অ্যাক্টেয়নের কাহিনি

ভার্জিলিও পিনেরার জন্ম ১৯১২ সালের ৪ আগস্ট কিউবার কারডেনাসে। তিনি একাধারে লেখক, নাট্যকার, কবি, ছোটগল্পকার এবং প্রাবন্ধিক ছিলেন; কিন্তু প্রকাশ্যে সমকামিতার জন্য তিনি তার সাহিত্যজীবনে বিখ্যাত হতে পারেননি, বরং কুখ্যাত হয়েছেন। সমকামিতার দায়ে ১৯৬১ সালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কারাগার থেকে ফেরার পর বাকি জীবন লেখালেখি করেই কাটিয়েছেন, কোনো লেখা প্রকাশ হবে না জানা সত্ত্বেও। ১৯৭৯ সালের ১৮ অক্টোবরে হাভানায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তার লিখে যাওয়া ৪৩টি গল্প নিয়ে ‘কোল্ড টেলস্’ নামক বইটি প্রকাশিত হয়।

অ্যাক্টেয়নের মিথ : অ্যাক্টেয়ন গ্রিক মিথলজির একজন বিখ্যাত নায়ক। সে ছিল একজন পশুপালক। একদিন তিনি বনে দেবী আর্টেমিসকে স্নান করার সময় দেখে ফেলেন। তাকে দেখে ক্রুদ্ধ আর্টেমিস অভিশাপ দেয়, কিছু বলার জন্য মুখ খুললেই সে একটি হরিণে পরিণত হবে। তারপর অ্যাক্টেয়ন তার কুকুরের দলকে যেতে দেখে ডাক দেন, এবং সাথে সাথে হরিণে পরিণত হয়ে যান। তার নিজের পালিত কুকুর তাকে চিনতে না পেরে তাড়া করে। এক পর্যায়ে অ্যাক্টেয়নকে ঘিরে ফেলে কুকুরের দল এবং টুকরো টুকরো করে খেলে ফেলে। গ্রিক মিথলজির এই ঘটনাকে দেব দেবীর সন্তুষ্টির জন্য মানুষের ত্যাগের সাথে তুলনা করা হয়।

হলুদ টুপি পরা লোকটা আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি এই চক্রের অংশ হতে চান? এই অ্যাক্টেয়ন চক্রের?’

‘এটা কি সম্ভব?’ আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ‘অ্যাক্টেয়ন চক্রের কি আদৌ কোনো অস্তিত্ব আছে?’

‘হ্যাঁ’, সে ঠান্ডা গলায় জবাব দিলো, ‘অবশ্যই আছে। কিন্তু তার চেয়েও জরুরি হচ্ছে অ্যাক্টেয়নের কাহিনির সেই শর্ত দুটোকে তুলে ধরা।’ নিজেকে সামলাতে না পেরে আমি তার শার্টের দুটি বোতাম খুলে তার বুক বরাবর তাকালাম। ‘হ্যাঁ’, সে আবার বলতে থাকল, ‘অ্যাক্টেয়নের কাহিনির দুটি শর্ত, (বলতে বলতে সে তার ডান হাত বাড়িয়ে আমার শার্টের প্রায় অর্ধেকটা খুলে ফেলল) প্রথম শর্তটি হলো, অ্যাক্টেয়নের মিথটি আবার ঘটতে পারে, পৃথিবীর যেকোনো জায়গায়।’ আমি হালকা করে আমার বুড়ো আঙুল ও কনিষ্ঠা তার বুকের মধ্যে দাবিয়ে দিলাম।

‘অ্যাক্টেয়নের কাহিনিতে গ্রিস সম্পর্কে একটু বেশিই অভিবাদন করা হয়েছে।’ এটা বলে সেও তার বুড়ো আঙুলের নখ আমার বুকের মাংসে দাবিয়ে দিল, ‘কিন্তু বিশ্বাস করুন, এমনকি এখানে, কিউবা বা কাজকো কিংবা পৃথিবীর যেকোনো জায়গাতেই অ্যাক্টেয়নের কাহিনি যথার্থভাবে ঘটা সম্ভব।’

আমি আস্তে করে আমার নখের চাপ বাড়িয়ে বললাম, ‘তাহলে তো আপনার চক্রটি বিশেষ জরুরি!’

‘অবশ্যই। অবশ্যই এটি জরুরি। যদিও সবকিছুই এই চক্রের পদপ্রার্থীর উপর নির্ভর করে (বলতে বলতে সে তার কব্জির চাপ আরো বাড়িয়ে দেয়) আর আমি বিশ্বাস করি প্রয়োজনীয় সব গুণাই আপনার মধ্যে আছে...’

আমি হালকা একটু আর্তনাদ করে উঠলাম, কিন্তু সে তা শুনে ফেলল এবং প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল, ‘আর দ্বিতীয় শর্তটি হলো (আমি তার হাতের দিকে তাকালাম, কোনো আঙুলই আর দেখা যাচ্ছে না, এবং তার গলার স্বর অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছিল) আর দ্বিতীয় শর্তটি হলো, এটা জানা যাবে না, একে চিহ্নিত করা সম্ভব না, নিয়ন্ত্রিত, উল্লেখ, ইঙ্গিত, স্থির করা সম্ভব না (সব কথা ট্রেনের বাঁশির মতো শোনাচ্ছিল) যে কোথায় অ্যাক্টেয়ন শেষ হয়, আর তার কুকুরগুলো উদ্ভূত হয়।’

আমি তখনই আপত্তি করে উঠলাম, ‘তাহলে... তাহলে কি অ্যাক্টেয়ন একজন ভিকটিম নয়?’

‘অবশ্যই অ্যাক্টেয়ন ভিকটিম না, একদমই না।’ সে আমার গায়ে মুখে বড় বড় থুতুর ফোঁটা ছিটাতে ছিটাতে বলল, ‘কুকুরগুলোও কেবল ভিকটিম হতে পারত, তাদের শিকারির মতো, এবং সে ক্ষেত্রে অ্যাক্টেয়ন কী হতো তা আপনি জানেন।’

এই বিস্ময়কর উদঘাটনে উত্তেজিত হয়ে আমি আর নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারলাম না, তার শার্টের বাকি বোতামগুলো খুলে আরেকটি হাত দাবিয়ে দিলাম তার বুকের ভেতর।

‘ওহ্! আপনি আমাকে এক অস্বাভাবিক চাপ থেকে মুক্ত করলেন’, আমি প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলাম, ‘আমার বুক থেকে এত বড় এক ভার নামিয়ে দিলেন।’

সে আমার বুকের দিকে তাকিয়ে আরো হাতের চাপ বাড়িয়ে বলল, ‘অবশ্যই। এটা যদি এত সহজ হতো! যদি বুঝে ফেলার পর এতই সহজ হয়ে উঠত...’ আমার বুক থেকে হাত দিয়ে ময়লা খোঁচানোর শব্দ পাওয়া গেল, কাঁপা কাঁপা স্বরে সে বলতে থাকল, ‘কল্পনা করুন দৃশ্যটি, কুকুরগুলো অ্যাক্টেয়নকে খুঁজে পেয়েছে, ঠিক যেভাবে আমি আপনাকে খুঁজে পেলাম; অ্যাক্টেয়নও কুকুরগুলোকে দেখে অসভ্য উল্লাসে ভরে উঠেছিল, ঠিক আমার মতো; বরং কুকুরগুলো বিষণ্ণ হয়ে উঠেছিল, অ্যাক্টেয়ন পালিয়ে যেতে পারত, যা কুকুরগুলো ভীষণভাবে চায়। তারা বিশ্বাস করে যে তাদের হাতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেয়ে পালিয়ে যাওয়াই অ্যাক্টেয়নের জন্য ভালো হবে। এবং... আপনি কি জানেন?...(এমন সময় তার গলায় প্রচণ্ড আতঙ্ক বোঝা যাচ্ছিল, তাই আমি দ্রুত আমার দুই হাত কব্জি পর্যন্ত তার বুকে ঢুকিয়ে দিলাম) ধন্যবাদ, ধন্যবাদ আপনাকে। কুকুরগুলো ভালো করেই জানে যে তারা অ্যাক্টেয়নের তুলনায় অনেক নিচে অবস্থান করে। হ্যাঁ, সেই অচল অবস্থানে থেকে...তারা যদি চায়...’ ‘এক মিনিট, আমাকে ক্ষমা করবেন বাধা দেওয়ার জন্য। (এই পর্যায়ে আমরা কণ্ঠও তার মতো হয়ে উঠছিল, ট্রেনের বাঁশির মতো, এবং আমার মুখ থেকেও থুতু ছিটতে শুরু করল) কিন্তু আপনি তো বিশ্বস্ত ছিলেন, যে কুকুরগুলো এই মর্যাদাহানির বিরোধী, এই অশুভ অবস্থায় যেটা কিনা বিজয়! না না! কোনোভাবে কি...তারা স্থির থাকবে পারবে না... আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি... আমাকে বিশ্বাস করুন... অ্যাক্টেয়ন কুকুরগুলোকে ভিন্ন বিচ্ছিন্ন করে...গিলে ফেলবে...’

এ পর্যায়ে এসে বলতে পারছি না যে, শেষ কথাগুলো কে বলছিল। এখানে আমাদের দুজনের কথা ও কাজ একদম মিলে যাচ্ছিল। দুজনই দুজনের বুকে হাত ঢুকিয়ে যাচ্ছিলাম, এবং যেহেতু দুজনের কাজই কথার সাথে মিলে যাচ্ছিল (জানি না আমার কথার সাথে তার কাজ, নাকি তার কথার সাথে আমার কাজ), এবং আমরা দুজনই একে অপরের সাথে মিশে যাচ্ছিলাম, একটি পিণ্ডে বা স্তূপে, অথবা একটি টিলায়, কিংবা একটি বিরামহীন চক্রে পরিণত হচ্ছিলাম।

ভাষান্তর : মাইশা তাবাসসুম

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //