জয়নুলের সংগ্রাম

দেশের শিল্পী ও শিল্পানুরাগীদের জন্য বিস্ময়কর এক শিল্প অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করার অসামান্য সুযোগ এসেছিল সম্প্রতি! ঢাকার ধানমণ্ডিতে গ্যালারি চিত্রকের সুপরিসর দেয়ালগুলোয় দেখা গেছে আমাদের পথিকৃৎশিল্পী জয়নুলের আঁকা শতাধিক মূল চিত্রকর্ম।

পাশাপাশি গ্যালারির মেঝেয় জয়নুলের ব্যবহার্য সামগ্রী, রঙ-তুলি, রঙের প্যালেট যেন শিল্পাচার্যের জীবনস্মৃতিকে জীবন্ত করে তুলেছিল। অসাধারণ একজন শিল্পী হিসেবে তার গড়ে ওঠার নানা পর্ব ও শিল্পীসত্তা বিকাশের অজস্র সংগ্রাম প্রতিফলিত হয়েছে অনন্য এ আয়োজনে। এ প্রদর্শনীর শিরোনাম ছিল ‘সংগ্রাম’।

এই সংগ্রাম অনগ্রসর নিম্নমধ্যবিত্ত এক তরুণের শিল্পপাঠের প্রতিবন্ধকতা দূর করা থেকে নিজের শ্রেণি অবস্থানকে একটু একটু করে বদলে দেবার নিরন্তর সংগ্রাম। এই সংগ্রামে দেশের একেবারে সাধারণ মানুষের নিত্যদিনকার লড়াইকে যেমন তুলে ধরেছেন শিল্পী তেমনই অংকনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার আদায়ের ন্যায্য লড়াইয়ের প্রতি তার অনুভূতিপ্রবণ তুমুল সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। আবার বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের নানাপর্যায়ে তার আঁকা চিত্রকর্মের সন্নিবেশও ঘটেছে এখানে।

শিল্পাচার্যের অনুশীলনধর্মী কতক চিত্রকর্মও এ প্রদর্শনীতে শোভা পাচ্ছে। আর আছে তার কিছু প্রাণের কথা- যাতে প্রতিফলিত হয়েছে তার জীবনদর্শন। অর্থাৎ সামগ্রিক জয়নুলকে উপস্থাপন করার একটা উত্তম প্রয়াস এই বিশেষ প্রদর্শনীতে লক্ষণীয়ভাবে উঠে এসেছে। প্রদর্শনীটির কিউরেটিং করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের তরুণ শিক্ষক শিল্পী সুমন ওয়াহিদ।

জয়নুলপত্নী নবতিপর জাহানারা আবেদিনের সযত্নে আগলে রাখা অমূল্য সম্পদ, পারিবারিক সংগ্রহ এবং একজন সংগ্রাহকের কাছ থেকে পাওয়া তিনটি সৃজনসহ শতাধিক চিত্রকর্ম নিয়ে বিশেষ এই প্রদর্শনী। আর প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রকাশিত গ্রন্থে জয়নুলের সংগ্রামের ইতিবৃত্ত তুলে ধরেছেন জয়নুল জীবনীকার ও বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক।

এ ছাড়াও এ গ্রন্থে জয়নুল আবেদিনের শিল্পভাবনা, একটি ছবির পটভূমি, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর লেখা জয়নুলের সংগ্রাম, চিত্তপ্রসাদের চিঠি ও জয়নুল সম্পর্কে তার লেখা, জয়নুলকে নিয়ে ১৯৫২ সালে শিল্পী কামরুল হাসানের একটি লেখা, বাঙালির ইতিহাসখ্যাত নীহাররঞ্জন পুত্র প্রণবরঞ্জন রায়ের লেখনী, গোলাম কুদ্দুসের মূল্যায়নসহ দেশ-বিদেশের অনেক শিল্পসমঝদারের নানা লেখা স্থান পেয়েছে। সুদৃশ্য এ চমৎকার গ্রন্থটি সব মনোমুগ্ধকর রচনায় সমৃদ্ধ।

ইংরেজ শাসকশ্রেণির সৃষ্ট তেতাল্লিশের মন্বন্তরের ছবি জয়নুলের সংগ্রামী চেতনার প্রথম বহিঃপ্রকাশ। বাস্তবিকভাবেই তিনি এঁকেছিলেন অনাহারী মানুষগুলোর অসহায়ত্বের বিচিত্র রূপ। খাদ্যের অন্বেষণে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা সহায়-সম্বলহীন মানুষগুলো যেন তার চেনা! তার ফেলে আসা গ্রামের গরিব-গুর্বা মানুষগুলোই যেন কলকাতার পথে নেমেছে। মানবিক বিপর্যয়ের কেন্দ্রে যে দুর্ভিক্ষ সেটি তিনি যথার্থই উপলব্ধি করে ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে নিজের প্রতিবাদকে মূর্ত করেছেন। সেই থেকে অসুন্দর আর অকল্যাণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সোচ্চার ছিলেন জয়নুল।

এ প্রদর্শনীতে সেই দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার কয়েকটি নিদর্শন আছে, কলকাতা বসবাসকালে সাঁওতাল নর-নারীর জীবনসংগ্রামের খসড়া রূপ এখানে রয়েছে। তার প্রিয় এক বিষয়- দুটি অবয়বের অনুশীলনও লক্ষ করলাম। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় লেখা ছোট একটি কাগজে তারিখবিহীন স্কেচ- ভুখা মিছিলের খসড়াও এঁকেছেন! জয়নুলের ব্র‍্যান্ড বিদ্রোহী গরুর মাথা নিচু করে তেড়ে আসার ভঙ্গিমা তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা ড্রয়িংও এখানে দেখতে পেলাম।

পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় থাকার সময় তিনি আরও এঁকেছিলেন ‘গুণটানা’, ‘সংগ্রাম’সহ আরও কয়েকটি চিত্র। মূলচিত্র আঁকার আগে প্রতিকূলতার বিপক্ষে শক্তি প্রয়োগের পেশি সঞ্চালনের অনুশীলনধর্মী স্কেচও এখানে প্রদর্শিত হয়েছে।

পূর্ণাঙ্গ ছবি আঁকার আগে শিল্পীদের নানা অনুশীলনের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে শিল্পীর যে সংগ্রাম- সেটি যে জয়নুলেও ছিল- তা দর্শক এবার আরও ভালো করে দেখতে পেলেন।

জয়নুলের কাজের ক্ষেত্র ও ব্যাপ্তি বিশাল ক্যানভাসের। চিরায়ত রূপ সৃজনের দিকে তার দৃষ্টি ছিল। কৃষিজীবী মানুষের চিরকালীন সংগ্রাম যেমন- ফসল বোনার আগে জমিতে লাঙল দেয়া, মই দেয়া, নিড়ানি দেয়া, ফসলকাটা, তোলা এসব নানা পর্যায়ের ছবি এঁকেছেন জয়নুল।

১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর বাংলার উপকূলে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানির বিয়োগান্তক মর্মন্তুদ ঘটনায় ব্যথিত জয়নুল সেই দুর্যোগক্লিষ্ট এলাকায় গিয়ে কিছু স্কেচ করেন। সেই অভিজ্ঞতায় ১৯৭৩ সালে তিনি আঁকলেন স্ক্রলচিত্র ‘মনপুরা-৭০’। দুর্যোগে অসংখ্য প্রাণনাশ ও মৃত্যুর উপত্যকা পেরিয়ে সব হারিয়ে বেঁচে থাকা বেদনাহত এক তরুণের উপস্থিতি যেন জীবনে ফেরার আশাবাদের প্রতীক। এই অংকনের কতক খসড়া এতে দেখা গেছে!

সেই ১৯৭০ সালেই তিনি মিশর, জর্দান, সিরিয়া, লেবানন সফরকালে নিজভ‚মি থেকে বিতাড়িত ফিলিস্তিনি জনগণের দুঃখ-কষ্ট ও তাদের সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করেছেন এবং নিজের প্রতিবাদ চেতনায় সেই সংগ্রামকে এঁকেছেন কালি-তুলি ও কাগজে, কলমে। এ সময় আঁকা ‘মুক্তি-সংগ্রাম’ শীর্ষক স্কেচে শৃঙ্খলাবদ্ধ দুহাত তুলে প্রতিবাদের ভঙ্গির রূপটি তো শাশ্বত! কালি-তুলিতে আঁকা এ চিত্রটি দিয়েই প্রদর্শনীর ব্র‍্যান্ডিং করা হয়েছে।

প্রধানত মানুষ- বিশেষ করে শ্রমজীবী ও জীবনসংগ্রামী মানুষ জয়নুলের চিত্রকর্মের কেন্দ্রে জায়গা নিয়েছে। দেশজ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সংগ্রামমুখর মানুষকে তিনি নিজের জীবনসংগ্রামের অন্তর্লীন আবেগের সঙ্গে দেখেছেন। আর এ জন্যই জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্ম চিরায়ত সংগ্রামের প্রতিফলক।

গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ১০৮তম জন্মবার্ষিকী। দিনটির স্মরণে গ্যালারি চিত্রকে আয়োজিত বিশেষ এ প্রদর্শনী শুরু হয় ১৩ ডিসেম্বর মঙ্গলবার, এটি চলেছে গত ৪ জানুয়ারি বুধবার। এমন মুগ্ধ করা একটি প্রদর্শনী সময়েরই প্রয়োজন এবং জয়নুলকে মনে করিয়ে দেবে যা এ প্রজন্মের শিক্ষার্থী ও চিত্রপ্রেমী সকল মানুষকে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //