যুদ্ধদিনের ডায়েরি

বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হচ্ছিল

১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন লাহোরের ছাত্র আনোয়ার শহীদ খান। তিনি মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম থেকে ডায়েরি লিখতে থাকেন। ডায়েরিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় তার অভিজ্ঞতার অস্থির মুহূর্ত রেকর্ড করেন। শহীদ খানের ছদ্মনাম ছিল শখ। তিনি নভেম্বরে লাহোর চলে যান। পেশাগতভাবে আনোয়ার শহীদ খান (১৯৪৯-) কয়েক দশক ধরে পাকিস্তানের বিভিন্ন উর্দু সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনের রিপোর্টার, সম্পাদক এবং কলামিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন।

২৮ মার্চ

লাউড স্পিকারের চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। একটি কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে, কারফিউ। এটা সকাল ৭টায় শেষ হতে চলেছে। এর কিছুক্ষণ পর... খুব কাছেই গুলির শব্দ শোনা গেল। সবাই উঠে বাইরে তাকালাম; কিন্তু কিছুই জানা গেল না। বাচ্চাদের মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেল। এরপর একের পর এক গুলি ও পাল্টা গুলির শব্দ আসতে থাকে। হঠাৎ একটা বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল পৃথিবী। মন থেকে আওয়াজ ভেসে এলো, আল্লাহ কল্যাণ করুন। 

পুলিশকে লক্ষ্য করে সেনাবাহিনী গোলাবর্ষণ করেছে বলে অনুমান করছি। তারপর থেকে, প্রতিটি বিস্ফোরণে আমার হৃদয় কেঁপে উঠত। নিয়মিত স্বয়ংক্রিয় আগুনের পাশাপাশি, লাগাতার ফায়ারের শব্দ ছিল। এতে অনুমান হয় যে নিয়মিত লড়াই চলছে। আমার হৃদয়ে হাজারো প্রশ্ন জাগছিল। 

বিকেলে মালি তাহির খবর নিয়ে আসেন যে পুলিশ লাইন থেকে ধোঁয়া আসছে। আইদানের ছোট বোন আতঙ্কিত ছিল। তাই আমি তাকে বিনোদন দেওয়ার জন্য একটি লুডো নিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পরে, তাহির আবার রিপোর্ট করে যে ইপিআর সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ করেছে। বেশিরভাগ যানবাহন ধ্বংস হয়ে গেছে ও ইপিআরও কামান ব্যবহার করছে; কিন্তু কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। আমরা সবকিছু ভুলে রঙ নিয়ে খেলা শুরু করলাম যাতে সবাই মজা করতে পারে; কিন্তু ঠিক তখনই দেখলাম সামনের উঠোনের সবাই পালাচ্ছে। জানতে পারলাম, মিলিটারি বাড়ি-ঘরে আগুন দিতে আসছে। আমি এই খবর শুনে খুব বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিলাম। এটি একটি সংকটময় মুহূর্ত ছিল। আমার মামারাও ভয় পেয়েছিলেন। আমি তাদের আশ্বস্ত করেছি ইনশাআল্লাহ এমন কিছু হবে না। আইদ আমাকে একটা আলাদা রুমে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘শহিদ ভাই, জীবনে আর সকাল হবে না, সন্ধ্যাই থেকে যাবে! আমি আমার সামনে মৃত্যু দেখছি, আর আমি মরতে প্রস্তুত।’ সবাইকে আশ্বস্ত ও সান্ত্বনা দিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম কী কী করা যায়। নিশ্চিত ছিলাম যে আমি লাহোরের বাসিন্দা একজন পশ্চিম পাকিস্তানি হিসেবে আমার পরিবারের জীবন ও মর্যাদা রক্ষা করতে সক্ষম হবো। নিজের জীবনের চেয়ে পুরো পরিবারের সকলের জীবনকে বেশি ভালোবাসছিলাম। বিষয়টি মাথায় রেখে আমি মাগরিবের নামায পড়লাম এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রার্থনা করলাম, যেন তিনি আমাকে ধৈর্য ও শক্তি দেন আর এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করেন। নামাজ পড়তে এসে দেখলাম ইমদাদ তার বোনদের সঙ্গে নামাজ পড়ছে। তিনি নিজে নামাজের ইমামতি করতেন। নামাজ শেষ হলে সবার হাত ওপরে ওঠে। আহ, কি এক হৃদয়গ্রাহী দৃশ্য। খবর রটে যে সেনাবাহিনীর অস্ত্র শেষ হয়ে গেছে। এখানে আসা সমস্ত সৈন্য ক্যাম্পের দিকে ছুটছে। পরে জানা যায় ঘটনাটি সত্য নয়।

মার্চ ২৯ 

আমি মাঝে মাঝে বাড়ি ফেরার কথা মনে করি; কিন্তু বাড়ি যাওয়ার কোনো উপায় দেখি না, আমি যখন ভবিষ্যতের দিকে তাকাই তখন দেখি অন্ধকার।

প্রতিনিয়ত মানসিক চাপে আর কিছুই ভালো লাগছে না, ডায়েরি লেখার মনও নেই। আজ সকালে পরিস্থিতি ছিল অনিশ্চিত। সব ধরনের গুজব উড়ছিল। সকালে, একটি গুজব শোনা যায় যে ইপিআর ও পুলিশ যৌথভাবে সামরিক বাহিনীর মনোবল ভেঙে দিয়েছে এবং শহরটি ইপিআরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমি খবরটি শুনলাম। একজন লোক এসে বলল- পুলিশ স্টেশন থেকে একটি রিপোর্ট এসেছে, তারা বন্দুক ব্যবহার করতে জানে এমন কাউকে ফোন করে বন্দুক বিতরণ করছে। কিছুক্ষণ পরেই খবর আসে পুলিশ লাইনের সব সৈন্যকে হত্যা করা হয়েছে আর তাদের লাশ কাফন পরা অবস্থায় পড়ে আছে, লোকজন রাইফেল নিয়ে পালাচ্ছে। আরেকটি গুজব হলো, কারাগার থেকে সব বন্দি পালিয়ে গেছে। মালিকে কেউ বিশ্বাস করেনি; কিন্তু পরে নিশ্চিত করা হয়েছিল যে পুলিশ লাইন গোলাগুলিতে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে এবং অনেক সৈন্য নিহত হয়েছে। আমরা যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝখানে থাকব না এই আতঙ্কে, পরিখা খননের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। 

শেষে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা কাজে এসেছে। (১৯৬৫ সালের যুদ্ধে আমি ভারতীয় সীমান্তের কাছে থাকতাম। যুদ্ধটা হয়েছিল জাল্লুর বিআরবি খালে, যেটা আমার পাকিস্তানের বাড়ি থেকে মাত্র ছয় মাইল দূরে।) কোনো ঘোষণা নেই। সকাল থেকে কারফিউ নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। নিজাম খবর জানিয়েছে যে সেনাবাহিনীও পরিখা খনন করেছে এবং আশপাশের এলাকায় কুঁড়েঘরে আগুন দিয়েছে। তাদের সংখ্যা কম নয়, অনুমান করা হচ্ছে এক হাজার। তাদের একটি রেডিও স্টেশনও রয়েছে। ঢাকা বেতার কেন্দ্র বিকেলে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। 

সন্ধ্যায়, অল ইন্ডিয়া রেডিও জানায়- ঢাকা বেতার কেন্দ্রে জনতা আক্রমণ করেছে এবং একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছে। শেখ মুজিবের গ্রেফতারের খবর সত্য বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিবিসির এক সংবাদদাতা। আজ সারাদিন দশ-বারোটা আগুন লেগেছে। অন্যদিকে অভ্যুত্থানের রিপোর্ট মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। ইপিআর এখনো সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আছে। 

মার্চ ৩০

অনিশ্চয়তার জগতে জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে প্রতিটা মুহূর্ত কেটে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মৃত্যুর পদধ্বনি এতো কাছে আসে যে কান পেতে শুনতে পাই। 

মুক্তিবাহিনী ছাড়াও চোর, ডাকাত   প্রভৃতি যারা আজ জেল থেকে পালিয়েছে, আর সব থেকে বেশি এবং সবচেয়ে বড় শত্রু যে সবসময় এক সঙ্গে থাকে ও এমনকি ছায়ার কাছাকাছি থাকে। পেটে ক্ষুধা... এই অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই মানুষ ক্ষুধায় মরতে শুরু করবে। আজ সকালে যখন আমি চোখ খুললাম, ভয়ংকর ও বেদনাদায়ক তথ্যের বন্যা আমার মনে প্রবেশ করেছে। যেন আমি আমার মনের জানালা খোলার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। স্বপ্নগুলো ভীতিকর ছিল, তবুও স্বপ্ন। দেখলাম কালাম সাহেব এসে বসে আছেন। কালাম সাহেব একটি বীমা কোম্পানীর অফিসার। তার সঙ্গে আলোচনা শুরু হলো বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে। তাদের কেউ স্বাভাবিক আশাবাদী হয়ে উঠেছেন আবার কেউ নিরাশ হয়ে উঠেছেন। তিনি মনে করেন যে এই লোকেরা দীর্ঘকাল যুদ্ধ করতে পারবে না আর শেষ পর্যন্ত তাদের আত্মসমর্পণ করতে হবে। 

অল ইন্ডিয়া রেডিও জানায়- চট্টগ্রাম, যশোর, কুমিল্লা, রাজশাহী, দিনাজপুর সবই স্বাধীন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে এখনো মানুষের বিশ্বাস কম; কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা মাত্র এক-চতুর্থাংশ। দেশটা সরকারি আর্মির নিয়ন্ত্রণে না থাকলেও স্বাধীন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নেই। তবে দেশের বিভিন্ন জেলায় সেনাবাহিনীর অবস্থা যে খুবই খারাপ তাতে কোনো সন্দেহ নেই এবং সেনাবাহিনী যেখানে সেখানে গোলাগুলি করছে। ভোরে রাজশাহীর ওপর দিয়ে দুটি বিমান উড়েছে। কারফিউ তুলে নেওয়ার পর থেকে খোলা কয়েকটি দোকান ও অফিস প্লেন দেখে বন্ধ হয়ে যায়। আজ জানা গেল যে, পুলিশ লাইনে গোলাগুলিতে অগণিত পুলিশ নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ১৭ জনের লাশ পাওয়া গেছে। তাদের দাহ ও দাফন করা হয়। একইসংখ্যক লোককে সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করে এবং পরে জেলা প্রশাসকের সুপারিশে ছেড়ে দেয়। বিকেলে খবর আসে রাজশাহীর একটি শহর স্বাধীন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। এখন তারা রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে, পুলিশ এবং ইপিআরও তাদের সঙ্গে ছিল। সেনাবাহিনী রেডিও স্টেশন, টেলিগ্রাফ, টেলিফোন এবং পাওয়ার হাউস ছাড়া শহরে টহল বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের মনোবল বেশ উঁচু বলে মনে হচ্ছে। শস্যের গুদাম দখল করে নিজেদের অবস্থান মজবুত করেছে। পাবনায় সেনাবাহিনীর অবস্থা খুবই খারাপ আর খুব শিগগিরই পাবনা স্বাধীন সেনাবাহিনীর দখলে চলে যাবে বলে জানা যাচ্ছে। সন্ধ্যায় অল ইন্ডিয়া রেডিও জানায় যে- বিশ্ববিদ্যালয়ে বোমা হামলা হয়েছে। অনুমান করা হয় যে প্রায় ৫০ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিহত হয়েছেন এবং হাসপাতালে বোমা হামলা হয়। অস্ট্রেলিয়ান রেডিও জানিয়েছে যে- জেনারেল টিক্কা খান আহত হওয়ার পর মারা গেছেন। 

এই মুহূর্তে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে যে খবর প্রচার হচ্ছে তা হলো- ঢাকা সেনানিবাস ও বিমানবন্দর দখলের জন্য তুমুল যুদ্ধ চলছে। এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে ভারত যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। আগামীকাল রেডক্রসের একটি জাহাজ ঢাকায় আসার কথা রয়েছে। আজ চাচাজান তার দুটি রাইফেল থানা থেকে নিয়ে এসেছেন; কিন্তু শুনলেন আজকে ঘোষণা করা হয়েছে তাদের ফেরত দিতে হবে। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে আগামীকাল কী হবে তা বলা যাচ্ছে না। উভয় পক্ষই যেকোনো মূল্যে জেতার চেষ্টা করবে এবং ফলাফল হবে ...

জীবন যখন এতো সস্তা হয়ে যায় তখন তার কোনো মূল্য থাকে না। সারাদিন গুজব শুনে এমন অবস্থা হয়ে যায় যে মনের শিরাগুলো আর প্রসারিত করার শক্তি থাকে না, সন্ধ্যার আগেই মাথা ব্যথা শুরু হয়। (সংক্ষেপিত)


উর্দু থেকে ভাষান্তর : মহিউদ্দীন মোহাম্মদ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //