বাঙালির রাজনৈতিক মানস ও ভাবনা

তুলনামূলক বিচারে বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাস গৌরবোজ্জ্বল নয়। বিদেশি ও দেশি অনেক পর্যবেক্ষকই বাঙালিকে বিশেষিত করেছেন-ঈর্ষাপরায়ণ, পরশ্রীকাতর, আত্মকলহপরায়ণ, ভাবালু, কর্মকুণ্ঠ, ইন্দ্রিয়পরবশ, কোপনস্বভাব, চক্রান্তপ্রবণ, ভীরু, সাহসহীন, অদূরদর্শী, অসহিষ্ণু আবেগপ্রবণ, হুজুগে ইত্যাদি বলে।

বাঙালি সম্পর্কে এসব মন্তব্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। দরিদ্র বাঙালিকে চিরকাল কঠোর পরিশ্রম করে জীবন রক্ষা করতে হয়েছে। উচ্চশ্রেণির সঙ্গে নিম্নশ্রেণির বাঙালির অনেক প্রভেদ। পূর্বোক্ত বিশেষণসমূহ হয়তো প্রয়োগ করা হয়েছে প্রধানত উচ্চ, অভিজাত শ্রেণির বাঙালিদের আচরণ লক্ষ্য করেই। নীহাররঞ্জন রায়, ‘বাঙ্গালির ইতিহাস’ গ্রন্থে বাংলাভাষী ভূখণ্ডের জনসাধারণের প্রাচীন কালের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে তাদের হৃদয়াবেগ ও ইন্দ্রিয়ালুতার কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর ভাষায় : প্রাচীন বাঙ্গালির হৃদয়াবেগ ও ইন্দ্রিয়ালুতার ইঙ্গিত তাহার প্রতিমা-শিল্পে এবং দেব-দেবীর রূপ-কল্পনায় ধরা পড়িয়াছে...। মধ্যযুগের গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে, সহজিয়া সাধনায়, বাউলদের সাধনায় যে বিশুদ্ধ ভক্তিরস ও হৃদয়াবেগের প্রসার, তাহার সূচনা দেখা গিয়াছিল আদি পর্বেই, এবং তাহা শুধু বৌদ্ধ বজ্রযানী, সহজযানীদের মধ্যেই নয়, তান্ত্রিক শক্তি-সাধনার মধ্যেই নয়, বৈষ্ণব-সাধনায়ও বটে। এই হৃদয়াবেগ ও ইন্দ্রিয়ালুতা- যে বহুলাংশে আদিম নরগোষ্ঠীর দান, তাহা আজিকার সাঁওতাল, শবর প্রভৃতির জীবনযাত্রা, পূজানুষ্ঠান, সামাজিক আচার, স্বপ্ন-কল্পনা, ভয়-ভাবনার দিকে তাকাইলে আর সন্দেহ থাকে না।... মধ্যযুগে দেখিতেছি, দেবই হউন আর দেবীই হউন, বাঙ্গালি যথাসম্ভব চেষ্টা করিয়াছে তাঁহাদের মর্তের ধুলায় নামাইয়া পরিবার-বন্ধনের মধ্যে বাঁধিতে এবং ইহগত সংসার-কল্পনার মধ্যে জড়াইতে, হৃদয়াবেগের মধ্যে তাঁহাদের পাইতে ও ভোগ করিতে, দূরে রাখিয়া শুধু পূজা নিবেদন করিতে নয়।... ষষ্ঠী, মনসা, হারীতী, বিষ্ণু-যশোদা প্রভৃতির রূপ-কল্পনায়ই-যে এই ভাবনা অভিব্যক্ত, তাহাই নয়; কার্তিকের কৌতুক, শিবের গৃহস্থালীর বর্ণনা, নেশাগ্রস্ত হৃদয়াবেগ দিয়া আপন করিয়া বাঁধা, সপরিবারে বিষ্ণু ও শিবের প্রত্যগমন করা প্রভৃতির মধ্যেও একই ভাবনা। (বাঙ্গালির ইতিহাস, আদিপর্ব, কলকাতা ১৯৯৮, পৃ ৮৫৯-৬০)।

বাঙালির রাজনীতিতে বাঙালি চরিত্রেরই প্রকাশ আছে নিঃসন্দেহে। কোনো জনসমষ্টির রাজনীতি কেবল তাদের রাজা, বাদশাহ, সম্রাট ও নেতাদের ব্যাপারই নয়; তাতে ওই জনসমষ্টির আচরণের প্রভাব ও বৈশিষ্ট্যের প্রকাশও ঘটে। জাতীয় চরিত্রে শাসক ও নেতাদের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে জনগণের বৈশিষ্ট্যও সংশ্লেষিত হয়। জাতীয় চরিত্র কোনো অপরিবর্তনীয় ব্যাপার নয়। জনসমষ্টির ধারাবাহিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় জাতীয় চরিত্র গড়ে ওঠে, আবার জাতির আত্মসচেতনতা, নতুন অভিজ্ঞতা, বৈদেশিক প্রভাব এবং জাতীয় সাধনা ও জাতীয় সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতীয় চরিত্র পরিবর্তিত হয়। কোনো জনগোষ্ঠীরই জাতীয় চরিত্র সব যুগে একরকম থাকে না। অনুন্নত জাতির উন্নতির এবং উন্নত জাতির পতনের দৃষ্টান্ত আমরা ইতিহাসে পাই। জাতীয় চরিত্র এবং জাতির উত্থান-পতনে রাজা, বাদশাহ ও নেতাদের যেমন ভূমিকা থাকে, তেমনি জনসাধারণেরও ভূমিকা থাকে।

বাঙালির জাতীয় জীবনে ধর্মান্তর, নতুন মতাদর্শ উদ্ভাবন, নানাভাবে বাইরের প্রভাবকে গ্রহণ করে নবায়িত হওয়ার ঘটনা কয়েকবার ঘটেছে। বাঙালি প্রাচীন যুগে বহিরাগত আর্য-ব্রাহ্মণ্য, জৈন ও বৌদ্ধ প্রভাবে; মধ্যযুগে বহিরাগত তুর্কি-পাঠান-মোগলদের ও ইসলামের প্রভাবে এবং আধুনিক যুগে ইউরোপীয় প্রভাবে এসেছে। নানাভাবে এসব প্রভাবকে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে গ্রহণ করেছে। ঔপনিবেশিক শাসনের চাপে অবাঞ্ছিত অনেক কিছু গ্রহণে বাধ্যও হয়েছে। নীহাররঞ্জন রায় উল্লেখ করেছেন-

আর্য ব্রাহ্মণ্য এবং বৌদ্ধ ও জৈন সাধনাদর্শে কিন্তু এই ঐকান্তিক হৃদয়াবেগ ও ইন্দ্রিয়ালুতার এতটা স্থান নাই। সেখানে ইন্দ্রিয়ভাবনা বস্তু-সম্পর্ক-বিচ্যুত; ভক্তি, জ্ঞানানুরাগ ও হৃদয়াবেগ বুদ্ধির অধীন। বস্তুত বাঙ্গালির অধ্যাত্মসাধনার তীব্র আবেগ ও প্রাণবন্ত গতি সনাতন আর্যধর্মে অনুপস্থিত। (ঐ, পৃ. ৮৫৯)

আর্য-ব্রাহ্মণ্য, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে বাঙালির বুদ্ধিগত ঐতিহ্য কিছুটা বিকশিত হয়েছে। তবে তা উল্লেখযোগ্য মাত্র, তার বেশি হয়তো নয়। আজও বাংলাদেশে, অন্তত রাজনীতিতে, আবেগকে বুদ্ধির অধীন মনে হয় না। মধ্যযুগে বাঙালি-সমাজের একাংশের ইসলামে ধর্মান্তর এই জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা। সেকালে বিদেশ থেকে এদেশে শুধু ইসলাম আসেনি, ইসলামের পাশাপশি এসেছে আফগান, ইরানি, তুর্কি-মোগল রাজত্ব-অভিলাষী ও ভাগ্যান্বেষী লোকরা। তারা এদেশে এসে রাজত্ব দখল করেছে এবং অর্থ-বিত্ত অর্জন করেছে। সম্পদ অর্জনের উদ্দেশ্যে আগত ভাগ্যান্বেষীরা বাংলার তুর্কি-মোগল-আফগান শাসকদের দরবারে ও প্রশাসনে চাকরি নিয়েছে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে। বাংলায় মধ্যযুগের এই বিদেশি শাসকদের কালে ফারসি রাষ্ট্রভাষা ছিল। মধ্যযুগে ভারতবর্ষে আগত বিদেশি শাসক-আমলা-ব্যবসায়ীদের ভাষার সঙ্গে হিন্দুস্তানি ভাষার মিশ্রণ ও সংশ্লেষণের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে উর্দূ ভাষা। বাঙালির বৌদ্ধিক ঐতিহ্য সেকালে বিকশিত হয়েছে প্রধানত সংস্কৃত ভাষার আশ্রয়ে, কিছুটা বাংলা ভাষায়। তাতে আরবি-ফারসির, প্রধানত ফারসির প্রভাব ছিল। বিদেশিরা ফারসি ভাষারই চর্চা করেছে, পরে উর্দুর।

ব্রিটিশ-শাসিত বাংলায় বাঙালির বুদ্ধিগত ঐতিহ্য বিকশিত হয়েছে বাঙলা ও ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে। বাংলা ভাষার গতি বার বার রুদ্ধ হয়েছে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর পরাধীনতার কারণে। প্রশ্ন হলো, নীহাররঞ্জন রায় প্রাচীন বাঙালির যে চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য লক্ষ করেছেন, আজকে বাংলাদেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল এলাকাতে বাঙালির চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য মূলগতভাবে তা থেকে কতটা উন্নত হয়েছে? আদৌ উন্নত হয়েছে কি? জাতীয় চরিত্র উন্নত না হলে, জাতির অভ্যন্তরে বৌদ্ধিক ঐতিহ্য সমৃদ্ধ না হলে, জাতীয় রাজনীতিতে বিচার-বুদ্ধি ও জ্ঞান ক্রিয়াশীল না-থাকলে জাতীয় রাজনীতি কি উন্নত ও গৌরবোজ্জ্বল হতে পারে?

বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাস দীর্ঘ পরাধীনতার ইতিহাস। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী দেখিয়ে থাকেন, বাঙালি-সমাজে সামন্তবাদী ব্যবস্থার স্বাভাবিক বিকাশ বিঘ্নিত হয়েছে বহিরারোপিত আর্য প্রভাবের ও পরাধীনতার ফলে। বাঙালি-সমাজে বুর্জোয়া ব্যবস্থার স্বাভাবিক বিকাশও বিঘ্নিত হয়েছে ইংরেজ আমলে পরাধীনতার ফলে। আত্মবিকাশের জন্য বিচার-বিবেচনার মধ্য দিয়ে বাধ্য হয়ে বাইরের প্রভাবকে গ্রহণ করা, আর ভয়ের কিংবা লোভের বশবর্তী হয়ে বাইরের প্রভাবকে গ্রহণ করা এক রকম ব্যাপার নয়। বর্তমান ঐতিহাসিক পর্যায়েও, নয়া-উপনিবেশবাদী বিশ্বব্যবস্থায়, ‘আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা’-র সম্পর্কের মধ্যে পড়ে বাংলাদেশে জনজীবনে স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে, সমতা-ভিত্তিক সম্পর্কের কোনো আয়োজন দেখা যাচ্ছে না। 

ইতিহাস-বিচারের এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সত্য আছে বলে মনে করি। সেই সঙ্গে মনে করি, জাতীয় সাধনা ও জাতীয় সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতীয় নিয়তির পরিবর্তন ঘটানো যায়। এই পরিবর্তন ঘটানোর কাজে জাতির জীবনে ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা, জাতীয় ইতিহাসের জ্ঞান এবং অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ অপরিহার্য। ইতিহাসের নামে স্বকল্পিত কাহিনী প্রচার করলে জাতির পক্ষে তা অকল্যাণকর হতে বাধ্য। ইতিহাস-বিকৃতি দ্বারা জাতির আত্মা বিকারপ্রাপ্ত হয়। ইতিহাসচর্চায় দরকার সম্মুখদৃষ্টির। একজন ব্রিটিশ নেতার উক্তি-The longer you can look back, the further you can look ahead. কেবল পেছনে তাকিয়ে থাকা অন্যায়, সামনে দেখতে হবে।

ইতিহাসে দেখা যায়, পাল ও সেন রাজবংশের লোকরা বাইরে থেকে এসে বাংলাভাষী ভূখণ্ডে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পালদের বহিরাগমনের প্রশ্নে অবশ্য মতপার্থক্য আছে। তবে 

পাল-সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল উত্তর ভারতের বিশাল অংশব্যাপী, এবং তাতে কেবল উত্তর-পশ্চিম বঙ্গই অন্তর্ভুক্ত ছিল- পূর্বাঙ্গ ছিল না। তুর্কি-মোগল, আফগান ও ইরানিরা মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশ থেকে এসে বাংলার ভূখণ্ডে রাজত্ব ও ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। ইংরেজরা নিতান্তই বাণিজ্য করতে এসে এদেশে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। বাঙালি স্বশাসনের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়নি। ফলে ইতিহাসে বাঙালি-চরিত্রে স্বাভাবিক স্ফূর্তি কমই দেখা যায়। তবে বাঙালি অবশ্যই সেই শক্তিরও অধিকারী, যার বলে সে মানবজাতির মূলধারায় টিকে আছে। এই শক্তিকে অব্যাহত রাখতে ও সমৃদ্ধ করতে হলে তাকে আত্মসচেতন হতে হবে এবং গভীরভাবে চিন্তা করে কাজ করতে হবে। জাতীয় জীবনে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতাকে পরম মূল্য দিতে হবে।

পাশ্চাত্য-প্রভাবে গত একশ বছর ধরে দীর্ঘ পরাধীনতার ছাপ গায়ে নিয়ে বাংলাভাষী ভূখণ্ডে আধুনিক রাজনীতির যে বিকাশ, তাতে মাঝে মাঝে কিছু উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। ইতিহাস গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে তা বোঝা যায়। অবশ্য একথা ঠিক যে, অতীতে পরাধীনতাকে মানতে সে বাধ্য হয়েছে বটে; কিন্তু তার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা কখনো নিঃশেষ হয়নি- চিরকাল সে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে। বাঙালির এই স্বাধীনতা-সংগ্রাম না থাকলে সে সভ্যজগতে টিকে থাকতে পারত না- আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের মতো কিংবা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের মতো অবস্থা হতো তার, কিংবা তার চেয়েও খারাপ অবস্থা হতো। স্বাধীনতার সংগ্রাম না থাকলে বাঙালি জনগোষ্ঠী হয়তো উপজাতিতে এবং উপজাতি থেকে অপজাতিতে পরিণত হতো। বাঙালির আবহমান কালের স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাস রচিত হয়নি। তবে সে ইতিহাসের প্রমাণ একেবারে মুছে যায়নি।

এ দেশের জনগণের সংগ্রামী ভূমিকা সব যুগেই পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে; কিন্তু এ সমাজে নেতৃত্বের ব্যর্থতাও লক্ষণীয়। বাংলার জনগণ উন্নত চরিত্রের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে পারেনি কোনো কালেই। স্বতঃস্ফূর্ততার দিকেই এ জাতির মানুষের প্রবণতা প্রবল। বাঙালির আধুনিক যুগের রাজনীতির প্রকৃত ইতিহাস সন্ধান করতে গেলেও হয়তো দেখা যাবে, গণআন্দোলনসমূহ যতটা নেতৃত্বের দ্বারা পরিকল্পিত ও পরিচালিত, তার চেয়ে অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ততা দ্বারা তাড়িত। স্বতঃস্ফূর্ততার তাড়না অত্যন্ত প্রবল বলে এবং রাজনীতিতে বুদ্ধির অনুশীলনের অভাবের কারণে, এ সমাজে গণতন্ত্রের ধারণা আজও স্বতঃস্ফূর্ততার পর্যায়েই আছে- বৌদ্ধিক বিবেচনার বিষয় হয়নি। এদেশে গণআন্দোলনের নেতৃত্ব গড়ে ওঠে বহুলাংশে স্বতঃস্ফূর্ত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে- কখনো কখনো পশ্চাৎবর্তী সংস্কার-বিশ্বাস ও মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণাকে কেন্দ্র করে। নিতান্ত গণভোটের মাধ্যমে সরকার গঠনের কাজকেই আজও এদেশে গণতন্ত্র মনে করা হয়। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও জীবনপদ্ধতির রূপ-স্বরূপ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা এদেশে আজও বিকশিত হয়নি।

এদেশের রাজনীতিতে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে; গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দ্বারা নয়। লক্ষণীয় যে, রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার কোনো কোনো ক্ষতিকর প্রবণতা এদেশে গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রী বলে আত্মপরিচয়-দানকারী প্রভাবশালী দলগুলোর মধ্যে আজও প্রবলভাবে বর্তমান। এমনকি রাজনৈতিক নেতৃত্বে বংশানুক্রমের প্রতি আনুগত্যের মনোভাব আজও কাটেনি; পারিবারিক ঐতিহ্যের মধ্যযুগীয় ধারণা নেতৃত্ব গঠনের সময় আজও ক্রিয়াশীল থাকে; অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার প্রশ্ন গৌণ হয়ে যায়। বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলে দু’জন অনভিজ্ঞ মহিলার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পেছনে কি-মনোভাব কাজ করেছে? অন্ধবিশ্বাস আজও প্রবলভাবে কাজ করে; 

চিন্তা-ভাবনার, বিচার-বিবেচনার, বিবেক-চালিত যুক্তি-তর্কের বিশেষ স্থান হয় না নেতৃত্ব সৃষ্টির প্রক্রিয়ায়। বিশ্বাসের দৃঢ়তা দিয়ে যে সত্যের প্রমাণ হয় না- এই বোধ প্রাধান্য বিস্তার করে না। ধূর্ততা, চতুরতা, ভাঁওতা, প্রতারণা ইত্যাদিকেই মনে করা হয় বুদ্ধির ব্যাপার; বুদ্ধির স্বরূপ সম্পর্কে কোনো 

চিন্তা-ভাবনা বিকশিত হয়নি। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিচার-বুদ্ধির স্থান আছে কি? পেছন থেকে বিকৃত বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ করছে পাশ্চাত্য আধিপত্যবাদীরা তাদের আধিপত্যবাদী স্বার্থে। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে উদাসীন।

বাঙালির বৌদ্ধিক ঐতিহ্য দুর্বল এবং সে দুর্বলতার পরিচয় রাজনীতিতেই সবচেয়ে প্রকট। লেখার ক্ষেত্রে গত হাজার বছরে বাঙালি কখনো কখনো উন্নত বৌদ্ধিক শক্তির পরিচয় দিয়েছে। বাঙালির চিন্তার কিংবা জ্ঞানের ইতিহাস রচনা করলে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে; কিন্তু রাজনীতিতে চিন্তা ও জ্ঞানকে কাজে লাগানো হয়নি। সভ্য জগতের যে কোনো মানদণ্ড অনুযায়ী, এ দেশের ব্রিটিশ-শাসনোত্তর রাজনৈতিক দলসমূহের রাজনৈতিক চরিত্র বিচার করতে গেলে উন্নত চরিত্রের কোনো রাজনৈতিক দলের সন্ধান পাওয়া যায় না। ব্রিটিশ শাসিত ভারতেও রাজনৈতিক দল যে বিশেষ উন্নত চরিত্র অর্জন করেছিল, তা বলার কোনো কারণ দেখি না। তবে স্বীকার করতে হবে যে, নিখিল ভারত কংগ্রেস কিছুটা উন্নত রাজনৈতিক চরিত্র অর্জন করেছিল মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্ব, যে ধারারই হোক, ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও, অনেক উন্নত চরিত্রের ছিল। স্মরণ রাখতে হবে যে, গান্ধী পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সমাজ-দার্শনিকদের একজন, তাঁর চিন্তা কর্মমুখী এবং তিনি পরিচিত হয়েছেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৈতিকতাবাদী ধপঃরারংঃ রূপে। গান্ধী ভারতে না-জন্মে ইউরোপের কোনো দেশে জন্মালে হয়তো পৃথিবীব্যাপী তাঁর চিন্তাধারা সম্পর্কে অনেক বেশি আলোচনা হতো, এবং মানবসভ্যতার বিকাশে তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাব অনেক বেশি পড়ত। তুলনামূলক আলোচনায় দেখা যাবে, বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস যেমন উজ্জ্বল নয়, তেমনি ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসও উজ্জ্বল নয়। বিদেশি শক্তির মোকাবেলায় ভারতবর্ষও ক্রমাগত ব্যর্থ হয়েছে এবং শাসিত হয়েছে বিদেশিদের দ্বারা। এই অনুজ্জ্বল ঐতিহ্যকে পেছনে রেখে গান্ধীর আত্মপ্রকাশ। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোকে বাদ দিলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে পৃথিবীর গরিব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভারতের রাজনীতি তুলনামূলকভাবে উন্নত। আমাদের বেলায় স্বীকার করতে হবে যে, ইংরেজ ও পাকিস্তানকালে আমাদের রাজনীতিতে এমন কিছু শক্তি অর্জিত হয়েছিল, যার ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা এবং জমিদারি ব্যবস্থার বিলোপ-সাধন সম্ভবপর হয়েছিল। তবে এটাও লক্ষণীয় যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরেই তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনীতি শক্তিহারা হয়ে পড়েছিল এবং বাঙালি-জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রবল হয়েছিল। এ সময়ের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই এদেশের রাজনীতি অভাবনীয় গতি লাভ করেছিল; কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরেই বাংলাদেশের রাজনীতি আবার দুর্বল হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে কোনো রাজনীতিবিদ নৈতিক প্রশ্নে কখনো আগ্রহ প্রকাশ করেননি। এদেশে রাজনীতিবিদরা স্বতঃস্ফূর্ত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়েছেন; ক্ষমতা দখলের লক্ষে- জনসাধারণকে পক্ষে পাওয়ার উদ্দেশ্যে- প্রতিপক্ষের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে প্রতিপক্ষকে উৎখাত করতে চেয়েছেন; আত্মপক্ষের অবস্থা কখনো বিচার করে দেখেননি, আত্মদর্শনের প্রয়োজন উপলব্ধি করেননি, আত্মগঠন সম্পর্কে চিন্তা করেননি। ‘ক্ষমতাসীনেরা পারছে না, আমরা ক্ষমতা হাতে পেলেই পারব।’- এই মনোভাব নিয়ে সব দলের লোকেরা প্রচার চালিয়ে থাকেন এবং ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন। ‘আমরা ক্ষমতা হাতে পেলে কেন, কীভাবে পারব’- এ প্রশ্নের মোকাবেলা করতে চান না কেউই। ফলে ক্ষমতা দখল সম্ভব হলেও ক্ষমতায় গিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা আর সম্ভব হয় না, ক্ষমতাসীন হতে না হতেই ক্ষমতাচ্যুতির বিপদ ঘনিয়ে আসে। মুসলিম লীগ, যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগের ইতিহাসে আত্মদর্শনের ও আত্মগঠনের প্রচেষ্টা কতখানি দেখা গেছে? ক্ষমতা দখলে এ সব দল ও জোট সফল হয়েছিল, সন্দেহ নেই; কিন্তু ক্ষমতাসীন হয়ে তারা কি কিছুমাত্রও সফল হয়েছিল? নেতৃত্ব নিতান্তই ব্যক্তিবিশেষের ব্যাপার নয়, দলগত ব্যাপারও, কেবল দলগত ব্যাপারও নয়, জনগণের ব্যাপার।

বাংলাদেশের ভূখণ্ডে রাজনীতিবিদরা শুধু যে নৈতিক প্রশ্নে আগ্রহ প্রকাশ করেননি, তাই নয়; ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণের প্রশ্নেও তাঁরা আগ্রহ প্রকাশ করেননি। অনেক পর্যবেক্ষকই বাঙালিকে অভিহিত করেছেন, আত্মবিস্মৃত ও ইতিহাসচেতনাহীন জনগোষ্ঠী বলে।

বাংলাভাষী ভূখণ্ডে শতাব্দীব্যাপী গণজাগরণের ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রথমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তান, তারপর পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ। রাষ্ট্রীয় ভাঙাগড়ার আকাঙ্ক্ষা ছাড়াও উন্নত জীবন প্রতিষ্ঠায় বহুমুখী আশা-আকাঙ্ক্ষা এই গণজাগরণের মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত হয়েছিল। গণজাগরণের ধারায় প্রতিটি আন্দোলনের সময়ে গড়ে উঠেছিল নেতৃত্ব, আত্মপ্রকাশ করেছিলেন নেতা। এই নেতাদের রাজনৈতিক চরিত্রে তাঁদের নিজেদের মেধার ও প্রতিভার বৈশিষ্ট্য যতটা রূপায়িত হয়েছিল, ততটাই প্রতিফলিত হয়েছিল তাঁদের নিজ নিজ কালের গণমানসও। মনে রাখতে হবে, যে জনগণ যখন যেমন নেতৃত্বের যোগ্য হয়, সেই তারাই আবার নিজেরা নিজেদের জন্য নিজেদের মধ্য থেকে তখন ঠিক সেই রকম নেতৃত্বই তৈরি করে। একজন লেখকের রচনায় পাচ্ছি : যে বিশাল ব্যাপক জনভূমিতে আমরা কোনো প্রতিভাকে জন্ম নিতে দেখি, তার প্রকৃতি ও প্রবণতাকে ঐ প্রতিভার মধ্যে প্রতিফলিত দেখি। তাই হীনবীর্য নীচ জনসাধারণের নেতাকেও আমরা দেখতে পাই হীনবীর্য নীচ হিসেবে, আর উদার কর্মোদ্যমে ভরপুর সৎ নাগরিকদের নেতাকে পাই মহান রূপে। লালনক্ষেত্র হিসেবে সাধারণ মানুষের সাধারণ জীবন তাই অসাধারণ মানুষের জন্য অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাপক জনসাধারণ যদি না থাকত এবং যদি তারা প্রতিভাবানের সৃষ্টিতে অনুভূত, প্রতিফলিত ও সৃষ্ট না-হতো, তবে প্রতিভাবান হিসেবে কেউ কোনোদিন স্বীকৃতি পেত না। (আফজালুল বাসার- ‘বাংলাদেশে নেতৃত্বের সমস্যা’, লোকায়ত, ষষ্ঠ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, জুন ১৯৮৮।)

বাংলার ভূখণ্ডে আধুনিক যুগে রাজনৈতিক প্রতিভার উদ্ভব ও বিকাশের পরিচয় নিতে হলে সামাজিক পটভূমি ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে রাজনৈতিক নেতাদের চিন্তাধারার ও কার্যাবলির বিবরণ সংগ্রহ করতে হবে। আধুনিক যুগে যঁরাা নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য কিছু নাম : আনন্দমোহন বসু (নেত্রকোণা ১৯৪৭-১৯০৬), সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (কলকাতা ১৮৪৮-১৯২৫), অশ্বিনীকুমার দত্ত (বরিশাল ১৮৫৬-১৯২৩), বিপিনচন্দ্র পাল (সিলেট ১৮৫৮-১৯৩২), চিত্তররঞ্জন দাশ (বিক্রমপুর ১৮৭০-১৯২৫), আরবিন্দ ঘোষ (কলকাতা ১৮৭২-১৯৫০), এ. কে. ফজলুল হক (বরিশাল ১৮৭৩-১৯৬২), আবদুল হামিদ খান ভাসানী (সিরাজগঞ্জ ১৮৮০-১৯৭৬), মানবেন্দ্রনাথ রায় (চব্বিশ পরগনা ১৮৮৭-১৯৫৪), শরৎচন্দ্র বসু (চব্বিশ পরগনা ১৮৮৯-১৯৫০), মুজফফর আহমদ (সন্দ্বীপ ১৮৮৯-১৯৭৩), হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি (কলকাতা ১৮৯২-১৯৬৩), সুভাষচন্দ্র বসু (চব্বিশ পরগনা ১৮৯৭-১৯৪৫), আবুল হাশিম (বর্ধমান ১৯০৫-১৯৭৫), শেখ মুজিবুর রহমান (গোপালগঞ্জ ১৯২০-১৯৭৫), তাজউদ্দীন আহমদ (ঢাকা ১৯২৫-১৯৭৫)। এঁরা সকলে সমান মাপের নেতা ছিলেন না। এঁদের চিন্তার ধরন আর কাজের পদ্ধতিও এক রকম ছিল না, মহত্ত্ব-বিচারেও এঁদের মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য দেখা যাবে। এঁদের কর্মকালের বৈশিষ্ট্যও একরকম ছিল না এবং চিন্তা ও কর্মও এক ধারায় বিকশিত হয়নি। তবে এঁদের নেতৃত্বের প্রভাব বাংলার জনজীবনে প্রবল ও প্রবলতরভাবে অনুভূত হয়েছে, কারও কারও প্রভাব ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্রই অনুভূত হয়েছে। এঁদের চিন্তা ও কর্মের মধ্য দিয়েই বাঙালির (হিন্দু-মুসলমান, বাংলাদেশি-ভারতীয়) রাজনৈতিক প্রতিভার অভিব্যক্তি ঘটেছে। এঁদেরই পাশে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে এঁদের বিরুদ্ধ-ধারায় নেতৃত্ব করেছেন : নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ (ঢাকা ১৮৬৬-১৯১৫), মোহাম্মদ আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮), তমিজউদ্দিন খান (ফরিদপুর ১৮৮৯-১৯৬৩), নুরুল আমিন (ময়মনসিংহ ১৮৯৩-১৯৭৪), খাজা নাজিমউদ্দিন (ঢাকা ১৮৯৪-১৯৬৪), খাজা শাহাবুদ্দিন (ঢাকা ১৮৯৯-১৯৭৭), আবদুল মোনেম খান (কিশোরগঞ্জ ১৮৯৯-১৯৭১), আবদুল মোত্তালেব মালিক (চুয়াডাঙ্গা ১৯০৫-১৯৯৫), আবদুস সবুর খান (খুলনা ১৯০৮-১৯৮২), ফজলুল কাদের চৌধুরী (চট্টগ্রাম ১৯১৯-১৯৭৩) প্রমুখ। এঁরাও সকলে সমমাপের নন এবং এঁদের ভূমিকাও সব সময় এক রকম ছিল না।

বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের ভূখণ্ডে গণজাগরণের ও গণআন্দোলনের ইতিহাস উজ্জ্বল; কিন্তু তার পর থেকে শতাব্দীব্যাপী গণজাগরণের ও গণআন্দোলনে ক্ষয়ের কাল চলছে। গত পঁচিশ-ত্রিশ বছর ধরে আন্দোলন হলেও, গণজাগরণের সে ধারা অবশিষ্ট নেই। অতীতের গণজাগরণের নেতাদের সম্পর্কে নানা ভুল-ভ্রান্তিসহ কোনো কোনো গ্রন্থে কিছু কিছু তথ্য সঙ্কলিত হয়েছে; কিন্তু সেগুলোতে তাঁদের নেতৃত্বের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের বিচার হয়নি। ফলে এই কালের ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নতুন প্রজন্মের লোকদের জীবনে অল্পই ঘটেছে। প্রবীণদের কাছ থেকে নবীনরা শুনে শুনে যে ইতিহাস জানে, তাতে সত্যের সঙ্গে অনেক মিথ্যা যুক্ত থাকে, তথ্যের সঙ্গে অনেক কল্পিত কাহিনি মিশ্রিত হয়, হীনস্বার্থের চেতনা সহজেই মৌখিক ইতিহাসের এই প্রক্রিয়াকে সত্যচ্যুত করে। হীনস্বার্থে অতীতের রাজনৈতিক নেতাদের ভাবমূর্তিকে ব্যবহারের চেষ্টাও অন্তত নেই। তাছাড়া রাজনীতিতে যে প্রস্তুতির, শিক্ষা-দীক্ষার, বুদ্ধি-বিবেচনার, জ্ঞানের ও কর্মের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাবার প্রয়োজন আছে- এই কথাটিই যেন বিস্মৃত।

বাংলাদেশের রাজনীতির যে নিদারুণ পতিত অবস্থা আজ দেখা যাচ্ছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য কেবল বর্তমান বাস্তবতার বিচার মোটেই পর্যাপ্ত নয়; দরকার ঐতিহাসিক সত্যের মুখোমুখি হওয়ার সাহস। শক্তি ও দুর্বলতা এবং ভালো ও মন্দ দুই দিকেই দৃষ্টি দিতে হবে। পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য দরকার অসাধারণ প্রতিভা। রাজনীতিতে প্রতিভা যতটা নেতার উপর নির্ভর করে, ততটাই নির্ভর করে সেই জনগণের উপর- যাদের থেকে নেতার আত্মপ্রকাশ। প্রতিভার সঙ্গে নৈতিক শক্তিও অপরিহার্য।

জাতীয় চরিত্র উন্নত করার এবং জাতীয় প্রতিভা সৃষ্টির জন্য জাতীয় জীবনে আমাদের সাধনা ও সংগ্রাম দরকার। আমরা আমাদের জাতীয় ভবিষ্যত অনেকখানি তৈরি করতে পারি, সবটাই দৈব বা আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছানিরপেক্ষ অনিবার্যতা নয়। জাতীয় সাধনা এবং জাতীয় সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পরাধীনতার ও পরনির্ভরতার নিয়তি আমরা কাটাতে পারি- উন্নতির সোপানে উত্তীর্ণ হতে পারি। বাঙালির জাতীয় চরিত্র সম্পর্কে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকরা সচরাচর যেসব বিশেষণ প্রয়োগ করে থাকেন, সেগুলোকে অতীতের বিষয়ে পরিণত করে আমাদেরকে এগোতে হবে। নৈতিক সচেতনতা ও বুদ্ধির সদ্ব্যবহার এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়ে সামাজিক, জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে আমাদের উন্নত চরিত্র অর্জন করতে হবে। সে উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব সৃষ্টি অপরিহার্য। উন্নত মানসিক জীবনের স্থিতির জন্য চাই উন্নত বৈষয়িক ভিত্তি। উন্নত আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ব্যবস্থা দ্বারা সেই বৈষয়িক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

উন্নত বৈষয়িক জীবন প্রতিষ্ঠার জন্য চাই, উন্নত মানসিক জীবন। আর উন্নত মানসিক জীবন ব্যতিরেকে উন্নত বৈষয়িক জীবন অর্থহীন। জাতির জীবনে এসব উপলব্ধি কার্যকরভাবে দেখা দিতে পারে, অনুকূল রাজনৈতিক নেতৃত্ব সৃষ্টি করা পারার মধ্যেই। 


লেখক : আহমদ শরীফ অধ্যাপক চেয়ার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //