আবুল হাসানের কবিতা: দুঃখ যাঁর মুক্তা

কৈশোর থেকে তারুণ্যে পা দেওয়ার সময়ে আমার খুব কাছের সঙ্গী ছিলেন কবি আবুল হাসান। ঘনায়মান বিকেলে যখন নদীর পাড়ে হাঁটতে যেতাম; আওড়াতাম, ‘প্রিয়তম পাতাগুলি ঝরে যাবে মনেও রাখবে না/আমি কে ছিলাম, কী ছিলাম-কেন আমি’। কিংবা ঘুমানোর সময় বালিশের পাশে রেখে দিতাম ‘আবুল হাসান রচনাসমগ্র’। কখনো কখনো বইখানার প্রচ্ছদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম আনমনে। আবুল হাসানের কবিতায় এমন, পড়তে পড়তে কখন আনমনা হয়ে যাবেন, টের পাওয়া মুশকিল। 

মনে হবে, বিরহের যে গান বেজে চলছে আত্মার কণ্ঠনালীতে তা যেকোনো সময় চিৎকার করে উঠবে ‘দুঃখের এক ইঞ্চি জমিও আমি অনাবাদী রাখবো না আমার ভেতর!’ বলে। এমন থরো থরো বেদনার কবি আবুল হাসান। দুঃখ ও আবেগ যাঁর কবিতার প্রধান শক্তি। বাংলা কবিতার পঞ্চপাণ্ডবের (ব্যতিক্রম জীবনানন্দ দাশ) বুদ্ধিবৃত্তিক কাব্যচর্চার অর্গল খুলে যিনি আবগকে দিয়েছেন শিল্পের সুষমা। কাব্যভাষাকে করেছেন আরও হৃদয়গ্রাহী ও যোগাযোগপ্রবণ। যে কারণে মাত্র ২৯ বছরের ব্যক্তিগত বোহেমিয়ানপনা শেষে কবিতা নিয়ে ঘরে ফিরতে পেরেছেন আবুল হাসান। আর সাধারণকেও হিম্মত দেননি ‘কবিতা বুঝি না’ বলার। আবুল হাসানের কবিতা বোধের। অনুভবের। ঢালাওভাবে আবেগীয় বলারও সুযোগ নেই। সময়ের কাছে তাঁর কবিতা প্রশ্ন রেখেছে। রয়েছে রাজনীতি সচেতনতা। বাংলার রূপকে দেখেছেন ‘নরম শরীর ভরা রাজহাঁস’-এর মতোন। সঙ্গে বিষণ্নতা ও না পাওয়ার নানা ব্যর্থতার আধুনিক কষ্ট মূল উপজীব্য তাঁর  কবিতার। ব্যক্তিগত জীবনের অস্থিরতার এক নিঃসঙ্গতা ভ্রমণ শেষে আবুল হাসানের উচ্চারণ—

‘অবশেষে জেনেছি মানুষ একা! 

জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা! 

দৃশ্যের বিপরীতে সে পারে না একাত্মা হতে এই পৃথিবীর সাথে কোনদিন।’ 

আবুল হাসান যে নাতিদীর্ঘ জীবন কাটিয়েছেন, তাতে নিজে যেমন কবিতায় মশুগুল থেকেছেন, তেমনি চারপাশকেও করে রেখেছিলেন কবিতাময় করে। বড় কবির স্বভাবটায় যেন এমন, তাদের সংস্পর্শে আসা অধিকাংশদেরও কবিতা পেয়ে বসে। ষাটের দশকের সবচেয়ে উজ্জ্বল কবি তিনি। মাত্র দশ বছরের কাব্যসাধনায় দিয়েছেন তিনটি কবিতার বই। মহাদেবের ত্রিশূলের মতোই তাতে অমরত্ব। জীবনানন্দ দাশের বরিশালের লোক বলেই বোধহয় অগ্রজের ছায়া আবুল হাসানের কবিতায় পড়েছিল। তবে ‘শিশিরের শব্দের মতোন’ আবেশ করা সেই ভাষা শক্তিতে সজ্ঞানে এড়িয়ে তিনি খুঁজেছেন নিজের পথ। আর আবুল হাসান নিজে যে বটবৃক্ষ হয়ে ছায়া বিলিয়েছেন তাতে শরীর জুড়িয়েছেন অনুজরা। যদিও  আমৃত্যু একটু ভালোবাসা ও নির্ভরশীলতা খুঁজে গেছেন তিনি-

‘বলি তাই এসেছি তোমার কাছে ইস্পাতিনী

শুশ্রূষার সবুজ চুম্বনে আজ স্নিগ্ধ কোরে দাও তুমি এ হেন মলিন মুখ, 

সামাজিক ওষ্ঠ আর অন্তরাল,

গভীর গভীরত অন্তরাল-

সেবিকা, সেবিকা!’

আবুল হাসান ‘করে’ নয়, লিখতেন ‘কোরে’। ‘বলে’কে লিখতেন ‘বোলে’। এমন আরও উদাহরণ আছে। এ নিতান্ত ব্যক্তিগত ইচ্ছে। অন্যরা যেন তাঁর কবিতা পাঠ করতে গিয়ে ক্রিয়াপদকে সঠিক উচ্চারণ করতে পারে, হয়তো সেই কারণে। আবুল হাসান নিজেও কী নিজের কবিতা আনমনে পাঠ করতেন না? নির্দিষ্ট খাতার চেয়ে কবি তো আগে মাথাতেই কবিতার পঙক্তিগুলো সাজিয়ে নেন। হয়তো কাছে সিগারেটের প্যাকেট পেয়েছেন, তা ছিঁড়ে লিখে ফেললেন একটি নিকোটিনের গন্ধমাখা কবিতা। নিজের সৃষ্টির প্রতি এ হেলা নয়, সৃষ্টিশীলতা। আবুল হাসান এমন স্বভাবজাত কবিই ছিলেন বটে। নয়তো এমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলতে পারতেন না-

‘আমি আমার ভালোবাসার স্বীকৃতি চাই 

স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে, 

মৃত্যুমাখা মাটির উপর দাঁড়িয়ে আছি একলা মানুষ, 

বেঁচে থাকার স্বীকৃতি চাই, 

স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে!’

প্রথম যে নারীকে ভালোবেসেছিলেন সে ভালোবাসার স্বীকৃতি পাননি আবুল হাসান। তা অবশ্য নিজেরই দোষে। সেই হতাশা কি আমৃত্যু তাঁকে তাড়া করেনি? না পা্ওয়ার ক্ষোভ ও অভিমানের যে দানা বুকে জমেছিল তা এমন হাতুড়ি পেটানোর শব্দে বেরিয়ে আসায় স্বাভাবিক। অবশ্য সুরাইয়া খানমের সঙ্গে যে প্রেম গড়ে উঠেছিল তাতে বেশ উচ্ছ্বলতার ছোঁয়া পেয়েছিলেন দুজনে। অসুস্থ সময়ে ও মৃত্যুশয্যায় সেই ভালোবাসা ছেড়ে যায়নি আবুল হাসানকে। কিন্তু অকালে চলে যাবেন বলেই কি এমন আশ্চর্য কাব্য প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি? নীরবে মুখ বুজে সয়েছিলেন এত দুঃখ? আর সেই দুঃখকে মনের খোলসে রেখে সৃষ্টি করেছেন মুক্তোখচিত পঙক্তিমালা— 

‘ঝিনুক নীরবে সহো

ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও

ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তা ফলাও!’

এত অভিমান-বিষাদ কেন জমেছিল আবুল হাসানের বুকের ভেতর? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ছিলেন। চাইলে পড়ালেখা শেষ করে চাকরি-বাকরি জুটিয়ে দিব্যি মধ্যবিত্ত এক সংসার পেতে বসতে পারতেন। তবে কী স্কুলের কতিপয় ভালো ছাত্রটি যেভাবে সঙ্গদোষে সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে পড়ে তেমনি আবুল হাসানের অসূখ তাঁকে ঠেলে দিয়েছিল কবিতায়? কবিতাও এক মাফিয়াচক্রের মতো। যে কাঁটাতারে একবার পা জড়ালে আজীবন সেই ক্ষতের অভিশাপ ও আশীর্বাদ নিয়ে বাঁচতে হয়—

‘নখের ভিতর নষ্ট ময়লা,/ চোখের ভিতর প্রেম,/ চুলের কাছে ফেরার বাতাস/ দেখেই শুধালেম,/ এখন তুমি কোথায় যাবে?/ কোন আঘাটার জল ঘোলাবে?/ কোন আগুনের স্পর্শ নেবে/রক্তে কি প্রব্লেম?’

ঢাকায় আসার পর উপনিবেশ হয়ে থাকা দেশের ভেতরটা দেখেছেন আবুল হাসান। ঘিরে ছিল ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তাও। মানসিকভাবে সেই চাপ হয়তো বহন করতে হয়েছে তাঁকে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সংকটের ভেতর নিজের অস্তিত্ব নিয়ে তাঁর উদ্বেগও হয়তো ছিল। হয়তো বন্ধুরা যখন মিছিলে, আর আবুল হাসান ভাবছেন এক শান্তিময় পৃথিবীর কথা। বুলেটের আঘাতে বা ক্ষুধায় লক্ষ মানুষের মৃত্যুর পরও ঘুমন্ত জাতিসংঘকে বলছেন, ‘মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবে না,… মানুষ চাঁদে গেল, আমি ভালোবাসা পেলুম/পৃথিবীতে তবু হানাহানি থামল না!’ 

ব্যক্তিগত জীবনে আবুল হাসান ছিলেন দলীয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকা মানুষ। কিন্তু আরিস্ততলের, ‘মানুষ রাজনীতিক জীব’ সংজ্ঞায় তো জানায় যায়, জন্ম মাত্রই মানুষ রাজনৈতিক প্রাণী; সে করুক বা না করুক। বড় বড় কর্পোরেটদের কাছে জনসাধারণ মাত্রই ভোক্তা আর ভোটের রাজনীতির কাছে ভোটার। সংবাদপত্রে চাকরি করার সুবাদে চারদিকে যে দূষিত রাজনীতি দেখেছেন তা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারেননি আবুল হাসান। বন্ধু কবি নির্মলেন্দু গুণের প্রত্যক্ষ রাজনীতি করা দেখেও শিল্পীর চোখে সবকিছুকে দেখেছেন তিনি। ‘অসভ্য দর্শন’ কবিতাটাও গুণকে উৎসর্গ করে। হয়তো আবুল হাসান জবাব দিতে চেয়েছিলেন, রাজনীতি নিয়ে তিনিও ভাবেন। তবে তা ভিন্নভাবে—

‘দালান উঠছে তাও রাজনীতি, দালান ভাঙছে তাও রাজনীতি,

দেবদারু কেটে নিচ্ছে নরোম কুঠার তাও রাজনীতি,

গোলাপ ফুটছে তাও রাজনীতি, গোলাপ ঝরছে তাও রাজনীতি!’

মানুষ জন্মাচ্ছে তাও রাজনীতি, মানুষ মরছে তাও রাজনীতি!’

কবিতায় সত্য বলতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু কিছু কথা হয়ে উঠে চিরন্তন। সময়ের প্রাসঙ্গিকতা রয়ে যায়। আজকের বাস্তবতায় আবুল হাসানের এই কবিতাটিও তেমন। এক ‘উদিত দুঃখের দেশের’ তিনি এক জনমদুঃখী কবি। ঘর থেকেও যে বিবাগী। মা-বাবা থেকেও যে অনাথ। পুলিশে চাকরি করা বাবাকে তাঁর মনে হয়, ‘নিম্নমানের মানুষ’। আর প্রেমিকাকে পেয়েও যে হারাতে চায়, ‘আমি ফিরব না আর, আমি কোনদিন/ কারো প্রেমিক হবো না; প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী চাই আজ/ আমি সব প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হবো।’

আবুল হাসানের কবিতা আত্মভ্রমণের। সেই ভ্রমণে হয়তো অনেক বন্ধুরা মিলে গেছে। আর কবি একা একা তাদের পাতায় মর্মর তোলা আওয়াজ ধরছেন কানে। কিংবা দৃশ্যকে বন্দী করতে চাইছেন চোখে। অথবা অনেক হাঁটাহাঁটির পরে রাতে চাঁদের আলোয় সিগারেট জ্বালিয়ে বসেছেন— ‘আমার কাছে আগুন ছিল না/ আমি চাঁদের আগুনে/ শাদা সিগ্রেট জ্বালিয়ে বসেছিলাম কুয়াশায়।’ আবুল হাসান হয়তো আগেই তাঁর নাতিদীর্ঘ জীবনের খবর পেয়েছিলেন, নয়তো কীভাবে বিবমিষা লাগা সবকিছুর কাছে আগে থেকে দরখাস্ত করে রাখলেন? 

‘এইসব থেকে আমি ছুটি চাই, ছুটি চাই

এই শিল্প, এই সামাজিক ফুল, হুলস্থুল সমিতি প্রধান যুগ

রৌদ্র আর রাত্রিভুক এই অবসাদ থেকে ছুটি চাই ছুটি চাই প্রভু!

সিংহযূথ, অশ্ববাহন থেকে ফিরে আসি আজকাল এতেও অনেক ক্লান্তি

বিবমিষা লাগে খুব ঘৃণা হয়, ঘৃণা হয় প্রভু আমি কি পাতক?’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //