নিষিদ্ধ নজরুল

উনিশ শতকের গোঁড়ার দিকে ব্রিটিশ-ভারতে নজরুল এবং নিষিদ্ধ শব্দটা প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে পৃথিবীব্যাপী হতাশা, মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পরিবেশে বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম যেন এক ধূমকেতুর নাম। রাজনীতি-সচেতনতা ও জনমূল-সংলগ্নতা নজরুলের কবি-চৈতন্যে এনেছিল নতুন মাত্রা। আর তাই বাঙালি পাঠককে সচকিত করে দিয়ে শাসকের আতঙ্ক হয়ে যে কবির আবির্ভাব হয়েছিল তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। পূর্ববর্তী কবিদের তুলনায় তার রাজনীতি-মনস্কতা অনেকটাই বেশি ছিল। নজরুল রাজনীতির সংস্পর্শে যে উদ্দীপ্ত হতেন, কিশোর বয়সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিতে চলে যাওয়া তার একটি প্রমাণ। 

নজরুলের দেশপ্রেম মুক্তির আকাঙ্ক্ষা বরাবরই তাকে নিষিদ্ধের দিকে ধাবিত করেছে। বেঙ্গলি ডবল কোম্পানিতে যোগদান করার ডাক নজরুল ইসলামের কানে পৌঁছেছিল সেটা তার কাছে ছিল দেশপ্রেমের আহ্বান। নইলে ক্লাসের প্রথম ছাত্র, সবাই যখন ভাবছিল পরীক্ষা দিলে সে স্কলারশিপ পাবে, সে কি কারণে সব ছেড়ে চলে গেল! তরুণ সৈনিকেরা প্রায়ই উদ্দাম স্বভাব নিয়ে ফিরে আসেন, আর সেখান থেকে নজরুল ফিরে এলেন দেশপ্রেমে ভরপুর হয়ে। করাচিতে তাদের ব্যারাকে যেকোনো রাজনৈতিক লেখাপত্র বা সাহিত্যের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। নিয়ম ছিল অত্যন্ত কঠোর, তবুও এই সব ব্যবস্থা নজরুলের কাছে হার মেনেছিল। সে এমন গোপন পথ খুলেছিল যে যার সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে নিষিদ্ধ পত্রপত্রিকা অবলীলাক্রমে প্রবেশ করত। সিডিশন কমিটির রিপোর্ট তাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল, কিন্তু জমাদার রায় সেই রিপোর্ট নজরুলের কাছে দেখেছিলেন। রুশ বিপ্লব সম্বন্ধেও নিষিদ্ধ সাহিত্য নজরুলের হাতে এসেছিল।

নজরুল যুদ্ধবিদ্যা শিখেছিলেন ভারতবর্ষে এক বিরাট সৈন্যবাহিনী গঠন করে, দেশ থেকে ইংরেজদের তাড়াবেন এই ছিল তাঁর বাসনা। তবে পল্টন থেকে ফিরে এসে সৈন্য বাহিনী গঠন করে দেশ স্বাধীন করতে না পারলেও তিনি তার কলমটি অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ‘নবযুগ’ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের তিনি গরম গরম সব প্রবন্ধ লিখতে লাগলেন। যে কারণে পরপর তিনবার সরকার পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশককে সতর্ক করেছিল। 

অসত্য অমঙ্গল অকল্যাণের গ্রাস থেকে তিনি মুক্ত করতে চেয়েছেন স্বদেশের মাটি আর মানুষকে। যুদ্ধোত্তর বিরুদ্ধ প্রতিবেশে দাঁড়িয়েও তিনি গেয়েছেন জীবনের জয়গান, উচ্চারণ করেছেন ঔপনিবেশিক শক্তির শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য বিদ্রোহের বাণী। নজরুলের রাজনৈতিক ভাবনায় যথেষ্ট অস্থিরতা ছিল। সে সময়ে তা অনেকেরই ছিল, কারণ সে সময় ১৯২০ থেকে ১৯৪০ এই দুই দশক অখণ্ড ভারতের রাজনীতিতে ছিল বহু ভাষার আবর্ত। অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদে আকৃষ্ট হয়ে পড়তেন। কংগ্রেসের রাজনীতি, সাম্যবাদের আদর্শ, সশস্ত্র বিপ্লববাদের লক্ষ্য এই তিনের প্রতিই বিভিন্ন সময়ে আকর্ষণ দেখা গেছে নজরুলের। 

১৯২০ সালের ৬ জানুয়ারি বিজলী পত্রিকায় প্রথম কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। কবিতাটি প্রকাশিত হওয়া মাত্রই ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে। ওই দিন বিজলী পত্রিকা দুবার ছাপতে হয়েছিল। যার সংখ্যা ছিল ২৯ হাজার। কমরেড মুজাফফর আহমেদের মতে, সেদিন কমপক্ষে দুই লাখ মানুষ কবিতাটি পড়েছিল। কবিতাটিতে দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালি মানসে ‘চির উন্নত মম শির’ হিসেবে বিরাজমান। বল বীর/ বল উন্নত মম শির/ শির নেহারি’ আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির/ বল বীর/ বল মহাবিশ্বের মহাকাল ফাঁড়ি/ চন্দ্র সূর্য গ্রহতারা ছাড়ি/ ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া/ খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া/ উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর! 

‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ১৯২২-এর ২২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ লেখার জন্য কারারুদ্ধ হন নজরুল। লিখেছিলেন, ‘দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি পূজা/ দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্তমাগে দশভুজা।’ ‘বিষের বাঁশী’তে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি উচ্চারণ করেছেন। বাজেয়াপ্ত হয়েছিল ‘বিষের বাঁশী’ (১৯২৪)। তা ছাড়া নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত হয়েছিল তার ‘ভাঙার গান’ (১৯২৪), প্রলয় শিখা (১৯৩১), চন্দ্রবিন্দু (১৯৩১)। প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘যুগবাণী’ (১৯২২), আর ‘দুর্দিনের যাত্রী’ (১৯২৬) বাজেয়াপ্ত হয়। কারারুদ্ধ হয়ে বিচারের সময় আদালতে দাঁড়িয়ে নির্ভয়ে যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন নজরুল, তাও এক জ্বলন্ত রাজনৈতিক কবিতা। শান্তিকামী মানুষের মাথার ওপরে ইংরেজ-শাসকদের দুঃশাসন, লুটপাট ও এ দেশেরই পদলেহী দালালরা অশান্তি ও রক্তের প্লাবন নামিয়ে দিয়েছিল যখন, সেই সময়ে ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বনকারী কবির কবিতায় উচ্চারিত হয়, ‘জাগো অনশন বন্দী ওঠ রে যত, জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত জাগো’। সর্বপ্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। ‘স্বরাজ টরাজ বুঝি না। কেননা এ কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশ বিদেশির অধীনে থাকবে না। প্রার্থনা বা আবেদন-নিবেদন করলে তারা শুনবে না, আমাদের এই প্রার্থনা করার ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে। এ কথা পরিষ্কার যে, শুধু স্বাধীনতা নয়, দরকার ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’। আর আবেদন-নিবেদনে এই পূর্ণ স্বাধীনতা মোটেই সম্ভব নয়। নজরুল একেবারে খাঁটি সত্যটা চাঁছাছোলা ভাষায় ঘোষণা করেছেন এখানে। 

‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতাটি তারই একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। এই কবিতায় বারবার উচ্চারিত হয়েছে ‘স্বরাজ’ শব্দটি কিছুটা ব্যঙ্গের ভঙ্গিতে লেখা হয়েছে “রবে না কো’ ম্যালেরিয়া মহামারী,/ স্বরাজ আসিছে চড়ে জুরি-গাড়ি, চাঁদা চাই, তারা ক্ষুধার অন্ন এনে দেয়, কাঁদে ছেলে-মেয়ে!/ মাতা কয়, ওরে চুপ হতভাগা, স্বরাজ আসে যে, দেখ চেয়ে!/ ক্ষুধাতুর শিশু চায়-না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন!/ বেলা বয়ে যায়, খায়নি কো বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন!/ কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়, স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়!... ” এই স্বরাজের অর্থ দেশের স্বাধীনতা নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গান্ধী বলেছিলেন এক বছরের মধ্যে এ দেশে স্বায়ত্তশাসন ও স্বরাজ এসে যাবে। এই বলে দেশের মানুষকে আশা দিয়েছিলেন এবং আন্দোলন বন্ধ রেখেছিলেন। ফলে বিরূপ হয়েছিল দেশবাসী।

নজরুলের রাজনৈতিক কবিতার আর একটি ক্ষেত্র হলো বিদ্রুপ ভঙ্গিতে লেখা ব্যঙ্গ-হাস্যমিশ্রিত রচনা। সেগুলো ‘চন্দ্রবিন্দু’ নামক সংকলনে একত্র করা হয় এবং প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সংকলনটি বাজেয়াপ্ত হয় ১৯৩১ সালে। এই সংকলনে আছে ‘

 ‘ডেমিনিয়ান স্ট্যাটাস’, ‘লিগ-অব নেশন’, ‘দে গরুর গা দুইয়ে’, ‘রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স’, ‘সাহেব ও মেমসাহেব’, আইমন কমিশনের রিপোর্ট : প্রথম ভাগ ‘ভারতের যাহা দেখিলেন’, এবং দ্বিতীয় ভাগ ‘ভারতের যাহা দেখাইলেন’, ‘প্রাথমিক শিক্ষা বিল’ প্রভৃতি।

চিত্তরঞ্জন দাস হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে মুসলমানদের জন্য অধিক কর্মসংস্থান সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে যে প্রস্তাব করেছিলেন, চিত্তরঞ্জনের অনুরাগী হওয়া সত্ত্বেও তা পছন্দ করতে পারেননি নজরুল। ‘চন্দ্রবিন্দুতে’ প্যাক্ট কবিতাটিতে তিনি লিখেছিলেন ‘বদনা গাড়ুতে গলাগলি করে, নব প্যাক্টের আশনাই,/মুসলমানের হাতে নাই ছুরি, হিন্দুর হাতে বাঁশ নাই।’ তার কবিতা শোষকের বিরুদ্ধে, জুলুমের প্রতিবাদে বন্দি, কারারুদ্ধ মজলুমের বা বিপ্লবীর শেকল ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ার এক দুর্দান্ত আহ্বান। দেশে দেশে বিপ্লবী, প্রতিবাদী, সংগ্রামী কবিদের কবিতা যখন আমরা পড়ি, এমনকি দেশের জন্য আত্ম-উৎসর্গকারী বা ফ্যাসিবাদের বলি হওয়া কবিদেরও আমরা যখন দেখি, তাদের সবার মধ্যে নজরুলের তুল্য এমন দ্রোহী, মুক্তিকামী কবি আর একজনকেও খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই তো বারে বারে তাঁর লেখা শাসকের কাছে ছিলো হুমকি। করা হয়েছে নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //