সংবিধান থেকে শ্রেণীকক্ষ

কোথায় কেমন আছে বাংলাদেশের দেশি ভাষাগুলি

বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ঐতিহ্য নানাবিধ আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদ্যাপিত হয় বটে, কিন্তু এটির যথাযথ প্রতিফলন চোখে পড়ে না অনেক ক্ষেত্রে, সেটা বহু বাংলাদেশির ব্যক্তিক বা গোষ্ঠীগত প্রাত্যহিক জীবনে হোক, বা প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরেই হোক। এই প্রবণতার একদিকে রয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে বাংলা ভাষা যেভাবে সর্বস্তরে প্রচলিত থাকার কথা ছিল, তা না থাকা।

অন্যদিকে এদেশের অনেক ‘দেশি ভাষা’ আটকে আছে যথাযথ পরিচিতি তথা স্বীকৃতি নেই, এমন একটি অস্পষ্ট ও প্রান্তিক পরিমণ্ডলে। শেষোক্ত বাস্তবতার উপর আলোকপাতের উদ্দেশ্যে সাজানো এই নিবন্ধে শুরুতেই একটু খোলাসা করে নেওয়া যাক, ‘দেশি ভাষা’ বলতে আমরা কোন ভাষাগুলিকে বোঝাচ্ছি। 

বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস অনুসারে বাংলা হল ‘ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা-পরিবার’-ভুক্ত একটি ‘আর্য’ ভাষা, যদিও এই ভাষায় ‘দেশি’ নামক একটি বিশেষ বর্গের অনেক ‘অনার্য’ শব্দও রয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে শেখানো হয়, বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত শব্দগুলিকে উৎস অনুসারে পাঁচটি ভাগে ফেলা যায়, যেগুলি হল, তৎসম, অর্ধতৎসম, তদ্ভব, দেশি এবং বিদেশি।

প্রথম তিনটি বর্গে পড়ে সংস্কৃত বা ‘আর্য’ উৎস থেকে আসা বিভিন্ন শব্দ, অন্যদিকে ‘বিদেশি’ হল বিগত আট-নয় শতাব্দীর মধ্যে বহিরাগত শাসক, ধর্মপ্রচারক বা বণিকদের মাধ্যমে আসা তুর্কি, ফারসি, আরবি, পর্তুগিজ, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষার শব্দ। বাকি থাকছে ‘দেশি’ বর্গটা।

ঠিক কোত্থেকে ‘দেশি’ শব্দগুলো এসেছে? এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যা শেখানো হয়, তার উদাহরণ হিসাবে একটি পাঠ্যপুস্তক থেকে নেওয়া নিচের উদ্ধৃতি দেখা নেওয়া যাক: ‘আর্যরা আসার আগে এদেশে অনার্যদের বসবাস ছিল। তারা ছিল এদেশের আদিম অধিবাসী।

যেসব শব্দ এসব আদিম অধিবাসী অনার্যদের ভাষা থেকে বাংলায় এসেছে সেসব শব্দকে দেশি শব্দ বলে’ (আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, বিদ্যাকোষ: বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও রচনা, সাগরিকা পাবলিকেশন্স, ২০১২, পৃ. ১১৩)। একই বইয়ে আরো বলা হয়েছে, ‘আর্যরা এদেশে এসেই অনার্যদের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। তবু অনার্যরা তাদের কিছু শব্দ আর্যদের উপহার দিতে সক্ষম হয়েছিল। বাংলা ভাষার শতকরা দুটি শব্দ এ উৎস থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয়।’ 

শেষোক্ত উদ্ধৃতির প্রেক্ষিতে একটা প্রশ্ন ওঠে, উক্ত অনার্যভাষী মানুষেরা, বা তাদের ভাষাগুলো, বাংলার শব্দভাণ্ডারে কিছু ‘উপহার’ দিয়েই কি হারিয়ে গেল এ অঞ্চল থেকে? যদি তা না হয়, তাহলে তাদের সমকালীন প্রতিনিধি কারা? এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে তথা বৃহত্তর বাংলা অঞ্চলে এমন অনেক জনগোষ্ঠী আছে, এবং ছিল – যেমন সাঁওতাল (বা ‘সান্তাল’), মুণ্ডা, গারো, খাসিয়া (‘খাসি’), ত্রিপুরা, মারমা, ম্রো – যাদের মাতৃভাষা বাংলা নয়, বা বাংলার মত ‘আর্য’ বর্গভুক্ত নয়।

এসব ভাষাকে প্রচলিত অর্থে ‘অনার্য’ তথা ‘দেশি’ বলা যায়, এবং বাংলা ভাষার ইতিহাস নিয়ে যাঁরা গভীর অনুসন্ধান চালিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই লক্ষ্য করেছেন যে, এমন একাধিক ভাষার সাথে বাংলার- বিশেষ করে বাংলার বিভিন্ন ‘আঞ্চলিক’ রূপের-ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে। এদিক থেকে সান্তালি, গারো, খাসিয়া প্রভৃতি ভাষাকে অবশ্যই ‘দেশি’ বলা যায়, যদিও বাংলা ব্যাকরণের বইগুলোতে সচরাচর এভাবে, সমকালীন প্রেক্ষিতে, কোনো ‘দেশি ভাষা’র পরিচয় দেওয়া হয় না। 

এই নিবন্ধে উক্ত অপ্রচলিত অর্থেই আমরা ‘দেশি ভাষা’ বর্গটা ব্যবহার করছি, যার আওতায় পড়বে বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’ হিসাবে পরিচিত (বা পরিচিত হতে ইচ্ছুক), এমন বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত অধিকাংশ ভাষা। আর এই প্রেক্ষিতে সুনির্দিষ্টভাবে যে দুটি পরিসরে আমরা বাংলাদেশের দেশি ভাষাগুলির বর্তমান অবস্থা নিয়ে আলোচনা করব, তার একটি হল সংবিধান, আর একটি হল শ্রেণীকক্ষ।  

অস্বীকৃতির অন্ধকারে ‘বহুভাষার বাংলাদেশ’

বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার উল্লেখ আছে, কিন্তু এদেশে বাংলা ছাড়াও যে আরো বহু ভাষা আছে, এ বিষয়ক কোনো স্বীকৃতি সেখানে নেই। উল্লেখ্য, সংবিধানের প্রথম ভাগে, ৩ নং অনুচ্ছেদে, ‘রাষ্ট্রভাষা’ শিরোনামের আওতায় সংক্ষেপে শুধু এটুকু বলা হয়েছে যে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’।

এখানে তুলনার খাতিরে উল্লেখ্য যে, ‘রাষ্ট্রধর্ম’ সংক্রান্ত যে অনুচ্ছেদ সংবিধানে রয়েছে (২ক), সেখানে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ বলার পর যোগ করা হয়েছে, ‘তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন’।

রাষ্ট্রভাষার বেলায় অনুরূপ কোনো ঘোষণা নেই! প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে বাংলা ছাড়া অন্যান্য ভাষার প্রচলন বা অস্তিত্ব রয়েছে কিনা, এ বিষয়ে একটি ব্যতিক্রম বাদে সংবিধানের কোথাও কিছুই বলা হয়নি। ব্যতিক্রমটা রয়েছে সংবিধানের একেবারে শেষে (১৫৩ নং অনুচ্ছেদে), যেখানে ইংরেজির প্রসঙ্গ এসেছে সংবিধানের সরকারিভাবে অনুমোদিত পাঠ বাংলা ও ইংরেজি, উভয় ভাষায় রয়েছে, সে বিষয়ক বক্তব্যের অংশ হিসাবে। 

বাংলাদেশে যে বাংলাভাষী বা বাঙালি ছাড়াও অন্যান্য বহু জাতির (বা অন্য ভাষাভাষী) মানুষ বহুকাল ধরে বসবাস করে আসছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানায়, যাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সক্রিয়ভাবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছিল, এই বিষয়টির স্বীকৃতিও সংবিধানে সেভাবে নেই। যেমন, ‘নাগরিকত্ব’ বিষয়ক সংবিধানের ‘৬(খ)’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালী ... বলিয়া পরিচিত হইবেন’।

অন্যদিকে, সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির অংশ হিসাবে উল্লিখিত ‘জাতীয়তাবাদ’ প্রসঙ্গে (৯ নং অনুচ্ছেদে) বলা হয়েছে, “ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন, সেই বাঙালী জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।” 

বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয় ও ইতিহাসের একটি বাঙালি-সর্বস্ব বয়ানকে সাংবিধানিক মহিমা দেওয়ার পর ‘অন্যদের অস্তিত্বের স্বীকৃতি হিসাবে দেখানো (২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংযোজিত) ‘২৩ক’ অনুচ্ছেদের তাৎপর্য কতটা অর্থবহ, সে প্রশ্ন রয়ে যায়। উল্লেখ্য, ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ- গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি’ শীর্ষক এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ লক্ষ্যণীয় যে, এই অনুচ্ছেদে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের দাবির সাথে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট দুটি বিষয়- ভূমি ও ভাষা-অনুল্লিখিত রয়ে গেছে। 

এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-ভাষা প্রভৃতির কারণে কোনো ব্যক্তির প্রতি কোনো বৈষম্য দেখানো যাবে না, মানবাধিকার সনদের এই নীতির আদলে বাংলাদেশের সংবিধানে ‘ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য’ শীর্ষক ২৮ নং অনুচ্ছেদ যুক্ত হলেও সেখানে উল্লিখিত বিষয়সমূহের তালিকায় ভাষা নেই। এই উহ্যতা কতটা সচেতনভাবে আরোপিত হয়েছে, তা গবেষণাসাপেক্ষ বিষয়। তবে বিষয়টি সংবিধানের অন্যত্র বাংলাদেশের ভাষিক বৈচিত্র্যের কোনো উল্লেখ না থাকার বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। 

আমরা যদি মেনে নেই যে বাংলাদেশ একটি বহু ভাষা ও বহু জাতির দেশ, এমন একটি রাষ্ট্র যা শুধু বাঙালির নয় - বা সব বাঙালিরও নয় - কিন্তু ওরাঁও, কোচ, খাসিয়া, খিয়াং, খুমি, গারো, চাক, চাকমা, ডালু, তঞ্চঙ্গ্যা, পাত্র, বম, বর্মন, বানাই, মণিপুরী, মান্দাই, মারমা, মাহাতো, ম্রো, সাঁওতাল, মুন্ডা, রাখাইন, হাজংসহ বিভিন্ন নামে পরিচিত প্রায় অর্ধশত জাতিরও, তাহলে আমরা একমত হতে পারি যে সংবিধানে তাদের অস্তিত্বের কথা আরো স্পষ্টভাবে ও সম্মানজনক ভাষায় (‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র’ প্রভৃতি তকমা ব্যতিরেকে) উল্লেখ করা যেত, যেভাবে এ কথাও বলা যেত যে, বাংলা এদেশের রাষ্ট্রভাষা হলেও এখানে মাতৃভাষা হিসাবে আরো বহু ভাষার প্রচলন রয়েছে, এবং এসব ভাষার বিকাশের জন্য রাষ্ট্র যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবে।  

শ্রেণীকক্ষে ‘মাতৃভাষা’র ব্যবহার

বাংলাদেশের শিশুরা তাদের শিক্ষাজীবনের শুরুতে নিজেদের পরিবারসমূহের শ্রেণীগত (তথা সামাজিক-সাংস্কৃতিক) অবস্থান অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন ভাষিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়। সমাজের উচ্চবিত্ত ও উঠতি শ্রেণীসমূহের শিশুদের অনেকের জন্য ইংরেজি হল শিক্ষার মাধ্যম, এবং এসব শিশুদের বেলায় বাসায়ও ইংরেজি বলাকে উৎসাহিত করা হয়।

পক্ষান্তরে যেসব শিশুর জন্য শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে রয়েছে ‘শুদ্ধ বাংলা’ নামক একটা প্রমিত ভাষা, তাদের বেলায় কথ্যরূপে বাসায় বা এলাকায় প্রচলিত বাংলার বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপকে শ্রেণীকক্ষের বাইরে রেখে দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে! অন্যদিকে যেসব শিশুরা বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবন শুরু করে, তাদের বেলায় রয়েছে আরবি শেখার বাধ্যবাধকতা।

কেবলমাত্র দেশের কিছু প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসরত আদিবাসী শিশুদের বেলায় চেষ্টা করা হয়েছে তাদের স্ব স্ব মাতৃভাষাকে শ্রেণীকক্ষে জায়গা দেওয়ার, যদিওবা ঠিক কিভাবে বা কতটুকু এটা করা হবে, এ ব্যাপারে সরকারি নির্দেশনায় অস্পষ্টতা ছিল শুরু থেকেই। 

আগে মূলত বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে আদিবাসী শিশুদের বেলায় শ্রেণীকক্ষে তাদের মাতৃভাষা ব্যবহারের কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যেগুলির পেছনে এই ভাবনা কাজ করেছিল যে, যেসব শিশুরা বিদ্যালয়ের প্রচলিত ভাষা (বাংলা) বোঝে না, তাদের বেলায় তাদের নিজস্ব ভাষাকে শিক্ষা তথা যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হবে শুরুতে, এরপর এক পর্যায়ে বাংলা শেখানো হবে, যা যথাসময়ে (ধরা যাক পঞ্চম শ্রেণীর পর) হয়ে উঠবে শিক্ষাদানের মূল মাধ্যম।

কাগজে কলমে এই পন্থার যৌক্তিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকলেও এটির বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনেক ধরনের সমস্যা সামনে চলে এসেছিল, যেগুলির একটি হল এমন একটি ধারণা যে, সংশ্লিষ্ট প্রান্তিক ভাষাগুলিকে পূর্ণাঙ্গ লিখিত রূপ দিয়েই মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা কার্যকর করতে হবে। 

বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’ (বা সরকারি পরিভাষায় ‘উপজাতীয়’ বা ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’) হিসাবে অভিহিত সকল জাতির ভাষাই প্রধানত কথ্য আকারেই চর্চিত হয়ে আসছে। এসব ভাষার লিখিত আকারে চর্চার যেমন খুব একটা চাহিদা বা রেওয়াজ নেই, তেমনি নেই এ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা। এমতাবস্থায় লিখিত আকারে নিজেদের ভাষা চর্চার কাজ অনেকে করে এসেছেন মূলত ব্যক্তিগত উদ্যোগে বা বিভিন্ন স্থানীয় সংগঠনের মাধ্যমে।

এছাড়া সীমিত পরিসরে অনুদান-নির্ভর ও এনজিও-বাস্তবায়িত বেশ কিছু মাতৃভাষা-ভিত্তিক শিক্ষা প্রকল্প দেখা গেছে নিকট অতীতে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের এসব খণ্ডিত উদ্যোগকে বেগবান করার ও পথ দেখানোর বিশেষ কোনো দিক-নির্দেশনা জাতীয় পর্যায়ে সেভাবে দেখা যায়নি, সেটা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেই হোক, আর রাষ্ট্রীয় নীতিমালাতেই হোক। 

সংবিধানেতো আদিবাসীদের কোনো স্বীকৃতিই নেই সে অর্থে, বিশেষ করে তাদের ভাষাসমূহের উল্লেখ কোনো আকারেই নেই সেখানে, যে কথা আগেই বলা হয়েছে। তথাপি এই অবস্থাতেই ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতে ‘আদিবাসী’ শব্দটি সরাসরি ব্যবহার করেই বলা হয়েছিল যে, আদিবাসী শিশুরা যেন বিদ্যালয়ে ‘মাতৃভাষা শিখতে’ পারে, তার ব্যবস্থা করা হবে।

কথাটা আবার পড়ুন, আদিবাসী শিশুদের জন্য ‘মাতৃভাষা শেখা’র ব্যবস্থা করা হবে বলা হয়েছে, ‘মাতৃভাষায় শেখা’ নয়। এনজিও মহলে অনেকেই বিষয়টিকে ছাপার ভুল বলেই গণ্য করে এসেছেন এ যাবত, কিন্তু এ নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো সরকারি ব্যাখ্যা কখনো দেওয়া হয়নি। যাই হোক, জাতীয় শিক্ষানীতিতে অস্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত এমন নির্দেশনার আলোকে ২০১১ সালের দিকে সরকারিভাবে এই ঘোষণাও দেওয়া হয় যে, প্রাথমিকভাবে মোট ছয়টি ভাষায় (চাকমা, মারমা, ককবরক বা ত্রিপুরা, গারো, সাদরি ও সাঁওতালি) আদিবাসী শিশুদের জন্য মাতৃভাষা-ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হবে প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে।

তবে মাঝপথে লিপি বিতর্কের কারণে সাঁওতালি ভাষার কার্যক্রম থমকে যায়, যে প্রেক্ষিতে শুধু বাকি পাঁচটি ভাষায় পর্যায়ক্রমে প্রাক-প্রাথমিক ও কয়েকটি প্রাথমিক শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক রচনার কাজ করা হয়। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন খবর থেকে জানা যায়, শ্রেণীকক্ষে এসব পাঠ্যপুস্তকের কার্যকর ব্যবহার এখনো পর্যন্ত সেভাবে দেখা যায়নি। 

উপরে উল্লেখ করা অবস্থার পেছনে মৌলিক অনেক সমস্যা ছিল ও রয়েছে। যেমন, প্রাক-প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় ‘পাঠ্যপুস্তক’ আদৌ প্রয়োজনীয় ছিল কিনা, এ প্রশ্ন করা হয়নি। একইভাবে পরের শ্রেণীগুলির জন্য বিভিন্ন ভাষায় ‘পাঠ্যপুস্তক’ প্রণয়ন করা হয়েছে বটে, কিন্তু সংশ্লিষ্ট ভাষাসমূহে সাক্ষরতা নেই, এমন শিক্ষকদের দিয়ে এসব বই ঠিক কীভাবে কতটা কাজে লাগানো যাবে, সে প্রশ্ন রয়ে গেছে।

আর এসব অমীমাংসিত প্রশ্নের পাশাপাশি আরো মৌলিক একটা প্রশ্ন রয়ে গেছে, সেটা হল এই যে, যেখানে বাংলাদেশে আদিবাসীদের অস্তিত্ব বা ভাষিক স্বাতন্ত্র্য স্পষ্টভাবে স্বীকার করা হয়নি সংবিধানে, সেখানে আদিবাসী শিশুদের শিক্ষার বেলায় তাদের মাতৃভাষার ব্যবহার সম্পর্কে জাতীয় শিক্ষানীতিতে অস্পষ্টভাবে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তার দৌড় কতটা হতে পারে? 

সর্বাগ্রে দরকার ভাষিক বৈচিত্র্যের যথাযথ স্বীকৃতি 

বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে যে বাংলা স্বীকৃত বা প্রতিষ্ঠিত, তা আসলে একটি লিখিত প্রমিত ভাষা, যা সে অর্থে অধিকাংশ বাংলাদেশির প্রকৃত ‘মাতৃভাষা’ নয়। উল্লেখ্য, পৃথিবীতে বর্তমানে ভাষা আছে ছয় থেকে সাত হাজারের মত, যেগুলির প্রায় সবটিই কারো না কারো মাতৃভাষা, কিন্তু রাষ্ট্রভাষার সংখ্যা সব মিলিয়ে দুই শতের সামান্য বেশি হবে হয়ত। ‘ভাষা’, ‘মাতৃভাষা’ বা ‘রাষ্ট্রভাষা’ ধারণাসমূহকে আমরা ঠিক কোন অর্থে ব্যবহার করছি, তার উপর নির্ভর করে এসব সংখ্যায় হেরফের হতে পারে, কিন্তু ‘মাতৃভাষা’ আর ‘রাষ্ট্রভাষা’ যে ঠিক এক বর্গের নয়, তা নিশ্চয় উল্লিখিত হিসাবের পার্থক্য থেকে বোঝা যাচ্ছে। 

বাংলার যে বিভিন্ন আঞ্চলিক কথ্য রূপ রয়েছে - যেগুলি সংশ্লিষ্ট এলাকাসমূহের সাধারণ মানুষের মাতৃভাষা- সেগুলির কোনো প্রশাসনিক মর্যাদা বা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই, বরং সরকারিভাবেই শ্রেণীকক্ষে এসব ভাষার ব্যবহার নিষিদ্ধ বা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এইসব ভাষার কিছু গৎ-বাঁধা এবং অনেকাংশে প্রেক্ষাপট-বিচ্যুত বা হাস্যউদ্রেককারী পরিবেশনা অবশ্য নাটক ও সাহিত্যে দেখা যায়, শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালির ভাষিক কর্তৃত্বের আওতায়, কিন্তু এসব ভাষা নিজেরাই সাহিত্যের বাহন হতে পারে কিনা, পারলেও তা হতে দেওয়া উচিত কিনা, সে প্রশ্ন রয়ে যায়, যা নিয়ে সম্যক আলোচনা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

কিন্তু এটি এখানে উল্লেখ করা হল এ কারণে যে এদেশে যেসব প্রান্তিক জাতি রয়েছে, তাদের অনেকের ভাষার প্রকৃত স্বরূপ ও ভূমিকা আসলে ‘আঞ্চলিক’ বাংলাসমূহের মতই। যেমন, প্রমিত বাংলার তুলনায় সিলেটি, চট্টগ্রামি ও অন্য কিছু আঞ্চলিক বাংলার যে দূরত্ব, চাকমা, বিষ্ণুপ্রিয়া, হাজং, সাদরি প্রভৃতি বেশ কিছু ভাষা যে তার চেয়ে অনেক বেশি দূরে রয়েছে, তা বলা যাবে না।

তথাপি বাংলা ভিন্ন অন্যান্য ভাষার কথা উঠলে (যেমন শ্রেণীকক্ষে মাতৃভাষা ব্যবহারের প্রসঙ্গে) আমরা শুধু শেষোক্ত ভাষাগুলির কথাই ভাবি, কিন্তু আঞ্চলিক বাংলাগুলিকে বিবেচনায় নেই না একেবারে, সেটা সাহিত্য বা শিক্ষা, যে প্রেক্ষাপটেই হোক না কেন। এটি দুর্ভাগ্যজনক, কেননা প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এই ভাষিক বৈচিত্র্যের প্রতি যদি যথাযথ মনোযোগ দেওয়া হত, তাহলে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তিক বর্গের বাঙালি শিশুরাও উপকৃত হত। 

যাই হোক, আমরা যদি শুধু আদিবাসীদের মধ্যে মাতৃভাষা হিসাবে প্রচলিত বিভিন্ন ‘দেশি’ ভাষা’র দিকে আরেকবার দৃষ্টি দেই, তাহলে দেখতে পাব যে, এসব ভাষায় লিখিত সাহিত্যের ধারা অবিকশিত বা ম্রিয়মান অবস্থায় থাকার একটা মূল কারণ নিহিত রয়েছে তাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রান্তিকতার মধ্যে, যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের ভূমির অধিকার হরণ করে সাংস্কৃতিকভাবে তাদেরকে ‘ক্ষুদ্র’, ‘নিচু’ ও ‘পশ্চাৎপদ’ হিসাবে গণ্য করা এবং তাদের ইতিহাস ও স্বকীয়তাকে মুছে ফেলার বিবিধ প্রয়াসের মাধ্যমে।

আমরা যদি চাই তাদের সবার ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি স্বমহিমায় বিকশিত হোক, তবে গোড়ায় জল দিতে হবে, যথাযথ স্বীকৃতি দিতে হবে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে, মেনে নিতে হবে তাদের ‘আদিবাসী’ অধিকার। এই অধিকার অগ্রাহ্য করে বাহ্যিক বিভিন্ন প্রলেপ দিয়ে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির প্রদর্শনীমূলক রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা হবে, আর সব বঞ্চনা-অবমাননা-অস্বীকৃতিকে আদিবাসীরা সাহিত্যিক সৃজনের মাধ্যমে কাটিয়ে উঠবে, তা কোনোভাবেই আশা করা যায় না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //