রুমীর যুদ্ধ, রেড সেক্টর ও বিজয়ের ঘোষণা

একাত্তর সালে রুমীর বয়স ছিল কুড়ি বছর। সেই সময়কার পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত এবং অতি-স্বচ্ছল পরিবারগুলোর মধ্যে একটি ছিল রুমীর বাবা-মা শরীফ ইমাম এবং জাহানারা ইমামের পরিবার। তার মাকে দেখে ঢাকার মানুষ সুচিত্রা সেন বলে ভুল করত। পেশায় শিক্ষক।

শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গনে তিনি ছিলেন অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তিত্ব। সেই সময় ঢাকা শহরে যে হাতে গোনা কয়েকজন নারী নিজে গাড়ি ড্রাইভ করতেন, জাহানারা ইমাম ছিলেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। বাবা ছিলেন তৎকালীন অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের অধিকর্তা। এমন পরিবারের সন্তান রুমী। তাকে চুল কাটাতে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা ক্লাবে গাড়িতে করে। আইএসসি পাস করেছে রুমী। ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছে। আবার আমেরিকার ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতেও তার অ্যাডমিশন হয়ে গেছে। সেই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসের ২ তারিখে তার ক্লাস শুরু হবে। তাকে তাই আমেরিকায় পৌঁছুতে হবে আগস্টের শেষের দিকে। সেখানে গিয়ে চার বছর পড়াশুনা করে পুরোদস্তুর বিদেশি ইঞ্জিনিয়ারিং সার্টিফিকেট নিয়ে ফিরে আসবে। একাত্তরের এপ্রিল মাসে দেশের এই উত্তাল অবস্থার মধ্যে বাবা-মা ভাবছেন, রুমীকে আগেই পাঠিয়ে দেবেন আমেরিকায়।

সালটা ঊনিশশো একাত্তর না হয়ে যদি একবিংশ শতাব্দীর হয়, তাহলে বাংলাদেশের যে কোনো বাবা-মা এইরকম পরিস্থিতি দেখলে ছেলেকে তো আগেই পাঠিয়ে দেবেন আমেরিকায়। বাবা-মা তো পাঠাবেনই, ছেলেও যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠবে। জাহান্নামে যাক দেশ, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।

কিন্তু রুমী আমেরিকা যায়নি। তার মা-বাবাও তাকে আমেরিকা যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করেননি। রুমী যুদ্ধে গেছে। ২ নম্বর সেক্টরে গেরিলা হিসাবে যোগ দিয়েছে। বাবা-মা তার বাধা হয়ে দাঁড়াননি। বরং নিজেরা তাকে যুদ্ধে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

অবিশ্বাস্য মনে হয়। কারণ এখনকার কথা বাদ দিলেও, সেই একাত্তরেও তো অনেক মা-বাবাই নিজেদের তরুণ-জোয়ান ছেলেদের যুদ্ধের আঁচ থেকে দূরে রাখার জন্য করেননি এমন কাজ নেই।

এখন কোনো রুমী তৈরি হবে বলে আশা করা যায় না। তাহলে তখন কেমন করে রুমীর মতো তরুণ-যুবকদের পেয়েছিলাম আমরা?

দেখা যাচ্ছে তার মা-ও একটু অবাকই হয়েছিলেন গণঅভুত্থানের সময় রুমীর কার্যকলাপ দেখে। নিজের দিনপঞ্জিতে লিখেও রেখেছেন সেকথা। রুমীর মতিগতি সুবিধার নয় মনে করে নন্দাই একরাম সাহেবকে বলেছিলেন রুমীর সঙ্গে কথা-বার্তা বলতে। একরাম সাহেবের রিপোর্ট তার মুখের ভাষাতেই লিখেছেন রুমীর মা জাহানারা ইমাম- ‘রুমীর সঙ্গে আলাপ করে আমি তো হতবাক। এইটুকু ছেলে এই বয়সে এত পড়াশুনা করে ফেলেছে? আগে তো ভাবতাম বড়লোকের ছাওয়াল হুশ হুশ করে গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়ায়- চোঙ্গা প্যান্ট পরে, গ্যাটম্যাট করে ইংরেজি কয়- আলালের ঘরের দুলাল; কিন্তু এখন দেখতিছি এ বড় সাংঘাতিক চিজ। মার্কস-এঙ্গেলস একেবারে গুলে খেয়েছে। মাও সে তুংয়ের মিলিটারি রাইটিংস সব পড়ে হজম করে ফেলেছে। এই বয়সে এমন মাথা, এমন ক্লিয়ার কনসেপশন, বাউরে, আমি তো আর দেখি নাই।’

আমরা এতক্ষণে জেনে গেছি রুমী ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। তার মতো পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড, তার মতো একাডেমিক মেধা, তার মতো তীক্ষ্ণধী সম্পন্ন কোনো ছেলে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হবে, এমনটি এখন ভাবা যায় না। কেননা দেশ যেভাবেই চলুক না কেন, জন্মসূত্রেই তার রয়েছে নিশ্চিত সামাজিক অবস্থান, নিশ্চিত হোয়াইট কলার পেশা। সে কোন দুঃখে যাবে রাস্তায় মিছিল করতে! 

কিন্তু রুমী গেছে। তার মতো আরো অনেকেই গেছে। কেননা সে সমাজে বিদ্যমান অসাম্য দেখে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি। এটিকে তার কাছে বরাবরই অসঞ্জস্য মনে হয়েছে। সেই মনের তাড়নাই তাকে বিপ্লবী ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতে বাধ্য করেছে।

দেশ তো তখন অগ্নিগর্ভ। স্টেডিয়ামে টেস্ট ক্রিকেট খেলা বন্ধ করে দর্শকরা স্লোগান দিতে দিতে বেরিয়ে আসছে। ছাত্র সংগঠনগুলো বেলা দেড়টায় ঘোষণা দিলে বেলা তিনটায় বিশাল জনসভা হয়ে যাচ্ছে। সরকার কারফিউ ঘোষণা করলেও কেউ সেটা মানছে না। দলে দলে লেকে রাস্তায় নেমে যাচ্ছে, ব্যারিকেড বানাচ্ছে। পুলিশ গুলি করছে। গুলি খেয়ে জনতা পালানোর বদলে আরো ক্ষেপে উঠছে, আরো জোরে স্লোগান দিচ্ছে। মিটিং-মিছিল একযোগে চলছে। মার্চের ২ তারিখে দেখা যাচ্ছে ঢাকায় যতগুলো ছাত্র, শ্রমিক, রাজনৈতিক দল আছে তারা সবাই সেদিন মিটিং ডেকেছে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ আর ডাকসুর যৌথ জনসভা বটতলায় বেলা ১১টায়, ৩টায় পল্টনে সমাবেশ। ন্যাপ ১১টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে, বিকালে পল্টনে। ন্যাপের কর্মসূচির সঙ্গে যোগ দিয়েছে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, কৃষক সমিতি। বাংলাদেশ জাতীয় লীগের সভা বায়তুল মোকাররমে বিকাল সাড়ে ৩টায়। নবগঠিত ফরোয়ার্ড স্টুডেন্ট ব্লকের সভাও বায়তুল মোকাররমে বিকাল ৪টায়। মার্চের ৩ তারিখে বটতলার জনসভায় ওড়ানো হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রস্তাবিত জাতীয় পতাকা। 

হরতাল চলছে। তার মধ্যেই চলছে লেখক সংগ্রাম শিবিরের মিটিং। হাসান হাফিজুর রহমান আহ্বায়ক। কমিটিতে আছেন সিকান্দার আবু জাফর, আহমদ শরীফ, শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, বদরুদ্দীন উমর, রণেশ দাশগুপ্ত, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, রোকনুজ্জামান খান, আবদুল গাফফার চৌধুরী, সুফিয়া কামাল, জহির রায়হান, আবদুল গণি হাজারী, আলাউদ্দিন আল-আজাদ, আহমদ ছফা, রাবেয়া খাতুন।

শিল্পীরাও আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন বিক্ষুব্ধ শিল্পী সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে। আলী মনসুর, সৈয়দ আবদুল হাদী, লায়লা আর্জুমান্দ বানু, মোস্তফা জামান আব্বাসী, জাহেদুর রহিম, ফেরদৌসী রহমান, বশির আহমেদ, খান আতাউর রহমান, বারীন মজুমদার, আলতাফ মাহমুদ, গোলাম মোস্তফা, কামরুল হাসান, অজিত রায়, হাসান ইমাম, কামাল লোহানী, জি এ মান্নান, আবদুল আহাদ, সমর দাস, গহর জামিল, রাজ্জাকের নেতৃত্বে চলছে লাগাতার কর্মসূচি।

পাকিস্তানি খেতাব বর্জন করে চলেছেন সচেতন বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বর্জন করেছেন ‘হেলালে ইমতিয়াজ’ খেতাব, মুনীর চৌধুরী বর্জন করেছেন ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’। নাটোর থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য ডাঃ শেখ মোবারক হোসেন ‘তমঘা-এ-পাকিস্তান’ এবং ফরিদপুর থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য শেখ মোশারফ হোসেন বর্জন করেছেন ‘তমঘা-এ-কায়েদে আজম’ খেতাব। দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিনের খেতাব ছিল দুইটি- ‘সিতারা-ই খেদমত’ আর ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’। দুটিই বর্জন করেছেন তিনি।

এমনকি জন্মান্ধদের সংগঠনও মিছিল করছে রাজপথে।

এই রকম অবস্থাতেই তো রুমীরা জন্মায়।

১৬ তারিখ সকালে জাহানারা ইমাম আবিষ্কার করলেন তার দুই ছেলে রুমী-জামী বাড়িতে বোমা বানাচ্ছে। তা দেখে ‘আমি কাঁপতে কাঁপতে নিজের ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। কি করি? কি বলি? সারাদেশ স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে; ঢাকায়, রাজশাহীতে, চট্টগ্রামে সবখানে এই দাবি তুলে শান্তিপ্রিয় বাঙালিরা আজ মরিয়া হয়ে লাঠি, সড়কি যা পাচ্ছে, তাই হাতে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে গুলির সামনে। ঘরে ঘরে নিজের হাতে বোমা পটকা, মলোটভ ককটেল বানিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে প্রতিপক্ষের ওপর। এই রকম সময়ে আমার ছেলেকে আমি কি চাইব ঘরে আটকে রাখতে? আমি কি চাইব সে শুধু বন্ধুবান্ধব নিয়ে জাঁকিয়ে বসে, স্বাধীনতার দাবি-দাওয়ার প্রশ্নে তর্ক-বিতর্ক, চুলচেরা বিশ্লেষণ নিয়ে মত্ত থাকুক?’

চুলচেরা বিশ্লেষণও অবশ্য চলছিল পাশাপাশি। ৭ মার্চের জনসভার পরে রুমী বাড়ি ফিরে আফসোস করছিল এই বলে যে- ‘আমার মনে হচ্ছে শেখ আজ অনায়াসে ঢাকা দখল করার মস্ত সুযোগ হারালেন।’

বড়রা প্রতিবাদ করলে রুমী সরাসরি জানায়- ‘আপনারা দেয়ালের লিখন পড়তে অপারগ। দেখেননি আজ মিটিংয়ে কত লোক স্বাধীন বাংলার পতাকা নিয়ে এসেছিল? জনগণ এখন স্বাধীনতাই চায়, এটা তাদের প্রাণের কথা। নইলে মাত্র এই ছ’দিনের কর্মকাণ্ডের মধ্যে সবাই সবখানে স্বাধীন বাংলার ওই রকম ম্যাপ লাগানো পতাকা সেলাই করার মতো একটা জটিল কাজ, অন্যসব কাজ ফেলে, সেটা আবার বাতাসে নাড়াতে নাড়াতে প্রকাশ্য দিবালোকে মিছিল করে যায়?’

ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসেছেন। লোককে দেখানো হচ্ছে যে শেখ মুজিবের সঙ্গে একটা সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি; কিন্তু রুমী প্রশ্ন তোলে পাকিস্তানের অনেক পদস্থ সামরিক কর্মকর্তার ঢাকা উপস্থিতি নিয়ে। তাদের মধ্যে আছেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ, প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল পীরজাদা, মেজর জেনারের ওমর এবং আরো ছয়জন ব্রিগেডিয়ার। শান্তি আলোচনার সামরিক অফিসারদের উপস্থিতি রুমীর সতর্ক পর্যবেক্ষণ এড়ায়নি। দিনের পর দিন আলোচনা চলছে। ২৫ মার্চ রুমীর বিরক্তি আর বাঁধ মানেনি- ‘সাদা গাড়িতে কালো পতাকা উড়িয়ে শেখ রোজ প্রেসিডেন্ট হাউজে যাচ্ছেন আর আসছেন, আলোচনার কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। ওদিকে প্লেনে করে রোজ সাদা পোশাকে হাজার হাজার সৈন্য এসে নামছে, চট্টগ্রামে অস্ত্রভর্তি জাহাজ ভিড়ছে। আর এদিকে ঢাকার রাস্তায় লাঠি-হাতে বীর বাঙালিরা ধেই ধেই করে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সালাম দিয়ে হৃষ্টচিত্তে বাড়ি ফিরে পেট-পুরে মাছ-ভাত খেয়ে ঘুম দিচ্ছে। ওরা শুধু সময় নিচ্ছে। ওরা আলোচনার নাম করে আমাদের ভুলিয়ে রাখছে। শেখ বড্ডো দেরি করে ফেলছেন। এ পথে আমরা বাঁচতে পারব না।’

সেই রাতেই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরস্ত্র অপ্রস্তুত বাঙালির ওপর।

এপ্রিলের ৯ তারিখে রুমী তার ইচ্ছা জানাল- ‘আম্মা আমি যুদ্ধে যেতে চাই।’

জাহানারা ইমাম মা হিসাবে ভেতরে ভেতরে কেঁপে তো উঠবেনই; কিন্তু একই সঙ্গে আনুষঙ্গিক কিছু প্রশ্নও ভেসে ওঠে তার মনে- কিন্তু যুদ্ধটা কোথায়? কেউ তো ঠিক করে কিছু বলতে পারছে না। সবখানে শুধু জল্লাদের নৃশংস হত্যার উল্লাস- হাতবাঁধা, চোখবাঁধা অসহায় নিরীহ জনগণের ওপর হায়েনাদের ঝাঁপিয়ে পড়ার নিষ্ঠুর মত্ততা। যুদ্ধ হচ্ছে- এ কথা ধরে নিলেও তা এতই অসম যুদ্ধ যে কয়েক দিনের মধ্যেই পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের আধুনিকতম মারণাস্ত্র দিয়ে বিদ্রোহী বাঙালিদের গুঁড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেবে। সবখান থেকে তো সেই খবরই শুনতে পাচ্ছি। এই রকম অবস্থায় রুমীকে যুদ্ধে যেতে দিই কি বলে?’

কিন্তু যেতে দিতে হয়েছিল। যুদ্ধক্ষেত্র খুঁজেও পেয়েছিল রুমী।

৬ মে রুমী বিদায় নিল বাড়ি থেকে। সঙ্গে নিয়েছে একটা ছোট এয়ারব্যাগ। তাতে দুসেট কাচা কাপড়, তোয়ালে, সাবান, স্যান্ডেল আর দুটো বই- ‘জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ও ‘সুকান্ত সমগ্র’। 

মা জাহানারা ইমাম গাড়ি চালিয়ে তাকে নামিয়ে দেবেন সেক্রেটারিয়েটের সেকেন্ড গেটে। গাড়িতে আছে ছোটভাই জামীও। পেছনের সিটে রুমী আর বাবা শরীফ ইমাম বসে। শরীফ সাহেবের হাতে খোলা পত্রিকা। পড়ার ভান করছেন। রুমী বলে রেখেছে, সেকেন্ড গেটে সে নেমে যাওয়া মাত্র তোমরা চলে যাবে। পেছন ফিরে তাকাবে না।

সেই কথা মেনে চলা হলো অক্ষরে অক্ষরে। মা জাহানারা ইমাম দিনপঞ্জিতে লিখলেন- ‘ইগলু আইসক্রিমের দোকানের সামনে গাড়ি থামালাম। রুমী আধাভর্তি পাতলা ছোট এয়ারব্যাগটা কাঁধে ফেলে নেমে সামনের দিকে হেঁটে চলে গেল। যেন একটা কলেজের ছেলে বই-খাতা নিয়ে পড়তে যাচ্ছে। আমি হুস করে এগিয়ে যেতে যেতে রিয়ারভিউ-এর আয়নায় চোখ রেখে রুমীকে একনজর দেখার চেষ্টা করলাম। দেখতে পেলাম না, সে ফুটপাতের চলমান জনস্রোতের মধ্যে মিশে গেছে।’

দুই

রুমী যোগ দিয়েছিল সেক্টর-২ এ।

নানা কারণে এই সেক্টরটি মুক্তিযুদ্ধের সময় আলাদাভাবে আলোচিত হবার দাবি রাখে।

সেক্টর কমান্ডার ছিলেন বাংলাদেশের সেনানায়কদের মধ্যে সবচাইতে সৃজনশীল এবং একরোখা দেশপ্রেমিক মেজর খালেদ মোশাররফ। অন্য কোনো সেক্টরে আওয়ামী লীগের ছাড়পত্র ছাড়া কোনো যুবক যোগ দেবার সুযোগ পেত না। বামপন্থিদের যুদ্ধে যোগ দেবার সুযোগ সহজে দেওয়া হতো না। খালেদ মোশাররফ এই আদেশ মানেননি। আওয়ামী লীগ তো বটেই, ভারত সরকারের নিষেধেও কর্ণপাত করেননি। যদিও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন সেনাপ্রধান আতাউল গণী ওসমানী বরাবরই সমর্থন জুগিয়ে গেছেন খালেদ মোশরারফকে; কিন্তু ভারত সরকারের চাপ এবং মুজিব বাহিনীর চাপ বরাবরই বহাল ছিল খালেদ মোশাররফের ওপর। এই কারণে ভারত সরকার সেক্টর-২ এর নাম দিয়েছিল রেড ব্রিগেড।

মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়জুড়ে রাজধানী ঢাকা ছিল সেক্টর-২ এর অধীনে। এখানে যত রকম গেরিলা অ্যাকশন এবং কর্মকাণ্ড চলেছে, তা থেকেই বোঝা যায় যে ক্ষুরধার এক যুদ্ধ-মস্তিষ্ক কাজ করছে সকল কাজের প্রেরণা হিসাবে। খালেদ তার কাজে যোগ্য সহকারী হিসাবে পেয়েছিলেন ক্যাপ্টেন হায়দারকে। ঢাকা শহর ছেয়ে ফেলেছিল যে শত শত গেরিলা, তারা সবাই ক্যাপ্টেন হায়দারের নিজের হাতে প্রশিক্ষিত। গেরিলাদের প্রতি খালেদ মোশাররফের নির্দেশ ছিল ব্রিজ-কালভার্ট-রেললাইন-দালানসহ যেসব স্থাপনায় নাশকতা চালানো হবে, সেগুলোর খুব বেশি ক্ষতি যেন না করা হয়। সাময়িকভাবে পাকবাহিনীকে দুর্বল করার জন্য এসব নাশকতা চালাতে হবে; কিন্তু পুরো স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেলে স্বাধীনতার পরে সেগুলো আবার নতুন করে তৈরি করতে হবে। তাতে জাতির প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হবে, এবং দেশে পুনর্গঠনের কাজ কঠিন হয়ে পড়বে।

এই বিষয়ে নিজের লেখা ‘ব্রেভ অব হার্ট’ বইতে আলোকপাত করেছেন ঢাকার অন্যতম গেরিলা যোদ্ধা হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক-

সেক্টর হেড কোয়ার্টারে কাজ করতে করতে আমরা অনুভব করলাম যে হঠাৎ করেই কিছু কিছু পরিবর্তনের ঘটনা ঘটছে। নতুন কিছু মুখ আসছে, দায়িত্ব গ্রহণ করছে, এবং সেইসঙ্গে পুরনো কিছু মুখকে আর দেখা যাচ্ছে না। তাদের মধ্যে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সেক্টরের সবাই যার অনুপস্থিতি অনুভব করেছে, বিশেষত ঢাকার গেরিলারা। সে হচ্ছে শহীদুল্লাহ খান বাদল। কেউই তার কথা বলত না। আমাদের প্রশ্নের উত্তরে মেজর এটিএম হায়দার বললেন- ‘বাদলকে এই সেক্টর ত্যাগ করতে হয়েছে প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকারের চাপে।’

আমরা জানতাম যে প্রবাসী সরকার সেক্টর-২ এর ওপর খুব একটা খুশি নয়। আমরা তার কারণও ভালো করেই জানতাম। অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, কমান্ডার-ইন-চিফ কর্নেল এম এ জি ওসমানী আমাদের সপক্ষেই ছিলেন; কিন্তু বাকি অনেকেই আমাদের প্রতি খুশি ছিলেন না কারণ আমাদের সেক্টর কোনোরূপ পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করত না, সে যে-ই হোক না কেন। প্রত্যেককেই দেশের জন্য যুদ্ধ করার সুযোগ দেওয়া হতো। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ঘন ঘন আমাদের সেক্টর পরিদর্শনে আসতেন। যুদ্ধের পরিকল্পনা ও অন্য যে কোনো জটিল সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তিনি কর্নেল খালেদের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন।

বিভিন্ন এমএনএ ও এমএলএর স্ট্যাম্পসহ স্বাক্ষর করা চিঠি নিয়ে যে যুবকরা আসত, তাদের প্রতি আলাদা কোনো গুরুত্ব দেওয়া হতো না এই সেক্টরে। তাদের জন্য কখনও বিশেষ রেশন বা অন্য কোনো বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সব ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে তাদের বেশিরভাগই ছিল ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন অথবা ছাত্রলীগের কর্মী। অন্য শহরের যে সকল ছাত্ররা অংশগ্রহণ করেছে তারা সকলেই ছিল বামপন্থি বা সমমনা। বিভিন্ন গ্রাম থেকে কৃষক এবং যুবক যারা অংশগ্রহণ করেছিল তাদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি।

বাদলকে যে এই সেক্টর ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল, তার অন্যতম কারণ হচ্ছে বাদল ছিল রাশেদ খান মেননের সবচেয়ে ছোট ভাই। রাশেদ খান মেনন সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানের একজন শক্তিশালী বাম ছাত্রনেতা ছিলেন। সুলতান মাহমুদ খান, একজন আর্কিটেক্ট এবং যুদ্ধের রিপোর্টার, তিনিও বাদলের বড় ভাই এবং আমাদের সেক্টরেই ছিলেন; কিন্তু প্রবাসী সরকার তাঁকে কোনো হুমকি মনে করেনি। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বের হয়ে আসা নতুন নেতৃত্ব ছাত্রদের মনে ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছিল, তাদের ও বামপন্থি ছাত্রদের প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকার হুমকি মনে করত।

অন্য একটি কারণ হতে পারে যে প্রবাসী সরকার সরকারিভাবে অন্য কোনো ফোর্সকে স্বীকৃতি দেয়নি। আওয়ামী লীগের পক্ষের ছাত্ররা যারা সাধারণত বিএলএফ অথবা মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত ছিল, তারা আমাদের সেক্টরে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। আমাদের সেক্টরের যুবক নেতাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাদের কাছে আরও একটি হুমকির মতো মনে হয়েছিল। রাজনৈতিক দলাদলি আমাদের সেক্টরে সক্রিয় ছিল না। রাজনৈতিক প্রচারণা ছাত্রদের ঐক্য এবং যুবক নেতৃত্বের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়েছিল। যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের ব্যপারে সবসময় মগ্ন, সেখানে অন্যরা আগ্রহী ছিল যুদ্ধের সুফল কীভাবে ভোগ করা যায় সেসব নিয়ে ব্যস্ত থাকতে। বিএলএফ-এর সদস্যরা ‘র’ বা ভারতীয় ইন্টেলিজেন্স-এর দ্বারা প্রশিক্ষিত ছিল। তাদের কাছে ভালো ভালো আধুনিক অস্ত্রপাতি এবং গোলাবারুদ ছিল এবং বেশিরভাগ সুবিধা তারাই ভোগ করত; কিন্তু যুদ্ধকে বোঝা বা কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করার অন্তর্নিহিত ক্ষমতা ও যোগ্যতা তাদের ছিল না। ভারতীয় ইন্টালিজেন্স বিভাগ যুদ্ধের ব্যাপারে যে ওরিয়েন্টেশন দিত, সেটা আমাদের থেকে ভিন্ন রকম ছিল।

আমাদের সেক্টর ও অন্যান্য সেক্টরগুলোতে আলোচনা শুরু হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা নিয়োগের প্রক্রিয়া এবং দেশের ভেতরে তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে। যারা নিজেদেরকে ‘বিএলএফ’ বলে পরিচয় দিত, তারা শত্রুর এনকাউন্টারের সময় অস্ত্র এবং গোলাবারুদ ফেলে পালাত। বিশেষত এই কাজ তারা করেছিল আমাদের মনতলি সাব-সেক্টরে। এরকম একবার পালানো সময় তারা প্রচুর মূল্যবান অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেলে এসেছিল। ফলে পরে আমাদের অনেক বড় রকমের ক্ষতি সহ্য করতে হয়েছিল। পরে তাদেরকে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল মনতলি সাব-সেক্টরে ক্যাপ্টেন আয়েন উদ্দিনের অধীনে।

আরেকবার দেখা গেল, যখন আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ত্রিমোহনীতে তাদের সর্বস্ব পণ করে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তখন ‘বিএলএফ’ গ্রুপ যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে পাশের এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছে। তাদের একমাত্র কাজ ছিল যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে এলাকার সাধারণ মানুষকে তাদের শক্তি দেখানো।

এরকম এক ঘটনায় কর্নেল খালেদ আগরতলা থেকে ফিরে আসার সময় তাঁর নিয়মিত বেসামরিক সঙ্গী শাহাদত ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘আমি কি কখনো তোমার রাজনৈতিক পরিচয় জিজ্ঞেস করেছি? আমি কখনো বাদল বা আলমকে তাদের রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের ব্যাপারে কিছু বলিনি। প্রকৃতপক্ষে যে যে আমাদের সেক্টরের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চেয়েছে, তাদের কাউকেই আমি কখনো এই ধরনের প্রশ্ন করিনি। প্রত্যেকেরই তার দেশের জন্য লড়াই করার অধিকার রয়েছে।’ তিনি শাহাদত ভাইকে প্রশ্ন করলেন, যদিও মনে হচ্ছিল তিনি কোনো উত্তর চাইছেন না, বরং নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলছেন- ‘তুমি কি বলতে পারো আমার ছেলেরা যুদ্ধে যোগ দিয়ে কোন অন্যায়টা করেছে? আমি তো বুঝতে পারছি না।’

শাহাদত ভাই কমান্ডারের দিকে তাকিয়ে ছিল; কিন্তু কোনো উত্তর দেয়নি। কর্নেল খালেদ নিজেই নিজের বক্তব্য শেষ করলেন- ‘শাহাদত, মজার ব্যাপারটা কী জানো, যাকেই আমি আমার ঘনিষ্ঠ বলে কাছে রাখতে চাই, বা কোনো বড় কাজের দায়িত্ব দিতে চাই, বা ছাত্রদের নেতৃত্ব নিতে বলি, দেখা যায় হয় সে বামপন্থি, অথবা আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থাহীন। নিশ্চয়ই এটা আমার বা তাদের দোষ নয়।’

১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পরেও সেক্টর-২ মনে করেনি যে তাদের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। বিশেষ করে ভারতীয় মিত্র বাহিনী যেন মুক্তিযোদ্ধাদের আগে রেডিও-টেলিভিশনে বিজয়ের ঘোষণা দিতে না পারে, সে ব্যাপারে পূর্ণ সচেতনতার পরিচয় দিয়েছে তখন মেজর হায়দারের পরিচালনাধীন সেক্টর-২। এই বিষয়ে আহত খালেদ মোশাররফ পরিষ্কার নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন।

এই বিষয়ে হাবিবুল আলম তার বইতে বিস্তারিত লিখেছেন-

দুইজন গেরিলা জানাল যে ভারতীয় মিত্র বাহিনী আজ রেডিও বাংলাদেশের দখল নিতে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে ভারতীয় বাহিনীর অফিসার-ইন-কমান্ড সকাল ৮টা বা সাড়ে ৮টার দিকে তাদের বিজয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন। খবরটি শুনে আমি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। আমার কাছে মনে হলো আমাদের জন্য এর চেয়ে বেশি অবমাননাকর আর কিছুই হতে পারে না যে বিদেশি একজন ব্যক্তি আমাদের রাজধানীতে আমাদের গণমাধ্যম থেকে আমাদের দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিচ্ছে। বার্তাটি আমাদের মাথার মধ্যে বন্য আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল। আমাদের সব নেতারা কি মরে গেছে যে কেউ একজন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বা সেক্টর-২ এর কেউ কেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারবে না? আমরা প্রতিজ্ঞা করলাম যে আমাদের সেক্টর কমান্ডার অথবা প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের কোনো প্রতিনিধি ছাড়া অন্য কাউকে প্রথম ঘোষণার সুযোগ নিতে দেব না। তার মানে হচ্ছে সঠিক ব্যক্তিকে না পাওয়া পর্যন্ত ওই জায়গা যে কোনো মূল্যে আমাদের নিজেদের দখলে রাখতে হবে। আমরা আরো দ্রুত চিন্তা করতে শুরু করলাম। আমাদের মধ্যে কে উপস্থিত আছেন যিনি প্রবাসী সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন? আমরা আমাদের কার্যকরী কমান্ডার মেজর এটিএম হায়দার ছাড়া আর কোনো নাম খুঁজে পেলাম না। তিনিই ১৬ ডিসেম্বর থেকে ঢাকায় সেক্টর-২ ও বাংলাদেশ বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করছেন। যদিও আমার মনে পড়েছিল লে. কর্নেল শফিউল্লাহ ঢাকার কোনো এক স্থানে বা নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করছেন; কিন্তু আমরা জানতাম না তিনি ঠিক কোন জায়গাতে রয়েছেন। দ্বিতীয়ত আমরা জানতে পেরেছিলাম যে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমাদের সি-ইন-সি উপস্থিত ছিলেন না। আমরা এটাও জানতে পেরেছিলাম যে আমাদের ডেপুটি চিফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার কলকাতা থেকে যৌথ কমান্ডের সঙ্গে রওনা দিয়েছেন। সুতরাং আমাদের হাতে বিকল্প ছিল সামান্যই। হয় আমরা হায়দার ভাইকে ধরে রাজি করাব স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে; অথবা ধ্বংস করে ফেলব রেডিও স্টেশন যাতে ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়ক এই বেতারের সুবিধা গ্রহণ করে ঘোষণা দিতে না পারেন।

মেজর হায়দার ও শাহাদত ভাই দু’জনেই অনুরোধমতো নির্ধারিত সময়ে চলে এলেন। আমরা সাংবাদিক কাদের মাহমুদ ও মি. এখলাস আহমেদকে পেলাম ভবনের প্রথম তলায়। তারা দু’জনেই শাহাদত ভাইয়ের পরিচিত। ফতেহ সঙ্গে সঙ্গে মেজর হায়দার ও শাহাদত ভাইকে কোণের একটি ঘরের দিকে নিয়ে গেল। তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন কাদের মাহমুদ। মেজর হায়দারের পাঠের জন্য ঘোষণাপত্র লিখলেন কাদের মাহমুদ ও শাহাদত ভাই। আমরা মেজর হায়দারকে পরিচয় করিয়ে দিলাম মি. শামসুল হুদা চৌধুরীর সঙ্গে। ততক্ষণে সেখানে পাঁচ-ছয় জন মুক্তিযোদ্ধা পৌঁছে গেছে। আমরা তাদের পরিষ্কার, দ্বিধাহীন নির্দেশনা দিলাম। মেইন গেট সাড়ে ৮টা পর্যন্ত পুরোপুরি বন্ধ রাখতে হবে, এবং আমাদের অনুমতি ছাড়া কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। যদি কোনো কারণে মিত্র বাহিনী এসে পড়ে, তাহলে তাদেও মেইন গেটে অপেক্ষায় রাখতে হবে যতক্ষণ সম্ভব, এবং যোগাযোগ করতে হবে আমাদের সঙ্গে। কোনো পরিস্থিতিতেই কাউকেই ভেতরে ঢুকতে দেওয়া চলবে না।

আমরা প্রস্তুতি নেওয়ার সময় একজন মুক্তিযোদ্ধা ছুটে এসে জানালো যে তিন-চার জন সৈন্য নিয়ে মিত্র বাহিনীর একজন অফিসার এসেছেন। তিনি ভেতরে প্রবেশ করতে চাইছেন। ফতেহ ছুটে গিয়ে মি. শামসুল হুদা চৌধুরীকে জানালো মিত্র বাহিনীর আগমনের কথা। মি. হুদা আঞ্চলিক পরিচালকের কক্ষে বসে ভারতীয় অফিসারকে অভ্যর্থনা জানালেন। অফিসার তাঁর সঙ্গে কয়েক মিনিট কথা বলে খুশি মনে চলে গেলেন। অফিসার চলে যাওয়ামাত্র মি. হুদা আমাদের জানালেন যে লে. কর্নেল পদবির এই অফিসারকে তিনি বলেছেন রেডিও স্টেশন চালু করতে অনেক সময় লাগবে।

আবার, যখন দেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রস্তুতি এগিয়ে চলেছে পুরোদমে, সাদেক হোসেন খোকার গ্রুপ তখন হঠাৎ আওয়ামী লীগের দুই নেতাকে সঙ্গে নিয়ে হাজির। আমরা শুধু শামসুজ্জোহা সাহেবকে চিনতে পারলাম। তিনি ছিলেন নারায়ণগঞ্জের এমপি। অন্য ভদ্রলোকটি জোহা সাহেবের চাইতে অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ; কিন্তু তিনি আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। মি. জোহা তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিলেন জহুর আহমেদ চৌধুরী বলে। আমরা তৎক্ষণাৎ অন্য একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে ভদ্রতার সঙ্গে তাদের আগমনের কারণ জানতে চাইলাম। প্রবীণ রাজনীতিবিদ মি. জহুর আহমেদ চৌধুরী মেজর হায়দারের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছার কথা বারবার জানাতে লাগলেন। আমরা কৌশলে তাঁদের সেই ঘরের মধ্যেই বসিয়ে রাখলাম। তাদের ব্যস্ত রাখার জন্য ফতেহ বলল যে তাঁরা যা বলতে চান, তা লিখে ফেলুন। 

সকাল ৮.১০ মিনিটে রেডিও বাংলাদেশ সম্প্রচার শুরু করল। মেজর হায়দার তাঁর বক্তৃতা দেওয়ার আগে ফতেহকে বলা হলো বাংলায় তার ঘোষণা দিতে। আমরা কাচের জানালা দিয়ে বাইরে থেকে দেখলাম ফতেহ শান্তভাবে বসে আছে মাইক্রোফোনের সামনে। তাকে নার্ভাস দেখাচ্ছিল। রেডিওর লোক তাকে শুরুর ইঙ্গিত দিল এবং লাল বাতি দেখাল। তার অর্থ হচ্ছে সে এখন সম্প্রচারের আওতায়। ফতেহ তার ঘোষণা শুরু করল।

সকাল ৮.১৫ মিনিটে মেজর হায়দারের বক্তব্য শুরু হলো। তিনি বললেন- ‘এই দেশ এখন শত্রুমুক্ত এবং সকল বাঙালি এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক।’ তিনি মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীর নিরাপত্তার জন্য কিছু নির্দেশনা মেনে চলার উপদেশ দিলেন। তাঁর ঘোষণা শেষ হওয়ামাত্র আমরা খোকা ও তার গ্রুপের কাছে এই কেন্দ্রের দায়িত্ব হস্তান্তর করে চলে এলাম।

তিন

প্রশিক্ষণ এবং কিছু ছোটখাটো অ্যাকশনের পরে রুমী ফিরে এল ঢাকায়। সেখানে তার প্রথম অ্যাকশন ২৫ আগস্ট। সেই অ্যাকশনের বর্ণনা শুনে শুনে বিস্তারিতই লিখেছেন জাহানারা ইমাম। আমরা বরং রুমীর সেদিনের অ্যাকশনের সঙ্গী হাবিবুল আলমের জবানীতেই সেটা শুনতে পারি।

২৫ আগস্ট ১৯৭১ দিনটি সপ্তাহের অন্য যে কোনো দিনের মতোই। সূর্য ছিল অন্য দিনের মতোই উজ্জ্বল আর আর্দ্রতা ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে। রাস্তার মানুষগুলো ঘামছিল খুব। অন্যান্য দিনের তুলনায় মনে হচ্ছিল শহরের রাস্তায় লোক চলাচল কম। ঐদিন আমরা দুপুরে ভালো খাবার খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা থাকবে, বিশেষ করে যারা অপারেশনে অংশ নিতে যাচ্ছে, তারা সবাই। চুল্লু ভাই এবং শাহাদত চৌধুরী দায়িত্ব নিয়েছিল খাবারের আয়োজনের এবং মুক্তিযোদ্ধাদের এক জায়গায় জড়ো করার। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে গেরিলারা একজন-দুইজন করে ধানমন্ডির হাইডআউটে এসে পৌঁছাল।

আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম যে বদি, স্বপন, কাজী, রুমী এবং আমি থাকব এক নম্বর গ্রুপে। দ্বিতীয় গ্রুপ গঠিত হবে জিয়া, চুল্লু ভাই, আনু, মুখতার ও হারিসকে নিয়ে। চুল্লু ভাই তার গাড়িতে হারিস এবং মুখতারকে নিয়ে যাবে। ওরা দুইজন অপারেশনের জন্য যে কোনো জায়গা থেকে একটি গাড়ি হাইজ্যাক করবে। বদি এবং আমি ধানমন্ডি এলাকা থেকে আমাদের গ্রুপের জন্য একটি গাড়ি হাইজ্যাক করব। বেলা ৩টা সাড়ে ৩টার দিকে সবার খাওয়া শেষ হলো। এবার যারা গাড়ি ছিনতাই করতে যাবে, তারা প্রস্তুত হতে শুরু করল।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হারিস এবং মুখতার চুল্লু ভাইয়ের গাড়িতে বেরিয়ে গেল। আমি আর বদি মেইন রোডে এসে একটি রিকশা নিলাম। আমরা রিকশাওয়ালাকে বললাম ধানমন্ডির রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে চলতে। সিগারেট ধরিয়ে আমরা ছিনতাই করার মতো গাড়ির সন্ধানে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। রিকশা ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের কালভার্ট পার হয়ে বামে মোড় নিল। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের এই এলাকার কোনো বাড়ির সামনে পার্ক করে রাখা গাড়ি হাইজ্যাক করতে হবে। আমরা ধানমন্ডি এলাকার অভ্যন্তরীণ রাস্তাগুলোতে ঘুরছি। আমরা বামে এফএও অফিস রেখে, মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স পার হয়ে লেকের কাছে এলাম। লেকটি বাঁক নিয়েছে ৩২ নম্বরের সামনে এসে। আমরা আবার ১৮ নম্বর রোড পেরিয়ে, আরেকটি কালভার্ট অতিক্রম করে চলে এলাম অর্ধ বৃত্তাকার ৮ নম্বর রোডে। এবার ডানে বাঁক নিয়ে আমরা ৭ নম্বর রোডের ক্রসিং-এসে রিকশা থামালাম। রিকশাওয়ালাকে দশ টাকার একটা নোট দিয়ে আমরা দক্ষিণ দিকে ৪ নম্বর রোড ধরে হাঁটতে শুরু করলাম।

হঠাৎ ৫ নম্বর রোডের ইন্টারসেকশনে দেখতে পেলাম একটা সাদা মাজদা গাড়ি আমাদের দিকে আসছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশনের সিদ্ধান্ত নিলাম। বদি রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গাড়ির পথরোধ করবে, আর আমি ড্রাইভারের কাছে গিয়ে জোর করে গাড়ির দখল নেবো। আমরা দেখতে পেলাম গাড়ির সামনের সিটে চশমা চোখে খুবই সুদর্শন একটা যুবককে, তার পাশে ড্যাশবোর্ডে দুই হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে খুবই সুন্দর একটা বাচ্চা। বদি রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুই হাত দুদিকে প্রসারিত করে দিল, যেন তার কোনো জরুরি প্রয়োজন আছে। আমাদের পাশ কাটিয়ে গেল দুটি রিকশা; কিন্তু ওরা আমাদের দিকে তাকালোই না। গাড়িটি গতি কমিয়ে আমাদের সামনে থেমে পড়ল।

ছিনতাই হয়ে গেল।

আমি ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলাম। বদি আমার পাশে। আমরা ৪ নম্বর রোড থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে এলাম আমাদের হাইডআউটে।

বদি বলল- ‘এখন একটা সিগারেট খেলে কেমন হয়!’ 

‘কেন নয়?’ আমি বললাম। গাড়িটা পোর্চে পার্ক করা হয়েছে। আমি গাড়ি থেকে নামলাম। গাড়ি থেকে নামার পরে আমার মনে হলো কার গাড়ি হাইজ্যাক করলাম তা জানার চেষ্টা করা প্রয়োজন। ভদ্রলোকের চেহারা আমাদের দু’জনের কাছেই পরিচিত মনে হচ্ছিল। আমি গাড়ির গ্লোভ কম্পার্টমেন্ট খুলে ডকুমেন্টগুলো বের করলাম। তাদের মধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্সও ছিল।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই হাইজ্যাক করা দ্বিতীয় গাড়িটাও হাইডআউটে চলে এলো। এ পর্যন্ত ভালোই চলছে বলা যায়। সব চলছে পরিকল্পনা অনুসারেই। হারিস এবং মুখতার দ্বিতীয় যে গাড়িটা এনেছে, সেটি একটি ফিয়াট- ৬০০। মনে হলো হারিস এটাকে ভালোভাবেই সামলাতে পারবে।

আমরা মাজদা গাড়িটার ডকুমেন্ট খুলে দেখলাম যে গাড়ির মালিক হচ্ছেন মি. মাহবুব আনাম। তিনি আমাদের সকলের বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজ আনামের বড় ভাই। তিনি কাজ করতেন পাকিস্তান ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানিতে। থাকতেন ধানমন্ডিতেই। মাহফুজ এবং মাহবুব আনাম ছিলেন জনাব আবুল মনসুর আহমদের পুত্র। আমরা সবাই খুশি। আবার একই সঙ্গে একটু খারাপও লাগছে কারণ হয়তো মি. মাহবুব আনাম তার গাড়িটা ফেরত না-ও পেতে পারেন।

পশ্চিমের আকাশে ম্লান হয়ে এল আলো। সূর্য আজ রাতের জন্য পৃথিবীর এই অংশকে উপহার দিল বিদায়ী চুম্বন। মেইন রোডের স্ট্রিটলাইটগুলো জ্বলে উঠল। তবে ধানমন্ডি এলাকার কিছু আভ্যন্তরীণ রাস্তায় আলো জ্বলল না। সেগুলোর মধ্যে ২৮ নম্বর রোডও ছিল। সেটা আমাদের জন্য আশীর্বাদ। কারণ এই সময় আমরা সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটি কামনা করছিলাম তা হচ্ছে অন্ধকার। আমাদের গাড়িতে উঠতে হবে এমনভাবে যাতে কেউ অস্ত্র দেখতে না পায়। পরিকল্পনামতো জিয়া তার গ্রুপ নিয়ে বেরিয়ে গেল। আমাদের মনে করিয়ে দিয়ে গেল যে ১৮ ও ২০ নম্বর রোডের মিশন শেষ করার পরে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কাছাকাছি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা।

আমি মাজদা সেডানের হুইলে বসলাম। আমার এসএমজি রইল বদির কাছে। সে আমার পাশে বসেছে সামনের সিটে। পেছনের সিটে আমার সোজাসুজি উঠেছে স্বপন। পেছনের সিটের বাম দিকে কাজী। আর তাদের দুইজনের মাঝখানে রুমী। এইভাবে ১৯৭১ সালের ২৫ আগস্ট রাত ৭টা- সাড়ে ৭টার দিকে ১০ মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে শুরু হলো ‘অপারেশন অজানা গন্তব্য’।

৭.২৫ মিনিটে মাজদা গাড়ি বেরিয়ে এল হাইডআউট থেকে। বদি ও আমি গাড়ি ছিনতাই করার জন্য যে রাস্তায় গিয়েছিলাম, এখন এগিয়ে চললাম সেই একই রাস্তা ধরে। চীনা কূটনীতিকের বাড়ির কাছে পৌঁছে দেখলাম সেখানে কোনো পাহারাদার নেই। আমরা তখন আমাদের কপাল পরীক্ষা করার জন্য এগিয়ে গেলাম ১৮ নম্বর রোডের দিকে। 

১৮ নম্বর রোডে আমরা দেখলাম ৮-১০ জন সৈন্য কাঁধে বন্দুক নিয়ে খুব নিশ্চিন্ত আরামের ভঙ্গিতে দায়িত্ব পালন করছে। তাদের মধ্যে দুই-তিনজন দাঁড়িয়ে আর বাকিরা বসে বসে কথা বলতে বলতে পেট দুলিয়ে হাসছে। আমার কাছে মনে হলো ব্রিগেডিয়ার বা পদস্থ অফিসারটি এখন বাড়িতে নেই বলেই ডিউটিরত সৈন্যরা এত হালকা মুডে রয়েছে। টার্গেটগুলো এখন আমাদের ডান দিকে। আমি কমরেডদের বললাম- ‘ও কে বন্ধুরা, আমরা এখন এখানে। দেখতেই পাচ্ছ জানোয়ারগুলো এখন আমাদের নাগালের মধ্যে। এই অপারেশনের জন্য আমাদের হাতে রয়েছে ঠিক তিন মিনিট।

আমি গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যাব এবং তারপরেই সাত মসজিদ রোড থেকে তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে ফিরে আসব। তখন শত্রুরা থাকবে আমাদের বাম দিকে। তখন বদি ও কাজীর দায়িত্ব হবে আমি কমান্ড করার সঙ্গে সঙ্গে সামনের ও পেছনের জানালা দিয়ে গুলি ছুড়তে শুরু করা’।

মাজদা টার্গেটের দিকে এগিয়ে একটু গতি কমালো, যাতে বদি ও কাজী দু’জনেই ভালোভাবে তাদের টার্গেট দেখে নিতে পারে। গাড়ি আরো সামনে এগুলো এবং আমি সাত মসজিদ রোডে পৌঁছে তীক্ষ্ণ একটা ইউ-টার্ন নিলাম। স্বপন ও রুমীকে বললাম রাস্তার দিকে নজর রাখতে। রুমী নজর রাখবে সামনের দিকে আর স্বপন পেছনের দিকে।

মসৃণ ও প্রায় নিঃশব্দ মাজদা গাড়িটি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল দরজা তথা টার্গেটের দিকে। আমি নিচু গলায় বললাম- ‘ফায়ার!’

বদি এবং কাজীর স্টেন তখনই সক্রিয় হয়ে উঠল। বদি গুলি ছুড়ল টার্গেটের পেট লক্ষ্য করে, আর কাজী নিশানা করল বুক। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাকসেনাদের মৃতদেহ লুটিয়ে পড়ল গেটের সামনে। অপারেশন শেষ হতে লাগল বড়জোর কয়েক সেকেন্ড। আমরা পাঁচজনই খুব খুশি- অন্তত দ্বিতীয় গ্রুপের কাছে বলার মতো কিছু তো পেলাম।

১৮ নম্বর রোড এখন মরুভূমির মতো জনশূন্য। আমি অ্যাক্সিলেটারের ওপর ডান পা দাবিয়ে ওই এলাকা ছেড়ে চলে এলাম। স্বপন ও রুমী প্রতিবাদ করে বলল তাদের গুলি ছোড়ার প্র্যাকটিস করার সুযোগ দেওয়া উচিত। এবং আমার উচিত নয় কোনোভাবেই তাদের বঞ্চিত করা। আমার মধ্যেও তখন ভাব এসে গেছে। বললাম- ‘ঠিক আছে, তাহলে আবার ২০ নম্বর রোড যাওয়া যাক।’ এবার আমরা ২০ নম্বর রোডে প্রবেশ করলাম বিপরীত লেন দিয়ে যাতে স্বপন ও রুমী টার্গেট প্র্যাকটিস করার সুযোগ পায়। দেখা গেল এবারও চীনা কূটনীতিককে পাহারা দেওয়ার জন্য যেখানে সৈন্য থাকার কথা, সেই সেন্ট্রিবক্সে কেউ নেই। আমরা কিছু সময় অপেক্ষা করে ভাবলাম দুই-একটা গ্রেনেড ছুড়ে দেই। পরে আবার মত পরিবর্তন করলাম। কোনো জায়গায় এক নাগাড়ে পাঁচ মিনিটের বেশি দেরি করতে নেই। কারণ তাহলে শত্রুর সহজ টার্গেটে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। 

আমরা ধানমন্ডি থেকে ৭ নম্বর রোড দিয়ে বেরিয়ে মিরপুর রোডে এলাম। আমাদের মাথায় আছে যে দ্বিতীয় গ্রুপের সঙ্গে আমাদের মিলিত হতে হবে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কাছে, তাই আমরা গাড়ির মুখ ঘোরালাম নিউমার্কেটের দিকে। আমরা ৫ নম্বর রোডের কাছাকাছি আসতেই পরিষ্কার দেখতে পেলাম যে পাকিস্তানি সৈন্যরা ইতোমধ্যেই একটি শক্তিশালী চেক-পোস্ট বসিয়েছে। তারা রাস্তার দুই দিক থেকে আসা সব গাড়িকেই পরীক্ষা করছে। আমাদের বুঝতে বাকি রইল না যে ধানমন্ডি ১৮ নম্বর রোডের অ্যাকশনের খবর ইতোমধ্যেই পৌঁছে গেছে আর্মি কন্ট্রোল রুমে।

মিরপুর রোডে শক্ত ব্যারিকেড দাঁড় করানো হয়েছে। দুইটি ট্রাক দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে রাস্তা। দুই ট্রাকের দিকে মুখ করে আছে একটি জিপ। আরেকটি জিপ পার্ক করা আছে আমাদের বাম দিকের পেট্রল পাম্পের সামনে নিউমার্কেটের দিকে মুখ করে। মিরপুরের দিক থেকে একবারে শুধু একটি গাড়িকেই যেতে দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যেই চার-পাঁচটি গাড়ি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছে চেকিং-এর উদ্দেশ্যে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো আমি আতঙ্কের নরকে ডুবে গেছি। আমি বুঝতে পেরেছি ফাঁদে পড়লে আমাদের পরিণাম কী হবে। পরিস্থিতি এমনই যে আমার পক্ষে এখন গাড়ি পেছন দিকে ঘুরিয়ে নেওয়াও সম্ভব নয়। আমাকে এখন এই সাঁড়াশির মধ্য দিয়েই যেতে হবে। আমি সামনে শত্রুদের দিকে চোখ রেখেই সাথীদের উদ্দেশ্যে বললাম যে আমাদের ব্যারিকেড ভেঙে বেরিয়ে যেতে হবে, কারণ সেটাই আমাদের বাঁচার একমাত্র সুযোগ। স্বপন এবং বদি সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করল আমি ঠিকমতো গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে যেতে পারব কি না। আমি ততক্ষণে দেখতে পেয়েছি রাস্তার ধারে দুই-তিনজন সৈন্য অস্ত্র বাগিয়ে শুয়ে আছে গুলি ছুড়তে প্রস্তুত অবস্থায়, এবং একজন একটি লাইট মেশিনগান তাক করে রেখেছে আমাদের দিকে। আমি বললাম যে স্বপন যদি লাইট মেশিনগানধারী সৈনিকটিকে খতম করতে পারে, তাহলে আমি এই বিশৃঙ্খলার মধ্য থেকে ঠিকই গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে যেতে পারব। প্রত্যেককে বললাম, আমি গাড়ি নিয়ে বামে মোড় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে তিন জানালা দিয়ে গুলি ছোড়া শুরু করতে হবে।

রুমী আর কাজী পেছন থেকে বলল- ‘আলম, তুমি কি দেখেছ ৫ নম্বর রোডের বাম দিকে আরো দুই-তিন জন সৈন্য দাঁড়িয়ে আছে?’ আমি বললাম যে দেখেছি। ওদের সামলানোর দায়িত্ব বদি আর কাজীর। ওরা যদি কাজটা ঠিকমতো করতে না পারে, তাহলে আমাদের সবাইকে আজ মরতে হবে।

শেষবারের মতো আমি বললাম যে আমি ‘ফায়ার’ শব্দটি বলব মাত্র একবার। এছাড়া আর কোনো কমান্ড থাকবে না। এটা হবে একটি যৌথ প্রচেষ্টা। আমি আস্তে গাড়িটাকে এগিয়ে নিতে শুরু করলাম লাইনে দাঁড়ানো গাড়িগুলোকে পাশ কাটিয়ে। দুই জন মিলিটারি পুলিশ গাড়িগুলোতে তল্লাশি চালাচ্ছে। তারা চিৎকার করে উঠল- ‘হল্ট!’ আমি নিজেকে বললাম- ‘খেলা শুরু হয়ে গেছে বাছা। দেখা যাক কে জেতে!’

থামতে বলার চিৎকার শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি হেডলাইট নিভিয়ে ফেললাম, এবং জ্বালিয়ে দিলাম ডান দিকের ইন্ডিকেটর লাইট। সেই সঙ্গে ডান দিকে ফলস একটা টার্ন নিতে গেলাম। মিলিটারি পুলিশের প্রতিক্রিয়া হলো সঙ্গে সঙ্গে। ওরা গালি দিয়ে চিৎকার করে উঠল- ‘বাস্টার্ড! তোমরা কোন ফাকিং-এ যাওয়ার চেষ্ট করছ? রোকো!’ যে কয়েক সেকেন্ড ইন্ডিকেটর লাইট জ্বলেছিল আমাদের ৫ নম্বর রোডের কাছে যাওয়ার জন্য সেই সময়টুকুই দরকার ছিল। বুদ্ধিটা কাজে লাগল। আমি একটুও ইতস্তত না করে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলাম এবং তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে ৫ নম্বর রোডে ঢুকে পড়লাম। সেই সঙ্গে চিৎকার করে উঠলাম- ‘ফায়ার! ফায়ার!’ 

যে মিলিটারি পুলিশটি বাম দিকে দাঁড়িয়েছিল, গাড়ি প্রায় তার ওপর দিয়ে যেতে শুরু করল। লোকটা একদিকে ঝাঁপ দিয়ে গাড়ির চাকা থেকে নিজেকে রক্ষা করল; কিন্তু পেছনের জানালা দিয়ে ছোড়া কাজীর বুলেট থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারল না। স্বপন এবং বদি এক সেকেন্ডও দেরি না করে তাদের অটোমেটিক সাব-মেশিনগান দিয়ে গুলি ছুড়তে শুরু করেছে রাস্তার দুই পাশে দাঁড়ানো সৈন্যদের দিকে।

গাড়ির ভেতর থেকে দুই-তিনটি অটোমেটিক অস্ত্র একনাগাড়ে গুলিবর্ষণ করছে, আমাদের গায়ে পড়ছে খালি খোসা ও গরম কার্তুজ। স্বপনের অস্ত্র থেকে ছোড়া শেল আমার কাঁধ স্পর্শ করল, আমি কেঁপে উঠলাম। স্বপনের গুলি নিশ্চয়ই লাইট মেশিনগানধারী সৈনিকটিকে নিষ্ক্রিয় করতে পেরেছে। কারণ সেখান থেকে প্রতিউত্তরে কোনো গুলি ছুটে এলো না। আমার চায়নিজ স্টেনগান থেকে বদি একনাগাড়ে গুলি ছুড়ে ম্যাগাজিন খালি করে ফেলল। বদির মাথা গাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেছে। সে তীব্র খুনের স্পৃহা নিয়ে গুলি ছুড়ে চলেছে। আমরা আর্মি ব্যারিকেড ভেঙে বেরিয়ে এলাম এবং নিজেদের জীবন রক্ষা করলাম। গাড়ি তখন ৫ নম্বর রোডে। গাড়ির ভেতরে তখনো ভাসছে বারুদের গন্ধ। ৫ নম্বর রোড একটা ছোট গলি যা মিরপুর রোডের সঙ্গে গ্রিনরোডকে সংযুক্ত করেছে। মাজদা গতি বাড়িয়ে দুইটি ল্যাম্পপোস্টকে অতিক্রম করল। রুমী উত্তেজনার বশে গাড়ির রিয়ার ভিউ মিররকে আড়াল করে ফেলেছে। আমরা তাকে বললাম ঘুরে বসে পেছনের দিকে লক্ষ্য রাখতে। রুমী ঘুরে বসে পেছনের রাস্তার দিকে মনোযোগ দিল। আমরা চিন্তিত ছিলাম, কারণ শত্রুরা আমাদের পিছু ধাওয়া করতে পারে।

আবার বামদিকের ইন্ডিকেটর জ্বালানো হলো, কারণ গাড়ি এবার গ্রিনরোডের দিকে বাঁক নেবে। হেডলাইট তখনো নেভানো। গাড়ি নিউমার্কেটের দিকে মুখ করে ডানে বাঁক নিল। আমি যখন গাড়ির বাঁক নেওয়া নিয়ে ব্যস্ত এই সময় রুমী চিৎকার করে উঠল- ‘ঐ দ্যাখো! একটা জিপ। শূয়োরের বাচ্চারা আমাদের অনুসরণ করার চেষ্টা করছে।’

কোনো কিছু বলতে হলো না। রুমী নিজেই স্টেনগান দিয়ে পেছনের জানালার কাচ ভেঙে জিপের দিকে গুলি চালাতে শুরু করল। কাজী এবং স্বপন পেছনের দুই পাশের জানালা দিয়ে যোগ দিল রুমীর সঙ্গে। আমরা দেখলাম রুমীর গুলি ড্রাইভারকে ঠিকই বিদ্ধ করতে পেরেছে। আমরা রিয়ার ভিউ মিররে দেখতে পেলাম যে আর্মি জিপটি আমাদের ধাওয়া করে আসছিল সেটি একটি ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা খেল। ড্রাইভারের দেহ তার পাশের জানালা দিয়ে আংশিক বাইরে বেরিয়ে ঝুলছে।

মাজদা নিউমার্কেটের দিকে এগিয়ে চলল। আমরা জানতে পারিনি আর্মি জিপে কতজন ছিল বা তাদের মধ্যে কতজন হতাহত হয়েছিল। আমরা প্রত্যেকেই বার বার পেছনে তাকাচ্ছিলাম। দেখতে পেলাম দুইটি ট্রাক আর একটা জিপ বামে মোড় নিয়ে গ্রীনরোডের দিকে এগুচ্ছে। ওদের ধোঁকা খেতে দেখে আমরা সবাই হাসিতে ফেটে পড়লাম। আমরা নিউ এলিফ্যান্ট রোডে ঢুকে হেডলাইট জ্বাললাম। গাড়ির মধ্যে জানালার ভাঙা কাচের অজস্র টুকরা; কিন্তু এ নিয়ে আমরা কেউ-ই একবিন্দু চিন্তিত না। এমনকী গরম কার্তুজের স্পর্শে আমাদের শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে গেলেও তা নিয়ে আমরা মোটেই ভাবলাম না। ইতোমধ্যে বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। 

ঢাকার সবগুলো গেরিলা গ্রুপ ৬ সেপ্টেম্বরের অ্যাকশন নিয়ে পরিকল্পনা করছে। পাকিস্তান সরকার ঐদিন প্রতিরক্ষা দিবস হিসাবে পালন করবে। সেদিন তাই গেরিলারা ঢাকার অনেকগুলো পয়েন্টে একযোগে হিট করতে চায়। বিশেষ করে রাজারবাগ পুলিশ লাইন প্যারেড গ্রাউন্ড আর বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ প্যারেড গ্রাউন্ডে। 

কিন্তু ২৯ আগস্ট তারিখেই পাকবাহিনী বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেল রুমীকে।

তারপর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি রুমীর।

চার

বাংলাদেশের মানুষ একাত্তরের সঙ্গে এখনকার পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছে কি?

সত্যি বটে, এখন এই দেশের মানুষ পেয়েছে নিজেদের পতাকা, নিজেদের ভূখণ্ড, নিজেদের স্বাধীনতার প্রতীক।

কিন্তু রাষ্ট্র তো জনগণের হয়নি। জনমুখী হয়নি।

রাষ্ট্রের বাজেট, রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড- সবকিছুই মুষ্টিমেয় সুবিধাবাদীর জন্যই। রাষ্ট্র চলছে পাকিস্তানি ধারাতেই সেই পুঁজিবাদের পথে। ইউরোপ-আমেরিকায় পুঁজিবাদ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল সারাবিশ্ব লুটপাট করে। পুঁজির জোগান এসেছিল এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার অসংখ্য জাতি এবং সভ্যতাকে ধ্বংস করে। কোটি কোটি মানুষের মুখের গ্রাস এবং জীবন কেড়ে এনে। 

কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজিপতিদের তো সামর্থ্য নাই অন্য দেশকে লুণ্ঠন করার। সামর্থ্য নাই অন্যদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক যুদ্ধে জয়ী হয়ে নিজেদের পুঁজি সঞ্চয় করার।

রাষ্ট্র তাই তাদের সুযোগ করে দিয়েছে নিজের দেশ এবং মানুষকে লুণ্ঠন করার। এই গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে আত্মসাৎ করে চলেছে এদেশের মাটি, এদেশের পানি-জলাভূমি-নদী, এদেশের আকাশ, এদেশের বাতাস, এদেশের বন-পাহাড়। 

এদেশে এখন রুমীর, শত শত রুমীর, হাজার হাজার রুমীর বড় প্রয়োজন। 

কিন্তু তথাকথিত উচ্চবিত্তের সন্তানদের মধ্য থেকে রুমী আর জন্ম নেবে না। তারা হয় বাপ-মায়ের লুটের টাকায় বিদেশে পড়তে যায়, অথবা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে বলিউড-হলিউড ফ্যাশনে নিজেদের জীবন গড়ে তুলতে চায়। তারা এদেশের সংস্কৃতি কী জিনিস বোঝে না, এদেশের স্বাধীনতা বলতে কী বোঝায় তা নিয়ে ভাবে না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো দূরের কথা, মুক্তিযুদ্ধ জিনিসটাই তাদের কাছে আলোচনাযোগ্য নয়।

কিন্তু দেশ তো বারবার রুমীকে খোঁজে।

তেল-গ্যাস রক্ষার আন্দোলনে রাস্তায় নামা গুটিকয় দেশপ্রেমিক ডাকে- রুমী!

বন্দর-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় রাস্তায় নামা জীবনবাজী যোদ্ধারা ডাকে- রুমী!

একাত্তরের হত্যাকারীদের বিচার দাবি করে শাহবাগ ডাকে- রুমী!

সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলনে বাউলরা একতারার সুরে ডাকে- রুমী!

সুন্দরবন রক্ষায় মরণপণ যুদ্ধে নামা তারুণ্য আহ্বান জানায়- রুমী!

কিন্তু কোনো সাড়া নাই।

রুমী কি আর জন্ম নেবে না? 


লেখক- কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //