ময়ূরপঙ্খী নাও পালটি তুলে কোথায় ভেসে যাও

...আমি যে গহিন গাঙের নাইয়া।/সাঁঝের বেলায় নাও বাইয়া যাই,/আপন মনে চাইয়া/ভাটির টানে বাইয়া চলি, ভাইটালি সুরে গাইয়া।...

এত নদী আছে যে দেশের, সে দেশের বুক জুড়ে উদ্দাম ঢেউ কেটে কেটে নৌকা ছুটে বেড়াবে এ আর নতুন কী! আর যে দেশের নদী আছে, হরেক রঙের নৌকা আছে তার তো গান থাকবেই। নদী নৌকা গান একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। নদীর তীরজুড়ে উর্বর পলিমাটিতে গড়ে ওঠা ভূখণ্ডের নাম বাংলা। এখন বাংলাদেশ নামে যে বদ্বীপ, মূলত তার ভাষা, সাহিত্য, সংগীত, ভাব, কৃষি, অর্থনীতি পুরোটাই গড়ে উঠেছিল নদীকে ঘিরে। ধীরলয়ে পলিমাটির ভূখণ্ডজুড়ে নদীগুলো আপন বুক জুড়ে বাজিয়ে গেছে তানপুরা।

বাংলার গ্রামগুলো নদীর তীরজুড়ে সমান্তরালে গড়ে উঠেছে। নৃতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে জানা যায়, এই গ্রামগুলো সমান্তরাল ছিল, এর পেছনে নদীর তীরজুড়ে উর্বর পলিসমৃদ্ধ ভূমি অনেকাংশে দায়ী। বাংলায় জালের মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নদী-নালা, খাল, বিল, হাওর-বাঁওড়। আবহমান কাল থেকে এই জলের কোলে নৌকাই ছিল আদি বাহন। নদীর তীরে গড়ে ওঠা বাংলা সংস্কৃতিতে নৌকা তাই ছিল জরুরি অনুষঙ্গ। বাংলার সাহিত্য ও লোকগাথায় বাংলা অঞ্চলে নদীপথ ও সমুদ্রপথে চলাচলে উপযোগী দাড়-টানা পণ্যবাহী জলযান নৌকা বা ডিঙার কথা আমরা একাধিক জায়গায় খুঁজে পাই। এ ছাড়াও প্রাচীন বাংলার অন্যতম কেন্দ্র চন্দ্রকেতু গড়ে পাওয়া বেশ কিছু পোড়ামাটির সিলে নৌকার উল্লেখও পাই। দুটো নৌকার নামও পাওয়া গেছে সেখানে। একটা হলো ‘এপ্য’ বা ‘এপ্পগ’ অন্যটা ‘জলধিসক্ল’ (জলধিশত্রু)। অনুমান করা হয় জলধিশত্রুটা ছিল যুদ্ধজাহাজ। খ্রিষ্টাব্দের প্রথম শতকের পেরি প্লাসের বিবরণীতেও এপ্পগ নামের জলযানের কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। কবি মুকুন্দ রায় ‘জঙ্গ’ নামের এক ধরনের বাণিজ্যিক জাহাজের কথা লিখেছিলেন।

এখনো বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জামালপুর এলাকায় ‘ঝঙ্গ’ নামের এক ধরনের নৌকা দেখা যায়, যা সম্ভবত সেই প্রাচীন জঙ্গেরই উত্তরসূরি। পনেরো শতকের শেষের দিকের কবি বিপ্রদাস পিপলাই, মুকুন্দরামের বর্ণনায় বর্ণাঢ্য নাম আর বিবরণে সব নৌকা উঠে এসেছে মাঝে মাঝে। কী দারুণ সব নাম! নরেশ্বর, সর্বজয়া, সুমঙ্গল, নবরত্ন, চিত্ররেখা, শশিমঙ্গল, মধুকর, দুর্গাবর, গুয়ারেখি, শঙ্খচূড় আরও কত নাম! খোল, পাটা, ছই বা ছাউনি, হাল, দাঁড়, পাল, পালের দড়ি, মাস্তুল, নোঙর, গলুই, বৈঠা, লগি ও গুণ। সে সময়ে নৌকা বানানো হতো কাঁঠাল, পিয়াল, তাল, শাল, গাম্ভারি, তমাল প্রভৃতি কাঠ দিয়ে। ছই বা ছাউনি এবং লগি বনানো হয় বাঁশ দিয়ে আর পাল তৈরি হয় শক্ত কাপড় জোড়া দিয়ে। মুসলমান শাসকদের আগমনের পর বাংলার নৌ-শিল্পের আরও বিকাশ হয়েছিল। কারণ এরা দেখেছিলেন কীভাবে বাংলার স্থানীয় শাসকগণ এই নদী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন স্বাধীনভাবে শাসন করেছেন।

নৌকার ঐতিহ্যের দিকে তাকালে অসংখ্য প্রচলিত নৌকার নাম পাওয়া যায়। যেগুলো গঠনশৈলী ও পরিবহনের উপর নির্ভর করে যেমন : ছিপ, বজরা, ময়ূরপঙ্খী, গয়না, পানসি, কোষা, ডিঙ্গি, পাতাম, বাচারি, গয়না, রপ্তানি, ঘাসি, সাম্পান, ফেটি, নায়রী, সওদাগরী, ইলশা, পাল তোলা নৌকা, কেড়াই নৌকা, বেদে বা সাপুরিয়া নৌকা, ভোট নৌকা, বৌচোরা নৌকা, লক্ষ্মী বিলাস, গণ্ডি বিলাস, খেয়া নৌকা, বাইচের নৌকা। এর মধ্যে অধিকাংশই প্রায় বিলুপ্তির পথে। নামের ক্ষেত্রে আছে অঞ্চল ভিত্তিক ভিন্নতা। এসব নৌকার কিছু আবার একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে আর বাকিগুলো এখন স্থান পেয়েছে জাদুঘরে। একই সঙ্গে কমে যাচ্ছে মাঝি-মাল্লা ও নৌকা তৈরির কারিগরের সংখ্যাও। কথিত আছে নৌকার মাঝিরা বংশপরম্পরায় প্রকৃতি বিশারদ হতো, তারা জানত কোন তারার অবস্থান কোনদিকে। তাছাড়া বাতাসের গন্ধ শুঁকেও বলে দিতে পারতেন ঝড়ের আগাম খবর, মেঘেদের ওড়াউড়ি দেখেও তারা বুঝে যেতেন সেদিনের আবহাওয়া কেমন যাবে। এসব জেনেবুঝেই তারা নৌকা ভাসাতেন অকূল দরিয়ায়। কূলকিনারহীন নৌকাতেই তাদের কেটে যেত দিনের পর দিন, সপ্তাহ, মাস কখনো বা বছর।

এমন তথ্যই আমরা পাই আমাদের পুরনো দিনের গল্পকথায়। বণিকেরা সপ্ত ডিঙা ভাসিয়ে বাণিজ্য করতে যেতেন। মা, বউ-ঝিয়ের দল পান সুপুরি দিয়ে সিঁদুর পরাতেন নৌকার গলুইয়ে। স্বামী সন্তানের মঙ্গল চেয়ে। চাঁদ সওদাগরের ডিঙায় যেমন সিঁদুর পরাতেন স্ত্রী সনকা। স্বামী সন্তানদের ডিঙা ভেসে যেতে যেতে চোখের আড়াল হলেই শুরু হতো পথ চেয়ে তাদের বিরহ-যাপন, উৎকণ্ঠা। নৌকা এবং নৌকাকে ঘিরে এক সময়ের সমাজ ব্যবস্থায় যে আবেগ অনুভূতি, বিপুল কর্মযজ্ঞ হতো তার নিরিখেই আমাদের কথাসাহিত্য পেয়েছিল অনবদ্য রসদ। ঋদ্ধ হয়েছিল সংস্কৃতি। মাঝির উদাত্ত কণ্ঠ পেয়েছিল সুর-কথার মালা। সৃষ্টি হয়েছিল প্রাণ জুড়ানো ভাটিয়ালি গান। যে গানে সুরে সুরে ডানা মেলত অব্যক্ত অভিমান, বিরহ, যন্ত্রণা, অপার সৃষ্টির কাছে বহুবিধ প্রশ্ন। রয়েছে প্রেম ও ঈশ্বরের প্রাধান্য। এতে একদিকে লৌকিক প্রেম চেতনা, অন্যদিকে আধ্যাত্মিক চেতনার প্রতিফলনও রয়েছে মাঝি-মাল্লাদের গান ভাটিয়ালিতে। যেমন তাদের কণ্ঠে উড়ত- ‘নদীর কূল নাই কিনার নাইরে/ আমি কোন কূল হৈতে কোন কূলে যাব/কাহারে শুধাইরে।’ ‘মনমাঝি তোর বৈঠা নে রে/আমি আর বাইতে পারলাম না/সারা জনম উজান বাইলাম/ভাটির নাগাল পাইলাম না...।’ তাই বলাই যায়, নৌকার মাঝিদের বিনোদন বলতেই ছিল ভাটিয়ালি গান। সেইসব নৌকার ‘মাঝি-মাল্লাদের’ এমন গানেই যেন ইতিহাসের কালজয়ী সাক্ষী হয়ে আজ বাংলার লোকসংস্কৃতির ধারক ও বাহক হয়েছে। ভাটি অঞ্চলের মানুষরা পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জলের উপর ভেসে ভেসে নৌকা বেয়ে চলার সময় দিনের পর দিন তাদের সামনে সুদূরপ্রসারী নদী পথ আর মাথার উপরে অনন্ত অসীম নীল আকাশ। দিগন্তব্যাপী এ নদীর শূন্যতার উপর নৌকার বাদাম উড়িয়ে নৌকা চলছে তো চলছেই যাত্রাপথের একঘেয়েমি কাটাতেই মাঝি মাল্লাদের মনের ভেতর ভাবের উদয় হলে এককভাবে ভাটিয়ালি গান গাইত। এমন গানের সৃষ্টির শুরুতে যেন বাদ্য-যন্ত্রের ব্যবহার হতো না।

ধীরে ধীরেই নানা লোকজ বাদ্যযন্ত্রেরও ব্যবহার হয়। দিগন্তব্যাপী টেউয়ের তালে তালে ভাবের উদয় ঘটিয়ে গানের কথাগুলো বানিয়ে বানিয়েই সুললিত কণ্ঠে গভীর আবেগে গাইত। অবসরে রঙ, বে-রঙের নৌকায় বসে মনের মধ্যে বহু জিজ্ঞাসার উত্তর উদয় করেই গান গাইত। পূর্ব বাংলার এমন গানই হয়ে উঠল সংগীতের একটি ধারা ‘ভাটিয়ালি গান’। নৌকা কেন্দ্রিক বাংলার সংস্কৃতিতে আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় নৌকাবাইচ। নৌকাবাইচ লোকায়ত বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি অংশ। তবে কবে এদেশে গণবিনোদন হিসেবে নৌকাবাইচের প্রচলন হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। ‘বাইচ’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি বিবেচনা করে তাত্ত্বিকগণ অনুমান করছেন যে মধ্যযুগের মুসলমান নবাব, সুবেদার, ভূস্বামীরা, যাদের নৌবাহিনী ছিল, তারা এই প্রতিযোগিতামূলক বিনোদনের সূত্রপাত করেছিলেন। তবে এ বিষয়ে দুটি জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। একটি জনশ্রুতি জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রাকে কেন্দ্র করে। জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রার সময় স্নানার্থীদের নিয়ে বহু নৌকার ছড়াছড়ি ও দৌড়াদৌড়ি পড়ে যায়। এতেই মাঝি-মাল্লা-যাত্রীরা প্রতিযোগিতার আনন্দ পায়। এ থেকেই কালক্রমে নৌকাবাইচের শুরু।

আরেকটি জনশ্রুতি প্রচলিত আছে, যেখানে বলা হয়- নৌকাবাইচ বাংলা সংস্কৃতিতে এসেছে পীরগাজীকে কেন্দ্র করে। আঠারো শতকের শুরুর দিকে কোনো এক গাজী পীর মেঘনা নদীর এক পাড়ে দাঁড়িয়ে অন্য পাড়ে থাকা তার ভক্তদের কাছে আসার আহ্বান করেন, কিন্তু ঘাটে কোনো নৌকা ছিল না। ভক্তরা তার কাছে আসতে একটি ডিঙি নৌকা খুঁজে বের করেন। যখনই নৌকাটি মাঝ নদীতে এলো তখনই নদীতে তোলপাড় আরম্ভ হলো। নদী ফুলে-ফেঁপে উঠল। তখন খবর পেয়ে চারপাশের যত নৌকা ছিল সেসব নিয়ে ছুটে আসেন ভক্তরা। সারি সারি নৌকা একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলার এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতার দৃশ্য শুরু হয়। এ থেকেই নৌকাবাইচের গোড়াপত্তন হয়। সেই নদী নেই, নেই নৌকাও। তবুও নগরায়ণের প্রবল স্রোতে টিমটিম করে হলেও আজো কোথাও কোথাও নৌকাবাইচ হয়ে থাকে। তবে সময়ের নিয়মে হারিয়ে গেছে নৌকাবাইচ কিংবা নৌকার আবেদন। জনজীবনে এসেছে যান্ত্রিকতা। এ যান্ত্রিক সভ্যতার ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে নৌকার ঐতিহ্যময় অমল দিন। এখন আর মাঝিকে গুণ টেনে নৌকা চালাতে হয় না। তাদের শরীরের বাঁকে বাঁকে আর খেলে না চিত্রকলার ভাঁজ। হৃদয় চিরে উঠে আসা সুরে মেলে না উত্তর। কোনো বোন গাঙের পাড়ে দাঁড়িয়ে নৌকার মাঝিদের ডেকে আর গায় না- কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া/আমার ভাইধন রে কইয়ো, নাইওর নিতো বইলা/তোরা কে যাস কে যাস...

এখন নদীতে ব্রিজ হয়েছে, নদী হারিয়েছে নাব্যতা। বিলঝিল পানিশূন্য সারা বছর। জলাশয়গুলো বালি ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। সুন্দরী পাল তোলা নৌকা চলবে কোথায়? ময়ূরপঙ্খী নাও পাল তুলে ভেসে ভেসে কোন বন্দরে কবে, কাথায় হারিয়ে গেছে আমরা আজ আর কেউ জানি না। সেদিনের পাল তোলা নৌকার গল্প আজ তাই শুধুই স্মৃতি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //