প্রাবন্ধিক জীবনানন্দ দাশ এবং কবিতার কথা

জীবনানন্দ দাশ (জন্ম- ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ এবং মৃত্যু- ২২ অক্টোবর ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম আধুনিক বাঙালি কবি। বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃত হিসেবে যে কয়েকজনের নাম উচ্চারিত হয়, জীবনানন্দ দাশ তাদের অন্যতম। নিসর্গবাদী জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রভাব পরিলক্ষিত হলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেন; হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী।

আজ অব্দি তার কবিতা সর্বমহলে সমানভাবে আদৃত। হয়তো এই রেশ থেকে যাবে আরও কয়েক প্রজন্মের মধ্যে পাঠপরম্পরায়। কেননা, কে কবি আর কবিতাইবা কী, তা তিনি চিনিয়ে দিয়েছেন। বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ পাঠকহৃদয়ে কেন তিনি বহুলভাবে অবশ্যপাঠ্য হয়ে থাকবেন, সে সম্পর্কে আমরা ধারণা পাই। সেই ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’র মধ্যে জীবনানন্দ প্রকৃত অর্থেই একজন কবি এবং এই রূপসী বাংলার তিনিই সবচেয়ে বড় কবি, শতাব্দীর পর শতাব্দীর পাঠকহৃদয়ে বহুলভাবে বহুকাল জীবিত থাকবেন- একথা অনিবার্যভাবে সত্য বলে প্রতীয়মান হয়।

জীবনানন্দ দাশ কবি হিসেবে পাঠকসমাজে সুখ্যাতি অর্জন করলেও গল্প-উপন্যাসেও অনন্য স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন যেমন করে, তেমনি রেখে গিয়েছেন প্রবন্ধেও। ‘কবিতার কথা’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থটি বই আকারে বাজারে আসে জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পর- ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে; কিন্তু প্রবন্ধগুলো কবির জীবদ্দশায়ই বিভিন্ন কাগজে মুদ্রণ হয়েছিল। ‘কবিতার কথা’ পনেরোটি প্রবন্ধের সংকলন।

এর মধ্যে ‘কবিতার কথা’ শিরোনামীয় প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশ হয় ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায়। এই প্রবন্ধের প্রথম বাক্যাংশই ‘সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি’। অর্থাৎ জীবনানন্দ দাশের মতে, কবিতা লিখলেই কাউকে কবি হিসেবে মেনে নেওয়া ঠিক নয়। প্লেটো ভালো কবিদের কয়েকটি গুণের কথা বলেছিলেন- ‘For all good poets, epic as well as lyric. Compose their beautiful poems not by art, but because they are inspired and processed. And as the corybantian revelers when they dance are not in their right mind, so the lyric poets are not in their mind when they are composing this beautiful strains.’

জীবনানন্দ দাশ মূলত এই বিষয়টিই অনবদ্য ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। ‘কবি- কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভেতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্য- বিকীরণ তাদের সাহায্য করছে। সাহায্য করছে; কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভেতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্য প্রাপ্ত হয়; নানা রকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।’

অর্থাৎ কবিতা লিখতে গেলে অবশ্যই কবির কিছু গুণ থাকা আবশ্যক। কারণ কবিতা হলো- বাস্তব অভিজ্ঞতার কল্পময় এক রূপ। বাস্তব অভিজ্ঞতা ‘স্বাতন্ত্র্য সারবত্তা’য় প্রকাশে কবির বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন হয়। প্রকৃত ‘কবি’ যিনি, তার মধ্যেই কেবল এসব বিশেষ গুণ থাকে। আর তার কবিতা পাঠকহৃদয় আন্দোলিত করবে, সমাদৃত হবে। 

‘কবিতার কথা’য় মোট পনেরোটি প্রবন্ধ রয়েছে। প্রবন্ধের শিরোনামগুলো হলো ‘কবিতার কথা’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা কবিতা’, ‘মাত্রাচেতনা’, ‘উত্তররৈবিক বাংলা কাব্য’, ‘কবিতা প্রসঙ্গে’, ‘কবিতার আত্মা ও শরীর’, ‘কি হিসেবে শাশ্বত’, ‘কবিতাপাঠ’, ‘দেশ কাল ও কবিতা’, ‘সত্য, বিশ্বাস ও কবিতা’, ‘রুচি, বিচার ও অন্যান্য কথা’, ‘কবিতার আলোচনা’, ‘আধুনিক কবিতা’, ‘বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ’, ‘অসমাপ্ত আলোচনা’। এ পনেরোটি প্রবন্ধের বাইরেও জীবনানন্দ দাশের আরও কিছু প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও সমালোচনা রয়েছে।

তবে সেই রচনা সামগ্রিকভাবে খুব যে বেশি, তা নয়। তার সাহিত্য- শিক্ষা- সমাজ বিষয়ক রচনার সংখ্যা মোট ৩০, গ্রন্থ ভূমিকা ও গ্রন্থালোচনা জাতীয় রচনার সংখ্যা ৯, স্মৃতিতর্পণমূলক রচনার সংখ্যা ৩ এবং বিবিধ প্রবন্ধ- নিবন্ধের সংখ্যা ৭। এর পরও আরও ৭টি খসড়া প্রবন্ধের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে জীবনানন্দের এসব গদ্য রচনার বেশির ভাগই ফরমায়েশী ধরনের লেখা।

সাহিত্য, শিক্ষা, সমাজ- এ তিনটি বিষয় নিয়ে মূলত জীবনানন্দ দাশ প্রবন্ধ ও নিবন্ধগুলো লিখেছিলেন। তার প্রবন্ধগুলোর শিরোনাম এরকম- ‘কবিতার কথা’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা কবিতা’, ‘মাত্রাচেতনা’, ‘উত্তররৈবিক বাংলা কাব্য’, ‘কবিতার আত্মা ও শরীর’, ‘কি হিসাবে কবিতা শ্বাশত’, ‘কবিতাপাঠ’, ‘দেশকাল ও কবিতা’, ‘সত্যবিশ্বাস ও কবিতা’, ‘রুচি, বিচার ও অন্যান্য কথা’, ‘কবিতার আলোচনা’, ‘আধুনিক কবিতা’, ‘বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ’, ‘কেন লিখি’, ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘শরৎচন্দ্র’, ‘কঙ্কাবতী ও অন্যান্য কবিতা’, ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’, ‘পৃথিবী ও সময়’, ‘যুক্তি, জিজ্ঞাসা ও বাঙালি’, ‘অর্থনৈতিক দিক’, ‘শিক্ষা ও ইংরেজি’, ‘শিক্ষা- দীক্ষা- শিক্ষকতা’, ‘শিক্ষার কথা’, ‘শিক্ষা সাহিত্যে ইংরেজি’ এবং ‘শিক্ষা-দীক্ষা’।

বলা যায়- সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতা নিয়ে জীবনানন্দ বেশ কিছু প্রবন্ধ ও নিবন্ধ লিখেছিলেন। তার প্রতিটি রচনাই বহুমাত্রিক মৌলিক চিন্তাসূত্রের স্বাক্ষর বহন করে। জীবনানন্দ সর্বোপরি একজন কবি। কবিতা ঘিরেই তার চিন্তা, চেতনা, ভাব এবং তা ভাষার মাধ্যমে তার সম্পূর্ণতা দিয়েছেন। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়- কাব্যরসিক, কাব্যপ্রেমী অথবা যারা এই পথ ধরে হাঁটছেন বা হাঁটবেন বলে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাদের কাছে ‘কবিতার কথা’ আধুনিকতার পথের নতুন দিশা দেবে, বাঁক চেনাবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //