধ হয় এবং বিষক্রিয়ায় লোকটিও মারা যায়। এভাবে কবির প্রতিশ্রুত সালামান কবিলার ১০০ জন লোকের হত্যা পরিপূর্ণ হয়।

শতখুনে খুনী কবি তবু নিন্দিত না হয়ে নন্দিত হয়ে আছে তার ক্বাসিদার জন্য। আর এই ক্বাসিদাটি পড়ানো হয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি বিভাগে। যেটির নাম “লামিয়াতুল আরাব”। এটি তার অনবদ্য সৃষ্টি। একজন গৃহহীন, স্বজনহীন, বন্ধুহীন, এমনকি সম্বলহীন সাহসী বেদুইন ক্ষুধার তাড়না সহ্য করে মরু-পর্বত অতিক্রম করে, রাতের আঁধারে বন্য হিংস্র পশুর ভয় উপেক্ষা করে, জীবনকে বিপন্ন করে কী রূপে আত্মমর্যাদার সাথে কালাতিপাত করতে পারে তার বাস্তবচিত্র এই বিখ্যাত কবিতা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //