‘আদর্শ ছেলে’র জননী কবি কুসুমকুমারী দাশ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

‘কুসুমকুমারী দাশ’ আর ‘আদর্শ ছেলে’ যেন সমার্থক। ‘কুসুমকুমারী’ নাম শুনলেই মানসপটে ভেসে ওঠে- ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’ পঙ্ক্তিদ্বয়। আবার এ পঙ্ক্তিদ্বয় কানে ভেসে এলেই ‘কুসুমকুমারী’ নাম হৃদয়ে ভেসে ওঠে।

যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তও বলেছেন- “বাঙ্গলাদেশের প্রতিভাশালিনী মহিলা কবিদের মধ্যে কুসুমকুমারীর নাম তেমন পরিচিত না হইলেও এমন বালক-বালিকা বা কিশোর-কিশোরী অল্পই দেখা যায়, যাহারা তাঁহার লিখিত ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটি পড়েন নাই। প্রায় প্রত্যেক শিশুপাঠ্য গ্রন্থেই তাঁহার এই কবিতাটি উদ্ধৃত হইয়া থাকে।” আর এ কবিতার কল্যাণেই কুসুমকুমারী দাশ শুধু রূপসী বাংলার কবি জীবননান্দ দাশের মা হয়েই নন, ‘আদর্শ ছেলে’র মধ্য দিয়ে বাঙালি-হৃদয়ে আজীবন টিকে থাকবেন একজন ‘কবি’ হিসেবে।

ঊনবিংশ শতকের বাঙালি নারী কবিদের মধ্যে কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন অগ্রগণ্য। জন্মেছিলেন বিদ্যানুরাগী পরিবারে ২১ সেপ্টেম্বর ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে। রাজা রামমোহন রায় যখন যুক্তিবাদের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে হিন্দুধর্ম ও সামাজিক রীতিনীতি সংস্কারে উদ্যোগী হয়ে ‘ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ব্রাহ্মধর্মের মাধ্যমে সংস্কারে ব্রতী হন, তখন বেশির ভাগ হিন্দুধর্মাবলম্বী তা সহজভাবে গ্রহণ করেননি। ব্যতিক্রমী ছিলেন কুসুমকুমারী দাশের পরিবার। বাবা চন্দ্রনাথ দাশ এবং চন্দ্রনাথের অগ্রজ কালীমোহন দাশ ‘ব্রাহ্মধর্ম’র দীক্ষা নিলে পৈতৃক নিবাস বরিশালের আগৈলঝাড়ার গৈলা গ্রামের সাধারণ হিন্দুরা তা মেনে নিতে পারেননি। চরম বিরোধিতার মুখে চন্দ্রনাথ দাশ তার পুত্র প্রিয়নাথ, তিন কন্যা কুসুমকুমারী, সুকুমারী ও হেমন্তকুমারীকে নিয়ে পৈতৃক ভিটা ছেড়ে চলে আসেন বরিশালে।

কুসুমকুমারী দাশকে ভর্তি করিয়ে দেন ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের উচ্চবিদ্যালয়ে। কুমুমকুমারী এখানেই পড়েন চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। পরে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়; কিন্তু চন্দ্রনাথ মেয়েকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে নিয়ে যান কলকাতায়। ওঠেন ‘প্রবাসী’ ও ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে। ভর্তি করে দেন বেথুন স্কুলে। রামানন্দের বাড়িতে এক বছর থেকে পড়াশোনার পর কুসুমকুমারী দাশ গিয়ে ওঠেন ব্রাহ্মবালিকা বোর্ডিংয়ে। প্রবেশিকা পড়াকালীন ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে বিয়ে হয় বরিশালের ব্রজমোহন ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক সত্যানন্দ দাশের সঙ্গে। এরপর তার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা আর করা হয়ে ওঠেনি। স্বামী-সংসারে প্রবেশের পর কুসুমকুমারী দাশ নারীশিক্ষা ও নারীর উন্নয়নে ব্রাহ্মসমাজ প্রবর্তিত কর্মে নিয়োজিত হন। তিনি ছিলেন বরিশাল মহিলা সভার সম্পাদক।

তবে কুসুমকুমারী দাশের লেখালেখিতে হাতেখড়ি শৈশবেই। লিখতেন কবিতা ও প্রবন্ধ এবং তা মূলত শিশু-কিশোর ও তরুণদের জন্য। ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘দাদার চিঠি’ নামে কবিতা প্রকাশিত হয় তৎকালীন বিখ্যাত পত্রিকা ‘মুকুল’-এ। বিয়ের পর রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় তার এ লেখনী ক্ষমতা সবসময় সমীহ করতেন এবং আরও লিখতে উৎসাহ দিতেন। ‘প্রবাসী’ ও ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় শিশুদের জন্য যে চিত্রশোভিত বর্ণশিক্ষার বই লিখেছিলেন, তার প্রথমভাগে কুসুমকুমারী রচিত যুক্তাক্ষরবিহীন ছোট ছোট পদ্যাংশ সংযুক্ত করেছিলেন। কুসুমকুমারীর কবিতাগুলো ব্রাহ্মবাদী ‘প্রবাসী’, ‘মুকুল’ ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

কবিতা, প্রবন্ধ, দিনলিপি, শিশুতোষ গল্প, অসমাপ্ত আত্মজীবনী রচনা করলেও কুসুমকুমারীর রচনার বড় অংশই কবিতা। তার কবিতা বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে শিশুতোষ কবিতা, শিক্ষা ও আদর্শমূলক কবিতা, ঈশ্বর ও ধর্ম বিষয়ক কবিতা, দেশাত্মবোধক কবিতা এবং ঋতুভিত্তিক কবিতা- এ পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। প্রবন্ধের বেশিরভাগই তিনি লিখেছেন ব্রাহ্মসমাজের বিভিন্ন সভায় পাঠের জন্য। ‘নারীত্বের আদর্শ’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে স্বর্ণপদক লাভ করেছিলেন কুসুমকুমারী দাশ। তার অসংখ্য রচনা কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে কবির প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত পঁচাত্তরটি কবিতা সুমিতা চক্রবর্তী সম্পাদিত গ্রন্থে পাওয়া যায়। 

কুসুমকুমারী দাশের কবিতা নিয়ে অম্বুজ বসু বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মহিলা কবিদের মধ্যে কুসুমকুমারীর একটি বৈশিষ্ট্যসমুজ্জ্বল স্থান ছিল। সহজ ও স্বভাব কবিত্ব নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন।’ তবে যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত মনে করেন, ‘বঙ্গদেশে যে কয়জন শ্রেষ্ঠ মহিলা কবি জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে ইঁহাকেও স্থান দেওয়া যায়।’ তার সার্বিক সাহিত্যকর্ম মূল্যায়ন করতে গিয়ে সুমিতা চক্রবর্তী লিখেছেন- ‘স্ত্রী শিক্ষার প্রথম যুগে যে মেয়েরা সারাজীবন সাহিত্য সাধনার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত রেখেছিলেন তিনি তাদেরই একজন, সাহিত্য রুচির একটি একান্ততা ছিল তাঁদের মধ্যে। নিজেদের জীবন ও সমাজ পরিবেশ থেকে একটি আদর্শ তারা ছেঁকে নিতেন এবং লেখায় তাঁকে রূপ দিতে চেষ্টা করতেন। লেখার মধ্য দিয়ে উচ্চভাব প্রকাশ করতে হবে। বঙ্কিম যুগের এই প্রতিষ্ঠিত ধারণার তারাই ছিলেন শেষ বাহক। সত্যিকার অর্থে ব্রাহ্মসমাজের নারীরা যে সময় স্ত্রী শিক্ষা ও স্ত্রী স্বাধীনতার পথ উন্মুক্ত করেছিলেন।’

দাম্পত্য জীবনে কুসুমকুমারী দাশ তিন সন্তানের জননী ছিলেন। পুত্র জীবনানন্দ দাশ, অশোকানন্দ দাশ ও সুচরিতা দাশ। এদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ উত্তরসূরির ধারা বজায় রেখে লেখালেখির সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে বিখ্যাত ‘রূপসী বাংলা’র কবি হিসেবে খ্যাত হয়ে আছেন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর কবি কুসুমকুমারী দাশ কলকাতার রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //