বক্তাবলীর গণহত্যা

মুক্তিযুদ্ধের সময় নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার বক্তাবলীর কয়েকটি গ্রামে ২৯ নভেম্বর ঘটেছিল গণহত্যা। সেদিন ছিল সোমবার। কনকনে শীতে ঘন কুয়াশায় ঢাকা ছিল পুরো গ্রাম। হত্যাযজ্ঞ শুরু হয় ভোর রাতে। গ্রামের মানুষ তখন ছিল গভীর ঘুমে। হঠাৎ গুলির শব্দ। দাউদাউ আগুন। চারদিকে চিৎকার-চেঁচামেচি। কান্নার আওয়াজ। দিশেহারা নিরীহ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ছুটছেন এদিক-সেদিক। 

যেন মৃত্যুনগরী। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদিন নির্বিচারে চালায় গণহত্যা, গান পাউডার দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দেয় গ্রামের বাড়ি-ঘর, জ্বালিয়ে দেয় ফসলি জমি, গোলার ফসল, গবাদি পশু। এ গণহত্যায় শহীদ হন এখানকার ১৩৯ জন মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী মানুষ। এখানকার শহীদদের স্মরণে বক্তাবলীর কানাইনগরে রয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। 

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের যেসব স্থানে গণহত্যা চালানো হয়েছে, বক্তাবলীর গণহত্যা তার মধ্যে অন্যতম। দুটি গণকবর এখনো এখানকার গণহত্যার সাক্ষী বহন করে চলছে। একটি গণকবর আছে বক্তাবলীর লক্ষীনগর গ্রামের পূর্বপাড়ায়। স্থানীয়রা জানান, এ গণকবরে ৮০ জন শহীদের লাশ দাফন করা হয়েছে।

আরেকটি গণকবর আছে আলীরটেকের মোক্তারকান্দি গ্রামের পশ্চিমপাড়ায়। এ ছাড়া এ এলাকার বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এখানকার অন্য শহীদের কবরগুলো। এ গণকবরগুলো মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমি।

২২টি গ্রাম নিয়ে বক্তাবলী ও আলীরটেক ইউনিয়ন। এর পূর্বদিকে বুড়িগঙ্গা, পশ্চিমে ধলেশ্বরী আর দক্ষিণে মেঘনা নদী। অন্যদিকে আছে এসবের শাখা নদী। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ এলাকা ছিল মুক্তাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। তাই মুক্তিযোদ্ধারা এখানকার বক্তাবলীর লক্ষীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আলীরটেকের মুক্তারকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঘাঁটি গড়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের এ ঘাঁটির খবরটি পায় পাকিস্তানি সেনারা। 

আর তাই তারা ভোর রাতে চারটি গানবোট নিয়ে নদীযোগে এসে গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষদের ঘিরে ফেলে এবং নির্বিচারে শুরু করে অত্যাচার। টানা বিকেল ৩টা পর্যন্ত চলে সেই অত্যাচারের তাণ্ডবলীলা। সকালের দিকে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম ও মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমান সেই যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। প্রায় দুই ঘণ্টা স্থায়ী সেই যুদ্ধে পাকিস্তানিদের পাঁচজন নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। পাকিস্তানি সেনারা তখন নিহত ও আহতদের নিয়ে ফিরে যায় সাময়িক সময়ের জন্য।

কিছু সময় পরে পাকিস্তানিরা আবার আসে আরও বেশি সেনা ও ভারী অস্ত্র নিয়ে। তখন পাকিস্তানি সেনাদের সামনে দাঁড়াতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হাঁটেন। গ্রামের মানুষও ছুটে পালাতে শুরু করে যে যেদিক পেরেছেন। কিন্তু তারপরও বাঁচতে পারেনি ১৩৯ জন। পাকিস্তানিরা তাদের ধরে এনে জড়ো করে বক্তাবলীর লক্ষীনগর গ্রামের পূর্বপাড়া সংলগ্ন বুড়িগঙ্গার তীরে। 

সেখানে সবাইকে হাত-পা বেঁধে একসঙ্গে গুলি করে হত্যা করা হয়। ডিক্রিরচর নামক স্থানেও একসঙ্গে ৪০ জনকে হাত-পা বেঁধে একলাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয় গুলি করে। এ ছাড়া গ্রামের অনেক স্থানে যারা বাঁচার জন্য লুকিয়ে ছিলেন, তাদেরও মারা হয় আগুনে পুড়িয়ে। সব মিলিয়ে পুরো এলাকা পরিণত হয় একটি মৃত্যুনগরীতে।

এসব হত্যাযজ্ঞ শেষে বিকেলে ফিরে যায় পাকিস্তানিরা। সন্ধ্যায় গ্রামে ফিরতে শুরু করেন গ্রামবাসী। তারপর সবাই খুঁজতে থাকেন সবার মা-বাবা, ভাই-বোন বা আত্মীয়-স্বজনকে। নদীর তীর থেকে শহীদদের লাশ তুলে এনে, কিংবা আগুনে পুড়ে যাওয়া লাশের অংশবিশেষ এনে গ্রামবাসী লক্ষীনগর ও মোক্তারকান্দিতে দুটি গণকবর দেন।

এ ছাড়া অনেকেই তার আত্মীয়-স্বজনের লাশ নিজেরাই নিজেদের আঙিনায় কবর দেন। এখানে সেদিন যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের কেউ কেউ এ এলাকার বাইরের লোকও ছিলেন। অনেক শহীদের লাশ নদীতে ভেসেও যায়। 

যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের মধ্যে ছিলেন ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, জেলেসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। ফজিলাতুন্নেছা নামে স্থানীয় একজন নারী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শহীদুল্লাহ, মুনীরুজ্জামান ও তার স্কুল পড়ুয়া ভাই শাহ আলমও ছিলেন এখানকার শহীদদের তালিকায়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় মো. সেকান্দার আলীর বয়স ছিল ২০ বছর। তার বাড়ি আলীরটেকের মোক্তারকান্দি। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা বাইতেন। মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন কাজে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতের জন্য সেকান্দার আলীর নৌকা নিয়ে যেতেন। জোয়ান সেকান্দার নৌকা বাইতেন শক্ত হাতে। তাকেও পাকিস্তানিরা গুলি করে। তার ডান হাতে একটি গুলি লাগে। তবু অল্পের জন্য বেঁচে যান তিনি। 

সেকান্দার আলী বলেন, সেদিনের কথা মনে পড়লে এখনো শরীর শিউরে ওঠে। শীতের মধ্যে মোটা কাঁথা গায়ে জড়িয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ গুলির শব্দে ঘুম ভাঙে। চোখ মেলে দেখি চারদিকে আগুন, মানুষের দৌড়-ঝাঁপ, কান্নাকাটি। প্রাণ বাঁচাতে আমরাও পালাই। সন্ধ্যায় ফিরে এসে দেখি বাড়ি-ঘর সবই আগুনে পুড়ে ছাই।

এদিক-সেদিক পড়ে আছে লাশ আর লাশ। নদীর তীরে গিয়ে দেখি লাশের স্তূপ। গ্রামের চারটি গরুও পুড়ে মারা যায় সেদিন। পুড়ে নষ্ট হয় গ্রামের কয়েকশ মণ আলু। তারপর আমরা সবাই মিলে বিভিন্ন স্থান থেকে লাশ সংগ্রহ করে যতটা সম্ভব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে গণকবর দিই।

নুরুল হকও মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা বাইতেন। তিনি বলেন, গোলজার নামে একজন বিহারি আমাদের গ্রামে আসা-যাওয়া করতো। সে নারায়গঞ্জের পাটকলে চাকরি করত। তিনিই সেদিন পাকিস্তানি সেনাদের ডেকে এনেছিলেন। ছবি: লেখক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //