মুখোমুখি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়-বাংলা একাডেমি

একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে মুখোমুখি অবস্থানে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমি। বইমেলার আমন্ত্রণপত্রে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লোগো ব্যবহার করতে চাওয়াকে কেন্দ্র করে মূলত এ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে।

আমন্ত্রণপত্রে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের লোগো ব্যবহার না করায় সচিবের বিরুদ্ধে বাংলা একাডেমিতে গিয়ে কর্মকর্তাদের হুমকি-ধমকি দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। এ অবস্থায় ‘একুশে বইমেলা-২০২৩’-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠান উপলক্ষে দ্বিতীয় দফায় আমন্ত্রণপত্র ছাপাতে হয়েছে বাংলা একাডেমিকে। নতুন আমন্ত্রণপত্রে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয়েছে সরকারি মনোগ্রাম। মন্ত্রণালয়ের তৎপরতাকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমিতে অবৈধ হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন লেখক-সাহিত্যিকসহ বিশিষ্টজনরা। তারা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুরের পদত্যাগও দাবি করেছেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত স্মারক বাংলা একাডেমি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সংস্কৃতির গবেষণায় নিয়োজিত জাতীয় ঐতিহ্যিক এবং ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান। বাংলা একাডেমি বাঙালি জতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক।

প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে একুশে বইমেলা আয়োজন করে থাকে। এটি শিল্প-সাহিত্যের এক অনন্য মিলনমেলা হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। একুশে বইমেলা শুরু থেকে বাংলা একাডেমির আয়োজনে হয়ে এলেও এবার সংস্কৃতি সচিব তার মন্ত্রণালয়ের নাম যুক্ত করতে চাওয়ায় দেখা দিয়েছে দ্বন্দ্ব।

আমন্ত্রণপত্র নিয়ে যা ঘটেছে

গত ২৩ জানুয়ারি বইমেলার কাজের অগ্রগতি পরিদর্শন করতে বাংলা একাডেমিতে গিয়েছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ ও সচিব আবুল মনসুর। তখন সচিব আমন্ত্রণপত্রে আয়োজক হিসেবে শুধু বাংলা একাডেমির লোগো কেন- সেই বিষয়ে জানতে চান। বাংলা একাডেমির কর্মকর্তারা সচিবকে বলেছিলেন, মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমি এবং মন্ত্রণালয় এই আয়োজনে সহযোগিতা করছে। তখন সচিব ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং তিনি মন্ত্রণালয়ের লোগো দিয়ে নতুন করে আমন্ত্রণপত্র ছাপাতে বলেন। একই সঙ্গে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ব্যানারেও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের লোগো ব্যবহারের নির্দেশ দেন সচিব। বাংলা একাডেমি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনের একটি প্রতিষ্ঠান বলেও কর্মকর্তাদের এ সময় জানান তিনি।

তখন মূলত সব আমন্ত্রণপত্র ও ব্যানার ছাপা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সচিবের মৌখিক নির্দেশের কারণে বাংলা একাডেমিকে সব আমন্ত্রণপত্র ও ব্যানার বাতিল করে নতুন করে তা ছাপতে হয়।

বইমেলার নীতিমালা এবং দীর্ঘদিনের রীতি অনুযায়ী বাংলা একাডেমিই একুশে বইমেলার আয়োজক হিসেবে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান। বইমেলার আমন্ত্রণপত্রে আগে কখনো সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নাম ও লোগো ব্যবহার করা হয়নি। 

এ বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে বিষয়টিকে লেখক-সাহিত্যিকরা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানটিতে মন্ত্রণালয়ের অযাচিত হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। বলা হচ্ছে, বাংলা একাডেমি আইন অনুযায়ী এটা করতে পারেন না।

এরপর সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী আমন্ত্রণপত্রে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মনোগ্রাম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে বাংলাদেশ সরকারের মনোগ্রাম ব্যবহার করে বাংলা একাডেমিকে আমন্ত্রণপত্র ছাপানোর মৌখিক নির্দেশ দেন বলে জানা গেছে।

এরপর প্রথম দফায় সাড়ে ছয় হাজার আমন্ত্রণপত্র বাতিল করে গত ২৫ জানুয়ারি নতুন আমন্ত্রণপত্র ছাপানো হয়। নতুন আমন্ত্রণপত্রে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয়েছে সরকারি মনোগ্রাম। গত ১০ বছরের বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রে মন্ত্রণালয় বা সরকারের মনোগ্রাম ব্যবহার করতে দেখা যায়নি বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেন, ‘বাংলা একাডেমি তো মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলা একাডেমি তো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বাইরের কিছু না। তাদের বাজেটের টাকা তো মন্ত্রণালয় থেকেই যায়। এলোকেশন অব বিজনেস অনুযায়ী বাংলা একাডেমি আইনের রক্ষক তো মন্ত্রণালয়। তাহলে মন্ত্রণালয়ের সংস্থা বা দপ্তরের কার্যক্রম তো মন্ত্রণালয়ের অধীনেই।’

সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় বইমেলা হয়। আগে যেভাবে ছিল, সেভাবেই সবকিছু হবে। বাংলা একাডেমিই সব দায়িত্ব পালন করবে। নতুন করে কিছু হচ্ছে না।’

বাংলা একাডেমি আইনে যা আছে

‘বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩’ অনুযায়ী বাংলা একাডেমি পরিচালিত হয়। আইনে বলা হয়েছে, ‘একাডেমি একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হইবে এবং ইহার স্থায়ী ধারাবাহিকতা ও একটি সাধারণ সিলমোহর থাকিবে এবং এই আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে ইহার স্থাবর ও অস্থাবর উভয় প্রকার সম্পত্তি অর্জন করিবার, অধিকারে রাখিবার ও হস্তান্তর করিবার ক্ষমতা থাকিবে।’ 

অর্থাৎ আইন অনুযায়ী বাংলা একাডেমি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। আইনে সরকারের ক্ষমতার পরিসীমাও উল্লেখ রয়েছে। আইনে নির্বাহী পরিষদ বিষয়ে বলা হয়, একাডেমি পরিচালনার জন্য যে সদস্যদের সমন্বয়ে নির্বাহী পরিষদ গঠিত হবে, সেখানে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় মনোনীত অন্যূন যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা থাকবেন।

আইনে বলা হয়েছে, একাডেমির সর্বময় কর্তৃত্ব সাধারণ পরিষদের উপর ন্যস্ত থাকিবে। সাধারণ পরিষদ একাডেমির কার্যাবলি তদারকি ও পর্যালোচনা করিবে এবং নির্বাহী পরিষদকে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা প্রদান করিবে।

একাডেমির সভাপতি, মহাপরিচালক, ফেলো এবং সদস্যদের সমন্বয়ে হবে একাডেমির সাধারণ পরিষদ। এছাড়া মহাপরিচালকের নেতৃত্বে থাকবে নির্বাহী পরিষদ।

‘অমর একুশে বইমেলা ২০২৩’-এর নীতিমালায় উল্লেখ আছে, ‘বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে উদযাপনের অংশ হিসেবে ‘অমর একুশে বইমেলা ২০২৩’ অনুষ্ঠিত হবে এবং বাংলা একাডেমির নির্বাহী পরিষদ কর্তৃক গঠিত ‘অমর একুশে বইমেলা পরিচালনা কমিটি ২০২৩’ বইমেলা পরিচালনা করবে।

মেলা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদার নেতৃত্বে এবার ৩১ সদস্যের কমিটি কাজ করছে। এছাড়া সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, গবেষক মফিদুল হকসহ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন দপ্তরের প্রতিনিধিরা রয়েছেন পরিচালনা কমিটির সদস্য হিসেবে।

বিশিষ্টজনেরা যা বলছেন

এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলা একাডেমির মতো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানকে সরকার কী দৃষ্টিতে দেখতে চায়, তার মর্যাদা স্বীকার করতে চায় কি চায় না, এই বিষয়টি স্পষ্ট হতে হবে। এত দিনের ইতিহাসে যা হয়নি, তা এ সরকারের সময়ে হলে অত্যন্ত বেদনাদায়ক। মনে হচ্ছে, এখানে একটা ভুলবোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে।’

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘অতীতে বইমেলার আমন্ত্রণপত্রে কখনোই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নাম বা লোগো ব্যবহার করা হয়নি। সব সময় আয়োজক হিসেবে বাংলা একাডেমির নাম এবং লোগো ব্যবহার হয়েছে। মন্ত্রণালয় যদি আমন্ত্রণপত্রে তাদের নাম-লোগো ব্যবহার করতে চায়, তখন বাংলা একাডেমি যে একটা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সেটা আর মনে হবে না।’

এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় লেখক কুলদা রায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘হুমকির মুখে একুশে বইমেলা। বইমেলাটি ছিনতাই করে নিতে চাইছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। বাংলা একাডেমি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এখানে মন্ত্রণালয়ের কোনো খবরদারি বা হস্তক্ষেপ অতীতে হয়নি। এরশাদ সরকারও একাডেমির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কখনো হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু এখন হচ্ছে। কার্যত এ ধরনের হস্তক্ষেপ সচিব বা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় করতে পারে না বিধি মোতাবেক। শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলা একাডেমি আইন পাস হয়। এই আইন অনুযায়ী এ ধরনের হস্তক্ষেপ সম্পুর্ণ অবৈধ।’

বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ তার ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

লেখক-শিল্পীদের বিবৃতি

বাংলা একাডেমির ওপর আমলাতন্ত্রের হস্তক্ষেপের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের ২৪ লেখক-শিল্পী। গত ২৬ জানুয়ারি গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা এ উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারা সচিবের ‘অসৌজন্যমূলক’ আচরণের সমালোচনাও করেছেন। নাট্যজন মামুনুর রশীদ, মুক্তিযোদ্ধা ও চলচ্চিত্রকার নাসির উদ্দীন ইউসুফ, কবি শামীম আজাদসহ অন্যান্য লেখক-শিল্পী বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন। 

বিবৃতিতে লেখক-শিল্পীরা বলেন, ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া আইন অনুযায়ী বাংলা একাডেমি একটি সংবিধিবদ্ধ স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে কার্যনির্বাহী পরিষদ। এই পরিষদে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনটি মন্ত্রণালয়ের সদস্য থাকেন। এছাড়া আছেন একাডেমির মহাপরিচালকসহ শিক্ষা-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের অন্য সদস্যরা। তারাই সিদ্ধান্ত নেন।

তারা বলেন, কোনো অবস্থাতেই সংস্কৃতি সচিব একাডেমির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। কিন্তু গণমাধ্যমে এসেছে, সম্প্রতি সংস্কৃতি সচিব বাংলা একাডেমিতে গিয়ে একাডেমির কর্মকর্তাদের হুমকি-ধমকি দিয়ে বইমেলাকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে নিতে চেয়েছেন। একাডেমির কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘কিসের স্বায়ত্তশাসন! আপনারা সবাই মন্ত্রণালয়ের অধীন। আপনারা যদি সের হন, মন্ত্রণালয় সোয়া সের।’

বিবৃতিতে বলা হয়, তার এই অসৌজন্যমূলক আচরণে আমরা স্তম্ভিত, মর্মাহত। সচিব কার্যত মহান সংসদে পাস হওয়া আইন লঙ্ঘন করেছেন। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে এই সচিবকে অপসারণ করা হোক। শিল্প-সাহিত্যে আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ চলবে না। আমরা চাই না ভবিষ্যতে বাংলা একাডেমির অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ হোক। আমরা চাই ইতিহাস-ঐতিহ্যবাহী, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত বাংলা একাডেমির মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকুক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //