বইমেলা প্রত্যাশা-প্রাপ্তির ফারাক

ঘনিয়ে আসছে মেলা শেষের সময়। আগামী ১৭ মার্চ পর্দা নামবে বাঙালির প্রাণের এই মেলার। তাই দিন যত ঘনিয়ে আসছে, মেলা ততই জমে উঠছে। এখন যারা মেলায় আসছেন, তাদের মধ্যে অধিকাংশই আসছেন বই কেনার জন্য। বইপ্রেমীরা বিভিন্ন স্টল ঘুরে ঘুরে তালিকা ধরে কিনছেন প্রিয় লেখকদের বই। মেলায় শুধু ঢাকা নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও আসছেন লেখক ও বইপ্রেমীরা। আসছেন বিদেশি দর্শনার্থীরাও। দম ফেলার ফুরসত নেই বিক্রয়কর্মীদের। বইমেলাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা শ্রেণি-পেশা ও বিভিন্ন বয়সী মানুষদের মিলনমেলা।

এদিকে মেলার শেষ দিকে এসে প্রাপ্তির হিসাব-নিকাষ মেলাতে দেখা যায়। শুরুর দিন থেকে মেলা ভালো হলেও, রয়েছে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতিও। প্রত্যাশার সঙ্গে রয়েছে প্রাপ্তির ফারাকও। এই ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে ক্ষোভের শেষ নেই মেলায় আসা দশনার্থী ও প্রকাশকদের।

সংশ্লিষ্ট একাধিক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বইমেলা মূলত দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশের জন্য। পাঠকের দেশীয় লেখকদের বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করতে বিদেশি লেখকের বই বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে; কিন্তু কে শোনে কার কথা। অনেক স্টলেই দেদারছে বিক্রি হয়েছে ভারতের বিভিন্ন লেখকের বই। এ ছাড়াও অনুবাদের বই বিক্রিতে মানা হচ্ছে না কোনো নিয়ম-নীতি। মূল লেখক বা প্রকাশকের অনুমতি নেওয়ার বিধান থাকলেও, তার তোয়াক্কা না করেই অনেক লেখক ও প্রকাশক হরদম বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ করে চলছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মূল লেখক আর প্রকাশকের অনুমতি ‘প্রচুর অর্থসাপেক্ষ’ বলে লেকক-প্রকাশকরা নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করছেন না। কপিরাইট অফিসের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, বইমেলায় অনুবাদের বই প্রকাশের আগে মূল লেখক বা প্রকাশকের অনুমতিপত্রের কপি কপিরাইট অফিসে জমা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে; কিন্তু হাতে গোনা কয়েকজন প্রকাশক ছাড়া কেউ তা জমা দেন না। মেলায় শত শত অনুবাদের বই এলেও, মানসম্মত অনুবাদ একবারেই কম বলে জানিয়েছেন অধিকাংশ পাঠক।

অন্যদিকে মেলায় বেচাকেনা জমজমাট হলেও, বইয়ের মান ও দাম নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন ও অভিযোগ। অবশ্য এই প্রশ্ন প্রতি বছরই থাকে। তবে মানসম্মত বইয়ের বিষয়টি এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, একটি ভালো বই মানুষকে সমৃদ্ধ করে। এ ছাড়া মেলায় ভালো বইয়ের পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় বইও প্রকাশ পাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেকেই নিজেকে লেখক হিসেবে জানানা দিতে নিজের টাকা দিয়ে এসব বই প্রকাশ করছেন। মেলায় প্রকাশিত মোট বইয়ের মধ্যে অধিকাংশই কবিতার বই; কিন্তু হাতেগোনা কয়েকজন কবি ছাড়া বাকিদের বই পাঠক সমাদৃত হচ্ছে না। অপ্রয়োজনীয় বইয়ের মতো অধিকাংশ কবিতার বই কবিরা নিজের পকেটের টাকা দিয়ে প্রকাশ করছেন।

মানের দিকে আসলে দেখা যায়, অনেক প্রকাশক প্রকাশিত বইটি ভালোভাবে সম্পাদনা না করেই প্রকাশ করছেন। এছাড়াও অনেক বইয়ে ভুলবাক্য ও বানান চোখে পড়ে অহরহ। ছাপা-বাঁধাইয়েও রয়েছে অনেক দুর্বলতা। আবার লেখকরা কী লিখেছেন, তা বিবেচনা না করেই টাকা পেয়ে মানহীন বই প্রকাশ করছেন অনেক মৌসুমি প্রকাশক। 

কয়েকজন প্রকাশক জানান, সরকারি ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আগের তুলনায় বই কম কিনছে। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। বাড়ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যাও; কিন্তু কমছে বই ক্রয়ের বাজেট। পাবলিক লাইব্রেরির অবস্থা দিন দিন উন্নতির দিকে যাচ্ছে না। গ্রামকেন্দ্রিক পাঠাগারের সংখ্যাও বাড়ছে না। এ ছাড়াও বইমেলায় আঞ্চলিক ভাষা কিংবা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা নিয়েও খুব একটা বই প্রকাশ হচ্ছে না। শিশু-কিশোরদের জন্য মনো-সামাজিক বই, ইতিহাস-ঐতিহ্য, লোকসংস্কৃতির বইও কম প্রকাশ হচ্ছে।

সরেজমিনে মেলা ঘুরে দেখা যায়, বিকেলে বইমেলা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ঢল নামে বইপ্রেমী। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই সব বয়সী দর্শনার্থী ও ক্রেতাদের পদধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠে মেলা প্রাঙ্গণ। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোর বিকেলবেলায় মেলায় তিল ধারণের ঠাঁই মিলে না। তবে ছুটির দিন থেকে অন্য দিনে বই বেশি বেচাকেনা হয় বলে জানিয়েছেন প্রকাশকরা। এ ছাড়াও মেলায় আগতদের মধ্যে অধিকাংশ তরুণ-তরুণী। তরুণদের বইমুখী হওয়ায় আশাবাদী সাহিত্যিকরা। মেলাকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে একটি যোগসূত্র। প্রতিদিন বিকেলেই মেলামাঠের বিভিন্ন প্রান্তে বসছে তাদের জমজমাট আড্ডা।

কথা প্রকাশের ব্যবস্থাপক ইউনুছ আলী বলেন, ছুটির দিনে অধিকাংশরাই ঘুরতে আসেন। তবে অন্য দিনে যারা আসেন, তারা বই কিনতে আসেন। আর এখন যারা আসছেন তারা প্রায় সবাই বই কিনছেন। মেলা ঘুরে জানা যায়, বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বই প্রকাশ হলেও, উপন্যাস, গল্প, গবেষণা, প্রবদ্ধ, বিজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, ভ্রমণগল্প, ইতিহাস-ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, শিশুতোষবিষয়ক বই বিক্রির শীর্ষে রয়েছে। 

অন্যদিকে এক সময় বইমেলার লিটলম্যাগ চত্বরে দিনভর আড্ডা চলতো তরুণ লেখক ও প্রকাশকদের। তরুণ পাঠকরাও ভিড় করতেন লিটলম্যাগ চত্বরে। সচেতন পাঠক ও লেখকদের মধ্যে চলত সমসাময়িক বিষয়ে তর্ক-বিতর্র্ক। প্রথাবিরোধী প্রকাশনার কারণে সাহসী, সংস্কারপন্থি লেখক ও পাঠকদের মূল আবেগের জায়গা ছিল লিটল ম্যাগাজিন; কিন্তু ক্রমেই জৌলুশ হারাচ্ছে বইমেলার লিটলম্যাগ চত্বর। এবার বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের লিটন ম্যাগ চত্বর ঘুরে দেখা যায়, পুরো মেলামাঠ জমজমাট থাকলেও অনেকট নিষ্প্রভ এই চত্বর।

প্রশংসা কুড়াচ্ছে দেশকাল পত্রিকা : বইমেলার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের স্টল ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ ত্রৈমাসিক দেশকাল স্টলের সামনে আসেন ফারহানা আক্তার। চল্লিশোর্ধ্ব ফারহানা ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এ সময় একটি সংখ্যার পাতায় দীর্ঘক্ষণ চোখ বুলিয়ে কিনে নেন সংখ্যাটি। এর সপ্তাহ খানেক পর আবার দেশকাল পত্রিকার স্টলে আসেন তিনি। কিনে নেন পুরাতন সব সংখ্যা। ফারাহানা জানান, ছাত্রজীবন থেকে দেশি-বিদেশি ম্যাগাজিন পড়ার প্রতি একটা ঝোঁক রয়েছে আমার; কিন্তু সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ থেকে খুব ভালোমানের ম্যাগাজিন বের হয় না। প্রায় সব ম্যাগাজিনেই গতানুগতিক বিষয়ের ওপর লেখা থাকে। এদিক দিয়ে দেশকাল পত্রিকার সঙ্গে অন্যসব ম্যাগাজিনের তুলনাই হয় না। এ পত্রিকায় নবীন-প্রবীণ লেখকদের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর অনুসন্ধানী ও গবেষণামূলক লেখা রয়েছে। সম্পাদনা, মেকাপ ও লেখার বিষয়গুলো অতুলনীয়। এভাবে প্রতিদিন বিভিন্ন পাঠক দেশকাল স্টলে এসে পত্রিকাটি কিনে এর প্রশংসা করছেন। 

মেলায় আসা পাঠকরা বাংলা একাডেমি চত্বরে দেশকাল পত্রিকার স্টলে (স্টল নং ৬৪৪) ঢুঁ মেরে কিনছেন দেশকাল পত্রিকার নতুন ও পুরনো সংখ্যাগুলো। এ ছাড়াও সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকালও কিনছেন অনেকে। প্রতিদিন বিকেলেই দেশকাল স্টলকে ঘিরে বসে লেখক-পাঠকদের জমজমাট আড্ডা।

স্টলের বিক্রয়কর্মী আসিফা হোসেন নীলা বলেন, আমার প্রত্যাশার থেকেও বেশি বিক্রি হচ্ছে। প্রতিদিনই পাঠকরা খোঁজ করে স্টলে আসছেন কিনছেন প্রিয় ম্যাগাজিনটি। আবার অনেকেই নিয়মিত ম্যাগাজিন পাওয়ার জন্য অগ্রিম টাকা দিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ একটি সংখ্যা কিনে পরবর্তীতে এসে পুরনো সংখ্যাগুলোও কিনছেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //