আলোর রঙ, রঙের আলো

এই সন্ধ্যার সময় কেন সার্কিট হাউসে ফিরেছি- জানি না। পশ্চিম আকাশে সূর্য। মেঘের পাহাড়ের ওপাশে ডুব দেবার অপেক্ষায়; কিন্তু সেই অপেক্ষাটুকু বেদনার নয়- উৎসবের। রঙ-খেলায় মত্ত অসংখ্য তরুণীদের প্রাণের কোলাহলের মতো অস্তগামী সূর্যটা চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে আলো আর রঙের ফোয়ারা।

ভোরের মতো সেই আলো তাতিয়ে তোলার মতো নয়, রাগী শিল্পীর আঁকা ছবির রঙের তেজদীপ্ত রৈখিকও নয়, দুপুরের যুদ্ধরত সৈনিকের তাপ আর উষ্ণতা আর উৎকণ্ঠার কোনো রঙ বা আলো কিছুই নেই সন্ধ্যার বিদায়ী সূর্যের যাত্রাপথে। সারাদিন চলতে চলতে ক্লান্ত পথিকের মতো সে ম্রিয়মানও নয়। অধিকন্তু দিনের শেষে পৃথিবীকে রাঙিয়ে তোলার মহা উৎসবের আয়োজন করেছে সন্ধ্যার এই সূর্য। দেহ থেকে সরিয়ে দিয়েছে তীব্রতার প্রলেপ। প্রখরতাও আর নেই। চোখ নষ্ট করে দেওয়ার তেজ ম্লান হয়ে এখন সে নববধূর সরিয়ে দেওয়া অবগুণ্ঠনের আড়ালে উন্মোচন করে দিয়েছে পেলব দেহের ঐশ্বর্য। এখন সে নরম, কোমল, করুণ। দেহে তার রঙের কোলাহল। সেই রঙ সে ছড়িয়ে দিয়েছে পশ্চিমের আকাশে। সেই আকাশের যত উপরে ওঠা যায় শুধু সেই সুদূরপ্রসারী অনন্তলোকে নয়- তার ডানে ও বাঁয়ে, সামনে ও পেছনে যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই রঙ আর রঙের আলো, আলোর রঙ।

কার মন সে রাঙিয়ে দিতে চায়- জানি না; কিন্তু প্রকৃতির ভেতরে চলছে রঙের কাড়াকাড়ি। নীড়ে ফেরা পাখিদের কোলাহল মধুর হয়ে উঠেছে ওই রঙের আবহে। গাছের ডগায় লেগেছে রঙের প্রলেপ। বাতাসের স্পর্শে বুক দেখানো পেট দেখানো পাতাদের একবার বুকে এবং পরেই পেটে লাগছে দুষ্টু রঙের আভা। বোটা থেকে যে পাতাটি এইমাত্র খসে পড়ছে বাতাসে তার কষ্টের কি শেষ আছে! নেই। কতদিন সে বৃক্ষ-মাতার গায়ে আদরে সোহাগে ভালোবসায় স্নেহে মমতায় জড়াজড়ি করে ছিল আর মনের আনন্দে বাতাসের সঙ্গে দুরন্তপনায় মত্ত ছিল। এখন নিরাশ্রয়ী বৃদ্ধ পাতা বাতাসের মায়ায় জড়িয়ে উড়ছে আর নামছে। ক্ষণকালের জন্য তার কষ্ট ভুলিয়ে দিতে চায় সন্ধ্যার আলো। তার যাত্রাপথে রঙ ছড়িয়ে আছে বাতাসের ঢেউয়ে ঢেউয়ে। বাতাসের ভালোবাসার টান কিছুতেই যেন সে আর ছিন্ন করতে পারছে না। মাটির মমতা মাখানো ঘাসে যখন সে নেমে আসে তখনও একবার দুইবার তিনবার সে বাতাসের কোলে দেহ রাখে। তার হলদে দেহের পরতে পরতে তখনো বৃক্ষ-মাতার মায়া জড়ানো আর ছিন্ন বোটার মাথা সিক্ত, জমে আছে এক ফোঁটা চোখের জল। 

২০১৬ সালের গ্রীষ্মের সেই সন্ধ্যায় ব্রাহ্মণবড়িয়া জেলার সার্কিট হাউসের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার চোখ গেল কৃষ্ণচূড়া গাছটির দিকে। মন হলো আমি মর্তলোকে নেই। মর্তে সুন্দরের সীমা আছে। কোনো এক স্বপ্নলোকে, আনন্দলোকে আমি চলে গেছি যেখানে সুন্দরের কোনো সীমা নেই।

বাংলাদেশে কৃষ্ণচূড়া বিরল কোনো উদ্ভিদ নয়। চিকন চিকন সবুজ পাতার আড়াল-আবডাল গলিয়ে একসময় ফুলগুলো যখন পুরো উদ্ভিদটিকে অধিকার করে নেয় তখন সেই মনোরম দৃশ্য মুগ্ধ করে সবাইকে; কিন্তু ঐ দিনের অভিজ্ঞতা কিছুটা ভিন্ন রকমের। অগ্নিলাল কৃষ্ণচূড়ায় পড়েছে সন্ধ্যার রক্তিম আলো। তার সঙ্গে মিশেছে সবুজ পাতার ছায়া-প্রচ্ছায়া। ওই কৃষ্ণচূড়া ফুলও তো শুধু লাল নয়- হলুদ, গোলাপি এবং প্রকৃতির আরও কত রঙ ওই ফুল আর ওই আলোর সঙ্গে মিশে কী যে এক অপরূপ রূপ পরিগ্রহ করেছে তা শুধু অনুভব করা যায়- কোনো ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা পাখিদের কোলাহল শুরু হয়েছে তখন। স্বজনদের সঙ্গে বিনিময় করছে দিনের অভিজ্ঞতা; কিন্তু ওই দোয়েল, ওই শ্যামা আর চড়ুইদের দলবল নিশ্চই জানে হোলিখেলার রঙের আনন্দে ওদের দেহ-মন রাঙিয়ে ওঠেছে তখন। 

সেই সময় আবির্ভূত হলো এক যুবতী। কী নাম তার, বাড়ি কোথায়, করে কী, এই সন্ধ্যায় নির্জন সার্কিট হাউসের পরিচ্ছন্ন বাতাসে কাজ কী তার- কিছুই জানি না আমি। পরেছে সে সালোয়ার-কামিজ-ওড়না। অফ-হোয়াইটের ওপর মেরুনের ছোপ দেওয়া জমিনে সবুজের আঁকিবুঁকি। ঠোঁটে মেরুন লিপস্টিক, নোখে মেরুন নেইল পলিশ, চুলে মেরুন ফিতার ফুল কার। ডান হাতে মেরুন ব্রেসলেট। হাতের তালু থেকে কনুই অবধি মেহেদি দিয়ে ফুল আর লতাপাতার আলপনা আঁকা।  

কৃষ্ণচূড়ার নিচে এসে দাঁড়াল সে। একা। অষ্টাদশীর শরীরজুড়ে তখন রঙের কোলাহল। পাখিদের, পাতাদের, পাপড়িদের আর বাতাসের হোলিখেলার সঙ্গে শামিল হয়েছে সেও। সবাই যেন উড়ছে- রঙিন ঘুড়ির মতো চারদিকে রঙের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে উড়ছে আর উড়ছে। অষ্টাদশীর রাঙিয়ে ওঠা চুল উড়ছে, ওড়নার প্রান্তদেশ উড়ছে। সেই ওড়াওড়ির মধ্যে সলজ্জ বিনম্রতায় বেরিয়ে আসছে তার উন্নত দেহবল্লরি। ওই দেখা দেওয়া আর আড়াল হওয়ার লুকোচুরি খেলা আমি দেখছি তার অজান্তে। আড়াল থেকে দেখার মতো নিবিড় দেখা আর হয় না। সেই দেখা প্রকৃতিকে দেখার মতো- কোনো ভান নেই, ভরম নেই, নিজে যা নয় তা কিছুমাত্র হওয়ার তাড়া নেই। সন্ধ্যার প্রকৃতির এই বিপুল কোলাহলের মধ্যে একজন অষ্টদশীর রাঙিয়ে ওঠা দেহ-মনে যে উচ্ছ্বলতা, পৃথিবীর আফুরন্ত আনন্দযজ্ঞে তার যে অংশগ্রহণ- আড়াল থেকে না দেখলে তার ঐশ্বর্য অনুভব করা সম্ভব নয়। আমি দেখলাম এবং প্রাণভরে নিজেকে সমৃদ্ধ করে নিলাম।

কোনো সুন্দরই সর্বক্ষণ নয়। অতি অল্প সময়ের মধ্যে সুন্দর আপন বিভা বিস্তার করে বিলুপ্ত হয়ে যায়। আর এখানেই সুন্দরের মহিমা। ওই সন্ধ্যার আলো, ওই কৃষ্ণচূড়া এবং ওই অষ্টাদশী খুব অল্প সময়ের জন্যই ছিল; কিন্তু আজও আমি ভুলিনি। সেই সুন্দর প্রকৃতিতে বিরাজমান ছিল নাকি আমার মনের গড়নেই কোনো পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল, আজ আর তা বলতে পারব না। তবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের কথা কোনো দিন ভুলতে পারব না। ‘আমি’ নামক একটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন-

আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ,

চুনি উঠল রাঙা হয়ে।

আমি চোখ মেললুম আকাশে,

জ্বলে উঠল আলো

পুবে পশ্চিমে।

গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম ‘সুন্দর’,

সুন্দর হলো সে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //