মিথ থেকে যখন নাটক হয়

আল কোরআনের সুরা ‘আল কাহফ’ এ অত্যন্ত শিক্ষণীয় একটা গল্প আছে। একই ধরনের গল্প বাইবেলে উল্লেখ না থাকলেও খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে প্রচলিত আছে। সুরা আল কাহফের গল্প ‘Companions of the Cave or The people of the Cave’ নামে পরিচিত। খ্রিস্টাদের মধ্যে একইরকম গল্প ‘Seven Sleepers’ নামে পরিচিত। প্রথমে আমরা দেখি সুরা আল কাহফের গল্পটা কী ছিল।

প্রাচীন রোম বা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো এক দেশে দদিয়ানুস নামে এক অত্যাচারী সম্রাট ছিল। মূর্তি পূজার সমর্থক। যারা তার এই মূর্তি পূজায় অংশ নিতো না তাদের জন্য কঠিন শাস্তি রাখা হতো। একদল যুবক, সেই মূর্তি পূজা নিয়ে প্রশ্ন তুলল। তাদের যুক্তি ছিল, একমাত্র সৃষ্টিকর্তার প্রতি মানুষ আনুগত্য প্রকাশ করতে পারে, মানুষের তৈরি কোনো কিছুর ওপরে নয়।


মূর্তি পূজার প্রতি প্রশ্ন তোলায় এবং আনুগত্য প্রকাশ না করার কারণে সেই যুবকদের ওপর নেমে এলো অত্যাচার। তারা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল তাদের রক্ষা করার জন্য। সেই যুবক দল নিজেদের রক্ষা করার জন্য একটা গুহায় যেয়ে হাজির হলো। আরবি শব্দ ‘কাহফ’ অর্থ গুহা। আল্লাহ তাদের ৩০৯ দিন সেই গুহায় ঘুম পাড়িয়ে রাখলেন। তাদের সঙ্গে একটা কুকুর ছিল, যে তাদের পাহারা দিয়েছিল।

ৎ৩০০ বছর পর তারা যখন ঘুম থেকে জেগে উঠল, দেখল তাদের দেশের সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। এসেছে নতুন সম্রাট, নতুন মুদ্রা। শহর আর সেই তিন শ বছর আগের শহর নেই। এই গল্পে কয়জন যুবক ছিল, কত বছর তারা ঘুমিয়ে ছিল, কুকুরের গায়ের রং কী ছিল ইত্যাদি নিয়ে পরবর্তীতে ইহুদিরা হযরত মোহাম্মদকে (সা.) প্রশ্ন তুলেছিল; কিন্তু এসব প্রশ্ন ছিল নিতান্তই বাহুল্য।

অগুরুত্বপূর্ণ, তাই সেসব প্রশ্নের উত্তর হযরত মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহর কাছে ছেড়ে দিতে বললেন। মূল যে কথাটা এই গল্পে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো সঠিক প্রশ্ন উত্থাপন। সঠিক বিষয়ের সঠিক প্রশ্ন উত্থাপনের মধ্যে দিয়ে মানুষ তার জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। সমাজে ক্রমাগত প্রশ্ন উত্থাপনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নেওয়া যায়। এটাই ছিল এই গল্পের মূল প্রতিপাদ্য অথবা মেসেজ।

আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই গল্পে ছিল। যে যুবক দল সেই গুহায় গিয়েছিল, সংখ্যায় তিন বা পাঁচ বা সাত যাই হোক না কেন, তারা কেউ কাউকে চিনত না। কিন্তু তারা ছিল একই মতাবলম্বীর মানুষ। ফলে তাদের মধ্যে খুব দ্রুত সখ্য গড়ে উঠেছিল এবং সহজেই তাদের সমস্যার সমাধান ঘটেছিল। এখানে যা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো, যাদের সঙ্গে আমরা মেলামেশা করি, নিত্য ওঠাবসা করি, তাদের দ্বারা আমাদের ধ্বংস ডেকে আনা হতে পারে অথবা ভালোর শীর্ষে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।

বাংলায় যেমন একটা প্রবাদ আছে, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’ -অনেকটা এই রকম অর্থ দাঁড়ায়। এই গল্পের অন্যতম মূল বার্তা আমাদের কাছে সেটাই প্রকাশ করে। অন্যদিকে, ‘Seven Sleepers’ গল্পটা অনেকটা এইরকম-২৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে রোমান সম্রাট ডেসিয়াসের (২০১ খ্রি:-২৫১ খ্রি:) পৌত্তলিক পূজার অত্যাচারে সাতজন খ্রিস্টান যুবক এক গুহায় একত্রিত হয় এবং কম্প্যানিয়নস অব দ্য কেভগল্পের মতোই বহুদিন পর তারা ঘুম থেকে জেগে ওঠে।

জেগে উঠে দেখে, আগের সেই রোমান সম্রাট আর নেই। তার জায়গায় সম্রাট থিওডোসিয়াস ২ (৪০৮-৪৫০ খ্রি:)-এর রাজত্ব চলছে। আগের সেই পৌত্তলিক পূজা আর নেই। সবাই খ্রিস্টধর্ম পালন করছে। এই গল্পের মোরাল হিসাবে আমরা দেখতে পাই মানুষের ভেতর ধৈর্য ধারণ এবং এক সৃষ্টিকর্তার ওপর গাঢ় বিশ্বাস মানুষকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে। ঘুমের মধ্যে দিয়ে এক রকমের ধৈর্য ধারণের প্রতীকী ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

যে কারণে সেই সাতজন যুবক ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর দেখে, তারা যে ধর্ম পালন করতো সেই খ্রিস্ট ধর্ম রোমে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে ইত্যাদি। পৌরাণিক গল্পগুলো শিক্ষণীয়, অনুধাবনযোগ্য, চিন্তাযোগ্য, সমকালীন হয় বলে যুগের পর যুগ ধরে টিকে থাকে। কখনো পুরনো হয় না। এই দুটি পৌরাণিক গল্প মানুষের দীর্ঘ ঘুমের গল্পের মধ্যে দিয়ে আমাদের কাছে একটা পজিটিভ বার্তা পৌঁছে দেয়। সুরা আল কাহফ দিয়ে যে গল্পের সূচন হয়েছিল, পরবর্তীতে এইরকম গল্প আরও লেখা হয়েছে।

তবে ওয়াশিংটন আরভিং এর লেখা ‘Rip Van Winkle’ গল্পটা এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা দরকার। ঠিক এই গল্পের আদলে, কলকাতার মঞ্চ নাটকের নাট্যপরিচালক ব্রাত্য বসুর (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী) পরিচালনায় ২০০২ সালে ‘উইংকেল টুইংকেল’ নামে একটা নাটকমঞ্চস্থ করা হয়।

নাটকটি সেই সময়ে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে এখনো সমকালীন। তবে দুটো গল্পের প্রেক্ষাপট এবং মেসেজ ভিন্ন। রিপ ভ্যান উইংকেল আমেরিকার বিপ্লব পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত এবং উইকল টুইকল বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরবর্তী সময়কে নিয়ে গঠিত। 

ওয়াশিংটন আরভিং তার রিপ ভ্যান উইংকেল গল্প সুরা আল কাহফ থেকে রূপান্তর করে লিখেছেন এবং পরবর্তীতে গল্পটি ভীষণ জনপ্রিয় হয়। অর্থের দিক সুরা আল কাহফের সঙ্গে মিল না থাকলেও চমৎকার মেসেজ এখানেও আছে। এই গল্পে আমরা দেখি, ১৭৭০ সালের দিকে রিপ ভ্যান উইংকেল নামে শান্তিপ্রিয় কিন্তু অলস এক লোক আমেরিকার হাডসন নদীর ধারে ক্যাটসকিল পাহাড় সংলগ্ন একটা গ্রামে বাস করত। সে শুধু ঘুমিয়ে সময় কাটাতো। মাঠে কাজ করতে তার ভালো লাগত না। এই অলসতার কারণে তার বউ তাকে বিরক্তিকর ভাবে ক্রমাগত বকে যেত। একদিন রিপ ভ্যান রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়, তার কুকুরকে নিয়ে। পথে এক অদ্ভূত লোকের সঙ্গে তার দেখা হয়।

নাট্যপরিচালক ব্রাত্য বসুর ‘উইংকেল টুইংকেল’ নাটকের একটি দৃশ্য।

যে বিশাল এক পিপা কাঁধে নিয়ে যাচ্ছিল। সেই লোক তাকে সাহায্য করার জন্য রিপ ভ্যানকে বিশেষভাবে অনুরোধ করে। রিপের ইচ্ছে না থাকলেও তাকে সাহায্য করে। কিছুদূর যাওয়ার পর তারা একটা পাহাড়ে যেয়ে হাজির হয়। রিপ সেখানে সেই অদ্ভূত লোকের মতো আরও কিছু লোকের দেখা পায়। তার পিপা থেকে পানীয় পান করছিল। রিপ তাদের সঙ্গে সেই পানীয় পান করে এবং ঘুমিয়ে পড়ে।

প্রায় বিশ বছর ঘুমিয়ে থাকার পর, রিপ যখন তার গ্রামে ফিরে আসে, সে দেখে সবকিছু পরিবর্তিত হয়ে গেছে। যে সরাইখানায় সে নিয়মিত যেতো সেখানে ইউনিয়ন হোটেল নামে একটা হোটেল উঠেছে। রাজা তৃতীয় জর্জের পোট্রেট ছবির জায়গায় জর্জ ওয়াশিংটনের ছবি ঝোলানো হয়েছে। মানুষজন সেখানে সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন নিয়ে কথা বলছে। রিপকে একজন জিজ্ঞেস করলো, সে কাকে ভোট দিয়েছে। প্রশ্ন শুনে রিপ হতভম্ব। রিপ ভোটের মানেই জানে না।

কারণ সে যখন ঘুমিয়ে পড়েছিল, আমেরিকা তখন ব্রিটেনের অধীনে কলোনি ছিল। ঘুম ভাঙার পর বিপ্লব পরবর্তী স্বাধীন আমেরিকা। যাক, শেষ পর্যন্ত রিপের সঙ্গে তার মেয়ের দেখা হয় এবং রিপ তার ঘুমের গল্প যারা শুনতে চাইতো তাদের শোনাতে থাকে এবং আগের মতোই অলস সময় পার করতে থাকে। অর্থাৎ রিপের কোন পরিবর্তন হয় না। বিপ্লব পূর্ববর্তী আমেরিকায় সে যেমন ছিল বিপ্লব পরবর্তী আমেরিকায় একইরকম থেকে যায়।

কিছু মানুষ সময় বদলের সঙ্গে নিজেকে বদলাতে পারে না। রিপ ভ্যান ঠিক সেই চরিত্রের। সামন্ত বা পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা, পরাধীন রাষ্ট্র বা স্বাধীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা ইত্যাদি সময়ে সে একই রিপ ভ্যান উইংকেল থেকে যায়। এই গল্পে বিশেষ কিছু বিষয় আমাদের ইঙ্গিত দিয়ে যায়। প্রথমত: সরাইখানার জায়গায় ইউনিয়ন হোটেল স্থাপনের মধ্য দিয়ে, কলোনিয়াল সামন্ত যুগের জায়গায় পুঁজিবাদি উৎপাদন ব্যবস্থার স্থানান্তর আমরা লক্ষ্য করি।

যে মানুষগুলো সরাইখানায় অলস সময় কাটাতো পরিবর্তিত মানুষগুলো এখন নতুন বাণিজ্য, নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (পুঁজিবাদি উৎপাদন ব্যবস্থা) ইত্যাদির প্রতীক নিদর্শন করে। দ্বিতীয়ত: স্বাধীনতা বনাম প্রজাপীড়ন। রিপের বউ পরাধীন দেশের প্রজাপীড়নের ভ‚মিকায় প্রতীকী আকারে গল্পে অবতীর্ণ হয়। স্বাধীনচেতা রিপ এই ধরনের পীড়ন সহ্য করতে না পেরে একদিন বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।

দীর্ঘ বিশ বছর ঘুমিয়ে থাকার পর যখন সে তার গ্রামে ফিরে আসে ততদিনে তার বউ মারা গেছে, রিপ তখন একরকম স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বাস্তবেও আমেরিকা তখন ব্রিটিশ কলোনি থেকে মুক্ত স্বাধীন। তৃতীয়ত: ইতিহাস বনাম গল্প। আরভিং তার গল্পটা আমেরিকার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নির্মাণ করেছেন। আসলে রিপ ভ্যান উইংকেল মূলত আমেরিকার স্বাধীনতা বিপ্লবের রূপকধর্মী একটা চমৎকার গল্প। 

অন্যদিকে উইংকেল-টুইংকেল নাটকে কোন রূপকের ব্যবহার আমরা দেখিনা। সমাজবাস্তবতার আলোকে নাটকের গল্প নির্মিত। নাটকের মূল চরিত্রের দীর্ঘ ঘুমের প্রতীকী ব্যবহার শুধু দেখা যায়। এখানে আমরা দেখি জেলে থাকা সব্যসাচী সেন নামে একজন কমিউনিস্ট বিপ্লবী ১৯৭৬ এর জানুয়ারি থেকে জানুয়ারি ২০০২ অর্থাৎ দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর ঘুমিয়ে থাকার পর হঠাৎ একদিন জেগে ওঠে এবং তার বাড়িতে এসে হাজির হয়।

ঠিক আগের গল্পগুলোর মতোই বাড়ি ফিরে দেখে সবকিছু বদলে গেছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ন্যায়-নীতি, আদর্শ ইত্যাদি সবকিছুর পরিবর্তন ঘটে গেছে। এমনকি তার নিজের ছেলে রুদ্র, যে রুদ্রকে কমিউনিস্ট বিপ্লবের আদর্শে বড় করছিলেন, সেও সম্পূর্ণ বদলে গেছে। রুদ্রর কাছে আদর্শ বলে এখন আর কিছু নেই।

সে তার মা যিনি সব্যসাচীর আদর্শে বিশ্বাসী, সেই মায়ের সঙ্গে তর্ক করার সময় মা যখন রুদ্রকে বলে, ‘আমরা পার্টি করতাম কিছু দেবার জন্য’। রুদ্র তখন তার মাকে বলে, ‘তোমাদের মতো বোকারা এখনো কিছু আছে। যুগটা পাল্টে গেছে মা। এখন সবাই নিজেরটা বুজছে। আর যে পারছে না হয় সে অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে বসে থাকছে নয়তো ফ্রাস্ট্রেডেট হয়ে অন্য কিস্তিকান্তা করছে। মানুষ এখন আইডিয়োলজি দেখে না। কাজ দেখে।’ পুরনো বন্ধু রাজেনের মুখেও প্রায় একই কথা শোনে সব্যসাচী। রাজেন বলে, ‘আমি শালা এই সোসাইটিকে বুঝে গেছি।

কারোর এখন কোনো কিছুতে যায় আসে না। আমার পুরনো অনেক কমরেড ওসব অত্যাচার পেরিয়ে আবার মূলস্রোতে আসতে পেরেছে। ’ রাজেনের কাছে সব্যসাচী জানতে পারে তাদের এক বন্ধু ডালাসের কোনো মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির চিফ একজিকিউটিভ পদে কাজ করছে, কেউ সর্বোচ্চ বিক্রীত পত্রিকার সাংবাদিক, কেউ বাংলাভাষা রক্ষা কমিটির অন্যতম পান্ডা এবং এভাবেই এক সময়ের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীরা একে একে মূলস্রোতে মিশে যাচ্ছে। ভেঙে পড়ছে পুরনো আদর্শ, নীতি ইত্যাদি। আসলে আদর্শের জায়গা স্থান করে নিয়েছে পক্ষপাতিত্ব।

কে কার পক্ষে থাকবে সেটাই এখন সব থেকে বড় কথা। যার কোন পক্ষ নেই সে আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। রুদ্র তাই তার বাবাকে বলে, “...গত ছাব্বিশ বছরে দুনিয়াটা একেবারেই বদলে গেছে। মাথার ওপর কোনো ছাতা নেই। কোন শিবির নেই, কোনো মিছিল নেই, আপনি এখন একা। একেবারে একা। কোনো না কোনো পক্ষ আপনাকে নিতেই হবে। কেননা, পক্ষ ছাড়া, শিবির ছাড়া আপনার অবস্থা হবে রিপ ভ্যান উইংকেলের মতো। সেও একদিন ঘুম থেকে জেগে উঠে কারোর সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারেনি। পক্ষ নিন সব্যসাচী। কোনো না কোনো পক্ষ আপনাকে নিতেই হবে...।”

কার্ল মার্কসের একটা উক্তি এখনো বিখ্যাত হয়ে আছে, সেটা হলো- ‘এতদিন দার্শনিকেরা পৃথিবীকে কেবল ব্যাখ্যা করে গেছেন; কিন্তু আসল কাজ হলো পৃথিবীকে বদলে দেয়া।’ অর্থাৎ পরিবর্তন। উইংকেল-টুইংকেলের সারা নাটকজুড়ে বদলে যাওয়া সময় নিয়ে কথা বলা হয়। রুদ্র তার বাবাকে গ্লাসনস্ত, পেরেসত্রয়কা, বার্লিন ওয়ালের ভাঙন থেকে শুরু করে মমতা ব্যানার্জী, মাইক্র চিপস, ওসামা বিন লাদেন, গ্লোবালাইজেশন, ইন্টারনেট, পোস্টমর্ডান, সিপিএম-এর শরীক দল সিপিআই ইত্যাদির ইতিহাস যখন মাত্র একটা সংলাপের মধ্যে দিয়ে বলে যায়, সব্যসাচী তখন বলে, ‘সব কি পাল্টে গেছে নাকি? তো পাল্টে কী হয়েছে? পাল্টানোটা ধরা যাচ্ছে কি ঠিকঠাক?

এসব বদলই কি আমরা চেয়েছিলাম?’ খুব গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ। পৃথিবীর পরিবর্তন খুব স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটে থাকে। এই পরিবর্তন অতীতে যেমন ঘটেছে, এখনো ঘটছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে।

প্রশ্ন হলো কী ধরনের পরিবর্তন? যে পরিবর্তন হয়েছে সেটা মানুষকে কল্যাণের দিকে নিয়ে যাবে? কোথায় পরিবর্তন? কীভাবে এই পরিবর্তন ঘটেছিল, ঘটছে বা ঘটবে? বাইরের পরিবর্তন দিয়ে কখনো ভেতরের পরিবর্তন বোঝা যেমন যায়না, তেমনি মূলের পরিবর্তন ঘটেও না। পৃথিবী যেমন ছিল ঠিক সেইরকম থেকে যায় অথবা আরও জটিল হতে থাকে।

গাছের গোঁড়ায় পানি না দিয়ে মাইক্র চিপস, গ্লোবালাইজেশন, পোস্ট মর্ডান, ইন্টারনেট ইত্যাদি দিয়ে শুধু গাছের ওপরে পানি ঢেলে, বাইরের যে পরিবর্তন আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেটাকে আদৌ কোনো পরিবর্তন বলা যাবে কিনা সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কার্ল মার্কস যে পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন সেটা মূলের পরিবর্তন ঘটানোর কথা বলেছেন। অর্থাৎ যে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার কারণে অসাম্য, ধনী-দরিদ্রের উচ্চ ব্যবধান ইত্যাদি ঘটে থাকে, সেই ব্যবস্থার পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন। যে কারণে, মার্কস তার ‘পুঁজি’ বইয়ে, শুধুই পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা এবং পর্যালোচনা করেছেন।

Companions of the Cave গল্পের চিত্রাঙ্কন

যে উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যেই সর্ষের ভুত বসে থাকে, সেই ভুত না তাড়ালে, বাইরের চাকচিক্য (গ্লোবালাইজেশন, পোস্ট মর্ডানিজম, ইন্টারনেট ইত্যাদি) কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না। সব্যসাচী তাই তার বাবার প্রসঙ্গ টেনে তরুণ সব্যসাচীকে বলে, ‘বাবা আমাকে বুঝতো না। যদি বুঝতো তাহলে জানতো আমি ততদিনে মনে মনে বিপ্লবী হয় গেছি। বাবার মতো অহিংস আন্দোলন করা বিপ্লবী নয়। এই বিপ্লব শুধু বাইরে থেকে নয়, ভেতর থেকে মানুষটাকে পাল্টে দেয়।’

তবে ভেতরের মানুষ তখনই পাল্টে যায়, যখন উৎপাদন ব্যবস্থাসহ সামগ্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে। তবে নাটকে আমরা যা দেখতে পাই সেটা হলো, কমিউনিজমের মন্দ দিকগুলি বারবার তুলে আনা হয়েছে, কটাক্ষ করা হয়েছে। সব্যসাচীর বন্ধু রাজেন বলে, ‘তুই, আমি, সবাই চোখ বন্ধ করে বাঁচি।

আমাদের চোখের সামনে দিয়ে হুহু করে ছুটে চলেছে সত্যিকারের রিয়ালিটি। যে রিয়ালিটি অবজ্ঞা ভরে আমাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। আমরা ভাবি আমরা তাকে রিফিউজ করেছি। আসলে ঠিক তার উল্টো।’ অর্থাৎ গত শতাব্দীতে যখন বিভিন্ন দেশে বিপ্লব ঘটছিল, বিপ্লবীরা ভেবেছিল তাদের বিপ্লব সফলতার দিকে যাচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে তার ফলাফল হয়েছে উল্টো। ফলাফল বাস্তব সন্দেহ নেই; কিন্তু এই বাস্তবতার মুখোমুখি কীভাবে দাঁড়ানো যায় তার কোনো সমাধান আমরা নাটকে পাই না।

বরং এই বাস্তবতার সঙ্গে মিশে যেতে নাট্যকার ইঙ্গিত করেন। পুঁজিবাদী অর্থনীতির জটিল সংকট নিয়ে কিছু মন্তব্য এখানে তুলে ধরা হলো। ‘মুক্ত বাজার’ এর নামে অন্যদের সিদ্ধান্তের তোয়াক্কা না করে বড় বড় করপোরেটগুলো নিজেরাই পণ্য উৎপাদনের (অর্থনীতির মৌলিক তিনটি বিষয় কী উৎপাদন করা হবে, কীভাবে করা হবে এবং কারজন্য করা হবে ইত্যাদি)-সিদ্ধান্ত নেয়।

‘বাক স্বাধীনতা’র নামে করপোরেট প্রেসগুলো নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয়, কার কথা প্রেসে যাবে আর কারটা যাবে না। ‘স্বাধীন ও অবাধ নির্বাচন’ এর নামে নাগরিকদের দুই করপোরেট প্রার্থীর মধ্যে একজনকে বেছে নিতে বলা হয়। ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’ র অর্থ শুধু করপোরেটদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র (তথ্যসূত্র: ফেসবুক গ্রুপ Existential Comics এর সৌজন্য )। কাজেই শুধু টাকা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পৃথিবী অবশ্যই একটা জটিল পৃথিবী। 

২০০৯ সালে প্রকাশিত ‘Witness to Permanent Revolution : The Documentary Record, edited and translated by Richard B. Day and Daniel Gaido’বইটির ওপর ডেভিড নর্থ একটা রিভিউ লিখেছিলেন এপ্রিল, ২০১০ সালে।

সেখানে ডেভিড নর্থ ডে এবং গাইডোর মাধ্যমে আমাদের জানাচ্ছেন, রিচার্ড বি ডে এবং ড্যানিয়েল গাইডো, উভয়ের মতে ‘In, realitythe relationbetween classesproduced political struggle above all else. What is more, the final else outcome of that struggleis determined by the development of class forces’ অর্থাৎ বাস্তবে বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে যে সম্পর্ক সেটা রাজনৈতিক সংঘর্ষ তৈরি বা উৎপন্ন করে।

শেষ পর্যন্ত যে ফলাফল বের হয়ে আসে সেটা শ্রেণিশক্তির উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ কোন শ্রেণি শাসনক্ষমতায় আছে তার ওপর নির্ভর করে। খুব স্বাভাবিকভাবে তাই ভাবা যায়, যে প্রলেতারিয়েত শ্রেণির কথা আমরা বরাবর জেনে এসেছি, তাদের ক্ষমতায় আসাটা খুব সহজ কাজ না; কিন্তু তাই বলে হাল ছেড়ে দেয়াও কোনো কাজের কথা না। কারণ, শ্রেণি সংঘর্ষ যতদিন থাকবে স্থায়ী বিপ্লবের প্রতি মানুষের আকাঙ্ক্ষা ততদিন টিকে থাকবে। 

দুটি গল্পের মধ্যে অর্থাৎ রিপ ভ্যান উইংকেল এবং উইংকেল-টুইংকেলের মধ্যে, রিপ ভ্যান আমাদের যতটা উদ্দীপিত করে ঠিক ততটাই হতাশ করে উইংকেল-টুইংকেল। রিপ ভ্যানে পূর্ণ স্বাধীনতার যে চিত্র আঁকা হয়, উইংকেল-টুইংকেলে ব্যর্থ বিপ্লবের কথা জানানো হয়। মানুষের দীর্ঘকালের কমিউনিস্ট বিপ্লবের সংগ্রামকে কটাক্ষ করা হয়। অথচ নাটকে ব্যর্থ বিপ্লবের উত্তরণের কোন পথ আমাদের দেখায় না।

বরং ইন্দ্র তার বাবাকে বলে আমাদের এই সময়ের সব থেকে বড় সিনড্রম হচ্ছে কনফিউশন। কথাটা একদম মিথ্যা তা বলা যাবে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর পৃথিবী আজ সত্যি একটা ঝাপসা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু সংগ্রাম থেমে থাকে নাই। শ্রেণি বৈষম্য দূর না হওয়া পর্যন্ত এই সংগ্রাম চলবে। 

মিথলজির গল্পগুলো যুগে যুগে মানুষকে উৎসাহ দিয়ে গেছে। সেসব গল্প সমকালীন সময়ের প্রেক্ষাপটে রূপান্তর করে যেসব গল্প পরবর্তিতে নির্মিত হয় সেসব গল্পও তাই পুরনো হয় না। সমকালীন হয়ে ওঠে। প্রতিটা মিথ আমাদের এমন কিছু শিখিয়ে দেয়, যে শিক্ষার ওপর ভিত্তি অসাধারণ সব গল্প নির্মিত হয়।

উইংকেল-টুইংকেল একেবারে নিখুঁত নাটক বলা যাবে না; কিন্তু সমকালীন সময়কে যথাযথভাবে ধরা হয়েছে। রিপ ভ্যান উইংকেল তার সময়ের প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে। এভাবে আমরা দেখতে পাই, মিথলজির গল্পগুলো এমনভাবে নির্মিত হয়েছে, যা পরবর্তী মানুষের কাছে সব সময় তার আবেদন রেখে গেছে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //