কাক-পরী

তুরস্ক দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার আনাতোলিয়া উপদ্বীপের সম্পূর্ণ অংশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বলকান উপদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত। ফলে ভৌগোলিকভাবে দেশটি একইসঙ্গে ইউরোপ ও এশিয়ার অন্তর্ভুক্ত। তুরস্কের প্রায় ৯৭ ভাগ আয়তনজুড়ে রয়েছে আনাতোলীয় অঞ্চলটি। এটি মূলত একটি পর্বতবেষ্টিত উচ্চ মালভূমি। এই উপকূলীয় এলাকায় সমভূমি দেখতে পাওয়া যায়।

তুরস্কের দক্ষিণ-ইউরোপীয় অংশটি ত্রাকিয়া নামে পরিচিত। এটি আয়তনে তুরস্কের মাত্র ৩ ভাগ হলেও দেশের ১০ ভাগ জনগণ এ অঞ্চলে বাস করে। আর এখানেই তুরস্ক ও গোটা ইউরোপের সবচেয়ে জনবহুল শহর ইস্তাম্বুল অবস্থিত। ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণসাগরকে সংযুক্তকারী বসফরাস প্রণালি, মর্মর সাগর ও দার্দানেলেস প্রণালি ত্রাকিয়া ও আনাতোলিয়াকে পৃথক করে রেখেছে।

তুর্কি সাহিত্যে পারস্য ও আরব সাহিত্যের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় বেশি। তুরস্কের সংস্কৃতি বৈচিত্র্যময়। গ্রিক, রোমান, ইসলামিক ও পশ্চিমা সংস্কৃতির মিশ্রণে তাদের একটি সংকর সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। অটোমান সম্রাটদের সময় তুরস্কে পশ্চিমা সংস্কৃতি ভিড়তে থাকে। তুরস্কের লোকগল্প বা উপকথা কিংবা রূপকথা যা-ই বলি না কেন, অত্যন্ত সমৃদ্ধ। 

আনাতোলিয়ান মালভূমির চারপাশকে ঘিরে রয়েছে অলিক ভাবনার এক একটি উপকথা। এই কল্পকাহিনীগুলো মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্য আর সাহিত্য মিলে এক অপূর্ব সমন্বয়ের সৃষ্টি করেছে। আরব্য রজনীর গল্প, গ্রিম ভাইদের রূপকথা, লুইস ক্যারোলের রূপকথা, অ্যান্ড্রু ল্যাঙের অদ্বিতীয় কথকভঙ্গির লোকগাথা অথবা পৃথিবীর সেরা রূপকথার রূপকার ডাচ লেখক হান্স ক্রিশ্চিয়ান আন্দেরসেন এবং আমাদের দক্ষিণারঞ্জন মিত্রের রূপকথার বিপুল রাজ্যের মতো তুর্কি ভাষার লোকগাথা সংগ্রহের উদ্যোগে নেন ইগনাক কুনোস। 

তুরস্কের আনাচে-কানাচে খুঁজে এইসব রূপকথা এবং লোকগাথা সংগ্রহ করে ১৮৮০ সালে সর্বপ্রথম ইংরেজি ভাষায় রূপদান করেছিলেন হাঙ্গেরিয়ান ও তুর্কি ভাষাবিদ এবং উপকথা-গবেষক ইগনাক কুনোস। ইংরেজিতে অনূদিত সেই সংকলনের নাম ছিল ‘ফোর্টি-ফোর তার্কিশ ফেয়ারি টেলস্’। তিনি মনে করতেন, আনাতোলিয়ানরা কখনো না কখনো কুড়িয়ে নেবে দামি পাথরের মতো তার সংগৃহীত গল্পগুলো। 

সম্প্রতি তুরস্কে ‘মাসাল’ নামের একটি বৃহৎ প্রকল্পেরর মাধ্যমে দশ হাজার গল্প সংগ্রহ ও পুনর্লিখনের কাজ চলছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুর্কি রূপকথা পৌঁছে দিতেই উদ্যোগটি গ্রহণ করা হয়েছে। আতাতুর্ক কালচারাল সেন্টারের এই প্রকল্পের মাধ্যমে তুরস্কে প্রথমবারের মতো লোকসংস্কৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে। কুনোসের সংগৃহীত তুরস্কের এই উপকথা সংকলনটি হাঙ্গেরিয়ান ও ইউরোপীয় ভাষাতেও প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে কুনোস ভাষাবিদ হওয়ার পাশাপাশি একাডেমি অব সায়েন্সেরও সদস্য ছিলেন। এই কাক-পরী (The Crow-Peri) রূপকথাটিও কুনোসের ‘ফোর্টি-ফোর তার্কিশ ফেয়ারি টেলস্’ সংকলন থেকে সংগৃহীত।

এক সময়ে তুরস্কে একটি লোক তার সন্তানের সঙ্গে বসবাস করত। পাখি বিক্রি করে সে জীবিকা নির্বাহ করত। ফলে তার বেশিরভাগ সময় কাটত জঙ্গলে। হঠাৎ একদিন সে মারা গেল। তার ছোট ছেলেটা এই সুবিশাল পৃথিবীতে খুবই একা হয়ে গেল। বাবার পেশা সম্পর্কে ছেলের কোনোরকম ধারণা ছিল না। একদিন ছেলেটি তার বাবার ফেলে রাখা পুরনো জিনিসপত্র গোছাচ্ছিল। তখন তার নজর পড়ল পাখি ধরার জন্য ব্যবহৃত জালের (ফাঁদ) দিকে। তারপর জালটাকে সঙ্গে নিয়ে সে জঙ্গলের দিকে রওনা দিল। তারপর একটা গাছের মধ্যে তা বিছিয়ে রেখে পাশেই অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা কাক উড়ে এসে সেই ফাঁদে আটকা পড়ে। ছেলেটি তখন গাছ বেঁয়ে ওপরে উঠে কাকটাকে খাঁচায় বন্দি করল; কিন্তু অন্য একটা সুন্দর এবং মূল্যবান পাখির পরিবর্তে মুক্তির জন্য কাকটা ছেলেটির কাছে কাকুতি-মিনতি করতে লাগল। কাকটার বিনয়ী বাক্য ছেলেটির হৃদয়কে এতটাই বিগলিত করল যে অবশেষে সে কাকটাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো।

ছেলেটি আবার ফাঁদ বিছিয়ে গাছের নিচে অপেক্ষা করল। হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটা পাখি উড়ে এসে সেই গাছের ডালে বসল, আর সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটির বিছানো ফাঁদে আটক হলো। পাখিটার সৌন্দর্য দেখে ছেলেটির মন মুগ্ধতায় ভরে গেল। এমন সুন্দর পাখি সে আগে কখনো দেখেনি।

‘পাখিটাকে বাদশাহের কাছে নিয়ে যেও। তিনি এটাকে নিশ্চয়ই কিনবেন।’ একথা বলেই কাকটা ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। ছেলেটি পাখিটাকে চুম্বন করে খাঁচার মধ্যে আটক করে প্রাসাদে পাঠিয়ে দিল। চমৎকার ছোট্ট পাখিটাকে দেখে বাদশাহ আনন্দে উৎফুল্ল হলেন। তারপর তিনি পাখিটাকে সোনার খাঁচায় রাখলেন। আর এদিকে তিনি পুরস্কারস্বরূপ ছেলেটিকে এত বেশি সোনা দিলেন যে, এগুলো কী করবে তা সে বুঝে উঠতে পারল না। 

সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাদশাহ অপরূপ পাখিটার সঙ্গেই মেতে রইলেন। বাদশাহের ছিল এক মন্ত্রী। ক্রমেই ছেলেটির সৌভাগ্য মন্ত্রীর হিংসার কারণ হয়ে উঠল। ফলে ছেলেটিকে নিঃস্ব করার জন্য সে ফন্দি আঁটতে লাগল। একদিন সে বাদশাহের কাছে গিয়ে বলল- ‘গজদন্তের খাঁচার মধ্যে পাখিটাকে কী সুন্দরই-না লাগবে, তাই নাহ?’

বাদশাহ বললেন-‘কিন্তু লালা, পর্যাপ্ত গজদন্ত আমি কোথা থেকে জোগাড় করব?’ 

দুষ্টু লালা প্রত্যুত্তরে জানালো- ‘যে পাখিটাকে আপনার কাছে এনেছে; একমাত্র সে-ই পারবে আপনার জন্য গজদন্ত আনতে।’

একথা শুনে তখন বাদশাহ পাখি শিকারিকে আদেশ দিলেন খাঁচা তৈরির জন্য গজদন্ত সংগ্রহ করে আনতে।

ছেলেটি দোনামোনা করতে লাগল, বলল- ‘এত গজদন্ত আমি কোথায় পাব?’

বাদশাহ উত্তরে বললেন-‘এটা তো সম্পূর্ণ তোমার ব্যাপার। গজদন্ত সংগ্রহের জন্য আমি তোমাকে কেবলমাত্র চল্লিশ দিন সময় দেব। এই সময়ের মধ্যে যদি তুমি গজদন্ত সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হও, তবে তোমার মুণ্ডচ্ছেদ করব।’

সমস্যার পাহাড় কাঁধে নিয়ে যুবকটি বাদশাহের প্রাসাদ ত্যাগ করল। দুশ্চিন্তায় তাকে পুরোপুরি ডুবে যেতে দেখে এক কাক যুবকটিকে জিজ্ঞাসা করল- ‘ওহে ভাই, তোমার মুখটাকে এইরকম ম্লান দেখাচ্ছে কেন?’

তখন পাখি শিকারি ছেলেটি জানালো- ‘ঐ ছোট্ট পাখিটা আমার কপালে কী দুর্ভাগ্যটাই না ডেকে এনেছে!’

সব শুনে কাক বলল- ‘দুঃখ ক’রো না। তুমি বরং বাদশাহের কাছে গিয়ে বলো চল্লিশটা ঠেলাগাড়ি ভর্তি করে সুরা দিতে।’

বাদশাহের প্রাসাদে গিয়ে সুরা সংগ্রহ করে ফেরার পথে যুবকটির পুনরায় দেখা হলো কাকের সঙ্গে। তখন কাকটা তাকে আবার বলল- ‘জঙ্গলের কাছে চল্লিশটা পানযোগ্য নালা আছে। সেখানে হাতির দল প্রায়ই পানি খেতে আসে। তুমি বরং সেখানে গিয়ে নালাগুলোতে সুরা মিশিয়ে দাও। আর হাতিরা যখন ঐ সুরা মেশানো পানি পান করে অচৈতন্য অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়বে, তখনই তুমি ওদের দাঁতগুলো কেটে নিয়ে বাদশাহের কাছে হাজির হবে।’ 

কাকের কথা মতো যুবকটি কাজ করল এবং গজদন্তগুলো চল্লিশটা ঠেলাগাড়িতে ভর্তি করে বাদশাহের প্রাসাদে ফিরে গেল। এতো গজদন্ত দেখে বাদশাহের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। উৎফুল্ল হয়ে তিনি পাখি শিকারিকে এবারে থলি ভরিয়ে পুরস্কারে দিলেন। ইতিমধ্যেই খাঁচা তৈরি করে পাখিটাকে তার মধ্যে বন্দি করা হলো। নতুন খাঁচার মধ্যে অপূর্ব পাখিটা আনন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে লাগল; কিন্তু সে আগের মতো গান আর গাইল না। এই দৃশ্য দেখে দুষ্টু মন্ত্রী বলল- ‘এর প্রভু যদি এখানে থাকত তবে নিশ্চয়ই সে গান গাইত।’

একথা শুনে বাদশাহ ভীষণ দুঃখ পেয়ে বললেন- ‘কিন্তু, কে-ই-বা জানে এর প্রভু কে? আর কোথায়ই-বা এর প্রভুকে খুঁজে পাবো?’

তখন মন্ত্রী বলল- ‘জাঁহাপনা, যে আপনার জন্য গজদন্ত এনেছে একমাত্র সে-ই পারবে পাখিটার মালিককে খুঁজে বের করতে।’ 

যুবকটিকে বাদশাহ প্রাসাদে ডেকে আদেশ দিলেন পাখিটার মালিককে খুঁজে আনবার জন্য। তখন পাখি শিকারিটি বলল- ‘আমি এর মালিককে কোথায় খুঁজে পাবো? আমি তো পাখিটাকে জঙ্গল থেকে ধরে এনেছি।’

সব কথা শুনে বাদশাহ বললেন- ‘তুমি কোথায় কীভাবে তাকে খুঁজবে তা কেবলমাত্র তোমার ব্যাপার। তোমাকে চল্লিশ দিন সময় দিলাম। এই সময়ের মধ্যে তুমি যদি পাখিটার মালিকে খুঁজে আনতে ব্যর্থ হও, তবে তোমাকে শূলে চড়ানো হবে।’

যুবকটি কাঁচুমাচু মুখ করে ঘরে ফিরে এলো, আর হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। ঠিক সেই সময়ে ঐ কাকটা সেখানে প্রতীয়মান হলো এবং যুবকটির কাছে দুঃখের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইল। ছেলেটির সঙ্গে যা যা অন্যায় হয়েছে তার সবটাই সে কাকটিকে জানালো। তখন কাকটা বলল- ‘আহা! এই তুচ্ছ ব্যাপারের জন্য তুমি চোখের জল অপচয় ক’রো না। তুমি বাদশাহের কাছে গিয়ে বলো, তোমার জন্য এমন একটা বড় জাহাজের ব্যবস্থা করতে। যার মধ্যে চল্লিশজন সুন্দরী তরুণী অনায়াসেই থাকতে পারবে। সঙ্গে থাকবে একটা সুন্দর বাগান আর স্নানের জন্য একটা পুকুর।’ 

কাকের কথা মতো সে বাদশাহের কাছে গিয়ে জলযাত্রার জন্য তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর কথা জানলো। পাখি শিকারির কথা মতো জাহাজ তৈরি করা হলো। এরপর সে ঐ জাহাজ নিয়ে জলপথে পাড়ি দিলো; কিন্তু সে কোনদিকে যাবে-ডান দিকে নাকি বাম দিকে? সে ভাবনায় ডুবে গেল। এমন সময় ঐ কাক এসে তার বাহুর ওপর বসে বলল- ‘তুমি সব সময়েই ডানদিকে যাবে। যতক্ষণ না উঁচু চূড়া বিশিষ্ট ধবধবে সাদা পর্বত দেখতে পাচ্ছো, ততক্ষণ পাল উড়িয়ে এগিয়ে যাবে। সেই পর্বতের পাদদেশেই বসবাস করে চল্লিশজন পরী। তারা জাহাজটাকে দেখা মাত্রই কৌতূহল নিয়ে তোমার দিকে এগিয়ে আসবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। তুমি শুধুমাত্র পরীরাণীকেই জাহাজে ওঠার জন্য অনুমতি দেবে। আর পরীরাণী যখন তোমার সঙ্গে ঘুরেঘুরে জাহাজটাকে পরিদর্শন করতে ব্যস্ত থাকবে তখন তুমি জাহাজটাকে বাড়ির পথে ছেড়ে নেবে। ততক্ষণ থামবে না যতক্ষণ না তুমি বাড়িতে পৌঁছাচ্ছ। জেনে রাখো-এই পরীরাণীই কিন্তু বাদশাহের প্রাসাদে বন্দি পাখিটার মালিক।’ 

কাকের কথা মতো যুবকটি জাহাজের পাল উড়িয়ে ডানদিকে এগিয়ে চলল। অবশেষে এসে পৌঁছাল উঁচু চূড়াবিশিষ্ট পর্বতের কাছে। সেই সময়ে পর্বত সংলগ্ন সমুদ্রতীরে চল্লিশজন পরী পায়চারি করছিল। তাদের নজর পড়লো পাল তোলা জাহাজের দিকে। পর্যবেক্ষণ করার জন্য পরীরাণী-সহ চল্লিশজন পরী এগিয়ে এলো। পরীরাণী পাখি শিকারী যুবকটিকে বলল-‘আমাদের রাজ্যের কেউ কখনও এইরকম আশ্চর্য জাহাজ দেখেনি। অনুগ্রহ করে আমার বান্ধবীসম প্রজাদের এই জলযানের ভেতরটা ঘুরে দেখতে দাও।’ তখন যুবকটি কেবলমাত্র পরীরাণীকেই সম্মতি দিলো জাহাজের ভেতরটা ঘুরে দেখবার জন্য। তারপর পরীরাণীকে জাহাজে তোলার জন্য সে নোঙর বাঁধল সমুদ্রের তীরে। চমৎকার জাহাজটাকে দেখে পরীরাণীর মন উৎফুল্ল হয়ে উঠল। সে হেঁটে হেঁটে জাহাজের পাটাতনের কাছে গেলো। তারপর নাচের তালে তালে বাগানের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরতে লাগল। বাগানের ভেতর পুকুর দেখে পরীরাণীর চোখগুলো আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠল। সে আনন্দে চিৎকার করে বলল- ‘কী সুন্দর পুকুর! আমি যেহেতু এখন এখানে আছি সেহেতু আমি এখানেই স্নান করব।’

পরীরাণী যখন স্নান করতে ব্যস্ত হলো, তখন জাহাজটাকে পেছনে নেওয়া হলো। যতক্ষণে পরীরাণীর স্নান শেষ হলো, ততক্ষণে জাহাজটা পরীদের বাসভূমি পেছনে রেখে অনেক দূরে এগিয়ে গিয়েছিল। তাড়াহুড়ো করে পরীরাণী জাহাজের পাটাতনের কাছে গিয়ে দেখল তার চারপাশে সমুদ্রের জল ছাড়া আর কিছুই নেই। ফলে পরীরাণী হতাশ হলো এবং সে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে শুরু করল। তার সঙ্গে এটা কী ঘটল? যুবকটি তাকে কোথায়ই-বা নিয়ে যাচ্ছে? যুবকটি তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল, আর বলল- ‘কান্না থামাও। তুমি ভালো মানুষদের কাছে যাচ্ছ। তোমাকে আমি বাদশাহের প্রাসাদে নিয়ে যাচ্ছি।’

শিগগিরই জাহাজটা সুষ্ঠুভাবে শহরের জেটিতে পৌঁছাল। এই খবর লোকমুখে বাদশাহের কানে যাওয়া মাত্রই বাদশাহ যুবকটির সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। পরীরাণীকে সঙ্গে নিয়ে পাখি শিকারিটি প্রাসাদে উপস্থিত হলো; কিন্তু পরীরাণী যখনই তার কোমল দুটি পা ফেলে বন্দি পাখিটার খাঁচার পাশ থেকে এগিয়ে গেল; সঙ্গে সঙ্গে পাখিটা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে গান গাইতে শুরু করল। এই মধুর সুর শুনে প্রাসাদে উপস্থিত সকলেই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। চেনা পাখিটার গান শুনে পরীরাণী কিছুটা স্বস্তি পেল। প্রথম দেখাতেই পরীর মায়াভরা মুখটা দেখে বাদশাহ এতটাই মুগ্ধ হলেন যে, তিনি কোনোভাবেই পরীরাণীর উজ্জ্বল মুখখানা থেকে চোখ ফেরাতে পারলেন না। বাদশাহের সঙ্গে বাক্যালাপের পর পরীরাণী কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো। খুব শিগগিরই তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলো। এখন বাদশাহ হলেন এ জগতের সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি। এদিকে মন্ত্রী ঈর্ষায় অস্থির হয়ে উঠল।

একদা বেগম রোগাক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল। কোনোভাবেই কোনো ওষুধ তার রোগ সারাতে পারছিল না। তার সুস্থতার ওষুধ একমাত্র পরীরাজ্যেই পাওয়া যাবে। এই সুযোগে ধূর্ত মন্ত্রী বাদশাহকে উপদেশ দিল-পাখি শিকারি যুবকটির পক্ষেই এই কাজ সহজ হবে। বাদশাহের আদেশ শুনে সে জালযাত্রার জন্য প্রস্তুত হলো। ঠিক সেই সময়ে কোথা থেকে যেন পুরনো সেই কাকটা আবার ফুড়ুৎ করে উড়ে এলো। আর জিজ্ঞাসা করল- ‘ওহে বন্ধু, এতো তাড়াহুড়ো করে কোথায় চললে?’

তখন সে প্রত্যুত্তরে জানালো বেগম ভীষণ অসুস্থ, তাই সে পরীরাজ্য থেকে বেগমের জন্য ঔষধ আনতে যাচ্ছে। একথা শুনে কাকটা বলল-‘পর্বতের অপর ধারেই তুমি পরীরাণীর প্রাসাদ দেখতে পাবে। আর সেই প্রাসাদের প্রবেশদ্বারে দু’টো হিংস্র সিংহ দেখতে পাবে। ওরা ঐ প্রাসাদটাকে পাহারা দিচ্ছে। নাও-এই পালকটা নাও। এটা দিয়ে তুমি সিংহগুলোর মুখে আঘাত করবে। তখন দেখবে সিংহরা তোমার আর কোনোরকমের ক্ষতি করতে পারবে না।’ 

পালকটাকে সঙ্গে নিয়ে যুবক জলপথে পাল উড়িয়ে এগিয়ে চলল। পর্বতের কাছে পৌঁছে সে নোঙড় ফেলল। এরপর সে বীরের মতো এগিয়ে গেলো সেই প্রাসাদের দরজায়। যেখানে হিংস্র সিংহরা বহুবছর ধরে বিশ্বস্ত প্রহরীর মতো পরীরাণীর প্রাসাদকে রক্ষা করে আসছে। আলখাল্লার পকেট থেকে সে পালক বের করে সিংহগুলোর মুখে আঘাত করতেই সিংহগুলো পথ ছেড়ে দাঁড়াল। তারপর পাখি শিকারিটি প্রাসাদে প্রবেশ করল। যুবকটিকে আসতে দেখে প্রাসাদে উপস্থিত অন্যান্য পরীরা তাদের প্রিয় রাণীর অসুস্থতার বিষয়টা আন্দাজ করে এবং দুর্লভ ঔষধ যুবকটির হাতে তুলে দিল। এরপর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে সে বাদশাহের প্রাসাদে পৌঁছাল। অসুস্থ বেগমের কক্ষে প্রবেশ করা মাত্রই কাকটা ফুড়ুৎ করে উড়ে এসে যুবকটির কাঁধের ওপর বসল। এখন দুজনেই বেগমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। এদিকে তো বেগমের প্রাণ যায়-যায়। বেগমকে তাড়াতাড়ি ওষুধ খাওয়ানো হলো। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলতেই বেগম দেখল- যুবকটি বেগমের পূর্বপরিচিত কাকটাকে সঙ্গে নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বেগম চিৎকার করে উঠল- ‘অপদার্থ পাখি! তোর কী এই দুর্দশাগ্রস্ত যুবকটির ওপর একটুও করুণা হয় না? তোর জন্য বেচারা কতটাই না বিপদের সম্মুখীন হয়েছে।’

তারপর বেগম তার স্বামীকে পুরো ঘটনাটা বিস্তারিতভাবে জানালো-এক সময়ে এই কাকটা পরীরাণীর সঙ্গে পরীরাজ্যেই বসবাস করত। সে ছিল রাণীর পরী-ভৃত্য। কাজে ফাঁকি দেওয়ার জন্য শাস্তি হিসাবে পরীরাণী তার ভৃত্যকে কাক-এ রূপান্তর করেছিল।

তারপর বেগম কাককে উদ্দেশ্য করে বলল- ‘আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি তুমি আমাকে এখনও আগের মতোই ভালোবাসো। ফলে তোমাকে আমি ক্ষমা করলাম।’

ততক্ষণাৎ কাকটা নিজেকে ঝাড়া দেওয়া মাত্রই একজন সুন্দরী তরুণীতে রূপান্তরিত হলো। বেগমের ইচ্ছেতে বাদশাহ পাখি শিকারিটির সঙ্গে ঐ কাক-পরীর বিয়ে দিলেন। আর দুষ্টু ঈর্ষান্বিত মন্ত্রীকে পদচ্যুত করে বাদশাহ সাহসী যুবকটির কাছে সভার প্রধান মন্ত্রীর আসন অর্পণ করলেন। এই ঘটনার পর থেকে সকলেই সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগল।  


ভূমিকা ও ভাষান্তর : এহসান হায়দার

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //