রক্তাক্ত উপত্যকার চিঠি

মোস্তফা, তোর চিঠি পেয়েছি। তুই জানালি আমার স্যাকরামেন্তোতে থাকার সমস্ত বন্দোবস্ত তুই করে ফেলেছিস। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পেয়েছি, সেটাও জানলাম। তুই আমার জন্য যা করেছিস বন্ধু, তা ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করা যাবে না; কিন্তু এর মধ্যে যা ঘটে গেছে, তুই যদি তা শুনিস, আমি জানি তুইও আকাশ থেকে পড়বি। এখন আর কোনো দ্বিধা নেই, কোনো সংশয় নেই। আমি মন স্থির করে ফেলেছি, আমি যাব না। আমার আর বুঝতে বাকি নেই, আমি এখন আর যেতে চাই না। ‘সেই শ্যামল নিসর্গের প্রান্তরে, নীলাভ ঢেউয়ের সৈকতে, অপরূপ রূপসীদের দেশে,’ তুই যেমনটা লিখেছিস-আমি এখন আর যেতে চাই না। না, আমি আমার এই দেশ ছেড়ে, এই ফিলিস্তিন ছেড়ে কোত্থাও যাব না। আমি এখানেই থাকব। 

আমার কানে এখনো বাজছে, তুই চলে যাওয়ার সময়ে দুজন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। একযোগে চিৎকার করে দু’জন বলেছিলাম- ‘আমরা বড়লোক হব! বড়লোক!! কিন্তু বলতে কষ্ট হচ্ছে, এখন থেকে থেকে আলাদা হবে তোর আমার পথ। আমার কিছুই করার নেই রে বন্ধু। তুই চলে যাওয়ার দিন কায়রো বিমানবন্দরের একদম শেষ মুহূর্তটা এখনো আমার চোখের সামনে ভাসে। বিমানের পাখার তীব্র ঘূর্ণন, কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছিল। সেই মুহূর্তে আমার আশেপাশের সব কিছু থরথর করে কাঁপছিল, শুধু স্থির ছিল তোর নিরব বিষণ্ণ মুখটা।

তোর চিরচেনা মুখটা একটুও বদলায়নি। গাজায় শিয়া কোয়ার্টারে থাকা আমাদের ছোট বেলার দিনগুলোর মতো রয়ে গেছিস, এখনোও দেখতে। শুধু বয়েসের কয়েকটা ভাঁজ এসেছে মাত্র। তাছাড়া আর তো কিছুই বদলায়নি। আমরা একসঙ্গেই বড় হলাম, একে অন্যের মন পড়তে তিল পরিমাণ কসুর হয়নি কখনো। আমরা তো প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমরা একসঙ্গে পাড়ি দেব জীবনের সমস্ত পথ; কিন্তু ‘আর ১৫ মিনিট পর প্লেন উড়াল দেবে। এভাবে ক্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকিস না। যা বলছি মন দিয়ে শোন। তুই সামনের বছর কুয়েতে যাবি। ওখানকার বেতনের টাকাটা থেকে বছরখানেক জমাতে পারলেই কেল্লাফতে। গাজার সব কিছু পেছনে ফেলে তুইও ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে আসতে পারবি। আমরা আবার সবকিছু নতুনভাবে শুরু করব। একটা নির্ঝঞ্ঝাট জীবন হবে। গাজার এই রক্তপাত আর অনিশ্চয়তা থেকে অনেকদূর!’

ওই মুহূর্তে আমি শুধু তোর দুই ঠোঁটের ওঠানামা দেখছিলাম। তুই তো এরকমই ছিলি সবসময়, কথা বলতে শুরু করলে আর থামার নাম গন্ধও নেই। হড়বড় করে বলতে থাকিস, বলতেই থাকিস। কীভাবে যেন আমি টের পাচ্ছিলাম তোর সেই কথার তুবড়ির পেছনে, তোর সিরিয়াস সিরিয়াস ভাব আনা কপোট চেষ্টার মুখোশের পেছনে, ক্যামন যেন একটা অতৃপ্তি তোকে আঁকড়ে ছিল। প্লেনের পাখার তীব্র শব্দ ছাপিয়ে একটা নিঃশব্দ বিষাদ তোর চোখ ঠিকরে বের হচ্ছিল। তোকে একপর্যায়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম- ‘আমদের কেন গাজা ছেড়ে দিতে হবে, অন্তত তিনটা ন্যায়সঙ্গত কারণ বল,’ তুই আমতা আমতা করছিলি। এই কথা সেই কথা দিয়ে গোঁজামিল দেওয়ার চেষ্টা করলি; কিন্তু কোনো সদুত্তর দিতে পারলি না। তোর কথা ছিল একটাই কেন থাকব গাজাতে? কেন থাকব আমরা এই রক্তপাতের ভেতর? প্রতিটা মুহূর্তে কেন আমাদের মাথার উপর ঝুলতে থাকবে অনিশ্চয়তার খড়গ? তারপর কায়রো এয়ারপোর্ট থেকে একটা প্লেন তোকে পেটে পুরে নিয়ে উড়ে গেল একটা সচ্ছল, নির্ঝঞ্ঝাট জীবনে। 

কুয়েত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কন্ট্রাকের কাজটা তুই পেয়ে গেলি; কিন্তু আমার হলো না। সেই নিদারুণ হাহাকারের দিনগুলোতেও তুই আমাকে ছেড়ে যাসনি। সেই দুঃস্বপ্নের মতো অভাবের দিনগুলোয় প্রতি মাসে তোর আমাকে কিছু টাকা পাঠানো বন্ধ হয়নি। আমার পরিবারের নাড়িনক্ষত্র কিছুই তো তোর অজানা ছিল না। রিফিউজি স্কুলে মাস্টারি করে কয় টাকাই বা মাইনে পেতাম। সে কয় টাকায় যে এতগুলো মুখের সংসার চলতো না, তা তুই হাড়ে হাড়ে টের পেতিস। তুই আমাকে অনুগ্রহ করছিস, এই ভেবে আমি আবার বেঁকে না বসি। তা নিয়ে তুই ছিলি টান টান সজাগ।

‘আরে এগুলা তো ধার রে বেটা। তুই বড়লোক হয়ে গেলে তোর থেকে ফেরত নেব না মনে করেছিস? 

আপাতত একটু সামলে নে দোস্ত, বড়ির সবাইকে একটু আগলে রাখিস’

আমার বৃদ্ধা মা, বিধবা ভাবী তার চারটা বাচ্চা। এদের সবার জিম্মাদারি ছিল আমার কাঁধে। সেই কঠিন দায়িত্ব পালনে তুই আমার পাশে ছিলি পুরোটা সময়। কখনো ছেড়ে যাসনি।

‘ভাল করে শোন, তুই আমাকে প্রতিদিন লিখবি। প্রতি ঘন্টার, প্রতি মুহূর্তের সব কিছু জানিয়ে লিখবি। প্লেন এখন-ই টেক অফ করবে। আবার তো দেখা হচ্ছেই, তার আগ পর্যন্ত বিদায়।’

তখন আমার গালে আলতো ছুঁয়ে গেল তোর কাঁপা কাঁপা ঠোঁট। আমাকে পিছনে ফেলে তুই এগিয়ে গেলি পলায়নপর বিমানটার দিকে। শেষবারের মতো যখন পিছনে ফিরে তাকালি, তখন চিকচিক করছিল তোর চোখ।

তার কিছুদিন পর অবশ্য কুয়েত সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় আমাকে কন্ট্রাকের কাজটা দিলো। তোকে তো সবই লিখেছি, তুই তো সবই জানিস! কেমন যেন একটা শামুকের ভিতর আটকে গিয়েছিল জীবন। একটা ছোট্ট গণ্ডির ভিতর সবকিছু। ক্লান্তিকর, চিটচিটে আর একঘেয়েমিপূর্ণ। সময়গুলো একটা কালো গহ্বরের ভেতর হারিয়ে যাচ্ছিল। সব কিছুতে কেমন যেন শূন্যতা। রাত হলেই দমবন্ধ লাগতো, ভবিষ্যতের কথা মনে হলেই মনে হতো চোরা গলিতে আটকে গেছি। মনে হতো আমি অকূল দরিয়ায় ভাসছি, আর সব নৌকা দূরে সরে যাচ্ছে ক্রমশ। সারা মাসে প্রাণের অস্তিত্ব টের পাওয়া যেত কেবল মাস শেষের ছুটিতে। তৃষিত কাকের মতো সেইটুকুর জন্য পথ চেয়ে থাকতাম।

বছরের মাঝামাঝি সময়ে হানাদার ইসরায়েলি সৈন্যরা বোমা হামলা করলো সাবহা জেলায়, আর গাজায়। আমাদের গাজায়! আমাদের শহরে! বোমা আর ধোয়ায় ছেয়ে গেল আমাদের শহরের সব পথ ঘাট। সে ঘটনায় আমার প্রতিদিনকার যাপনে একটা ছেদ আসার কথা ছিল। তবে আমি তেমন গা করলাম না। আমি তখন এই সব কিছু ছেড়ে কালিফোর্নিয়ায় সৌভাগ্যের সাগরে ভেসে যাওয়ার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে রইলাম। সেখানে আমি নিজের মতো বাঁচবো। এই সব কিছুই পিছনে পড়ে থাকবে। আমাকে কিছুই স্পর্শ করতে পারবে না। এই বারংবার হামলা আর দুর্দশার জন্য গাজা আর তার সব কিছুকে ঘৃণা করা শুরু করলাম। সবার প্রতি আমার চরম বিতৃষ্ণা তৈরি হতে থাকল। 

ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাওয়া শহরটাকে, কোনো রুগ্ণ হাতে আঁকার চেষ্টায় ব্যর্থ একটা ধূসর ক্যানভাস মনে হতে লাগল। আমি ভাবছিলাম একবার এই মরার শহর থেকে পার পেয়ে নিই, আর কখনো আসব না। চলে যেতে পারলে আমার মা, বিধবা ভাবী আর এতিম বাচ্চাদের টাকার কমতি হবে না, তাদের আর অভাবের মুখ দেখতে হবে না; কিন্তু আমি ভাবছিলাম আমাকে এই মরার শহর থেকে পালাতে হবে। এই সাত বছরের বন্দি বাতাসের চেয়ে অনেক দূরে, ক্যালিফোর্নিয়ার শ্যামল বনে, উন্মুক্ত সৈকতে আমাকে নিতে হবে বুক ভরা নিঃশ্বাস। বাবা হারানো এই ফুটফুটে বাচ্চাগুলোর মায়া আমাকে এতদিন আটকে রেখেছিল এই অন্ধ কূয়ায়; কিন্তু তার অর্থ এই না যে, এই করুণ পরিণতি আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে অনন্তকাল। আমি ভাবছিলাম, আমাকে উড়ে যেতে হবে এই অন্ধকূয়া থেকে দূর, বহুদূর, যোজন যোজন দূর।

আর কেউ না বুঝুক তুই তো বুঝিস মোস্তফা! তোর পিছনে ফেলে যাওয়া গল্পটা কী এর চেয়ে কোনো অংশে আলাদা, বল? গাজা আমাদের জন্য কী রেখেছে যে আমরা এই ভূখন্ড আঁকড়ে ধরে লড়াই করব? কেন আমরা এই ভূখন্ড ছেড়ে, উৎখাতের গ্লানি পিছনে ফেলে, আরো নিরাপদ কোথাও চলে যাব না? শুধু একটুখানি বাঁচার জন্য? একটা নিরাপদ ভবিষ্যত কী আমাদের হৃদয়ের গভীরের ক্ষতকে, এই যে আমাদের ঘর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো, সেসব বেদনাকে ভুলিয়ে দিতে পারে না? কেন পারে না? 

জুনের ছুটিতে বাড়ি আসলাম। একটু একটু করে তল্পিতল্পা গুছিয়ে মনে মনে বিদায়ের প্রহর গুনছিলাম। মনের ভেতর অপেক্ষার মিষ্টি একটা সুর বাজছিল। মনে হচ্ছিল এইতো, আরেকটু। সুদিন এইতো কাছে আসলো বলে। নির্দয় ঢেউয়ের তোড়ে কাটফাটা রোদ আর তপ্ত বালিতে একটা শামুক যেমন নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলে খোলসের ভেতর, গাজায় এসে মনে হলো ঠিক তেমনিভাবে চারদিকে রক্তপিপাসু কসাই দ্বারা অবরুদ্ধ গাজা নিজেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে নিঃশ্চুপে। সমস্ত গাজা শহরকে নিশুতি রাতে দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি হয়ে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকা বালকের চেয়েও ভয়ার্ত লাগছিল। সব সরু গলি-ঘুপচি, মুখোমুখি দাঁড়ানো প্রশস্ত ব্যালকনি নিয়ে থমথমে দাঁড়িয়ে ছিল গাজা। আমাদের গাজা। 

বলতে পারিস কিসের টানে মানুষ পারিবারের কাছে ফিরে আসে? তার ঘরে?স্মৃতির সাতকাহনে? যেমন করে বসন্তের নতুন ঘাসেরা ভেড়ার পালকে টেনে নিয়ে যায় উপত্যকায়, যেমন করে বৃষ্টি ডেকে নিয়ে আসে ব্যাঙের ডাক, যেমন করে মোরগের ডাক নিয়ে আসে সাত সকাল। কখনো কী ভেবে দেখেছিস মোস্তফা কিসের টানে মানুষ ঘরে ফেরে? 

আমি জানি না। 

আমি শুধু জানি মায়ের সঙ্গে দেখা হবে কতদিন পর, এই ভাবতে ভাবতে কাক ডাকা ভোরে দরজায় কড়া নাড়ছিলাম। দরজা খুলে ভাবী আমাকে দেখে কয়েক মুহূর্ত পর হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ভাবীর কান্না দেখে আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাবী কোনো রকমে বলতে পারলেন ‘নাদিয়া..!!’ ‘হাসপাতালে!! ’ ভাবী আবার ফোঁপাতে শুরু করলেন। তোর নাদিয়ার কথা মনে আছে মোস্তফা? আমার ভাইয়ের তেরো বৎসরের ফুটফুটে বাচ্চাটা? 

সেদিন সন্ধ্যায় এক কেজি আপেল কিনে আমি নাদিয়াকে দেখতে হাসপাতালের দিকে রওনা দিলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম বড় ধরনের কোনো একটা অঘটন ঘটেছে, মা আর ভাবী আমাকে খোলসা করে কিছু বলেনি সারাদিনে। এমন ভারি কিছু একটা যা তাদের জিভ ঠেলে শব্দ হয়ে উঠে আসতে সাহস পারেনি। নাদিয়া ছোটবেলা থেকেই আমার ন্যাওটা। শুধু নাদিয়া না, নাদিয়ার মতো আরো যারা এই অবরুদ্ধ সময়ে জন্মেছে, বড় হয়েছে, তাদের সবার প্রতি আমার কেমন যেন একটা মায়া কাজ করে। ওদের কপালে শুধু পরাজয়, রক্তপাত আর উৎখাত হওয়াটাই জুটলো; কিন্তু জীবনের যে রূপ-রঙ, উল্লাস! পার্বণ! ওদেরকে আমরা সেসবের কিছুই দিতে পারিনি। জীবনের সৌষ্ঠব-নন্দনের সবকিছুই ওদের অজানা রয়ে গেল! এটা মনে হলেই আমার কেমন যেন কুন্ঠাবোধ হয়। ওদের জন্য পরাণ পোড়ে! 

তারপর কী হলো? আমি জানি না, কিচ্ছু জানি না। আমি একটা শান্ত সাদা ঘরে ঢুকলাম। অসুস্থ বাচ্চাটার চোখে মুখে এক সুগভীর সৌম্য নিরবতা, এক আশ্চর্য পবিত্র আভা বিরাজ করছিল! কতটা নিষ্ঠুর আঘাত একটা নিষ্পাপ বাচ্চাকে এতটা স্থির আর স্থবির করে দিতে পারে! 

নাদিয়া বিছানায় হেলান দেওয়া, ওর পিঠে একটা বড়সড় বালিশ দিয়ে ঠেক দেওয়া। ওর সব চুল আলুথালু হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। এক সুতীব্র আর্তনাদ ওর নিশ্চুপ চোখ ঠিকরে বের হচ্ছিল। ওর কাজল কালো চোখের মণি চিকচিক করছিল অব্যক্ত হাহাকারে; কিন্তু মুখটা একদম স্থির, নিশ্চল। যেন আঘাতে আঘাতে জর্জরিত কোনো পয়গম্বরের অচঞ্চল মুখশ্রী! একটা শিশু মাত্র; কিন্তু এই ফুটফুটে শিশুর মুখে যেন ভর করেছে শতাব্দী প্রাচীন বোধিবৃক্ষের নীরবতা।

‘নাদিয়া!’ আমিই ডাকলাম না পেছন থেকে অন্য কেউ ডাকলো আমার খেয়াল নেই। ও চোখ তুলে আমার দিকে তাকাতেই আমি গলে গেলাম গরম চায়ে ফেলা চিনির দানার মতোন। আমার সমস্ত অস্তিত্বে স্নেহ ছড়িয়ে যেতে লাগলো চৈতালী বাতাসের শিমুল তুলার মতো।

ঠোঁটের কোণে ঈষৎ বাঁকা খুশি ফুটিয়ে ও জিজ্ঞেস করলো ‘কাকু! কুয়েত থেকে তুমি কখন এসেছো?’

ওর গলায় হুট করে কথা থেমে এলো। হাতের সাহায্যে একটু একটু সোজা হয়ে আমার দিকে একটু ঝুঁকে বসার চেষ্টা করলো। ওর পিঠে বালিশটা ঠিকমতো গুঁজে দিয়ে আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম। 

‘নাদিয়া আমি কুয়েত থেকে তোমার জন্য অনেক উপহার এনেছি। তুমি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে বাড়ি আসলে, সবকিছু তোমাকে একসঙ্গে দেব। তড়িঘড়ি করে সেরে ওঠো তো মামণি। তুমি চিঠিতে লাল ট্রাউজারের কথা লিখেছিলে না? তোমার জন্য লাল ট্রাউজারও এনেছি।’

পরিস্থিতির চাপে পড়ে মিথ্যা বলে ফেললাম; কিন্তু যখন বলা শুরু করলাম, আর থামলাম না। শুধু শুধু বাচ্চাটার মন ভাঙতে ইচ্ছা করলো না। এমনভাবে বললাম, যে সেসব কথা আমি নিজেই বিশ্বাস করতে শুরু করলাম খানিকক্ষণ পর। 

কিন্তু একি! আমার কথা শুনে আকস্মিকভাবে নাদিয়া হকচকিয়ে গেল কেন? ও মাথা নিচু করে ফেললো! একটা বিকট নিরবতা যেন গ্রাস করলো সমস্ত কিছুকে। খানিকক্ষণ পর আমার হাতের পিঠে টপটপ করে নাদিয়ার চোখের পানির উষ্ণ ধারা গড়াতে শুরু করলো। ফুটফুটে বাচ্চাটা অঝোর ধারায় অশ্রু গড়াতে লাগলো ক্রমাগত। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না তখনো। 

আমি বোকার মত ওকে জিজ্ঞেস করলাম- ‘কী হলো নাদিয়া, কিছু তো বলো? লাল ট্রাউজারের কথা শুনে তুমি খুশি হওনি?’ আহত হরিণীর দৃষ্টি নিয়ে ও আমার দিকে মুখ তুললো। যেন কিছু বলতে চায়; কিন্তু মনে হলো পৃথিবীর সমস্ত কথা ওর দুই সারি দাঁতের কপাটের ভেতর আঁটকে গেছে। 

তারপর আমার কানে ওর কন্ঠস্বর এসে পৌঁছালো, বহুদূর দেশের কোনো দ্বীপের থেকে ভেসে আসা ক্ষীয়মান শোকগাঁথার মতো... 

‘কাকু!’

ও হাত বাড়িয়ে ওর গায়ের ওপর থেকে সাদা চাদরটা সরাল। তর্জনি উঁচিয়ে ওর পা বরাবর নির্দেশ করলো, উরুর গোড়া থেকে কেটে ফেলা। সেখানে কিচ্ছু নেই! 

বন্ধু, নাদিয়ার পায়ের কথা আমি কীভাবে ভুলবো, বলতে পারিস? উরুর একদম গোড়া থেকে নিচের সব কেটে ফেলে দেওয়া। না আমি ভুলতে পারবো না। আমি ভুলতে পারবো না তীব্র যন্ত্রণায় নীলচে হয়ে যাওয়া ওর মুখ ঠিকরে ঠিকরে বের হওয়া গাঁঢ় বিষাদ। 

আমি হাসপাতাল থেকে ছুটে বের হলাম। নাদিয়ার জন্য বয়ে নিয়ে যাওয়া এক কেজি আপেল আমার হাতেই রইলো। গোধূলির সূর্যটা যেন সব পথ ঘাটের উপর রক্ত ছড়িয়ে দিচ্ছিল। আমার গায়ের প্রতিটি রক্ত কণা, প্রতিটি কোষ টগবগ করে ফুটছিল। সেই আলোয়, বিশ্বাস কর মোস্তফা সেই আলোয় আমি নতুন এক গাজা দেখতে পেলাম। এই গাজা তুই-আমি আগে কক্ষণো দেখিনি। শিয়া কোয়ার্টারের মুখে পাথরের স্তুপের প্রতিরোধ। সেই শিয়া কোয়ার্টার যেখানে একসময় তুই আমি জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছিলাম। যেখান থেকে হানাদারেরা আমাদেরকে একদিন গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিল; কিন্তু কেন? এই জবাবটা তাদের দিতেই হবে মোস্তফা। সেই দিনের-সেই আবির রাঙা আলোতে আমি এক নতুন ফিলিস্তিনের মুখোমুখি হয়েছি মোস্তফা। যে গাজায় আমরা একসময় বাস করতাম, যে গাজায় আমরা সাত সাতটা বছর অবরুদ্ধ হয়ে কাটালাম। এই গাজা তার চাইতেও বিশাল কিছু, অন্য কিছু। সেই বিকালের ফিলিস্তিন অন্য এক ফিলিস্তিন। 

মনে হলো নতুন একটা যুগের শুরু। আমি টের পেলাম যে রাস্তা দিয়ে সেদিন বাড়ির পথে হাঁটা ধরলাম, সেটা বহুদূরের পথের কেবল শুরু। সে পথ অনেক লম্বা, সাফাদ পর্যন্ত বিস্তৃত। সেদিনের পর থেকে এই গাজা কেবল অত্যাচারের ভয়ে থরথর, কেবল শোকে বিহবল নয়। এই গাজা প্রতিরোধের গাজা। এই গাজা একটা কেঁটে নেওয়া পা ফেরত চাইতে এসেছে। 

রোদের তীব্র আলোয় চোখ জ্বালা করছিল। রাস্তায় এসে লোকমুখে জানতে পেলাম বোমার আঘাত আর আগুনের লেলিহান শিখার হাত থেকে ছোট ভাই বোনদের বাঁচাতেই নাদিয়া ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দাঁতে দাঁত চেপে নিজে শরীর পেতে দিয়ে বর্ম হয়ে ওদেরকে রক্ষা করেছে। নাদিয়া চাইলে ও পা-টা বাঁচাতে পারতো; কিন্তু তা না করে ভাই বোনদের বাঁচাতে ‘ও’ ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

কিন্তু কেন? 

না বন্ধু না, আমি স্যাকরামেন্তোতে আসবো না। এবং এতে আমার কোনো আফসোস থাকবে না। এবং আমরা ছোটবেলায় একসঙ্গে যে স্বপ্ন দেখেছিলাম তাও শেষ করবো না। গাজা ছেড়ে যাওয়ার সময় বুকের মধ্যে অস্বস্তি আর বিরক্তির যে বীজ তুই বয়ে নিয়ে গিয়েছিস, সেটা হয়তো সবুজ প্রন্তরের খোলা বাতাস আর নীলাভ সাগরের ঢেউ পেয়ে তোর ভিতরে ভিতরে একটা মহীরুহর আকার ধারণ করেছে; কিন্তু তোর অস্তিত্ব জুড়ে বেড়ে ওঠা এই পরগাছার সুবিশাল মহীরুহর ভীড়ে তোর নিজের সত্তাকে খুঁজে পেতে হলে, এইসব বদখত ধ্বংসস্তূপ আর পরাজিততের মধ্যে তোকে ফিরে আসতেই হবে। সব আগাছা উপড়ে ফেলে। 

আমি তোর কাছে আসবো না; কিন্তু তোকে ফিরে আসতেই হবে। আমাদের চোখের সামনে ফিরে আসতে হবে, আমাদের আলিঙ্গনে ফিরে আসতে হবে। নাদিয়ার উরুর গোড়া থেকে বিসর্জন দেওয়া পা-টা থেকে শিক্ষা নিয়ে ফিরে আয়। নাদিয়ার কেটে ফেলা পা-টা ফেরত নেওয়ার দাবি নিয়ে ফিরে আয়। না হলে এই জীবন আর অস্তিত্বের কী দাম? আর কিইবা তার মানে?

তুই ফিরে আয় বন্ধু! আমরা সবাই তোর পথ চেয়ে আছি।

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের অন্যতম প্রধান আরব্য উপন্যাসিক ও প্রগতিবাদী নাট্যকার ঘাসান ফায়িজ কানাফানি ফিলিস্তিনের আক্কা শহরে এক মধ্যবিত্ত সুন্নি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন ঘাসান কানাফানি। ড্যানিশ নাগরিক অ্যানি হুভারের সঙ্গে কানাফানির বিবাহ হয়েছিল। জাফার একটি ফরাসি ক্যাথলিক মিশনারি স্কুলে কানাফানি তার প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। ১৯৪৮ সালে যখন আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধ শুরু হয় এবং তা আক্কাতেও ছড়িয়ে পড়ে, তখন মাত্র বারো বছর বয়সে কানাফানি ও তার পরিবারকে জাফা ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। তিনি ১৯৫৭ সালে আল রাইর সম্পাদক হন এবং সেই বছরই তার প্রথম গল্প ‘এ নিউ সান’ প্রকাশিত হয়। তিনি ছোট গল্প, উপন্যাস এবং নাটক পাশাপাশি সাংবাদিকতা সংক্রান্ত নিবন্ধ এবং বিশ্লেষণমূলক লেখা লিখেছেন। তার রচনা ১৬টি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি একজন প্রতিভাবান চিত্রশিল্পীও ছিলেন। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ১৯৭২ সালের ৮ জুলাই বৈরুতে কানাফানিকে হত্যা করা হয়। ইসরায়েলের প্রধান ও জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ শেষ পর্যন্ত এই হত্যাকা-ের দায় স্বীকার করে। লেবাননের দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকা কানাফানির মৃত্যু সংবাদে লিখেছিল, ‘তিনি এমন যোদ্ধা ছিলেন যে, কখনো বন্দুক চালাতেন না, যার অস্ত্র ছিল বল-পয়েন্ট কলম, এবং তার রণক্ষেত্র ছিল তার পত্রিকার পাতাগুলো।’ ঘর ছাড়া দেশ ছাড়া হবার পরও ফিলিস্তিনের জন্যই তিনি তার শেষবিন্দু রক্ত দিয়েই লিখে গিয়েছেন ‘আমি ফিলিস্তিনের সন্তান’। তার ‘এ লেটার ফ্রম গাঁজা’ গল্পটি ১৯৫৬ সালে রচিত হয়।


ভাষান্তর : আহসান মুন্না

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //