নিস্তব্ধ, নরক-বসন্ত

ডিডিটি বা ডাইক্লোরো ডাইফেনাইল ট্রাইক্লোরোইথেন একটি রাসায়নিক কীটনাশক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, কীটপতঙ্গ আর ম্যালেরিয়া দমনে বিস্তীর্ণ ফসলি মাঠ, বনভূমি, জলাভূমি ও লোকালয় সংলগ্ন এলাকার উপর বিমানযোগে স্প্রে করা হয়েছিল এই ডিডিটি। সেই রাসায়নিক বিষে জীর্ণ হয়ে মরে গেল গাছেরা, ঝরল পাতারা। সেই পাতায় থাকা বিষে, বিষাক্ত হলো নিচের মাটি।

মাটির উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা কীট-পতঙ্গের গায়ে ছড়িয়ে গেল সেই বিষ। যে পাখির দল সেই কীট খেয়ে বেঁচে পেট ভরছিল, সেই পাখির দলও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মরে যেতে লাগল। কাতর হয়ে ডানা ঝাপটানো বন্ধ করে একে একে ঝরে পড়তে লাগল তাদের নিথর নীরব দেহ। সেই সব বিস্তীর্ণ বন আর মাঠের উপর। পাখির দলের মধুর কলতানে মুখরিত থাকত যে বসন্ত, সেই বসন্ত হয়ে পড়ল নীরব, নরকের মতো নীরব। 

র‌্যাচেল কারসনের মৃত্যুর পর পরিবেশ রক্ষার অন্দোলন একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ নিয়ে সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। তার বই সাইলেন্ট স্প্রিং-এর যে পরিমাণ সরব প্রভাব তৈরি হয় তার ফলস্বরূপ ১৯৭০ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রশাসন মার্কিন পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা সৃষ্টি করে। প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার তাকে মরণোত্তর রাষ্ট্রপতি স্বাধীনতা পদক প্রদান করেন

সেই নারকীয় নিস্তব্ধতা নিয়ে বিজ্ঞানী-বুদ্ধিজীবী মহলে তেমন কোনো সাড়া শব্দ নেই। উল্টো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ী সোল্লসিত মার্কিন প্রশাসন তাদের করা হিরোশিমা নাগাসাকি হামলার নামের আদলেইজ্জবিমানযোগে মাকড় দমনের এই কর্মসূচির নাম দিয়েছিল ইনসেক্ট বোম্বিং। লক্ষ্য ছিল বিমান থেকে ডিডিটির স্প্রে দাগিয়ে নাস্তানাবুদ করে দেওয়া হবে সব কীটপতঙ্গ। কাছাকাছি সময়ে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ থেকে সৈনিক ও জনসাধারণকে বাঁচাতে অনেকটা বাধ্যতামূলকভাবে মানবদেহেও স্প্রে করা হচ্ছিল ডিডিটি। শরীরে, চুলে, এমনকি জামার ভেতরেও। সেই সময় ডিডিটির জয়জয়কারে মুখরিত মার্কিন মুল্লুক ও সেখানকার গণমাধ্যম। অথচ ক্যানবেরিসহ অনেক ফল আর সবজিতে ছেয়ে গেছে ডিডিটির বিষ। সেই সময়ে অ্যাডভান্সড ক্যান্সার রিসার্চ ল্যাবে কয়েকজন বিজ্ঞানী অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যে হতবাক হয়ে গেলেন। ডিডিটির বিষ মানবদেহ ও প্রাণীর শরীরে নিশ্চিতভাবে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান! 

কিন্তু সেই গবেষণার ফল আটকে রইল সরকারি ফাইলের লাল ফিতায়। সেই সব গবেষণালব্ধ ফল সেই ক্ষুদ্র বিজ্ঞানী মহলের চৌহদ্দির সীমা পেরিয়ে কোনোভাবেই আসতে পারেনি জনসাধারণের সচেতনতার সীমায়। কারণ বড় বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠী ডিডিটি জাত কীটনাশকে বিনিয়োগ করে ফেলেছে অজস্র সম্পদ। আর সেই যাত্রার সঙ্গে তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন কদমে কদম ফেলে প্রচার করে গেছে রাসায়নিক কীটনাশকের স্তুতিগাথা। রাসায়নিক কীটনাশক ও সারনির্ভর কৃষি-বিপ্লব এবং তার হাত ধরে আসা অর্থনৈতিক সুদিনের হাতছানি। সেসব সুবিশাল কর্মযজ্ঞের যে মাত্রায় প্রচার ও প্রচারণা করা হয়েছিল, তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে কিছু বলা, তার বিরুদ্ধে কোনো প্রশ্ন তোলা যেন বিরাট ধৃষ্টতা। অনেকটা খুব প্রতিষ্ঠিত কোনো কিছুকে অপবাদ দিয়ে শিরোনামে আসার অপচেষ্টার মতো। 

কিন্তু সেই স্রোতের বিপরীতে কেউ একজন এসে দাঁড়ালেন, অকুতোভয় আর অসম্ভব সংবেদনশীল কেউ একজন। দায়িত্বশীল হাতে ধরলেন কলম, লিখলেন সেই নিথর হয়ে যাওয়া পাখিগুলোর শোকে, নিস্তব্ধ বসন্তের আর্তনাদে। বিখ্যাত আমেরিকান লেখিকা, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় অতন্দ্র সৈনিক র‌্যাচেল লুইস কারসন লিখলেন তার অমর বই ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ বা ‘নিস্তব্ধ-নরক বসন্ত’। 

৩০ জুন ১৯৬২-তে প্রথম প্রকাশিত হওয়া এই ৩৬৮ পৃষ্ঠার প্রবন্ধমূলক বইটি সাড়া জাগালো অভূতপূর্ব। তথ্য-প্রমাণনির্ভর এই বইটিকে পরিবেশবাদী অন্দোলনের সর্বাধিক প্রভাবশালী ও সর্বপ্রথম বই হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যা পরবর্তী সময়ে শত শত কোটি মানুষের মধ্যে জীব-বৈচিত্র্য ও প্রকৃতির প্রতি মানুষের সংবেদনশীলতা জাগ্রত করতে, রাসায়নিক দূষণের প্রতি সচেতনতা সৃষ্টিতে অকাট্য দলিল হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে, আজকের দিন পর্যন্ত। আধুনিক জীবনে রাসায়নিকের ক্ষয়ক্ষতি আর তার বিপরীতে মানুষের যে পরিবেশবাদী বোধ, সচেতনতা, আন্দোলন; এই সব নিয়ে সমগ্র পৃথিবীতে যে চেতনাগত পটপরিবর্তন দেখা যায়, সেসবের কথা বলতে গেলে, সবার শুরুতে আসে সাইলেন্ট স্প্রিং তথা র‌্যাচেল কারসনের নাম।

পেনসিলভানিয়ার স্প্রিং ডেল নামক গ্রামে, পারিবারিক খামার বাড়িতে ১৯০৭ সালের ২৭ মে, র‌্যাচেলের জন্ম। প্রচুর বই আর নৈসর্গিক গ্রামীণ পরিবেশে কাটে তার শৈশব। তাদের খামার বাড়িটি আকারে ছিল ৬৫ একরের মতো। তার মধ্যেই সারাদিন চষে বেড়াতেন, র‌্যাচেলের শিশু মনে তৈরি হতো হরেক রকমের গল্প। ভাঙা ভাঙা অক্ষরে শিশু র‌্যাচেল প্রথম গল্প লেখেন ৮ বছর বয়সে। ১০ বছর বয়সেই তার প্রথম লেখা ছাপা হয় আমেরিকার বিখ্যাত শিশুপত্রিকা সেইন্ট নিকোলাস ম্যাগাজিনে। তিনি নিজেও তখন নিকোলাস ম্যাগাজিনের একনিষ্ঠ পাঠিকা। প্রচুর শিশু সাহিত্যের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে র‌্যাচেলের। যাদের কাজ তার মননে প্রবল ছাপ ফেলে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন; বেট্রিক্স পটার, জিন স্ট্রেট্টন পর্টার, হারম্যান মেলভিল, রবার্ট লুই স্টিভেনসন্স। বেট্রিক্স পটার হলেন ইংরেজ লেখিকা, পরিবেশ বিজ্ঞানী, বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে প্রকৃতিরক্ষায় একজন জাগ্রত কণ্ঠস্বর। অন্যদিকে জিন স্ট্রেট্টন একজন আমেরিকান লেখিকা, প্রকৃতিবাদী আলোকচিত্রী, যার লেখা ও ছবিতে ফুটে উঠত প্রকৃতির প্রতি সচেতন হওয়ার তীব্র আহ্বান। এ সবের সঙ্গে পরিচয় র‌্যাচেলের পরবর্তী জীবন ও ব্যক্তিত্বের ভিত রচনা করে দেয়। 

১৯২৫ সালে র‌্যাচেল তার ক্লাসের ২৫ শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে তার হাইস্কুল শেষ করেন। স্কুলে পড়াকাল থেকেই র‌্যাচেল সংবাদপত্রে নিয়মিত লেখা দিতে থাকেন। যা তার জীবনের শেষ পর্যন্ত চলতে থাকে। হাইস্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি পেনসিলভানিয়া কলেজ অব উইম্যানে প্রথমে ইংরেজি ভাষা শিক্ষায় পড়াশোনা শুরু করেন। পরবর্তীকালে তা পরিবর্তন করে জীববিজ্ঞানে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯২৯ থেকে তিনি জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক জীববিজ্ঞান গবেষণাগারে জীববিজ্ঞান ও জেনেটিক্স নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যান এবং ১৯৩২ সালে সেখান থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর তিনি পিএইচডি গবেষণায়ও যুক্ত হয়েছিলেন; কিন্তু তখন আমেরিকার অর্থনীতি ইতিহাসের ভয়াবহতম মন্দায় জর্জরিত। সেই পরিস্থিতিতে ১৯৩৪ সালে র‌্যাচেলকে পরিবারের হাল ধরতে জীবিকার জন্য যোগ দিতে হয় চাকরিতে। তাই ছাড়তে হয় জন হপকিন্সের আঙিনা, সঙ্গে পিএইচডি ডিগ্রিটাও। তার পরের বছর তার বাবা মারা যান, তারপর থেকে পরিবারের দেখ-ভালের পুরোটাই র‌্যাচেলের কাঁধে। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মৎস্য সম্পদ অধিপ্তরের প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগ, তাদের কার্যক্রমকে জনগণের কাছে পরিচিত ও জনপ্রিয় করতে একটা রেডিও প্রোগ্রাম পরিচালনা করত। প্রোগ্রামটির নাম ছিল ‘রোমান্স আন্ডার দি সি’। সেই অনুষ্ঠানটির ধারাভাষ্য লেখার জন্য পরপর দুজন লেখকের ব্যর্থতার পর ৩য় ব্যক্তি হিসেবে র‌্যাচেল দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এই চাকরিটি ছিল অস্থায়ী। র‌্যাচেলের গবেষণা ও লেখনী তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অসম্ভব মুগ্ধ করল। তাই তিনি র‌্যাচেলকে মৎস্য-সম্পদ অধিদপ্তরের পরিচিতিমূলক পুস্তক রচনার দায়িত্ব দেন। এর মধ্যে র‌্যাচেল ‘রোমান্স আন্ডার দি সি’-এর জন্য লেখাগুলোকে আরও একটু ঘষেমেজে পরিবর্ধিত করে স্থানীয় ম্যাগাজিন ও পত্রিকাগুলোতে পাঠাতে থাকেন, যা নিয়মিতভাবে ছাপা হতে থাকে। র‌্যাচেল মৎস্য অধিদপ্তরের গবেষকদের প্রাপ্ত ফলগুলো নিরীক্ষা করতে থাকেন। সেখান থেকে জনসাধারণের জন্য সংবাদপত্রগুলোতে সমুদ্রের তলদেশের বর্ণিল জগৎ নিয়ে নিয়মিত নিবন্ধ লিখতে থাকেন। ‘ওয়ার্ল্ড অব ওয়াটার’ নামে অধিদপ্তরের পুস্তিকাটি বের হলে, সুখপাঠ্য হিসেবে খুবই প্রশংসিত হয়। যার একটি পরিবর্ধিত সংস্করণ ‘আন্ডার সি’ নামে ১৯৩৭ সালে মাসিক আটলান্টিক ম্যাগাজিনে বের হয়। সেটি পাঠক সমাদৃত হলে সমুদ্রের তলদেশের বিশদ বর্ণনা দিয়ে র‌্যাচেল প্রবন্ধটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ বই লিখতে মনস্থির করেন। একই বছর দুই সন্তানকে রেখে র‌্যাচেলের বোনও মারা যান। তাদের দেখা-শোনার দায়িত্বও র‌্যাচেলকে নিতে হয়।

১৯৪১ সালে র‌্যাচেলের প্রথম বই ‘আন্ডার দ্য সি ওইন্ড’ বের হয়। বিভিন্ন মহলে বইটি ব্যাপকভাবে সমাদৃত হলেও তেমন বিক্রি হয়নি; কিন্তু এই বইটি র‌্যাচেলের লেখালেখিতে গুরুত্বপূর্ণ মোড় এনে দেয়। সেই সময়টায় র‌্যাচেল ব্যাপকহারে ডিডিটি স্প্রে করার ফলে এর ঝুঁকির ব্যাপারটা লক্ষ করেন। তা নিয়ে নিজের মতো করে তথ্য সংগ্রহ ও পড়াশোনা করতে থাকেন, তবে এ নিয়ে কোথাও কোনো লেখা প্রকাশ করেননি। 

চল্লিশের দশকের প্রায় পুরোটা সময় র‌্যাচেল মৎস্য অধিদপ্তরের প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগে নিরলস কাজ করে যান। সেই সুবাদে প্রচুর নতুন বিষয়বস্তু আর গবেষণা লব্ধ ফলের সঙ্গে তিনি পরিচিত হতে থাকেন। সমুদ্রের জীব-বৈচিত্র্য নিয়ে জানাশোনা আরও প্রখর হতে থাকে। ১৯৪৯ সালে তিনি সেই বিভাগের মুখ্য সম্পাদক হিসেবে স্থলাভিসিক্ত হন।

১৯৫০ সমুদ্রের তলদেশ ও সেখানকার জীবনের বিকাশের ইতিহাস নিয়ে র‌্যাচেল তার প্রথম বইয়ের সিরিজ হিসেবে তার ২য় বই ‘সি অ্যারাউন্ড আস’ লেখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেই বইয়ের প্রস্তাবনা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসকে জানালে তারা বইটি ছাপাতে আগ্রহ প্রকাশ করে। র‌্যাচেল লেখায় হাত দেন। সায়েন্স ডাইজেস্ট, দ্য ইয়েল রিভিউসহ স্বনামধন্য সব ম্যাগাজিনে প্রবন্ধ আকারে ‘সি অ্যারাউন্ড আস’-এর একেকটি অধ্যায় ছাপা হতে থাকে। বই ছাপানোর আগেই ‘বার্থ অব অ্যান আইল্যান্ড’ অধ্যায়টি সে বছরের সেরা বিজ্ঞান রচনা হিসেবে জর্জ ওয়েস্টিন হাউস পদক লাভ করে। দ্য নিউইয়র্কারে ধারাবাহিকভাবে নয়টি অধ্যায় ছাপা হয়। 

সি অ্যারাউন্ড আস ২ জুলাই ১৯৫১ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়; যা র‌্যাচেল কারসনের ক্যারিয়ারে অভাবনীয় সাফল্য ও অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য এনে দেয়। বইটি টানা ৮৬ সপ্তাহজুড়ে নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার লিস্টে বলবৎ থাকে। ১৯৫২ সালে বইটি নন-ফিকশন ক্যাটাগরিতে জাতীয় পুস্তক পদক, জন ব্রগস মেডেলসহ অসংখ্য পুরস্কার ও দুটি সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি এনে দেয়। এই বইটির অভাবনীয় সাফল্যে তার প্রথম বইয়ের পুনঃমুদ্রণের চাহিদা তৈরি হয়। এবং আশ্চর্যকজনক প্রায় এক যুগ পরে পুনঃমুদ্রিত হয়ে আন্ডার দ্য সি উইন্ড ও বেস্টসেলার হিসেবে বিক্রি হয়। 

অর্থনৈতিক সচ্ছলতা নিশ্চিত হওয়ার পর পুরোদস্তুর ১৯৫২ সালে র‌্যাচেল কারসন তার সরকারি পদ থেকে ইস্তফা দেন। সি অ্যারাউন্ড আস-এর উপর নির্মিত ডকুমেন্টারি সিনেমা ১৯৫৩ সালে, ডকুমেন্টারি বিভাগে সেরা ছবি হিসেবে একাডেমি অ্যাওয়ার্ডে পুরস্কৃত হয়। 

১৯৫৩ সালে সমুদ্র পাড়ের বাস্তুসংস্থান ও জীব-বৈচিত্র্য নিয়ে সমুদ্র বিষয়ক তার তৃতীয় বইয়ে হাত দেন। ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত দ্য এজ অব দ্য সি বইটিও ব্যবসা সফল হয়। 

পরবর্তী দুই বছরে তিনি একাধিক বিষয়ের উপর বেশ অনেকগুলো প্রবন্ধ লেখেন। তার পাশাপাশি বিভিন্ন পরিবেশবাদী গোষ্ঠী যেমন, সঙ্গে তার যোগাযোগ বাড়তে থাকে। একটা সময় পর তার সমস্ত মনোযোগ পরিবেশ রক্ষায় কেন্দ্রীভূত হয়। এর মধ্যে ১৯৫৭ সালে আমেরিকার ফেডারেল সরকার স্পঞ্জ মথ নিধনে ব্যাপক আকারে বিমানযোগে ডিডিটিসহ আরও কয়েকটি কীটনাশক স্প্রে করে। লং আইল্যান্ডের অধিবাসীরা বাদী হয়ে সুপ্রিম কোর্টে একটা মামলা করে। তখন আবার বড় আকারে ডিডিটি র‌্যাচেল কারসনের মনোযোগ কাড়ে। বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী সময়ে এ নিয়ে তার অনুসন্ধানকে তিনি আরও বৃহৎ আকারে শুরু করে। দীর্ঘদিন ধরে কর্মের সুবাদে বিভিন্ন বিজ্ঞানী ও গবেষক মহলে তৈরি হওয়া তার সম্পর্কগুলোকে তিনি কাজে লাগান। তাদের মাধ্যমে নানান রাষ্ট্রীয় গোপন নথি তার হাতে আসে। ডিডিটি ও ক্যান্সার নিয়ে গবেষণাকারী প্রচুর গবেষকের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা শুরু করেন। ডিডিটি ও অন্যান্য রাসায়নিক দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে ও মানুষের কাছে সরেজমিনে উপস্থিত হয়ে তিনি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে থাকেন। ১৯৬০ সাল নাগাদ তার কাছে সুবিশাল ও শক্তিশালী তথ্য-প্রমাণ পুঞ্জীভূত হয়। 

সে বছরের ডিসেম্বরে মিস কারসনের স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ে। তারপরও তিনি তার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৬১ সালের মাঝামাঝি নাগাদ সবকিছু মোটামুটি গোছানো হয়। সবার শেষে লেখা হয় প্রথম অধ্যায়টা, যা বাংলায় বললে অনেকটা এমন শোনাবে: ‘ভবিষ্যতের কারও কাছে এসব সবুজের গল্প রূপকথা শোনাবে’। বইটির প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেন লুইস অ্যান্ড লইস ডার্লিং। অবশেষে ১৯৬২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর হগটন মিফ্লিন প্রকাশনী থেকে বের হয় সাইলেন্ট স্প্রিং ।

এরপর ডিডিটি ও রাসায়নিক ব্যবসায় বিনিয়োগকারী গোষ্ঠী, তাদের নিযুক্ত প্রতিনিধি দল ও আইনজীবীরা নানাভাবে র‌্যাচেল কারসনকে আক্রমণ করতে থাকেন। কখনো অপবাদ, কুৎসা রটিয়ে, কখনো বা মানহানির মামলা করে। সরকারের কৃষি বিভাগে কর্তব্যরত এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমে বলেন, ‘এই চিরকুমারী বন্ধ্যা মেয়েলোকটার এত জেনেটিক্স (বংশগতিবিদ্যা) নিয়ে জানতে হবে কেন?’ মার্কিন সরকারের কৃষি সচিব এক চিঠিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে মিস কারসনের ব্যাপারে এমন মন্তব্য করেন, ‘এত রূপসী হয়েও তিনি চিরকুমারী রয়ে গেছেন কেন? তিনি নিশ্চয়ই কমিউনিস্ট, মানে রাশিয়ার গুপ্তচর!’ 

এতসব অপবাদ কুৎসা আর আক্রমণের পরও তার সরল শব্দচয়ন, হৃদয়গ্রাহী কাব্যিক বর্ণনা, প্রাঞ্জল উপস্থাপন আর অকাট্য বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণে সাইলেন্ট স্প্রিং ফুটেছে সকল কাঁটা ধন্য করে। 

এই বইয়ের বিষয়বস্তু নানা মহলে ব্যাপকভাবে বিতর্ক ও সচেতনতার সৃষ্টি করে। বৈজ্ঞানিক মহলে কারসনের উপস্থাপিত অভিযোগসমূহ নিয়ে ব্যাপক আকারে গবেষণা শুরু হয়, যার বেশির ভাগ ফলাফলই কারসনের বক্তব্যকে সমর্থন করে। জনসাধারণের মধ্যে সৃষ্ট জাগরণ নিয়ে কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। র‌্যাচেল কারসনকে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা পর্ষদের মুখোমুখি হতে হয়। ১৯৬৩ সালে পর্ষদ তার রিপোর্ট প্রকাশ করে, যার বেশির ভাগই কারসনের বক্তব্যের পক্ষে যায়। শেষ পর্যন্ত মার্কিন সিনেট সাব কমিটি র‌্যাচেল কারসনকে ডাকেন এবং বালাই দমন নীতি তৈরিতে তার সুপারিশ জানতে চান। 

ক্যান্সারের চিকিৎসা চলাকালে তার শরীরের অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। অবশেষে ১৯৬৪ সালের ১৪ এপ্রিল মেরিল্যান্ডে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সৎকারের সময় তার অস্থিভস্মের কিছু অংশ কারসনের মায়ের কবরের পাশে সমাহিত করে আর বাকি অংশ আটলান্টিক সৈকতের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। জীবনের সবচেয়ে বড় অংশ সমুদ্র নিয়ে কাজ করতে করতে সব শেষে তিনি সমুদ্রের সঙ্গে মিশে গেছেন। 

তার মৃত্যুর পর পরিবেশ রক্ষার অন্দোলন একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ নিয়ে সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। তার বই সাইলেন্ট স্প্রিং-এর যে পরিমাণ সরব প্রভাব তৈরি হয়, তার ফলস্বরূপ ১৯৭০ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রশাসন মার্কিন পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা সৃষ্টি করে। প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার তাকে মরণোত্তর রাষ্ট্রপতি স্বাধীনতা পদক প্রদান করেন। 

২০০৬ সালে ডিসকভারি ম্যাগাজিন সাইলেন্ট স্প্রিংকে তাদের সর্বকালের সেরা ২৫ বিজ্ঞান বইয়ের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। এখন পর্যন্ত বইটি ১৭টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৯৬ সালে এইচ এফ ভান এমডেন এবং ডেভিড প্যাকাল, সাইলেন্ট স্প্রিংকে অনুসরণ করে লেখেন বিয়ন্ড সাইলেন্ট স্প্রিং। পরিবেশবাদী ডেভিড এটেনবার্গ মনে করেন, চার্লস ডারউইনের অরিজিন অব স্পিসিসের পর সাইলেন্ট স্প্রিং সম্ভবত বৈজ্ঞানিক জগতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী বই।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //