বিভূতিভূষণের বৃক্ষলতা

বাংলা সাহিত্যের পাঠক সমাজে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নিখুঁত প্রকৃতির রূপকার হিসেবে অধিক পরিচিত। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ফুল, লতা-পাতা ও প্রতিদিনকার দেখা পথে-প্রান্তরের বৃক্ষাদির বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর সাহিত্যে। পৃথিবী দেখে মুগ্ধ হওয়াকে যদি দার্শনিকতা বলা হয় তবে বিভূতিভূষণকে দার্শনিক বলতেই হবে। প্রকৃতি ও পৃথিবীর প্রতি বিমুগ্ধতাই মানুষকে তার বাসযোগ্য ভূমণ্ডলের প্রতি কৃতজ্ঞ করে তোলে।

পৃথিবী দেখে বিস্মিত হতে না শিখলে মানবিক মন হয়ে পড়ে যন্ত্রবৎ। বসবাসের ভূমি থেকে আমরা যতটুকু গ্রহণ করি ঠিক ততটুকু সেই ভূমিকে ফিরিয়ে দিতে পারলে তবেই দায়বদ্ধতার পরিপূর্ণতা অর্জন সম্ভব। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রকৃতিনির্ভর রচনাগুলোতে সেকথাই জোর দিয়ে বলেছেন। বাংলা অঞ্চল থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত দেখা না দেখা, পরিচিত-অপরিচিত সবুজ পৃথিবীর পরিচয় মেলে বিভূতির সাহিত্যে। 

অনেক সমালোচকই একসময় বিভূতিভূষণকে নিছক পলায়নবাদী প্রকৃতির কথক হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। পথের পাঁচালী (১৯২৯), অপরাজিত (১৯৩১), আরণ্যক (১৯৩৯), ইছামতী (১৯৫০) উপন্যাসগুলো পড়তে পড়তে কখনো কখনো একথা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে বিভূতিভূষণ প্রকৃতিকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে এক রোমান্টিক কল্পনাজগতে বিচরণ করেছেন। কিন্তু উপরিতলের এই চিন্তা বিভূতির ক্ষেত্রে একেবারেই প্রযোজ্য নয়।

শুধু উপন্যাস সাহিত্যে নয়, সাহিত্যের অন্যান্য অংশেও তিনি সচেতনভাবে সবুজ পৃথিবী, পরিবেশবাদী ভাবনা ও বিপন্ন পৃথিবীর সঙ্কট তুলে ধরেছেন। অভিযাত্রিক (১৯৪১), তৃণাঙ্কুর (১৯৪৩), ঊর্মিমুখর (১৯৪৪) ও হে অরণ্য কথা কও (১৯৪৮) নামক দিনলিপি ও স্মৃতিকথায় বিভূতিভূষণ পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষ, বন, অরণ্যানী ও প্রাণিকুলের জন্য অভয়ারণ্য সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাই বিভূতির সাহিত্যে প্রকৃতি হয়ে উঠেছে বাক্সময় সত্তা।

মানুষের মতো প্রাণসত্তায় কথা বলে ওঠে বিভূতির প্রকৃতি আর সেকারণেই তাঁর গ্রন্থের নাম হয়ে ওঠে- হে অরণ্য কথা কও। প্রচলিত আছে যে নিজ গ্রামের সলতেখাগি আমগাছ কেটে ফেললে বিভূতিভূষণ কর্তিত গাছের গুঁড়ি ধরে কান্না করেছিলেন। বৃক্ষ নিয়ে এমনই ছিল তাঁর আবেগ। অন্যদিকে আরণ্যক উপন্যাসে রাজু পাঁড়ে যে বনজঙ্গল কেটে চাষাবাদের জমি বের করতে চাইলেও তার বারবার মনে হয়েছে এখানে বৃক্ষ-লতার গায়ে অস্ত্র রাখলে পেছন থেকে কে যেন টেনে ধরে। বিভূতিভূষণের প্রকৃতি শুধু নিছক গাছগাছালি নয় বরং আধুনিক সময়ের যে প্রকৃতির ধ্বংসোন্মুখ অবস্থা তার বর্ণনাও তিনি দিয়েছেন তাঁর রচনায়।

বিভিন্ন সময় বুনো ও অপরিচিত বৃক্ষ-লতাকে নামে সম্বোধন করে তিনি আপন করে নিয়েছেন। তাঁর রচিত আরণ্যক উপন্যাসে প্রচুর চেনা-অচেনা বৃক্ষ-লতার বর্ণনা মেলে। ভাণ্ডী ফুল বলে এক ধরনের ফুলের কথা বিভূতি বলেছেন। গাছ ছোট আকৃতির, ঔষধি। পাতায় আঙুলের মতো ছড়ানো শিরা। ফুলের রঙ গোলাপি-বেগুনি। মাঝখানে রয়েছে চোখ বা ফোঁটা। এর বৈজ্ঞানিক নাম  Geranium ocellatumশ্যাওড়া গাছের প্রসঙ্গ বিভূতির লেখনীতে এসেছে বহুবার। সাধারণত জঙ্গলে বেড়ে ওঠা এই বৃক্ষ মাঝারি গড়নের। এর পাতা খসখসে ও ঘন সবুজ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Streblus asper. অন্যদিকে বিভূতি বেশিরভাগ সময় আশশ্যাওড়াকে শেওড়া নামে ডেকেছেন। যা কোনোভাবেই শুধু শ্যাওড়া নয়। এই আশশ্যাওড়ার অন্য নামগুলোর মধ্যে মটকিলা ও দাঁতন অধিক পরিচিত।

সাধারণত ঝোপজঙ্গলে জন্ম নেওয়া একধরনের উদ্ভিদ আশশ্যাওড়া। এর বৈজ্ঞানিক নাম Glycosmis pentaphylla. আশশ্যাওড়া গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। সাধারণত ডালপালা হয় না। সাদা থোকা থোকা ফুল সাধারণত মিষ্টি গন্ধযুক্ত হয়ে থাকে। ফলের রঙ পাকলে অনেকটা সবুজাভ সাদা রঙের। পথের পাঁচালী উপন্যাসে দুর্গা বলেছে- ‘অপু একটা বাঁশের কঞ্চি দ্যাখ তো খুঁজে- তাই দিয়ে টেনে টেনে আনব। পরে সে পুকুরধারের ঝোপের শেওড়া গাছ হইতে পাকা শেওডার ফল তুলিযা খাইতে লাগিল। অপু বনের মধ্যে কঞ্চি খুঁজিতে খুঁজিতে দেখিতে পাইয়া বলিল- ও দিদি, ও ফল খাসনি!-দূর-আশ-শ্যাওডার ফল কি খায়রে! ও-তো পাখিতে খায়- ফুল ও বৃক্ষ নিয়ে বিভূতির ছিল নিজস্ব কিছু চিন্তা।যেসব বিদেশি ফুল প্রবল আগ্রাসী সেসব তিনি যত্রতত্র রোপণ করার বিরোধী ছিলেন।

বিশেষ করে প্রাকৃতিক বনভূমিতে সেসব তিনি রোপণ করতে চাইতেন না। যার দরুন আরণ্যক যুগল প্রসাদ বিদেশি বোগেনভোলিয়া ও ভিঁয়োরা লতা সরস্বতী কুণ্ডরীর ধারে রোপণ করেনি। এটি আসলে বিভূতিভূষণের নিজেরই মতামতকে প্রতিষ্ঠিত করার একটি চরিত্র মাত্র। মূলত বিভূতি চাইতেন দেশি গাছপালায় ঢাকা অকৃত্রিম পরিবেশ মানুষের হাতে পড়ে যেন কৃত্রিম হয়ে না যায়। বিভূতি এত অধিক বন্য ফুলের বর্ণনা দিয়েছেন যার কোনো কোনোটি সম্পর্কে উদ্ভিদতত্ত্ববিদও নিশ্চিত হতে পারেননি। যেমন দুধলি ফুল ও দুধিয়া ফুল বলে দুধরনের ফুলের বর্ণনা বিভূতিভূষণ দিয়েছেন যা আসলে কোন ফুল নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

বাংলার ঋতুতে হেমন্তে ছাতিম ফুলের দেখা মেলে। একে সপ্তপর্ণীও বলা হয়। বিভূতির কথাসাহিত্য জুড়ে ছাতিম ফুলের জয়জয়কার। বিভূতির জন্মলগ্নের সময়টি ছিল ছাতিম ফোটার উপযুক্ত সময়। ছাতিম চিরসবুজ একটি বৃক্ষ। ডালগুলো ছত্রাকারে সাজানো। বেশিরভাগ সময় ডালের ডগায় ৭টি করে পাতা থাকে কখনো ৫টিও থাকে। যার দরুন এর অন্য নাম হয়েছে সপ্তপর্ণী। এটি থোকা থোকা ফুটে থাকে। এর রঙ সাদা। ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত এই ফুল ফুটলে চারিদিকে সুবাস ছড়িয়ে পড়ে। এর কাণ্ড, ডাল ও পাতা ছিঁড়লে দুধকষ পাওয়া যায়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Alstonia scholaris. এছাড়াও বিভূতিভূষণের রচনার স্তরে স্তরে বহু উদ্ভিদ ও নাম না জানা বুনো লতা এবং ফুলের নাম রয়েছে। যা উল্লেখ করতে গেলে দীর্ঘ তালিকায় শেষ করা যাবে না।

বৃক্ষ-লতার বিভূতিভূষণ মনে করেন দল বাঁধিয়া প্রকৃতি দেখতে যাওয়ার মধ্যে কোনো সার্থকতা নেই। এমন অবস্থায় প্রকৃতি তার অবগুণ্ঠন খোলে না। এ প্রসঙ্গে বিভূতিভূষণের কথাই যেন চরম সত্য- প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের যেতে হয় একাকী, তবেই প্রকৃতি-রানী অবগুণ্ঠন উন্মোচন করেন দর্শকের সামনে, নতুবা নয়। চুপ করে বসে থাকতে হয়, একমনে ভাবতে হয়, মাঝে মাঝে চারিদিকে চেয়ে দেখলে মনে আপনিই কত ভাবনা এসে পড়ে। এমন বহুসময় বিভূতিভূষণ কাটিয়েছিলেন খেলাতচন্দ্র স্টেটের দেখাশোনা করতে গিয়ে। বিচিত্র রকমের প্রকৃতি পরিবেশের সাথে তার এই নিবিড় অবস্থান তাকে আরও অধিক প্রকৃতিপ্রেমিক ও প্রকৃতি সচেতন কথাসাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //