চেতনায় ভাস্বর ভাাষাসৈনিক সৈয়দা ইসাবেলা

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন পৃথিবীর যে কোনো জাতির ভাষার অধিকার দাবিতে অন্দোলনসমূহের মধ্যে অন্যতম প্রধান সফল গৌরবোজ্জ্বল এক আন্দোলন। এই আন্দোলন এত বিশাল ব্যাপক ও তাৎপর্যমণ্ডিত যে একে সকলেই বিনা দ্বিধায় ‘মহান আন্দোলন’ বলে আখ্যায়িত করেন। ভাষা আন্দোলন বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের মহত্তম অধ্যায়। আমাদের মহান স্বাধীনতা আন্দোলনেরও মূল ভিত্তি ও উৎস ছিল ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত স্মৃতিবিজড়িত একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

এ আন্দোলনে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের ভূমিকা ছিল খুবই গৌরবোজ্জ্বল। ১৪৪ ধারা ভাঙার মিছিলে নারীরাও অংশগ্রহণ করেন। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন এলাকায় নারীরা ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে সিরাজগঞ্জে থেকে স্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন সৈয়দা ইসাবেলা।

সৈয়দা ইসাবেলা সিরাজগঞ্জবাসীর কাছে সর্বদা শ্রদ্ধেয় একটি নাম। নারী জাগরণ এবং মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদান রেখে গেছেন। কর্মে, কীর্তিতে ও গৌরবে নিবেদিত প্রাণ এই ব্যক্তিত্ব আলো ছড়িয়েছেন পরিবারে, পিছিয়ে পড়া নারী সমাজ ও দেশের জন্য। যে সময়ে তিনি নারী প্রগতি ও ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন সে সময়ে মেয়েদের জন্য ছিল আনেক কিছু নিষিদ্ধ। সকল বাধা আর সীমাবদ্ধতাকে উপেক্ষা করে অবগুন্ঠনের শিকল ভেঙে তিনি বেরিয়ে এসেছিলেন বীরদর্পে। এই সাহসী অগ্নিকন্যার দৃপ্ত পদচারণায় সিরাজগঞ্জের মতো মফস্বল এলাকায় ভাষার চেতনায় জাগ্রত হয় মেয়েরা।

নারীমুক্তির স্বপ্নই ছিল তাঁর সকল কর্মে অনুপ্রেরণা। বেগম রোকেয়া ছিলেন তাঁর আদর্শ। সৈয়দা ইসাবেলার পৈতৃক বাড়ি সিরাজগঞ্জের বাণীকুঞ্জে। কলকাতায় ১৯৪২ সালে ২৪ ডিসেম্বরে সৈয়দ মোহম্মদ ইসহাক ও আছিরুন নেছার পরিববারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-মাতা দু’জনেই ছিলেন শিক্ষক। বড় চাচা সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী উপমহাদেশের মুসলিম রেনেসাঁর অগ্রদূত। ইসাবেলা ছিলেন তাঁর সুযোগ্য উত্তরাধিকারী।

সৈয়দা ইসাবেলার বেড়ে ওঠা কলকাতাতে। লেখাপড়ার শুরু বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলে। কলকাতায় দাঙ্গা শুরু হলে পরিবারের সঙ্গে তিনি সিরাজগঞ্জ চলে আসেন। সেখানেই তিনি লেখাপড়া, বিবাহ, শিক্ষকতাসহ কর্মময় জীবনযাপন করেন।

সিরাজগঞ্জে ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন সাইফুল ইসলাম। তাঁর নেতৃত্বে ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে হাজার হাজার ছাত্র জনতার মিছিলে শহর প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। ২৩ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জে আহুত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট এবং মিছিল হয়। ২৪ ও ২৫ তারিখে ধর্মঘট অব্যাহত থাকে। সিরাজগঞ্জের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো ছাত্রীরা মিছিলে যোগ দেয়। সালেহা গার্লস স্কুলের মেয়েরা রাজপথে নেমে আসে। ফররুখ শিয়র, সাহেব আলী, আনোয়ার হোসেন রতুসহ রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রগতিশীল অংশের আন্দোলন জনগণকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন সৈয়দা ইসাবেলার মতো আরো অনেক মেয়ে।

সৈয়দা ইসাবেলার স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন রতু মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি স্বামীর সঙ্গে সহযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে কাজ করেছেন।

সার্বিক বিচারে সিরাজগঞ্জের ইতিহাসে তিনি ছিলেন সমকালে মহীয়সী নারী ব্যক্তিত্ব। সংগ্রাম, সততা আর সাহস ও আন্তরিকতায় এক মমতাময়ী মা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নিজেকে। তিনি তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে একদিকে যেমন হাতে কলম তুলে নিয়েছিলেন নারীদের জাগিয়ে তুলতে অন্যদিকে নারীদের নতুন পথের সন্ধান দিয়ে ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশ গঠনের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে যোগ দেন সিরাজগঞ্জ শহরের গৌরী আরবান উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে। দায়িত্ব নেন প্রধান শিক্ষিকার। অবসর জীবনে সঙ্গী হয়েছে লেখা। সাহিত্যেও জগতেও স্থান করে নিয়েছেন আপন আলোয়।

ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার সৈয়দা ইসাবেলাকে ২০২১ সালে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে। রত্নগর্ভা হিসেবেও তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন। ভাষাসৈনিক ইসাবেলা ২০১৩ সালে ১২ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। স্বাধীনতার সঠিক মূল্যায়ন করে বাংলাদেশের মেয়েরা যেন বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি এই স্বপ্ন দেখে গেছেন। ভাষার মাসে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই ভাষাসৈনিক সৈয়দা ইসাবেলার প্রতি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //