বিদ্রোহের হাত কখনো ছাড়তে নেই

হালদারপাড়া, জলখুরি, বাতিপোস্ট, ডাকঘর, বামুনপাড়া, মিঞা মহল্লা এরকম অজস্র নাম। গায়ে গায়ে লাগানো হিন্দু-মুসলিম অঞ্চল। বিপুল এই জনপদ কলকাতার মধ্যে আর এক কলকাতা। বড় বেশি জীবন্ত এসব জনপদের কথা সেভাবে কেউ বলে না। হয়তো জানেও না। কিম্বা জানতে চায়ও না। মেটেবুরুজ, আক্রা, নুঙ্গি, চটা, মহেশতলা চারপাশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে দর্জি শিল্পের ওপর। যে পাড়ার কথা বলছি তাদের এক চিলতে সরু রাস্তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। এ পাড়ার নাম জলখুরি। চারপাশে হিন্দু-মুসলমানের চমৎকার দীর্ঘ সহাবস্থান। এখানে যে কোনো বাসায় বসলেই শুনতে পাবেন পুরনো দিনের কথকতা। 

তখনো এসব এলাকা শহর হয়ে ওঠেনি। ফলে গল্পে ঘুরেফিরে আসে গ্রামীণ সব আখ্যান। আর আসে এক অত্যাশ্চর্য কাহিনী যা প্রবীণদের স্মৃতিতে আজও অম্লান। বছরের পর বছর ধরে লোক মুখে পল্লবিত হতে হতে এখন তা আঞ্চলিক এক রূপকথা হয়ে গেছে। পড়ন্ত বিকেলে জমাটবাঁধা ভিড়, গোপন কথা ফাঁস করার মতো গলায় বলতে লাগল- একদিন এই রাস্তা দিয়ে নজরুল ইসলাম হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলেন। একা। তখন তিনি খুব অসুস্থ। অসহায়। ভবঘুরের মতো ঘুরতে ঘুরতে কিভাবে যেন এসে পড়েছিলেন এই অখ্যাত জনপদে। কেউ বলেন, সম্ভবত কাছাকাছি কোথাও স্ত্রী প্রমিলাদেবীর মাসী থাকতেন। সেই বাসা খুঁজছিলেন উদভ্রান্ত কবি। কেউ বলেন বন্ধু থাকতেন। কোনটা আসল কারণ, ইতিহাস তা মনে রাখেনি। 

ইতিহাস অনেক কিছু মনে রাখে। আবার রাখেও না। তারা নজরুল ইসলামের খ্যাতি প্রতিভা মনে রেখেছে। নিয়ম মেনে নির্দিষ্ট দিনে পুঁথি দেখে তাই মহা আড়ম্বরে পালন করা হয় কবির জন্ম ও মৃত্যুদিবস। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সভায় উঁচু গলায় আমরা সুশীল ভদ্দর লোকেরা মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান পাঠ করি; কিন্তু যা বলি, তা বিশ্বাস করি না। আর যা বিশ্বাস করি, তা বলি না। ইতিহাস শুধু জানে নজরুল ইসলাম আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন চির বিদ্রোহী, যিনি আপনাকে ছাড়া আর কাউকেই কুর্নিশ করতে শেখেননি। 

আক্রার দর্জি মহল্লায় পড়ন্ত বিকেলে নজরুল চর্চা শুনতে শুনতে আমার কেমন মনে হলো নজরুল যেন হেঁটে যাচ্ছেন। সালটা সম্ভবত ১৯৪২-৪৩ হবে। অবিভক্ত বঙ্গ তখন রাজনৈতিক টানাপড়েনে দীর্ন। একদিকে চরম দুর্ভিক্ষ। সামান্য ফ্যানের জন্য লোকের দরজায় দরজায় মাথা কুটছে গরিব মানুষ। ফুটপাথে পড়ে অজস্র লাশ। মেয়েরা স্রেফ একমুঠো ভাতের জন্য বিক্রি হয়ে যাচ্ছে পশুর চেয়েও সস্তায়। অন্যদিকে কংগ্রেস ডাক দিয়েছে করেঙ্গ ইয়ে মরেঙ্গের। মেদিনীপুরে শহীদ হলেন মাতঙ্গিনী হাজরা। ডাক দিলেন ইংরেজ ভারত ছাড়ার। বঙ্গে তখন ফজলুল হক শ্যামাপ্রসাদ জুটির শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা ক্ষমতায়। কমিউনিস্ট পার্টির প্রত্যক্ষ মদদে চব্বিশ পরগনা, খুলনা রংপুর, দিনাজপুরে গড়ে উঠেছে নতুনধারার এক কৃষক আন্দোলনের। ইতিহাস যাকে মনে রেখেছে তে-ভাগা আধিয়ার সংগ্রাম বলে। 

চটা আক্রা নুঙ্গির গরিব মহল্লার অলিগলি দিয়ে ছুটে চলেছেন সাম্যবাদে বিশ্বাসী এক ঋজু মেরুদণ্ডের কবি। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি নতুন এক চিত্রকল্প। হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির বাংলা দিয়ে হেঁটে চলেছেন আদ্যন্ত অসাম্প্রদায়িক এক কবি। নজরুল ইসলামের হাঁটার কোনো শেষ নেই। অনেক অনেক কাজ তার বাকি। 

‘আমি সেই দিন হব শান্ত যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না। ’....

কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় খুব ছোটবেলায়। আমার নানার বাসার ঠিক উল্টোদিকে থাকতেন কবি। ছোট্ট সিআইটি ফ্ল্যাটের তিনতলায়। আমাদের ছাদ থেকে তাকালেই দেখতাম কবিকে। ওনার দুই নাতনি মিষ্টি ও খিলখিল দিদির বন্ধু ছিল বলে ওদের বাসায় যেতাম। গেলেই একবার পা টিপে টিপে নজরুল ইসলামের ঘরে যেতাম। ভয়ে ভয়ে। তখন এত ছোট যে, মনে হত ওই লোকটা যদি কামড়ে দেয়। অসুস্থ কবি আমাদের মতোন ছোটদের কাছে ওই লোকটিই ছিলেন। জন্মদিনে সকাল থেকে লোকে লোকে ঘর উপচে উঠত। কাজী সাহেবকে ভালো পাঞ্জাবি পরিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে ধবধবে সাদা চাদরের ওপর বসিয়ে রাখতেন বাড়ির লোকজন। গলায় বোধহয় ফুলের মালাও থাকত। লোকজন সবাই ফুল মিষ্টি ধুতি চাদর আরও কত রকমের উপহার আনতেন। লাইন করে তারা একে একে কবির হাতে সব তুলে দিতেন। 

কবির বাড়ির ছোটরা তা নিয়ে কোথাও গুছিয়ে রাখত। পাড়ায় সেদিন উৎসব উৎসব মেজাজ। এমন একনামি লোক পাড়ায় থাকেন গর্ব হবে না! তখনো কলকাতায় রকের আড্ডা জমজমাট। এন্টালিক্রিস্টোফার রোডের এই পাড়া এক মিনি ভারতবর্ষ। হিন্দু মুসলমান খ্রিষ্টান সব ধর্মের সহাবস্থান। বড়দিনের আগের রাত থেকে এখানে শুরু হয়ে যেত রঙিন কাগজের ফুল দিয়ে পুরো এলাকাকে রঙিন করে তোলা। ঈদের সকালে নতুন জামাকাপড় পরে পরস্পরকে কোলাকুলি করাও বেশ ভালো লাগত। হিন্দুদের দোল দুর্গোৎসবতো ছিলই। কাছেই রথবাড়ি। রথের দিন পেল্লায় রথ বের হতো সেখান থেকে। নজরুল জয়ন্তীও ছিল এখানে আর এক উৎসব। ভি আই পি গাড়ি এলেই পাড়ার ছেলেরা নিজেরাই আগ বাড়িয়ে ঠিক করে দিত কোনো গাড়ি কোথায় থাকবে। আমরা ছোটরা মুগ্ধ হয়ে দেখতাম সুবেশ নরনারী পরিপাটি সেজে মুখে এক চিলতে হাসি ও হাতে বড় গিফটের প্যাকেট নিয়ে নজরুল যে ডি ব্লকে থাকতেন, সেদিকে হনহনিয়ে হেঁটে যেতেন। কেউ কেউ আবার যাবার আগে পাড়ার ছেলেদের দিকে মুচকি হাসতেন। ওইটুকুই ছিল ছেলেদের বড় পাওয়া। এখনো, এতদিন বাদেও যেন সেই দেঁতো হাসি আর গায়ের ফুরফুরে সেন্টের সুবাস টের পাই, কবির জন্মদিন এলেই। 

কবি ভবনে (বাঁ থেকে) উমা কাজী, মিষ্টি কাজী, কাজী নজরুল ইসলাম, বাবুল কাজী ও খিলখিল কাজী

বিভিন্ন বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে মহিলারা তাকিয়ে থাকতেন নজরুলের ঘরের দিকে। আসলে দেখতে চাইতেন কোন বিশিষ্টজন এসেছেন। তখনতো আর টিভি চ্যানেলের উপদ্রব এত ছিল না। থাকলে লাইভ দেখাতে ওই ছোট্ট ঘরে তারাও নিশ্চয়ই গুঁতোগুতি করতেন। পর্দা একটু ফাঁক হলেই মহিলা মহল গর্জন করে উঠতেন চিন্ময় চিন্ময় বলে। কেউ আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলেন ওই তো ধীরেন বসু। চিন্ময় চট্টোপধ্যায়, ধীরেন বসু ছাড়াও আসতেন অনেক নামি অনামি সংগীতশিল্পীরা। রাজনৈতিক কোনো নেতা বা অভিনেতাদের কখনো দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। প্রায় প্রতি বছর নিয়ম করে সকাল সকাল ঠিক পৌঁছে যেতেন ড. অঞ্জলি মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবন্তী মজুমদার। শ্রাবন্তীর তখন দারুণ গ্ল্যামার। ওকে দেখলেই তরুণদের চাপা উল্লাস ওই ছোটবেলাতেও ঠিক টের পেতাম। 

আমাদের সেদিন ছুটি। কেউ পড়তে বসার কথাও বলতেন না। চলে যেতাম দাদুর ফ্ল্যাটে। তখনো তিনি ছোটদের কাছে কবি নন। শুধুই দাদু। এটুকু বুঝি যে উনি বিখ্যাত কেউ নিশ্চয়ই। না হলে জন্মদিনে এতএত লোক ফুলমালা নিয়ে আসে কেন! বড়রাও বলতেন উনি কাজী নজরুল ইসলাম। মস্ত কবি। এখন ভাবি উনি কি সত্যি সত্যি শুধুই মস্ত কবি ছিলেন? না গোটা অচলায়ত নাড়িয়ে দেবার এক শক্তিধর যোদ্ধা!

কাজী সাহেব চুপচাপ বসে থাকতেন। কোনো ভিড় একটুও ওঁকে স্পর্শ করত না। এখন হলে বলতাম, ‘ফুলেরও জলসয় নীরব কেন কবি’! চোখ দুটি; কিন্তু ছিল ভারি জীবন্ত। ভাসা ভাসা বড় চোখ দেখে মনে হত অসুস্থ কবি আচমকাই যেন কিছু বলে উঠবেন। এখন ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। মনের ভুল কিনা জানি না শুধু জন্মদিনে নয়, অন্যান্য দিনেও কাছে গেলেই নজরুল অন্য বাচ্চাদের দিকে সেভাবে ফিরেও তাকাতেন না; কিন্তু আমাকে কেমন হাতের ইশারায় কাছে ডাকতেন। হতে পারে এ আমার মনের ভুল বা অবচেতনের কষ্ট কল্পনা; কিন্তু এটা ঠিক যে আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো কোলের কাছে গিয়ে চুপটি করে বসে থাকতাম। নজরুল ইসলামের হাতের মুঠোয় ধরা থাকত আমার কচি হাত। দীর্ঘ সময় ধরে এভাবেই আমরা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু হতাম। অসম এই বন্ধুত্বে কখনো ছেদ হয়নি। সম্ভবত হবেও না। 

রাত বাড়তেই কাজী সাহেবের বাড়ি থেকে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজে পাড়া মাথায় উঠত। কেমন যেন ভয় ভয় লাগত। কে জানে বোধহয় বুড়ো অসুস্থ মানুষটার জন্য অজানা আশঙ্কায়। বললাম না হাতের ছোঁয়া আর চোখের চাহুনিতে আমরা বঊন্ধ হয়ে গেছিলাম। ঘরের ভেতরে চিৎকার ক্রমেই বাড়ছে। একা একা ছাদে উঠে জানলার ফাঁক দিয়ে বুড়ো মানুষটাকে এক পলক দেখতে চাইতাম। জোরে শব্দ করে জানলার সামান্য ফাঁকটুকুও কারা যেন বন্ধ করে দিল। পাড়ার ছেলেরা হৈহৈ করতে করতে ছুটে এলো। সিঁড়িভেঙে তাদের ওপরে যাবার আওয়াজ কানে আসতে না আসতেই তাদের নিচে নামার শব্দও শুনতে পলাম। প্রায় প্রতি জন্মদিনেই কোন এক অজ্ঞাত কারণে কাজী নজরুল ইসলামের পারিবারিক বিরোধ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যেত যা এখনো ভুলতে পারি না। তবু ভাগ্যি কবির সামনে ঘটলেও এসব কোনোকিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারত না। 

শৈশবের দিনগুলো কখন কোথায় যেন বড্ড তাড়াতাড়ি হারিয়ে গেল। সেই কাজি সাহেবের বাড়ি যাওয়া, হাতটা জড়িয়ে ধরে থাকা, জন্মদিনে নিয়ম করে ওঁকে প্রণাম করা, সব দ্রুত ঝাপসা হয়ে গেল। কলকাতা তখন অগ্নিগর্ভ। দেয়ালে দেয়ালে লেখা হচ্ছে সত্তর দশককে মুক্তির দশকে পরিণত কর। প্রতিটি হত্যার বদলা নাও। খুন বদলা এসব শব্দে ভারি হয়ে উঠেছে কলকাতার আকাশ। নানা টালমাটাল পরিস্থিতিতে কখন স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেলেন কাজী নজরুল ইসলাম। 

বড় হয়ে গেলাম। তখন একবার এন্টালি গিয়ে হঠাৎ একদিন ছাদে উঠে ‘দাদু’কে খুব দেখতে ইচ্ছে হলো। বুকের ভেতরটা কেমন খাঁ খাঁ করে উঠল। সব পাল্টে গেছে। উঁকি মেরে পাশের মুসলিম পাড়ার দিকে তাকালাম। আলো জ্বলছে, মমতাজদের বাসায়। কে জানে আছে কিনা। নাকি অন্য কেউ ও বাড়ির বাসিন্দা হয়েছে। এই ছাদ শৈশবের দিনগুলো মনে করিয়ে দিল। এই ছাদ থেকেই জীবনের প্রথম দাঙ্গা দেখেছিলাম। চারপাশে আগুন আর আগুন। মমতাজদের বাসায় কারা যেন আগুন ধরিয়ে দিল। ও ছিল আমার বঊন্ধ। নজরুল ইসলামের বাড়িও সুনসান। জানালাটা বন্ধ। ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল, আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে, ভাগ হয়নিকো নজরুল’... এর চেয়ে বড় মিথ্যে আর কিছু হয় না। নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ পরম যত্নে নজরুল ইসলামকে নিয়ে চলে গেছে। কাঁটাতার পেরিয়ে আমাদের সাধ্য কি তাঁর কাছে পৌঁছবার!

আমরা বলি বটে তিনি আমাদের ধর্ম নিরপেক্ষতার আইকন। যে কোনো দাঙ্গা বিরোধী মিছিলে মিটিংয়ে নিয়ম করে তাঁর কবিতা গান শোনানো একটা রেওয়াজ মাত্র। তাকে ছবি করে মালা পরিয়ে সাজিয়ে রেখেছি মাত্র। ভালোবাসিনি। বাসলে দেশভাগের পর ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গ এভাবে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের পথে হাঁটত না। ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ, আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানি তাগিদ’...প্রতিবার চাঁদ রাতে ভাঙর, দেগঙ্গা, হাড়োয়া যেতে যেতে মুগ্ধ হয়ে শুনি। ঝলমলে পোশাকে বাচ্চাদের মুখে চোখে এক স্বর্গীয় আভা। অনেক অনেক দিন পরে ছোটবেলাটা ফিরে ফিরে আসে নজরুল ইসলামের গানে। এবার লকডাউনের ঈদে বাড়ি বন্দি হয়ে নেটে নজরুলের ওই অতি জনপ্রিয় গান শুনতে শুনতেই অবাক হয়ে গেলাম। বাংলাদেশে কত কত শিল্পী কতভাবে গানটি গেয়েছেন। এ বঙ্গে শুধু একজন সতীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া আর কেউ গেয়েছেন বলে মনে হলো না। পরে খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে দেখলাম এ বাংলায় নজরুল ইসলামের সেই গানগুলোই জনপ্রিয় বা বিশিষ্ট জনগান, যাতে আরবি, ফার্সি বা ঊর্দুর প্রভাব কম। এ বঙ্গেও নজরুল একাডেমি আছে। কাজি সাহেবের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ও হয়েছে। জন্ম ও মৃত্যুদিনে ঘটা করে তা পালন করা হয়। তারা পীঠে বা তারকেশ্বরে পুজোদেবার নিষ্ঠায় শিল্পী সাহিত্যিকরা ছুটে যান চুরুলিয়ায়। যেখানে জন্মেছিলেন আদ্যন্ত অসাম্প্রদায়িক এককবি। যেখানকার মাটিতে শুয়ে আছেন কবি পত্নী প্রমীলা দেবী। তবু কোনো অত্যাশ্চর্য কারণে নজরুল ইসলামের বই বছরের পর বছর অবিক্রীত থেকে যায়। 

অথচ আজ এমন জটিল সময়ে নজরুল ইসলামকে আমাদের বড় দরকার। নজরুল ইসলামের মতো অসাম্প্রদায়িক খুব কম জন ছিলেন। কি তখন, কি এখনো, যিনি কর্মে ও যাপনে এক ছিলেন। দুই ছেলের নাম রেখেছিলেন সব্যসাচী ও অনিরুদ্ধ। ডাক নাম ছিল একজনের সান ইয়াৎ সেন ও অন্যজনের লেনিন। ১৯২১ সালের নভেম্বর মাসেই ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুজফফর আহমদের সঙ্গে মিলে নজরুল কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার কথা ভেবেছেন। মুজাফফর আহমদ আত্মজীবনীতে লিখছেন- ‘নজরুল আর আমি মিলে ঠিক করি কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার কাজে এগিয়ে যাব। পড়াশোনা করব বলে সামান্য কিছু পুথিপুস্তকও কিনেছিলাম। ’ এই সময় পার্টি তৈরির সিদ্ধান্তের পরের মাসেই নজরুল লিখলেন তার বিখ্যাত বিদ্রোহী কবিতা। 

ছাপা হয় ১৯২২ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। বিজলী সাপ্তাহিকে বের হবার সঙ্গে সঙ্গে কলকাতাজুড়ে শোরগোল পড়ে যায়। লাখ লাখ লোকের হাতে ঘুরতে থাকে কবিতাটা। কিছু দিন বাদে নতুন আর এক কবিতায় নজরুল কমিউনিস্ট পার্টিকে আরো স্পষ্টভাবে স্বাগত জানালেন। লিখলেন-বজ্র শিখার মশাল জ্বেলে আসছে ভয়ংকর- ওরে ওই আসছে ভয়ংকর...। 

তারও আগে ১৯১৯ সালে, রুশ বিপ্লবের মাত্র দু’বছর বাদে বলশেভিক সাফল্য আবেগাপ্লুত হয়ে করাচি থেকে পাঠানো ব্যথার দান গল্পে লিখলেন লাল ফৌজের কথা। গল্পের প্রধান দুই চরিত্র দারা ও সয়ফুল লাল ফৌজে যোগ দিয়েছিল। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় তা ছাপা হবার সময় আতঙ্কিত মুজাফফর আহমদ লাল ফৌজ কেটে মুক্তি সেবক সৈন্যদল বসিয়ে দেন। কারণ তিনি জানতেন, ব্রিটিশ-ভারতে লাল ফৌজ শব্দ ব্যবহার করলে নজরুলকে কেমন হেনস্তা করা হবে। 

এখন স্বাধীনতার এত বছর বাদে যখন আবার ভারতের কোনো কোনো রাজ্যে লেনিনের বই রাখার ‘অপরাধে’ পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করছে, তখন এই আদ্যন্ত বিপ্লবী নজরুলকে আড়াল করে রাখাও এক ধরনের অপরাধ। 

১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে জীবনের শেষ বক্তৃতায় নজরুল বলেছিলেন- ‘হিন্দু মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব, অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকার পাষান স্তূপের মতো জমা আছে। এই অসাম্য, এই ভেদাভেদ জ্ঞান দূর করতেই এসেছিলাম- আমার কাব্যে, সংগীতে, কর্মজীবনে অভেদসুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম’। এর পরপরেই রেডিওতে গল্প বলতে বলতে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অনেক ডাক্তার বদ্যিও তাকে সারাতে পারল না। ধীরে ধীরে তিনি সম্পূর্ণ নীরব হয়ে গেলেন। ওই ৪১-৪২ সাল থেকে নজরুলের এ বঙ্গ থেকে চির বিদায়, দীর্ঘ এ সময়ে উপমহাদেশের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। দেশভাগ, দাঙ্গা, কৃষক বিদ্রোহ, খরা-বন্যা-মহামারি। নজরুল সব কিছুর নীরব সাক্ষীমাত্র। তার সাম্যবাদ নিয়েও কত প্রশ্ন। এক এক সময় মনে হয় নজরুলের দীর্ঘ নীরবতাও হয়তো এক ধরনের প্রতিবাদ। শেষ ভাষণে নজরুল যা বলেছেন আজও তা চরম সত্যি। 

পাসপোর্ট ভিসা করে ইমিগ্রেশন জটিলতা মিটিয়ে অনেক অনেক বছর বাদে ঢাকায় এক যাই যাই সূর্যের আলোয় ফের একবার কবির মুখোমুখি। ভার্সিটির লাগোয়া কবরে চিরকালের মতো নীরবে শুয়ে আছেন মহাকবি। চোখের কোণ ভিজে যাচ্ছে। ছোটবেলার আমি কীভাবে যেন ফিরে এলো। এখন কোথাও কোনো শব্দ নেই। জনমানবশূন্য ঢাকায় কবি যেন মৃদু হেসে হাত দিয়ে ডাকছেন। ছোটবেলার মতোই কেমন ঘোরের মধ্যে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। যত যন্ত্রণাই হোক বিপ্লবের, বিদ্রোহের হাত কখনো ছাড়তে নেই।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //