হেই সামালো ধান না থাকলে

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো কারো জন্ম হয় না

‘দরদটাকে মুখের বদলে বুকের মধ্যে এবং তাৎক্ষণিকের বদলে বরাবরের করে নেবার কাব্যটাই’ লিখতে চেয়েছেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তাঁর লেখার মূলমন্ত্র মানুষ। শোনা যায়, তিনি জানালার পাশে বসেই লিখতেন। মানুষ দেখতে দেখতে। মানুষ দেখতে দেখতেই কলকাতা শহরটাকে চিনে ফেলেন।

তবে এ চেনার মধ্যে রোমান্টিসিজমের গদগদ রূপ নেই। তাহলে কী আছে সেই বাস্তবে? আকাশ আছে, ফুল-পাখি আছে, সূর্য, চাঁদ আছে। সেই আকাশের চাঁদ হাতছানি দেয় না? সুভাষ বলেন, ‘ওসব কেবল বুর্জোয়াদের মায়া।’ মায়া! কারণ, ইউটোপিয়ায় ভেসে বেড়িয়ে ‘আমরা তো নই প্রজাপতি-সন্ধানী!/অন্তত, আজ মাড়াই না তার ছায়া।’

বুদ্ধদেব বসু একবার লিখেছিলেন, ‘বাঙালি কবির হাতেও কবিতা আর শুধু বীণা হয়ে বাজছে না, অস্ত্র হয়েও ঝলসাচ্ছে।’ সুকান্তের ঝলসানো রুটির মতোই যা ‘ব্যঙ্গ-চিত্র বিদ্রুপ-বিকৃত’। এমন জনম দুঃখিনী রাস্তা দেখতে দেখতে রোমান্টিসিজম কল্পনা করা অনেকটা নিরোর বেহালা বাজানোর মতো। লিখতে বসে এই স্ফুরণ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সংবেদনা। সুকান্ত ভট্টাচার্যকে নিয়ে এক আলোচনায় লিখছিলাম, কেউ কেউ ৪৩-এর দুর্ভিক্ষের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে সরাসরি দায়ী করেন। ভারতীয় লেখিকা মঞ্জুশ্রী মুখার্জি তাঁর ‘চার্চিলস সিক্রেট ওয়ার’ বইয়ে এই দুর্ভিক্ষকে মানবসৃষ্ট বলে নিন্দা করেছেন। চার্চিলের বিরুদ্ধে বইটিতে তিনি অভিযোগ তোলেন, এই দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির পেছনে বর্ণবৈষম্যও তাকে কিছুটা উসকে দিয়েছে। রাস্তায় মারা যাওয়া মানুষের ছবিগুলি সাম্রাজ্যবাদী সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভকে আরও তীব্র করে তোলে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯১৯-এ।

দুর্ভিক্ষের টাটকা স্মৃতি তাঁকে নাড়িয়ে দিয়েছিল : ‘পেট জ্বলছে, ক্ষেত জ্বলছে/হুজুর, জেনে রাখুন/খাজনা এবার মাপ না হলে/জ্বলে উঠবে আগুন।’ এত আগুন তাঁর কলমে ঝরে। ‘বুভুক্ষিতং ন প্রতিভাতি কিক্ষিৎ’ অর্থাৎ ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে সৌন্দর্য প্রকাশিত হয় না। এই সারসত্য সুভাষ মুখোপাধ্যায় আজন্ম বিশ্বাস করতেন। লিখেছেন ‘প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য/ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা।’ এই লাইন তো বাংলা সাহিত্যে একপ্রকার প্রবাদের মতোই। এভাবেই তাঁর সেই লেখার জানালা দিয়ে কবি দেখেন, শতাব্দীলাঞ্ছিত আর্তের কান্না। যা প্রতি নিশ্বাসে লজ্জা বয়ে আনে।

ফ্ল্যাশব্যাকে যাব। ১৯৩০-এর দশক ছিল বাংলার একটি যুগ সৃষ্টিকারী দশক। কলকাতার দ্রুত নগরায়ণ ঘটে গিয়েছিল ততদিনে। ওই সময়টা ‘মহান’ সামাজিক রাজনৈতিক উত্থানের সময়। মহান শব্দটা কোটের মধ্যে রাখলাম, কারণ ব্রিটিশদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড ওই সময়টায় প্রবল বাড়তে থাকে। এমনই পরিপ্রেক্ষিতে, ১৯৪০ সালেই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘পদাতিক’ নামে একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়। এটি এমন একটা বই, যার বিষয়বস্তু ঝাঁজালো। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম প্রকাশিত বই এই পদাতিক সাহিত্যের বৃত্তে ঝড় তুলেছিল। অনেক সমালোচক আজও এই বইকে আধুনিক বাংলা কবিতার বিকাশে একটি মাইলফলক বলে মনে করেন। পরবর্তী কল্লোল প্রজন্মের কবিদের কাছেও ‘পদাতিক’-এর ভূমিকা অনেক। সেই যুগের উত্থান-পতনের সঙ্গে বাঙালি প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরেছিল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা- ‘শত্রুপক্ষ আচমকা যদি ছোঁড়ে কামান/বলব বৎস, সভ্যতা যেন থাকে বজায়/চোখ বুজে কোন কোকিলের দিকে ফেরাবো না কান’- এতটাই ‘অ-রোমান্টিক’ ও সরল দৃষ্টিভঙ্গি বাংলা কবিতায় নতুন একটি যুগের সূচনা করেছিল।

যখন আইএ পড়ছেন, কবি সমর সেন তাঁকে পড়তে দেন ‘হ্যান্ডবুক অব মার্কসিজম’। শোনা যায়, এই বইটি পড়েই তিনি মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৪২-এ স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনে অনার্স-সহ স্নাতক হন। ততদিনে অবশ্য সমসাময়িক কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো অল্প বয়সেই দৃঢ় রাজনৈতিক বিশ্বাস গড়ে তুলেছিলেন। কলেজ-জীবনে বামপন্থি ছাত্র ও রাজনীতিতে সক্রিয় সুভাষ মুখোপাধ্যায় একসময় যা বলেছিলেন, তা নিজের ভাষায় বলতে গেলে, তাঁর কাছে রাজনৈতিক স্লোগান কেবলই স্লোগান ছিল না। এসবের প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। লাল পতাকা ও স্লোগান যেন কবির জীবনেরই অংশ। তিনি স্লোগান লিখতেন। অন্যদের কাছে যা স্লোগান ছিল, তা কবির কাছে নিছক কেবল শব্দ নয়। বরং ওই শব্দগুলির জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিলেন সুভাষ। এই ১৯৪২ সালেই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। সাম্যবাদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া এবং তাঁর আদর্শ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতাকে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা দেয়। ‘পদাতিক কবি’ হিসেবে পরিচিত হন। এই পরিচিতি আজন্মকাল তাঁর নামের সঙ্গে সেঁটে ছিল।

বুদ্ধদেব বসু একবার সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘তিনি ব্যক্তিবাদের বিরোধী, তার মুক্তি কামনা এলাকার জন্যও নয়, সমগ্র মনুষ্য সমাজেরই জন্য। সাম্য ও সংহতি ছাড়া মুক্তির অন্য কোন সংজ্ঞার্থ তাঁর মনে নেই।’ এই কারণেই শহর কলকাতায় আন্দোলনে শামিল হয়েছেন, লিফলেট লিখেছেন, কারফিউ-আবদ্ধ দেওয়ালে জ্বলন্ত পোস্টার সাঁটিয়েছেন কবি। ১৯৪২ সালে মার্চ মাসে গঠিত ‘ফ্যাসিস্ট বিরোধী লেখক ও শিল্পী সমিতি’র প্রথম সারিতে ছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। এই সমিতির অন্যতম নেতা সাহিত্যিক সোমেন চন্দের নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে এই সমিতি গঠিত হয়েছিল। ’৪২-এর ৮ মার্চ আততায়ীর হামলায় নিহত হয়েছিলেন সোমেন চন্দ। তিনিই বাংলার ফ্যাসিবাদী বিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ। বাংলাদেশের বিশিষ্ট দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, প্রবন্ধকার সরদার ফজলুল করিমের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন বাংলার সমস্ত জেলা শহরেই ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা ছিল এর অন্যতম শক্তিশালী কেন্দ্র।

১৯৪২ সালের ৮ মার্চ ঢাকার বুদ্ধিজীবী, লেখকরা ফ্যাসিবাদ বিরোধী সম্মেলনের আহ্বান করেন। তাঁর ভাষায়, ‘স্থানীয় জেলা পার্টির অনুরোধে কমরেড বঙ্কিম মুখার্জি ও জ্যোতি বসু সেখানে বক্তা হিসেবে যান। সম্মেলন উপলক্ষে শহরের খুবই উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং রাজনৈতিক মহল প্রায় তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রথম যারা সম্মেলনের পক্ষে, দ্বিতীয় যারা সরাসরি বিপক্ষে, তৃতীয় যারা মোটামুটিভাবে তুষ্ণীভাব অবলম্বন করে নিরপেক্ষতার অবতরণ করেছিলেন। শেষোক্তদের মধ্যে প্রধানত কংগ্রেস মতবাদের অনুসারীরা ও দ্বিতীয় দলে ছিলেন জাতীয় বিপ্লবী, বিশেষত শ্রীসংঘ ও বিভিন্ন লোকেরা। যাই হোক, সম্মেলনের দিন সকালে উদ্যোক্তাদের অন্যতম তরুণ সাহিত্যিক সোমেন চন্দ আততায়ীর হাতে নিহত হন।’

হয়তো এই কারণেই কেউ সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে ‘কবি’ বলুক, তা কখনো চাইতেন না। কবির বড় মেয়ে কৃষ্ণকলি (পুপে) রায় ‘আনন্দবাজার’কে বলেছিলেন, হাঁটতে পছন্দ করতেন কবি। হাঁটতে হাঁটতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে আড্ডা দিতে এবং কথা বলতেও ভীষণ পছন্দ করতেন তিনি। আবার হয়তো বাজারে গিয়েছেন। খেয়াল করতেন, কে ফাঁকা বসে রয়েছেন। তাঁর কাছ থেকেই সব জিনিস কিনে নিয়ে আসতেন। কবিকন্যার কথায়, ‘নিয়মিত পচা মাছ আনতেন। তা নিয়ে মা-র সঙ্গে ঝামেলাও হতো। বাবা শুধু বলতেন, ওঁর (যাঁর কাছ থেকে মাছ কিনেছেন) বউনি হচ্ছিল না। তাই এনেছি। না হলে ওঁদের চলবে কী করে।’ আসলেই এই সহজ সরল জীবনবোধই ফুটে উঠেছে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখায়। দৈনন্দিন জীবনের সহজাত সৌন্দর্য, সাধারণ মানুষের প্রতি সহানুভূতি, মানবতার প্রতি তাঁর বিশ্বাসই ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’-এর মতো অবিস্মরণীয় কবিতা তৈরি করেছে।

হয়তো এই কারণেই নিজের লেখা সম্পর্কে কবি নিজেই বলেছেন, ‘আমার লেখায় আমি দেখেছি, যে জায়গাটা লোকে খুব প্রশংসা করেছে, এটা দারুণ লিখেছো, সে সব জায়গা, আমি দেখেছি, আসলে আমার নয়। অন্যের কথা। সাধারণ মানুষের কথা। আমি মেরে দিয়েছি। আত্মসাৎ করেছি। কেউ ভিক্ষে করে খায়। তুমি কী করো? না, টুকিয়ে, টুকিয়ে খাই।’ তাঁর মতো লোকেদেরই ‘মা-সরস্বতী দিনের পর দিন নাকে দড়ি দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়ে মারেন’।

’৬০-এর দশকের শেষের দিকে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে জেল খাটতে হয় তাঁকে; কিন্তু কখনোই তাঁর কণ্ঠ হারাননি। ওই দশকের গোড়ার দিকে কয়েক বছর সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে যৌথভাবে ‘সন্দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনা করা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা ১৯৮০-র দশকের শেষভাগ থেকে অন্য ‘ডিকশনে’ পৌঁছায়। এর প্রধান কারণ কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি মোহভঙ্গ। এর ফলস্বরূপ প্রকাশিত হয় ‘যা রে কাগজের নৌকো’ (১৯৮৯), ‘ধর্মের কাল’ (১৯৯১), ‘একবার বিদায় দে, মা’। ‘কলাপাতায় আলতা-সিঁদুর/পাড়ে রেখে সুয্যিঠাকুর/ঝাঁপ দেন জলে/মার কপালে কাঁচপোকার টিপ/চাঁদ হিংসেয় জ্বলে/খোকার হাতে ছিপ/জলের গায়ে ছবি/ক্ষীর নদীর কূলে ব’সে হাই/তুলতে তুলতে খোকা/দেখতে পাচ্ছে সবই/কোথাও কারো ভুলে/ছবি উঠল দুলে/ঢেউ হারাল খেই/কোথাও কিচ্ছু নেই/সমস্তই ভোঁ ভাঁ/চোখের পাতায় মুড়ে/ঘুমের মধ্যে মা তুমি দিয়েছিলে/স্বপ্ন হয়তো বা/ছিপ নিয়ে গেল কোলাব্যাঙে/মাছ নিয়ে গেল চিলে/মা, তুমি জল পাঠাও মরা গাঙে।’

এরপর হেই সামালো ধান থাকে না, জান মান কবুল হয় না, মরা গাঙে বান আনতে অত্যাচারী জাতির অপরাজয়ও আত্মার প্রতীক ধনঞ্জয় বৈরাগীর জন্ম হয় না, জন্ম হয় না সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো কারোরই। আজকের এই টানাপোড়েনের সময় বাঙালি সত্যিই বড় ‘অভাবী’ হয়ে পড়েছে তাই।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //