হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ এবং বঙ্গীয় শব্দকোষ

‘কোথা গো ডুব মেরে রয়েছ তলে হরিচরণ! কোন গরতে? বুঝেছি! শব্দ-অবধি-জলে মুঠাচ্ছ খুব অরথে!’ হরিচরণকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তার সম্পর্কে এভাবেই একটি শ্লোক রচনা করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

হরিচরণ আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন একনিষ্ঠ সাধক। ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ। পরে রবীন্দ্রনাথের কৃপায় শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক। গভীরভাবে মনোনিবেশ করেছিলেন অভিধান রচনায়। চল্লিশ বছর তার নিরবচ্ছিন্ন অধ্যবসায় ও কঠোর সাধনায় প্রকাশিত হয় তার ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’। অবশ্য এ কাজে তাকে নিয়োজিত করেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

বাবার মৃত্যুর পর আর্থিক অবস্থার চরম অবনতি ঘটে হরিচরণের। পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই খুঁজতে থাকেন জীবিকা নির্বাহের পথ। জুটেও যায়। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন দাদা যদুনাথ চট্টোপাধ্যায়। তিনি তখন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জোড়াসাঁকো বাড়ির সদর বিভাগে খাজাঞ্চির কাজ করতেন। হরিচরণের ভাষায়- ‘আমি মধ্যে মধ্যে তার অফিসে যাইতাম এবং তাঁহার মুখে কবীন্দ্রের বিদ্যোৎসাহিতা ও বিদ্যানুরাগিতার কথা এবং কবিত্বের ভূয়সী প্রশংসা তন্ময় হইয়া শুনতাম। একদিন জোড়াসাঁকোর বাটীতেই দাদার মুখেই কথায় কথায় শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্য্যাশ্রমের কথা শুনিলাম। ছাত্রজীবনে আমার একান্ত ইচ্ছা ছিল যে, আমি যেখানেই যে কার্য্যইে থাকি না কেন, বিদ্যালোচনা- বিশেষত সংস্কৃতের চর্চ্চা- আমি কখনও ত্যাগ করিব না’;

কিন্তু কর্মজীবনের শুরুটা সেভাবে হয়নি। তবে “তখন জানিতে পারি নাই যে, আমার ভাগ্যবিধাতা আমার অলক্ষ্যে ‘তথাস্তু’ বলিয়া স্বপ্নদৃষ্টের ন্যায় আমার সেই অলীক আশা সফল করিতে উদ্যত হইয়াছেন।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারির অন্তর্গত পতিসরের কাছারিতে সেরেস্তা হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। ‘আমার দাদা একদিন কবিবরের নিকট তাঁহার পূর্ব্ব প্রদত্ত বৃত্তির উল্লেখপূর্ব্বক আমার পরিচয় দিয়া, মফস্বলে আমার জন্য একটি কার্য্যরে প্রার্থনা জানাইলে, কবিবর তৎক্ষণাৎ তাহা স্বীকার করেন এবং তদানীন্তন সদর নাএব শ্রীযুক্ত অমৃতলাল বন্দ্যোপ্যাধ্যায়কে ডাকাইয়া, আমাতে মফস্বলে কোন একটি কার্য্যে নিযুক্ত করার অনুমতি দেন।’ চলে যান কালীগ্রাম পরগণারসদর কাছারি পতিসরে। পদবি সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট। ম্যানেজার ছিলেন শ্রীযুক্ত শৈলেশচন্দ্র মজুমদার। হরিচরণ কাছারিতে থেকে দাপ্তরিক কর্ম সম্পাদন করতেন। পাশাপাশি পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজ। একদিন জমিদারিকাজ পরিদর্শনে আসেন রবীন্দ্রনাথ। “দুই একটি কুশল-প্রশ্নাদি জিজ্ঞাসার পর, আমি বিদায় লইয়া আমার ঘরে ফিরিয়া আসিলাম। কিছুক্ষণ পরে একজন আমার ঘরে আসিয়া বলিলেন- ‘বাবুমশাই আপনাকে ডাকিতেছেন, আসুন।” কিছু কুশলাদির পর তরুণ হরিচরণকে রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি এখানে কি কর?’ হরিচরণ বললেন- ‘আমিনের সেরেস্তায় কাজ করি।’ এরপর বললেন ‘দিনে সেরেস্তায় কার্য্য কর, রাত্রিতে কি কর?’ হরিচরণ বললেন- ‘সন্ধ্যার পরে কিছুক্ষণ সংস্কৃতের আলোচনা করি ও কিছুক্ষণ এক পুস্তকের পাণ্ডুলিপি দেখিয়া press copy প্রস্তুত করি।’ শুনে রবীন্দ্রনাথ চমকিত হলেন। পাণ্ডুলিপিটি দেখতেও চাইলেন। রবীন্দ্রনাথ পাণ্ডুলিপিটি হাতে নিয়ে বাক্যরুদ্ধ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ দেখে পাণ্ডুলিপিটি ফেরত দিয়ে বিদায় নিলেন।

এরপরই ভাগ্যবিধাতা তার অলক্ষ্যে ‘তথাস্তু’ বলে স্বপ্নদৃষ্টের মতো সেই অলীক আশা সফল করেতে উদ্যত হলেন। শান্তিনিকেতন থেকে হঠাৎ পতিসরের ম্যানেজার শৈলেশচন্দ্র মজুমদারের কাছে একটি পত্র এলো ‘শৈলেশ, তোমার সংস্কৃতজ্ঞ কর্মচারীকে এইখানে পাঠাইয়া দাও।’

রবীন্দ্রনাথ জহুরি চিনতেন। বিধুশেখর শাস্ত্রী, ক্ষিতিমোহন সেন, জগদানন্দ রায় এবং ঠাকুর পরিবারের দিকপালদের সঙ্গে একসারিতে হরিচরণকে অধ্যাপক হিসেবে ঠাঁই দিয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনে গিয়ে ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ নামক অভিধান রচনায় প্ররোচিত করেন। অবশ্য বাঙালি সমাজে হরিচরণের তখনো পরিচিতি গড়ে ওঠেনি। বয়সও কম। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা পর্যন্ত নেই। তবে তিনি ছিলেন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। অন্যান্য পণ্ডিত ও সংস্কৃতজ্ঞের মতো হরিচরণও দিনের কাজের শেষে সংস্কৃতচর্চায় নিজেকে বিকশিত করেন। এ বিষয়ে তার একটি পাণ্ডুলিপিও ছিল। রবীন্দ্রনাথ শুনে, তখন তাঁকে তাঁর অসম্পূর্ণ ‘সংস্কৃত প্রবেশ’ বইটি রচনার দায়িত্ব দেন। সেটি শেষ হওয়ার আগেই পান নতুন দায়িত্ব। কবিগুরু জানালেন, ‘বাংলা ভাষার কোনো শব্দকোষ নেই, তোমাকে একটি অভিধান লিখতে হবে।’ যদিও তখনো শেষ হয়নি ‘সংস্কৃত প্রবেশ’ রচনার কাজ। হরিচরণ সময় চেয়ে নিলেন গুরুর কাছ থেকে। ১৯০৫ সালে তিন খণ্ডর সংস্কৃত প্রবেশ রচনা শেষ হয়। তার মধ্যেই রচনা সম্পন্ন করেছেন একটি ‘পালি প্রবেশ’ও। পালি ভাষা না হলেও, বাংলা ভাষার তৎসম ও তদ্ভব শব্দের সঙ্গে সংস্কৃতের যথেষ্ট মিল রয়েছে। ফলে সংস্কৃত প্রবেশ এবং পালি প্রবেশ লেখার অভিজ্ঞতা তাকে সাহায্য করেছিল বাংলা অভিধান লেখার ক্ষেত্রে। 

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য কাজ অভিধান রচনা। শুরু করেছিলেন ১৩১২ বঙ্গাব্দ বা ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে আর শেষ করেন ১৩৩০ বঙ্গাব্দ বা ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে। অভিধানটির মুদ্রণকাজ শেষ হয় ১৩৫২ বঙ্গাব্দ বা ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে। ১৩১২-১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দ। মধ্যবর্তী ৪০ বছর। হরিচরণ অভিধান নিয়ে এত খুঁটিনাটি কাজ করেন, যা তাকে উন্নীত করেছে সম্মানের চরম শিখরে। কাজপাগল মানুষ ছিলেন। ৭৫ বছর বয়সেও বিশ্বভারতী থেকে অবসর নেওয়ার পরও আগের মতো নিজের কাজে মগ্ন থাকতেন। অভিধান ছাড়াও তিনি রচনা করেন ‘সংস্কৃত প্রবেশ’, ‘পালি প্রবেশ’, ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’, ‘Hints on Sanskrit Translation and Composition’, ‘কবির কথা’, ‘রবীন্দ্রনাথের কথা’। এছাড়া তিনি ম্যাথু আর্নল্ডের ‘শোরাব রোস্তম’, ‘বশিষ্ট বিশ্বামিত্র’, ‘কবিকথা মঞ্জুষা’ প্রভৃতি গ্রন্থ অমিত্রাক্ষর ছন্দে অনুবাদ করেছিলেন। হরিচরণ চোখে কম দেখতেন তখন। ইংরেজ ঐতিহাসিক-সাহিত্যিক গিবনের মতো তিনি কখনো ভাবেননি, তাঁর সব কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। সব সময় তিনি ছিলেন হাসিখুশিতে পূর্ণ। সুখ-দুঃখে ছিলেন অবিচল। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পান ‘সরোজিনী স্বর্ণপদক’ এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পান ‘দেশিকোত্তম’ (ডি লিট) উপাধি।

তার জন্ম ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন, উত্তর চব্বিশ পরগনার যশাইকাটিতে মায়ের পৈতৃক ভিটেয়। বাবা নিবারণচন্দ্র। মা জগৎমোহিনী দেবী। প্রাথমিক পড়াশোনা মামাবাড়ি। দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা। কোনোভাবে স্কুল শেষ করে বিএ তৃতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হওয়ার পর শুরু হয় আর্থিক অনটন। লেখাপড়াও ইস্তফা দিতে হয় তখনই। তবু তিনি পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিলেন শিক্ষার মতো মহৎ কিছুর পৃষ্ঠপোষক, শব্দ অনুসন্ধানী, ভাষার চিকিৎসক, পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //