বেলথাজারের দুর্লভ একটি বিকেল

১৯৮২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ নিঃসন্দেহে এক স্মরণীয় লেখক। কলম্বিয়ার এই লব্ধপ্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকের জন্ম ১৯২৭ সালের ৬ মার্চ আরকাতাকার ছোট্ট একটি গ্রামে। পড়ালেখা শেষ করে সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন এবং বিশ্বের বহু দেশ পরিভ্রমণ করেন, ১৯১৪ সালের ১৭ এপ্রিল ৮৭ বছর বয়সে মেক্সিকো সিটিতে তাঁর দেহাবসান ঘটে। অত্যন্ত স্বাভাবিক অথচ নিজস্ব একটি ভঙ্গির জন্য মার্কেজের গল্প বিশিষ্টতার দাবি রাখে। ‘লিফ স্টর্ম’, ‘নো ওয়ান রাইটস টু দ্য কর্নেল’ এবং ‘ইনোসেন্ট ইরেনদিরা’ তার উল্লেখযোগ্য গল্পসংকলন। 

খাঁচাটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। অভ্যেসের বশে বেলথাজার সেটাকে ঘরে চালের ছাঁইতে ঝুলিয়ে রাখল। দুপুরে তার খাওয়া-দাওয়া যখন শেষ হলো ততক্ষণে সবাই বলতে শুরু করেছে, ওটা পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে সুন্দর খাঁচা। এত লোক ওটাকে দেখতে এসেছে যে বাড়ির সামনে রীতিমতো একটা ভিড় জমে উঠেছে। অতএব খাঁচাটাকে নামিয়ে, বেলথাজারকে দোকান বন্ধ করে দিতে হলো। ‘তোমাকে দাড়ি কামাতে হবে,’ স্ত্রী উরসুলা তাকে বলল, ‘একটা সন্ন্যাসীর মতো দেখাচ্ছে তোমাকে।’ ‘দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর দাড়ি কামানো খারাপ,’ বলল বেলথাজার। তার গালে দু-সপ্তাহের দাড়ি- ছোট ছোট, শক্ত শক্ত আর খোঁচা খোঁচা- ঠিক যেন খচ্চরের কেশর আর কোনো ভয়-পাওয়া বালকের সাধারণ অভিব্যক্তির মতো; কিন্তু অভিব্যক্তিটা কপট। ফেব্রুয়ারিতে বেলথাজারের বয়স তিরিশ হলো, চার বছর ধরে সে উরসুলার সঙ্গে বাস করছে; কিন্তু বিয়ে করেনি এবং ওদের কোনো সন্তানাদিও হয়নি। জীবন তাকে সতর্ক হওয়ার জন্য অনেক যুক্তি দেখিয়েছে; কিন্তু ভয় পাওয়ার জন্য একটাও না। সে জানতই না যে কিছু কিছু লোকের কাছে তার সদ্য তৈরি করা খাঁচাটা পৃথিবীর মধ্যে সব চাইতে সুন্দর। শিশুকাল থেকে সে খাঁচা বানানোয় অভ্যস্ত, অন্যগুলোর তুলনায় এটাকে তার আদৌ তেমন কঠিন কাজ বলে মনে হয়নি। ‘তাহলে একটু বিশ্রাম নাও,’ মহিলা বলল, ‘ওই দাড়ি নিয়ে তুমি কোথাও মুখ দেখাতে যেতে পারবে না।’ বিশ্রাম করতে করতেই প্রতিবেশীদের খাঁচাটা দেখাবার জন্য তাকে বেশ কয়েক বার দড়ির দোলনাটা থেকে নেমে আসতে হলো। তখন পর্যন্ত উরসুলা খাঁচাটার দিকে সামান্যই মনোযোগ দিয়েছে। আসলে ও বিরক্ত হয়ে উঠেছিল, কারণ খাঁচাটার পেছনে পুরোপুরি লেগে থাকতে গিয়ে ওর স্বামী নিজের ছুতোরখানার কাজে অবহেলা করেছে, দু-সপ্তাহে খুব কম সময়ই ঘুমিয়েছে, শুধু এপাশ-ওপাশ করেছে আর বিড়বিড় করে অসংলগ্ন প্রলাপ বকেছে এবং দাড়ি কামানোর কথা চিন্তাও করেনি; কিন্তু সদ্য সম্পূর্ণ হওয়া খাঁচাটার চেহারা দেখে ওর সমস্ত বিরক্তি জল হয়ে গেল। বেলথাজার যখন ঘুমের চটকাটা থেকে জাগল ততক্ষণে উরসুলা তার পাতলুন এবং একটা জামা ইস্ত্রি করে, দোলনাটার কাছে একটা সুর্সিতে রেখে দিয়েছে আর খাঁচাটাকে নিয়ে রেখেছে খাওয়ার টেবিলে। চুপচাপ বসে খাঁচাটাকে দেখছিল। ‘এটার জন্য তুমি কত নেবে?’ জিজ্ঞেস করল উরসুলা। ‘জানি না’, বেলাথাজার জবাব দিল। ‘তিরিশ পেসো চাইব, দেখি যদি বিশ দেয়।’ ‘পঞ্চাশ চেয়ো। এই দু-সপ্তাহে তুমি অনেকটা ঘুম নষ্ট করেছ। তাছাড়া খাঁচাটাও তো বেশ বড়সড়। আমার মনে হয় এত বড় খাঁচা আমি জন্মেও দেখিনি।’ বেলথাজার দাড়ি কামাতে শুরু করল। ‘তোমার কি মনে হয় ওরা আমাকে পঞ্চাশ পেসো দেবে?’ ‘মি. চেপে মন্তিয়েলের কাছে সেটা কিছুই নয় আর কাঁচাটাও ওই দাম পাবার যোগ্য।’ উরসুলা বলল, ‘তোমার ষাট চাওয়া উচিত।’

বাড়িটা দমবন্ধ করা ছায়ায় পড়ে আছে। এটা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ, ঘুঘুরে পোকাগুলোর অবিশ্রান্ত গুঞ্জনে গরমটা যেন আরও কম সহনীয় বলে মনে হয়। পোশাক-আশাক পরে, বাড়িটাকে একটু ঠান্ডা করে তোলার বাসনায় বেলথাজার উঠোনের দরজাটা খুলে দিতেই একদল বাচ্চাকাচ্চা খাওয়ার ঘরে ঢুকে পড়ল। সেদিন বিকেলে স্ত্রীর কথা ভাবতে ভাবতে ডক্টর জিরালদো একটি রোগীকে দেখতে গেলেন এবং সেখান থেকে ফিরে বেলথাজারের বাড়িতে গেলেন খাঁচাটাকে একবার ভালো করে দেখবেন বলে। বেলথাজারের খাওয়ার ঘরে অনেক লোক। প্রদর্শনীর জন্য খাঁচাটাকে টেবিলের ওপরে রাখা হয়েছে, ওপরে তারের তৈরি বিশাল গম্বুজ, ভেতরে তিনটে তলা, এধার থেকে ওধারে যাবার বারান্দা-পথ, খাওয়া এবং ঘুমের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কুঠুরি, তাছাড়া পাখিদের বিনোদনের জন্য আলাদা জায়গায় দোলনা ঝোলানো- এ যেন বিশাল এক বরফ-কারখানার ছোট্ট একটা নকশা। 

‘এ হলো কল্পনার উত্তরণ।’ ভিড়ের জটলা থেকে বেলথাজারকে খুঁজে নিয়ে ডাক্তার তার দিকে জননীসুলভ দৃষ্টি মেলে ধরলেন। ‘তুমি একজন অসাধারণ স্থপতি হতে পারতে হে।’

 বেলথাজার লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল, ‘ধন্যবাদ।’ ‘সত্যি বলছি,’ ডাক্তার বললেন। যৌবনকালে সুন্দরী ছিলেন- এমন মহিলাদের মতো তাঁর চেহারাটিও মসৃণ ও ঈষৎ নাদুসনুদুস। হাত দুটিও নরম কোমল। লাতিন বলতে থাকা পুরোহিতের মতো কণ্ঠস্বরে তিনি বললেন, ‘এর মধ্যে পাখি রাখারও কোনো প্রয়োজন নেই।’ খাঁচাটাকে তিনি দর্শকদের চোখের সামনে ঘুরিয়ে ধরলেন, যেন ওটাকে তিনি নিলামে বিক্রি করতে চলেছেন। তারপর বললেন ‘গাছে ঝুলিয়ে দিলে এটা নিজে থেকেই গান গাইবে।’ খাঁচাটা ফের টেবিলে রেখে, এক মুহূর্ত একটু চিন্তা করে, ফের তিনি সেটার দিকে তাকালেন, ‘বেশ, তাহলে আমিই এটা নেব।’

‘এটা বিচ্ছিরি হয়ে গেছে,’ উরসুলা বলল।

‘এটা মি. চেপে মন্তিয়েলের ছেলের,’ বেলথাজার বলল, ‘সে বিশেষ করে এটার ফরমাশ দিয়েছিল।’

ডাক্তার এক সম্মানজনক ভঙ্গিমা গ্রহণ করলেন ‘নকশাটা কি সে-ই তোমাকে দিয়েছিল?’

‘আজ্ঞে না,’ বেলথাজার বলল। ‘একজোড়া ট্রুপিয়ালের জন্য সে একটা বড় খাঁচা চেয়েছিল- এই রকম একটা।’ ডাক্তার খাঁচাটার দিকে তাকালেন; ‘কিন্তু এটা তো ট্রুপিয়ালের খাঁচা নয়।’ ‘ট্রুপিয়ালের খাঁচা বই কি,’ টেবিলের দিকে এগোতে এগোতে বেলথাজার বলল। বাচ্চাগুলো ঘিরে ধরল তাকে। তর্জনী দিয়ে বিভিন্ন কুঠুরিকে দেখিয়ে সে বলল, ‘মাপজোকগুলো সব সাবধানে হিসেব করে নেওয়া হয়েছে।’ তারপর আঙুলের গাঁট দিয়ে সে গম্বুজটাতে আঘাত করতেই এক অনুনাদী ঝঙ্কারে সমস্ত খাঁচাটা ভরে উঠল।

‘এর চাইতে শক্ত তার আপনি কোথাও খুঁজে পাবেন না,’ বেলথাজার বলল। ‘প্রত্যেকটা জোড়ের মুখ বাইরে থেকে আর ভেতর থেকে ঝালা লাগানো আছে।’ ‘এটা একটা তোতাপাখির পক্ষেও বেশ বড়,’ একটা বাচ্চা ওদের কথাবার্তায় বাধা দিয়ে বলল। ‘ঠিক তাই’, বেলথাজার বলল।

ডাক্তার মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘বেশ; কিন্তু সে তো তোমাকে খাঁচার নকশাটা দেয়নি! সঠিক কোনো মাপজোক বা ছিরিছাঁদের কথাও বলেনি। শুধু ট্রুপিয়ালদের মতো করে একটা যথেষ্ট বড়সড় খাঁচা বানাতে বলেছিল। ঠিক কি না?’ ‘আজ্ঞে, ঠিক।’ ‘তাহলে কোনো অসুবিধে নেই। ট্রুপিয়ালের পক্ষে যথেষ্ট বড়সড় একটা খাঁচা বানাবার কথা এক জিনিস আর বিশেষ করে এই খাঁচাটার কথা বলা আর এক জিনিস। এমন কোনো প্রমাণ নেই যে ঠিক এই খাঁচাটাই তোমাকে করতে বলা হয়েছিল।’ ‘ঠিক এই খাঁচাটাই’, বেলথাজার বিভ্রান্ত হয়ে উঠল, ‘আর তাই আমি এটা গড়েছি।’ ডাক্তার একটা অধৈর্য ভঙ্গিমা প্রকাশ করলেন। ‘তুমি তো আর একটা খাঁচা গড়ে দিতে পারো,’ স্বামীর দিকে তাকালো উরসুলা। তারপর ডাক্তারকে বলল, ‘আপনার তো তেমন কোনো তাড়া নেই!’ ‘আমি আজ বিকেলেই এটা দেব বলে স্ত্রীকে কথা দিয়েছি।’

‘আমি ভীষণ দুঃখিত, ডাক্তারবাবু।’ বেলথাজার বলল, ‘কিন্তু যেটা একজনকে বিক্রি করা হয়ে গেছে, সেটা আমি আর আপনাকে বিক্রি করতে পারি না।’

ডাক্তার দু-কাঁধে ঝাঁকুনি তুললেন। তারপর একটা রুমাল দিয়ে ঘাড় থেকে ঘাম মুছে নিয়ে, নীরবে খাঁচাটার সম্পর্কে চিন্তা করতে লাগলেন স্থির অথচ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে- যেমন করে মানুষ ক্রমশ দূরে সরে যাওয়া জাহাজের দিকে দৃষ্টি মেলে রাখে। ‘এটার জন্য ওরা তোমাকে কত দিয়েছে?’ বেলথাজার কোনো জবাব না দিয়ে উরসুলার চোখ দুটোকে খুঁজতে চাইল। ‘ষাট পেসো,’ জবাব দিলো উরসুলা।

ডাক্তার খাঁচাটার দিকেই তাকিয়ে রইলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘খুব সুন্দর! দারুণ!’ তারপর হাসি মুখে দরজার দিকে এগোতে এগোতে প্রচণ্ড উদ্দীপনা সহকারে নিজেকে হাওয়া করতে শুরু করলেন এবং এই ঘটনাটার চিহ্ন চিরদিনের মতোই তাঁর স্মৃতি থেকে উধাও হয়ে গেল। ‘মন্তিয়েল খুব বড়লোক,’ বললেন উনি। দেখে যেমন মনে হয়, আসলে জোসে মন্তিয়েল ঠিক ততটা ধনী নন- কিন্তু তা হবার জন্য তিনি যে কোনো কাজ করতে পারেন। কয়েকটা বাড়ির পরেই তার বাড়ি, যা নানান ধরনের জিনিসপত্রে বোঝাই এবং তার মধ্যে বিক্রি হতে পারে না এমন কোনো জিনিসের সন্ধান কেউ আজ অব্দি পায়নি। খাঁচার সংবাদটাতে তিনি নির্বিকার হয়েই ছিলেন। মৃত্যুভয়ে আবিষ্ট তাঁর স্ত্রী দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর দরজা-জানলা বন্ধ করে, ঘণ্টা দুই ঘরের ছায়ার দিকে চোখ মেলে শুয়েছিলেন আর জোসে মন্তিয়েল তখন দিবানিদ্রা উপভোগ করছিলেন। অনেক কণ্ঠস্বরের শোরগোলে অবাক হয়ে মহিলা বৈঠকখানা ঘরের দরজাটা খুলতেই বাড়ির সামনে একটা ভিড় দেখতে পেলেন। ভিড়ের মাঝখানে খাঁচা হাতে বেলথাজার, তার পরনে সাদা পোশাক, গালের দাড়ি সদ্য কামানো, মুখে এক সুন্দর সারল্যের অভিব্যক্তি- যে অভিব্যক্তি নিয়ে গরিবরা ধনীগৃহের দিকে এগিয়ে যায়।

‘কী অপূর্ব জিনিস!’ জোসে মন্তিয়েরে স্ত্রী উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। ঝলমলে মুখে বেলথাজারকে ভেতরে নিয়ে যেতে যেতে উনি বললেন, ‘এমন জিনিস আমি জীবনেও দেখিনি।’ তারপর দরজার সামনে জমে ওঠা ভিড়ে বিরক্ত হয়ে ফের যোগ করলেন; ‘কিন্তু ওরা আমার বসার ঘরটাকে খেলা দেখার জায়গা করে তোলার আগে, তুমি ওটাকে ভেতরে নিয়ে এসো।’ 

‘এসে দ্যাখো, কী সুন্দর একটা জিনিস!’ ওঁর স্ত্রী চিৎকার করেই জবাব দিলেন। অস্বাভাবিক মোটা এবং রোমশ চেহারার জোসে মন্তিয়েল তোয়ালেটা গলায় জড়িয়ে শোয়ার ঘরের জানলায় গিয়ে হাজির হলেন।

‘ওটা কী?’ জোসের স্ত্রী হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকালেন। জোসে মন্তিয়েলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পেপে এটার জন্য ফরমাশ করেছিল।’ ঠিক সেই মুহূর্তে কিছু ঘটেনি; কিন্তু বেলথাজারের মনে হলো কে যেন তক্ষুনি তার সামনে স্নানঘরের দরজাটা খুলে দিল। অন্তর্বাস পরা অবস্থাতেই জোসে মন্তিয়েল শোয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে ডাকলেন, ‘পেপে!’ ‘এখনো ফেরেনি’, ওঁর স্ত্রী নিস্পন্দ অবস্থায় অস্ফুটে বললেন। ঠিক তখনই পেপে দোরগোড়ায় এসে হাজির হলো। ছেলেটির বয়স বছর বারো। মায়ের মতো তারও চেহারায় শান্ত কারুণ্য, দীর্ঘ অক্ষিপক্ষগুলো আলতো হয়ে উঠে গেছে ওপরের দিকে। ‘এখানে আয়’, জোসে মন্তিয়েল ছেলেকে বললেন। ‘তুই ওটার জন্য ফরমাশ করেছিলি?’ বাচ্চাটা মাথা নত করল। জোসে মন্তিয়েল চুল ধরে টেনে ছেলেকে তাঁর চোখের দিকে তাকাতে বাধ্য করলেন। ‘জবাব দে।’ বাচ্চাটা ঠোঁট কামড়ে রাখল, কোনো জবাব দিল না। জোসে মন্তিয়েল বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিয়ে রাগে গনগন করতে করতে বেলথাজারের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন, ‘আমি ভীষণ দুঃখিত, বেলথাজার। কিন্তু কাজটাতে হাত দেবার আগে আমার সঙ্গে তোমার কথা বলে নেওয়া উচিত ছিলো। একটা বাচ্চার সঙ্গে চুক্তি করার কথা একমাত্র তুমিই ভাবতে পারো।’ কথা বলতে বলতে ভদ্রলোকের মুখটা ফের শান্ত হয়ে উঠল। খাঁচাটার দিকে না তাকিয়ে, উনি সেটাকে তুলে নিয়ে বেলথাজারের হাতে তুলে দিলেন। ‘এক্ষুনি এটা নিয়ে কেটে পড়ো। তারপর যাকে পারো, বিক্রি করার চেষ্টা করোগে। আমি তোমার কাছে মিনতি করছি, এই নিয়ে আমার সঙ্গে আর কথা বাড়িও না।’ বেলথাজারের পিঠে মৃদু চাপড় মেরে উনি বুঝিয়ে বললেন, ডাক্তার-বাবু আমাকে রাগারাগি করতে নিষেধ করে দিয়েছেন।’ বেলথাজার খাঁচাটা হাতে নিয়ে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে একবার পেপের দিকে না তাকানো অব্দি বাচ্চাটা নিষ্পলক চোখে নিস্পন্দ হয়েই দাঁড়িয়ে ছিল। তারপরেই সে গলা দিয়ে কুকুরের গর্জনের মতো একটা গরগর আওয়াজ তুলে, মেঝেতে আছড়ে পড়ে তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দিল। একটা ক্ষিপ্ত জন্তুর মৃত্যুযন্ত্রণা দেখতে হলে যেমন করে দেখত, ঠিক তেমনি করেই বাচ্চাকে লক্ষ করল বেলথাজার। তখন প্রায় চারটে বাজে। ওই সময় তার নিজের বাড়িতে, উরসুলা একটা অনেক পুরনো গান গাইতে গাইতে পেঁয়াজ কুচোচ্ছিল।

‘পেপে’, বেলথাজার ডাকল।

স্মিত মুখে বাচ্চাটার কাছে গিয়ে, খাঁচাটা ওর দিকে এগিয়ে দিল সে। বাচ্চাটা লাফিয়ে উঠে, প্রায় তার মতোই বড়সড় খাঁচাটাকে জাপটে ধরল এবং কী বলবে বুঝতে না পেরে খাঁচাটার জালির ভেতর দিয়ে তাকিয়ে রইল বেলথাজারের দিকে। এতক্ষণ সে এক বিন্দুও অশ্রুপাত করেনি।

‘বেলথাজার’, জোসে মন্তিয়েল নরম গলায় বললেন, ‘আমি তোমার ওটাকে নিয়ে চলে যেতে বলেছিলাম।’ ‘ওটা দিয়ে দাও’, মহিলা বাচ্চাটাকে নির্দেশ দিলেন।

‘ওটা তুমি রাখো’, বেলথাজার বলল। তারপর জোসে মন্তিয়েলকে বলল, ‘আর যা-ই হোক, ওটা তো আমি এই জন্যই বানিয়েছিলাম!’ ‘তাতে কিছুই এসে যায় না’, বেলথাজার বলল। ‘স্রেফ পেপেকে উপহার দেব বলেই আমি ওটা তৈরি করেছিলাম। ওটার জন্য কোনো দাম নেব বলে আমি আশাও করিনি।’

দর্শকবৃন্দ দরজাটা আটকে রেখেছিল। বেলথাজার যখন তাদের ভেতর থেকে পথ করে বেরোচ্ছে, জোসে মন্তিয়েল তখন বৈঠকখানার মাঝখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছেন। উনি তখন প্রচণ্ড পাংশুল এবং ওঁর চোখ দুটো লাল হয়ে উঠতে শুরু করেছে। ‘বুদ্ধু কোথাকার! তোর ওই ফালতু জিনিসটা নিয়ে যা এখান থেকে।’ জোসে মন্তিয়েল তারস্বরে বললেন, ‘একটা বাইরের লোক এসে আমার বাড়িতে হুকুম চালাবে, তা আমরা কিছুতেই বরদাশত করব না। কুত্তির বাচ্চা!’ সর্বসাধারণের মিলন সভায় জয়ধ্বনির সঙ্গে বেলথাজারকে অভ্যর্থনা জানানো হলো। ওই মুহূর্তটা অব্দি বেলথাজার ভেবেছিল, সে সুন্দর একটা খাঁচা তৈরি করেছে- যেমনটি আগে আর কোনাদিনও করেনি, খাঁচাটা তাকে জোসে মন্তিয়েলের ছেলেকে দিয়ে দিতে হয়েছে- যাতে সে কান্নাকাটিটা চালিয়ে না যায় এবং এর মধ্যে কোনোটাই তেমন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়; কিন্তু তারপর সে অনুভব করল, অনেকের কাছে এর সব কিছুরই একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে এবং ফলে সামান্য উত্তেজনা অনুভব করল বেলথাজার। ‘তাহলে খাঁচাটার জন্য ওরা তোমাকে পঞ্চাশ পেসো দিয়েছে?’ ‘ষাট’, বেলথাজার বলল। ‘তোমাকে শাবাশ, ভাই!’ একজন বলল, ‘তুমিই হলে একমাত্র লোক, যে মি. চেপে মন্তিয়েলের কাছ থেকে এতোগুলো টাকা আদায় করে নিতে পেরেছ। কাজেই আমাদের উৎসব পালন করতে হবে।’ ওরা বেলথাজারকে একটা বিয়ার কিনে দিল, পরিবর্তে সেও প্রত্যেককে একবার করে খাওয়াল। জীবনে এই প্রথম বেহিসেবী মদ্যপান, তাই সন্ধ্যায় মধ্যেই মানুষটা সম্পূর্ণ মাতাল হয়ে গেল। তখন সে এক হাজার খাঁচা তৈরি করার এক বিশাল পরিকল্পনার কথা বলতে লাগল, প্রতিটা খাঁচার দাম হবে ষাট পেসো করে...তারপর দশ লক্ষ খাঁচা- তখন সে ছ-কোটি পেসোর মালিক হয়ে যাবে। ‘বড়লোকগুলো মরে যাবার আগে, ওদের কাছে বিক্রি করার জন্য আমাদের অনেক জিনিস তৈরি করতে হবে। বেহেড মাতাল হয়ে বেলথাজার বলতে থাকে, ‘ওরা সবাই অসুস্থ, সবাই মরে যাবে। ওদের এমন অবস্থা যে এখন ওরা আর রাগতেও পারে না।’ গান-বাজনা শোনার জন্য গত দু ঘণ্টা ধরে সে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটার মধ্যে ক্রমাগত পয়সা গুঁজে যাচ্ছিল, যন্ত্রটাও বেজে যাচ্ছিল অবিরাম। সবাই বেলথাজারে সুস্বাস্থ্য, শুভেচ্ছা আর সৌভাগ্য এবং বড়োলোকদের মৃত্যুকামনায় মদ্য পান করল- কিন্তু খাওয়াদাওয়ার সময় হতেই সবাই তাকে সভাগৃহে একা ফেলে রেখে চলে গেল।

পেঁয়াজ কুচি দিয়ে ঢাকা এক থালা ভাজা মাংস নিয়ে উরসুলা আটটা অব্দি বেলথাজারের জন্য অপেক্ষা করেছিল। কে একজন এসে ওকে বলেছিল ওর স্বামী সভা-ঘরে রয়েছে- আনন্দে সে উত্তেজিত, প্রলাপ বকছে, সবাইকে বিয়ার কিনে দিচ্ছে; কিন্তু উরসুলা কথাটা বিশ্বাস করেনি, কারণ বেলথাজার কোনোদিন মাতাল হয়নি। প্রায় মাঝরাতে ও যখন শুতে গেল, বেলথাজার তখন একটা আলোকিত ঘরে। ঘরের মধ্যে ছোট ছোট টেবিল, প্রত্যেকটাতে চারটে করে কুর্সি এবং বাইরে নাচের জায়গা, সেখানে চিড়িয়ারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেলথাজারের মুখটা রুজ পাউডারে মাখামাখি! আর একটা পাও হাঁটতে পারছিল না বলে সে ভাবছিল, দুটো মেয়েছেলেকে নিয়ে সে একই বিছানায় শুয়ে পড়তে চায়। ইতিমধ্যে সে এত খরচ করে ফেলেছে যে নিজের হাতঘড়িটা তাকে বাঁধা রাখতে হয়েছে- কথা দিয়েছে, পরের দিন ওটা সে ছাড়িয়ে নেবে। এক মুহূর্ত বাদে রাস্তায় হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থাকা অবস্থায় সে অনুভব করল, তার জুতোজোড়া খুলে নেওয়া হচ্ছে- কিন্তু তার জীবনের সব চাইতে সুখময় স্বপ্নটাকে সে তখন ত্যাগ করতে চাইছিল না। যে মহিলারা ভোর পাাঁচটার প্রার্থনা-সভায় যাচ্ছিলেন, তাঁরা বেলথাজারের দিকে তাকাতে সাহস পাননি- তাঁরা ভেবেছিলেন, মানুষটা মরে গেছে।


ভাষান্তর : সুবর্র্ণ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //