গোলাপ নিয়ে যত আলাপ

পৃথিবীতে গোলাপ এক আশ্চর্য ফুল, বলা হয়ে থাকে ফুলদের রানী গোলাপ। কী করে এলো পৃথিবীতে এ এক আশ্চর্য ঘটনা। জীবাশ্ম থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, প্রাচীনতম গোলাপের বয়স দুই কোটি ৬০ লাখ বছর থেকে তিন কোটি ৮০ লাখ বছর।

ভারতীয় উপমহাদেশে গোলাপ এসেছে প্রায় পাঁচ শ বছর আগে বসরা থেকে। মোগল সম্রাট বাবর প্রথম ‘বসরা’ নামের এক গোলাপ নিয়ে এসেছিলেন। সুগন্ধি গোলাপি রঙের এ গোলাপ এখনো এ দেশে ‘বসরা’ নামে পরিচিত। বিভিন্ন বর্ণের গোলাপ ফুল আছে। যেমন-কাঠগোলাপ, লাল গোলাপ, সাদা গোলাপ, কালো গোলাপ প্রভৃতি। গোলাপ পাপড়ির গড়ন ও বিন্যাসে এক রকম নান্দনিকতা আছে, যা মানুষকে আকৃষ্ট করে। গোলাপ একটি সম্পূর্ণ ফুল। গোলাপের আদি নিবাস এশিয়া মহাদেশে। অল্প কিছু প্রজাতির আদি বাস ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা মহাদেশে। গোলাপের বহুমুখী ব্যবহারও আছে।

গোলাপের পাপড়ি থেকে জ্যাম, জেলি প্রস্তুত করা হয়। সুগন্ধির জন্য পারস্য, চীন ও ভারতে গোলাপজলের প্রচলন আছে। গোলাপ ফুলের সুবাস কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন প্রসাধনসামগ্রী যেমন-পারফিউম, সাবান ইত্যাদি তৈরি করা হয়। ভেষজ হিসেবেও গোলাপগাছ ব্যবহৃত হয়। গোলাপের ফল ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ।  

গোলাপ নিয়ে উপকথারও শেষ নেই, সে সকল উপকথার কয়েকটি জেনে রাখি- প্রেমিকা ভিনাস তাঁর প্রেমাস্পদ অ্যাডোনিসের সঙ্গে মিলিত হবার কামনায় অধীরপদে অভিসারে যাচ্ছিলেন এক কণ্টকারণের বন্ধুর পথে। কাঁটাবনের ভেতর দিয়ে আনমনে হাঁটার সময় ঝোপের কাঁটার ঘায়ে তাঁর পা থেকে রক্ত ঝরে। সে রক্তই হয়ে ওঠে লালগোলাপ।

অপর উপাখ্যানে আছে এর বিপরীত ভাষ্য। অ্যাডোনিসকে শিকারির বেশে অরণ্যে ঘুরতে দেখে গ্রিকভিনাস আফ্রোদিতি তাঁর প্রেমে পড়েন এবং প্রেমাস্পদের সঙ্গলাভের উদ্দেশ্যে স্বর্গলোক ছেড়ে মর্ত্যরে বনে ঘুরতে থাকেন। ঘটনাটা আফ্রোদিতির অপর প্রণয়ী রণদেবতা অ্যারেসের কানে গেলে জেলাস অ্যারেস একদিন বুনোশূকরের বেশে অ্যাডেনিসকে আক্রমণ করে হত্যা করেন।

ক্ষত-বিক্ষত অ্যাডোনিসের দেহনিঃসৃত রক্ত থেকে জন্ম নেয় লাল গোলাপ।

আরেক গল্পে রয়েছে, ভিনাসের সৌন্দর্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে গোলাপ সৃষ্টি করেন সিবিল। কেউ বলেন প্রেমের দেবতা কিউপিডের হাসির মূর্তরূপই হলো গোলাপ। আবার কেউ বলেন, ঊষাদেবী অরোরার কেশবিন্যাসের সময় ঝরে পড়ে গোলাপ। আরেক গল্পমতে, গোলাপের আবির্ভাব হয় এক কুমারীর প্রার্থনায়। বেথেলহেমে তাঁকে অন্যায়ভাবে জীবন্ত দাহ করতে গেলে তিনি বিধাতার কাছে প্রার্থনায় রত হন। প্রার্থনা গৃহীত হলে বিধাতা লেলিহান কাষ্ঠখণ্ডগুলোকে লালগোলাপে এবং অপ্রজ্বলিতগুলোকে সাদাগোলাপে পরিণত করেন।

আরেক কাহিনিতে- গোলাপ স্বর্গেই ফুটেছিল, তবে সাদাগোলাপ। আকৃষ্ট হয়ে ইভ তাকে চুম্বন করতে গেলে সাদাগোলাপটি লজ্জায় লালগোলাপ হয়ে যায়। এতকিছুর বাইরে আরব্য উপাখ্যান বলছে, পদ্মফুল রাতে ঘুমায় বলেই বিধাতা দিবানিশি ফুটে-থাকা গোলাপফুল সৃষ্টি করেন। গানের পাখি বুলবুল ভালোবেসে গোলাপটিকে আলিঙ্গন করতে গেলে সে কাঁটায় আহত হয় এবং আহত বুলবুলের রক্তে রঞ্জিত হয়ে সাদাগোলাপটি লালগোলাপে রূপান্তরিত হয়।

এদিকে হিন্দু পুরাণে রয়েছে-বিষ্ণুদেব মর্ত্যে এসে সরোবরে যেখানে স্নান করছিলেন, সেখানে একটি পদ্মফুল ফোটে। ফুলটি থেকে ব্রহ্মা বেরিয়ে এসে বিষ্ণুকে বলেন- ফুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম এটিই। বিষ্ণু ব্রহ্মাকে আমন্ত্রণ করে বৈকুণ্ঠে এনে গোলাপ দেখালে ব্রহ্মা স্বীকার করেন যে গোলাপই সৃষ্টির সেরা ফুল।

আবার এক গল্পে, করিন্থের রূপসী রানি রোদান্তে এক দঙ্গল প্রেমিকের অবিরাম উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে ডায়ানাদেবীর মন্দিরে আশ্রয় নিলে ডায়ানার পূজারির দল রূপে মুগ্ধ হয়ে দেবীর বদলে রানি রোদান্তের পূজা শুরু করে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ডায়ানার ভাই অ্যাপোলো রূপসী রোদান্তেকে গোলাপে আর তাঁর প্রেমিকদের পোকামাকড়ে পরিণত করেন। বলুন তো, এ কেমন বিচার- প্রেমাস্পদাকে গোলাপ আর প্রেমিকদের পোকামাকড়?

রচনাটি লেখক আবদুশ শাকুর প্রণীত ‘গোলাপ নামা’ গ্রন্থ অবলম্বনে তৈরি করেছেন- রেজাউল হক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //