পঞ্চবটীর ছায়ায় খুঁজি অক্ষত অক্ষর

ভাবনা ভবন 

ভাবনার করিডোরে পা রাখতে শিখেই এটুকু বুঝেছিলাম, আমার ভাবনাগুলো স্বাধীনচেতা, বাউণ্ডুলে আর নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করা কিশোরের মতো। আলোকে যেমন চার দেয়ালে বন্দি করা যায় না, আমার চিন্তা আর অবচেতনের নিজস্বতাকে আটকানো যায় না কোনো কিছুতেই। জেলের মাছ ধরবার দৃশ্যে যে মন কখনো জেলের জন্যে খুশি হয় আবার পরক্ষণেই মাছের জন্যে দুঃখ পায় সে মন বড় বেপরোয়া।

আমি কাকে আমার ভাবনা থেকে সরিয়ে দেবো? মাঠের সাদা বক থেকে শুরু করে সাদা মনের সন্ধানে জনারণ্য থেকে বিরান জনপদের নির্ভীক নাবিক মন আমার কিছু একটা বলতে চায়। বলার বিষয় আর আকুতি যখন আগ্নেয়গিরির মতো টগবগ করে ফুটতে শুরু করছে, তখনই বাবা পুতুলের পরিবর্তে হাতে তুলে দিয়েছিলেন কাগজ আর কলম। আর আমার কেবলই মনে হতো, জীবনটা মূলত সাদা পাতার মতো। তাকে কথায় আর গল্পে ভরিয়ে তোলাতেই প্রকৃত আনন্দ। সেই আমার কলম চলা শুরু। কলমের ডগা থেকে বেরিয়ে আসা সেইসব অক্ষরের লাভা ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রের অসঙ্গতিকে কতটা পোড়াতে পেরেছে, আমার ভেতরকার অনুভবের হাতিয়ারকে কতটা তীক্ষ্ণ আর শানিত করতে পেরেছে আমি জানি না, তবে যথাযথ উত্তরণের চেষ্টায় কোনো খামতি ছিল না, এখনো নেই। যেহেতু প্রকৃতিই আমার একমাত্র শিক্ষাগুরু তাই বাধ্যগত ছাত্রের মতো আমি প্রতিনিয়ত শিখে যাই। আমার ভাবনা ভবনের বিস্তার শুরু হয়। অক্ষরগুলো কাগজে ভেসে উঠতেই রবীন্দ্রনাথ ভর করে মনে, ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি।’

কী লিখি কেন লিখি? 

নাগরিক নীহারিকায় হারিয়ে যে মানুষ তার নিঃসঙ্গতার সাথে কথা বলে, সবুজ থেকে বিচ্ছিন্নতা বোধে অসুখী হয়ে তার নিদান সন্ধান করে তিনি মূলত লেখাতেই মহৌষধিই খুঁজে বেড়ান। কী লিখি বলতে গেলে বলতে হয় বাজারের ফর্দ থেকে শুরু করে ব্যাংকের চেক, কবিতা থেকে শুরু করে গল্প, প্রবন্ধ, সম্পাদকীয় কত কীই না লিখি। তবে যদি প্রশ্ন করা হয় কী লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি তাহলে বলব যা কিছু আমার চেতনায় ও মননে ঢেউ তোলে, যা আমার চিন্তাকে প্রসারিত করে, যা আমার চিরচেনা জগতের বাইরে গিয়ে বিপুলা এই পৃথিবীর বিস্তৃত আয়োজনে আমাকে কিঞ্চিৎ হলেও সংযোগ স্থাপন করায়, কিছু অলৌকিক শব্দসম্ভার যা মস্তিষ্কে ঝিঁঝি পোকার মতো নয়তো প্রজাপতির পাখার মতো ঢেউ তোলে; তাই আমার জন্যে সাবলীল ও স্বস্তির। ভীষণ অসম্ভবে যে আমার অধ্যাত্মলোকের প্রদীপ হয়ে জ্বলে তাই তো কবিতা। ফসলের হাসি দেখে তৃপ্তির আভায় উদ্ভাসিত হয় যে কৃষকের মুখ, সেই মুখও আমার ভাবনায় কবিতার ধ্রুপদী অভিযাত্রী হয়ে ওঠে। 

‘কাগজের বুকে কী হবে কবিতা লিখে? 

তার চেয়ে করো জীবন কবিতাময়,- ’

আমি হয়তো কবিতায় তাই করতে চাই। চাই কবিতায় কিছু সময়কে ধরে রাখতে। খুব করে চাই, পক্ষ-বিপক্ষ বিচার না করে সত্যের মতোই ক্ষুরধার কিছু কবিতা হোক যার কাছে পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী কেউ যেন দাঁড়াতে না পারে। ম্যাক্সিকান তরুণ কবি নাদিয়া গার্সিয়ার কবিতার মতো আমিও কালো পিঁপড়ে হতে চাই, ‘এই তো, শোনা যাচ্ছে কালো পিঁপড়েদের শব্দ/যারা মিছিল করে হেঁটে আসছে/সমস্ত ভয়কে তুড়ি মেরে/যে রক্তপাতের ভয়ে/এতদিন মাথা নিচু করে ছিল আমাদের মাটি।’ (কালো পিঁপড়ে) 

আমার বা আমাদের চারপাশের বসন্তদিনের বাতাস যেমন বয়, ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব তার চেয়ে বেশি বই কম নয়। সেই বাস্তব, পরাবাস্তব সময়ের নিগূঢ় সত্য, কঠিন কঠোর জীবনচরিত, সময় ও দুঃসময়ের ইতিহাস, মাটি লগ্ন সম্প্রদায়ের আচার-আচরণ, ভাষার সুষমা, ঐতিহ্যের পরম্পরা তুলে আনতে গল্পের হাত ধরি। 

চিন্তাধারার সাথে গবেষণালব্ধ মতামত, তথ্য, তত্ত্ব ও উপাত্তনির্ভর কিছু গদ্যকে সৃজনশীলতার সমম্বয় ঘটিয়ে একটি পর্যালোচনায় দাঁড় করাতে প্রবন্ধের দ্বারস্থ হই। 

আর কেন লিখি? নিজের স্বস্তির জন্যে লিখি। কারণ আমি জানি আমার লেখা নিজ আত্মার প্রশান্তির জন্যে। অনেক শখ করে একটা একটা করে জমানো চকোলেটের খোসা যদি কোনো শিশুর হাত থেকে এক নিমিষেই কেউ কেড়ে নেয়, তখন ওর বুকের ভেতরটা আর মুখে কষ্টের ভাষাটা আমি পড়তে চাই। এ জন্যেই লিখি। তিল তিল করে জমানো জীবন কেউ কেড়ে নিলে তার বিনিময়ে বাতাসে কিছু অভিমান তো রাখতেই পারে মানুষ। আমি সেই অভিমানের ভাষা পড়তে চাই। এ জন্যেই লিখি। প্রতিটি পাহাড় যেমন কিছু শীত জমিয়ে রাখে সবুজের বুকপকেটে তেমন করে আমিও ফোঁটা ফোঁটা শব্দ জমা করে রাখি আমার হৃদপেয়ালায়। 

ছেলেবেলার উৎসাহ ছিল পুরস্কারপ্রাপ্তি। গল্প, কবিতা, ছড়া, যে কোনো কিছু লিখে পুরস্কার পেলেই মনে হতো আমি পেরেছি। এখনো যে কোনো স্বীকৃতিতে আনন্দ পাই বটে। তবে অনুভবের জায়গা থেকে সতর্ক হই। আরও দায়বদ্ধ হই। ক্ষুরধার আর যোগ্য মস্তিষ্কের সমালোচনাকে মাথায় করে রাখি। তারাই আমার সত্যিকারের শিক্ষক। এই লেখাই এনে দিয়েছে অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা। এই লেখার মাধ্যমেই খুঁজে পেয়েছি কিছু অসাধারণ বন্ধু। আমি কৃতজ্ঞ প্রত্যেকের কাছে। এ কারণেই লিখে যাওয়া। 

হে তরু এ ধরাতলে রহিব না যবে

আমি বিশ্বাস করি প্রকৃত সত্য লুকিয়ে থাকে প্রকৃতির পাতা পঞ্জিতে। আমি সেই সাধনায় ব্রতী হতে চাই। সত্যের তিতাটুকু বাদ দিয়ে মিথ্যের মাখনে মাখিয়ে যে লেখা লিখতে হয় তেমন লেখা আমি লিখতে চাই না। কী লাভ তাতে? এ জন্যেই লেখার সংখ্যা নয় সৌন্দর্য ও সৌকর্য বাড়ানোয় মন দিয়েছি। সব অনন্তে মিলিয়ে গেলেও যেতে পারে। আফসোস নেই। লিখতে গিয়ে ভাবিনি কেউ এ লেখা পড়বে কি পড়বে না। কেউ পড়লে আনন্দ পাব, সমালোচনা করলে আরও শিখব, না পড়লেও দুঃখ নেই। মহাকালের কাছে রেখে যাব আমার অনুভব। এই প্রাপ্তিটাই বা কম কী? হয়তো কারও পড়তে ইচ্ছে হবে হয়তো কেউ এই লেখার হাত ধরেই জানবে পিছনে ফেলে আসা সময়ের গল্প, দেখবে অতীতের চিত্রকল্প। তাই এমন প্রশ্ন মাথায় এলে সাথে সাথেই মনে পড়ে বার্গম্যানের উইন্টার লাইট দেখার পর ফ্রাসোয়া ক্রফোর সেই বিখ্যাত উক্তি- ‘yes, Bergman is trying to tell us that spectators all over the world are turning away from the movies but that he thinks we must continue to make films Ôjust the sameÕ even we have doubts and even if there is no one in the theaters.’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //