কেশ

অঁরি রোনে আলবের্ট গী দো মোপাসঁকে (Henri René Albert Guy de Maupassant, 1850-1893) ধরা হয় ফরাসি সাহিত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল ও খ্যাতিমান ছোটগল্পকার হিসেবে। তিনি ফ্রান্সের বাস্তববাদ (Le naturalism) ঘরানার লেখক ছিলেন। জন্ম ফ্রান্সের শাতো দো মিরোমেসনিলে (Château de Miromesnil)। সারা জীবন বিচিত্র সব বিষয়ে তিনি লিখে গিয়েছেন অবিরত।

সেকালের ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় জীবনের বাস্তবতা, বিশেষত সমাজের ঘাত-সংঘাত, অর্থনীতি, দারিদ্র্য, দাম্পত্য জীবন, প্রেম, যৌনতা, মনোবৈকল্য প্রভৃতি বিষয় নিয়ে বিচিত্র সব গল্প তিনি উপস্থাপন করেছেন, যেখানে জীবনের রূঢ় কঠোরতা তিনি নগ্নভাবে প্রকাশ করেছেন। যে কারণে গুস্তাভ ফ্লবেয়ারের (Gustave Flaubert, 1821-1880) মতো সাহিত্যিক যথার্থবাদের (Literary realism) অন্যতম প্রধান নায়কের গুরু হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ১৮৭০ সালের ফ্রাঙ্কো-প্রুশীয় যুদ্ধও তার জীবনে ছাপ ফেলে, তারও প্রভাব আছে তার গল্পে। ছয়টি উপন্যাস, ৩০০ ছোটগল্প, তিনটি ভ্রমণ বিষয়ক বই তিনি লেখেন।

বেশ কিছু কবিতাও তিনি লিখেছেন। যদিও খ্যাতি তিনি পেয়েছেন মূলত ছোটগল্পকার হিসেবে। ১৮৮০ সালে তার প্রথম ছোটগল্প ‘বোল দো সুইফ’  (Boule de Suif) বা দ\‘চর্বির ডিব্বা’ প্রকাশিত হলে তিনি ব্যাপক পরিচিতি পান। এখন পর্যন্ত ফরাসি সাহিত্যে এবং আধুনিক বিশ্বসাহিত্যে তার প্রভাব অপরিসীম। ‘কেশ’ (La chevelure) তার অন্যতম বিখ্যাত ছোটগল্প। ১৩ মে, ১৮৮৪ সালে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। 

*

ছাদের দেওয়ালগুলো ছিল নগ্ন, সেগুলোতে সাদা চুনকাম করা হয়েছে। সংকীর্ণ, গ্রিল দেওয়া জানালা এতটাই উপরে ফুটো করে বানানো হয়েছিল যাতে কেউ নাগাল না পায়, আর আলোকিত সেই কক্ষে ছিল ছমছমে ভাব। পাগলটা একটা খড়ের তৈরি চেয়ারের উপর বসে ছিল, তাকিয়ে দেখছিল আমাদের স্থির দৃষ্টিতে, যে দৃষ্টিতে ছিল শূন্যতা, ভৌতিক ভাব। সে ছিল রোগাটে, গাল তুবড়ে গিয়েছে, চুল প্রায় সবই সাদা, দেখে বোঝা যায় যে, তা গত কয়েক মাসে হয়েছে। তার শুকিয়ে যাওয়া অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের তুলনায় তার পোশাক ছিল অনেক বড়, তার বসে যাওয়া বুক, আর দেবে যাওয়া পাকস্থলীর তুলনায়ও। যে কেউ ভাবতে পারে সে তার চিন্তার কারণে বিপর্যস্ত, যা তাকে কুরে খেয়েছে, যেভাবে ফল কুরে খায় কীট। তার পাগলামি, তার চিন্তা, তার মাথার মধ্যেই ছিল গোঁয়ার, নাকাল করা, আগ্রাসী। তার শরীরটাও তা খাচ্ছিল একটু একটু করে। সেই অদৃশ্য, অপ্রতিরোধ্য, অধরা, অপার্থিব চিন্তা তার রক্ত শুষে নিচ্ছিল, নির্বাপিত করছিল তার জীবন প্রদীপ।

কী এক রহস্যকে সে তার স্বপ্ন দিয়ে হত্যা করেছিল। যন্ত্রণা সহ্য করছিল, আতঙ্কিত ছিল, ছিল বিধ্বস্ত; আর এই দশা তাকে অধিকার করে নিয়েছিল। কি অদ্ভুত, ভয়ঙ্কর আর বিপজ্জনক স্বপ্নই না তার কপালের ভেতর গেড়ে বসেছিল, সে কারণেই কি সে কপালটা গভীরভাবে কুঁচকাত, ক্রমাগতই কুঞ্চিত ওটাকে নাড়াত?

ডাক্তার আমাকে বললেন, ‘তার মধ্যে ভয়ঙ্কর ক্রোধের বায়ু আছে। সে আমার দেখা ভয়ঙ্করতম উন্মাদ। যৌনতার সঙ্গে প্রমত্ত উন্মাদনা তার ধাত। তার মধ্যে এক ধরনের নেক্রোফিলিয়া বা শবরথী রয়েছে (১)। তার ডায়েরিতেও যা সে লিখেছে, তাতে তার মনোরোগ ধরা পড়ে। আর তার রোগটা যে ওই মনেই-তা অনুমান করা যায়। আপনি আগ্রহী হলে এই নথিতে চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন।’ আমি ডাক্তারকে অনুসরণ করে তার কক্ষে প্রবেশ করলাম। ‘পড়ুন’, তিনি বললেন, ‘আর আপনার মতামত দিন।’

এই হলো তাই, যা এই ডায়েরি ধারণ করে আছে।

*

বত্রিশ বছর পর্যন্ত আমি একটি শান্ত প্রেমহীন জীবন-যাপন করেছি। জীবন আমার কাছে ছিল খুবই সরল, খুবই ভালো এবং খুবই সহজ। আমি ধনাঢ্য ছিলাম। অনেক বিষয়ে আমার আকাক্সক্ষা থাকাতে কোনো একটি বিষয়ে আমার অনুরাগ জন্মেনি। আর তা বাঁচার জন্য ভালোই! প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠতাম আনন্দের সঙ্গে সেইসব করতে, যা আমাকে আনন্দ দিত, আর ঘুমাতামও তৃপ্তি নিয়ে, শান্তিময় আগামীকাল ও উদ্বেগহীন ভবিষ্যতের প্রত্যাশা নিয়ে।

আমি রেখেছিলাম জনাকয়েক রক্ষিতা, তাদের জন্য হৃদয়ে বাসনা তাড়িত না হয়েই, অথবা তাদের অধিকারে রাখার জন্য আত্মাকে ভালোবাসায় ক্ষত-বিক্ষত না করেই। এভাবে বাঁচাই ভালো। এভাবে ভালোবাসা উত্তম, কিন্তু ভয়ানক। আবার যারা অন্য সবার মতো ভালোবাসে, তারা অবশ্যই এক প্রগাঢ় সুখ আস্বাদন করে, সম্ভবত তা আমার চেয়ে কম, কারণ ভালোবাসা আমাকে খুঁজতে এসেছিল এক অবিশ্বাস্য উপায়ে। 

ধনাঢ্য হওয়ার কারণে আমি খুঁজতাম প্রাচীন আসবাবপত্র ও পুরনো জিনিসপত্র; আর আমার মাঝে মাঝে মনে হতো কোনো অজানা সব হাত এই জিনিসগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখত, অজানা চোখেরা সেগুলোর তারিফ করত, অজানা হৃদয়েরা সেগুলো ভালোবাসত, কারণ আমরা তো সেসব ভালোবাসিই। আমি প্রায়ই গত শতাব্দীর একটি ছোট ঘড়ি দেখার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করতাম। ঘড়িটা ছিল খুবই মিষ্টি, খুবই সুন্দর, এনামেল ও খোদাই করা সোনা দিয়ে তৈরি। সে এসেছিল একদিন এক মেয়ের সঙ্গে, যে এই সুন্দর রত্ন কিনে, তাকে অধিকার করে উৎফুল্ল হয়েছিল।

ঘড়ি তার হৃদস্পন্দন বন্ধ করেনি, তার যান্ত্রিক জীবনকালে গত শতাব্দী থেকে আজ পর্যন্ত সে নিয়মিত টিকটিক শব্দে বেজেই চলছিল। কে প্রথম এটিকে বুকের উপর রেখেছিল কাপড়ের উষ্ণতায়, আর ঘড়ির হৃদয় বেজে চলছিল ওই নারীর হৃদয়ের বিপরীতে? কোন হাত তার উষ্ণ আঙুলের ডগা দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেটিকে দম দিয়েছে, যার ফলে চীনামাটির মেষপালক ওইভেজা চামড়ার ক্রমাগত সংস্পর্শে একদা বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে? কোন চোখ ওই ফুলেল ডায়ালের উপর রেখে চোরাচোখে কোন মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় থাকত, সেই কাক্সিক্ষত ঘণ্টার, স্বর্গীয় ঘণ্টার?

কতই না আমি জানতে চেয়েছি, দেখতে চেয়েছি তাকে, যে এই অত্যাশ্চর্য ও দুর্লভ বস্তুটিকে পছন্দ করেছিল। সে মৃত। আমি সেই অতীতকালের এক রমণীর ইচ্ছা দিয়ে আচ্ছন্ন হয়েছি। আমাকে এখন পর্যন্ত যারা ভালোবেসেছে, তাদের সবাইকে ভালোবেসেছি। অতীতকালের পুরনো কমনীয়তা আমার হৃদয়কে অনুশোচনায় পূর্ণ করে। আহ! সৌন্দর্য, স্মিতহাসি, নবীন সোহাগ, আকাঙ্ক্ষা! এ সবেরই কি অনন্তকালব্যাপী স্থায়ী হওয়া উচিত নয়!

কীভাবে আমি কেঁদেছিলাম সারারাত ধরে সেই পুরনো দিনের বেচারা রমণীদের উপর, যারা কতই না সুন্দর, কতই না কোমল, কতই না মিষ্টি ছিল, আর তাদের হাত প্রসারিত হয়েছিল তাকে চুম্বন করতে, আর তারা আজ মৃত। চুম্বন অমর। সে ঠোঁট থেকে আরেক ঠোঁটে, শতাব্দী থেকে আরেক শতাব্দীতে, যুগ থেকে যুগান্তরে যায়-পুরুষেরা তা সংগ্রহ করে, অপরকে প্রদান করে, মারা যায়।

অতীত আমাকে আকর্ষণ করে, বর্তমান আমাকে ভীত করে, কারণ ভবিষ্যৎ মৃত। আমি সবকিছুর জন্য অনুশোচনা করি যা হয়েছে, আমি বিলাপ করি তাদের জন্য যারা বেঁচেছিলেন, আমি সময়কে, ঘণ্টাকে থামাতে চাই। কিন্তু সে যায়, সে যায়, সে চলে যায়, সে আমাকে এক সেকেন্ড থেকে আরেক সেকেন্ডে নেয়, আমার একটুকুকে নেয় আগামীকালের শূন্যতার জন্য। 

গতকালকে বিদায়। আমি আপনাকে ভালোবাসি। 

কিন্তু আমি অভিযুক্ত নই। আমি তাকে খুঁজে পেয়েছি, নিজেই, যার জন্য আমি অপেক্ষমাণ ছিলাম, আর তার অবিশ্বাস্য আনন্দ আমাকে আস্বাদন করেছিল। 

আমি এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকালে প্যারিসের রাস্তা দিয়ে হনহনিয়ে হাঁটছিলাম, আমার আত্মা ছিল উৎসবমুখর, পায়ে ছিল স্ফূর্তি, দোকানগুলোর দিকে শূন্য আকাঙ্ক্ষা নিয়ে নিষ্কর্মা ভ্রমণবিলাসীর মতো তাকিয়ে দেখছিলাম। হঠাৎই চোখে পড়ল এক পুরাকীর্তি ব্যবসায়ীকে, সঙ্গে সপ্তদশ শতাব্দীর এক আসবাব। সেটি ছিল খুব সুন্দর, খুব দুর্লভ। আমি ধরতে পেরেছিলাম যে, সেটি ছিল ভেনেসীয় শিল্পী ভিতেলির কাজ; ওই জামানায় তিনি ছিলেন বিখ্যাত। 

তারপর আমি হাঁটতে লাগলাম।

তারপর কী হলো, ওই আসবাবের স্মৃতি আমাকে এত শক্তিশালীভাবে তাড়া করল, আমি আবার পিছিয়ে এলাম। আমি দোকানের সামনে আবার থামলাম সেটিকে দেখতে; আর আমি অনুভব করলাম সেটি আমাকে প্রলুব্ধ করেছে। 

কী এক অনন্য জিনিস এই প্রলোভন! তুমি এক বস্তুর দিকে তাকাও, আর একটু একটু করে সে তোমাকে প্রলুব্ধ করে, তোমাকে যন্ত্রণা দেয়, তোমাকে আক্রমণ করে, যেমন করে রমণীর মুখ। এর মোহনীয়তা তোমার ভেতর প্রবেশ করে, আর সে এক অদ্ভুত মোহনীয়তা, যা আসে তার আকৃতি, রঙ, বাহ্যিক অবয়ব থেকে। আমরা ইতোমধ্যে একে ভালোবেসেছি, আমরা তাকে চাই, তাকে চাই। পাবার প্রয়োজন তোমাকে জয় করে, প্রথমে তা হালকা প্রয়োজন, লাজুক, পরে তা বৃদ্ধি পায়, রূপ নেয় প্রবলের, দুর্দমনীয়ের। 

ব্যবসায়ী বোধহয় অনুমান করে নেয় দৃষ্টির আগুন, গোপন আর ক্রমবর্ধমান বাসনা থেকে। আমি ওই আসবাবটিকে কিনে নিয়ে সোজা বাড়ি চলে এলাম। সেটিকে রাখলাম আমার ঘরে। 

ওহ! আমি করুণা করি তাদের যারা সংগ্রাহকের সদ্য কেনা স্বল্প প্রয়োজনীয় রত্নের মূল্য বোঝে না। একে চোখ আর হাত দিয়ে সোহাগ করা হয়, এ যেন মাংস দিয়ে তৈরি; যে কোনো সময় এর কাছে ফেরা যায়, এর সম্পর্কে সবসময় ভাবা হয়, তা যেখানেই যাওয়া হোক না, যা-ই করা হোক। তার প্রিয় স্মৃতি আপনাকে তাড়া করবে রাস্তায়, পৃথিবীতে, সর্বত্র; আর যখন আপনি বাড়ি ফেরেন, আপনার টুপি ও দস্তানা খোলার আগে আপনি প্রেমিকের কোমলতা নিয়ে তার ধ্যানে মগ্ন হবেন। 

সত্যি বলতে, আমি আট দিন ধরে এই আসবাবটিকে ভালোবাসলাম। আমি প্রতিটি মুহূর্তে এর দরজাগুলোকে, দেরাজগুলোকে খুললাম; আমি এটিকে নিয়ে রত হলাম স্ফূর্তি সহকারে, একে পেয়ে আমি অধিকারের সব অন্তরঙ্গ আনন্দকে পরখ করলাম। 

সে যা হোক, এক সন্ধ্যায় একটি ফলকের পুরুত্ব অনুভব করে আমি বুঝতে পারলাম, সেখানে একটি গুপ্তস্থান আছে। আমার হৃদস্পন্দন শুরু হলো; আর সারারাত আমি অনুসন্ধান চালালাম এই রহস্যভেদ করতে, কিন্তু ব্যর্থ হলাম।

পরের দিন আমি একটি ব্লেড কাঠের কারুকাজের একটি খাঁজে ঢুকিয়ে দিলাম। একটি বোর্ড পিছলে নামল, আমি দেখলাম মখমলের পটভূমি পর্যন্ত প্রসারিত জায়গাটিতে কোনো নারীর অপূর্ব একগুচ্ছ চুল। 

হ্যাঁ, চুল, বেশ খানিকটা সোনালি চুল, প্রায় লাল, যা চামড়া ঘেঁষে কাটা হয়েছে, আর তা একটি সোনালি দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছে। 

আমি বিমূঢ়, কম্পমান, বিপদাপন্ন হয়ে রইলাম! এক ধরনের পুরনো অচেতন সুগন্ধি, যেন ঘ্রাণের আত্মা, ওই বিস্ময়কর অবশেষ রহস্যময় দেরাজ থেকে উড়ে এলো। 

আমি তাকে কোমলভাবে, প্রায় ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যতার সঙ্গে ওই গোপন জায়গা থেকে নিয়ে আসলাম। অনতিবিলম্বে সে কুণ্ডলীমুক্ত হলো, তার সোনালি প্রবাহ ভূমি স্পর্শ করল, ঘন ও হালকা, নমনীয় ও জ্বলন্ত ধূমকেতুর লেজের মতো তা বিভাময়। 

এক অদ্ভুত আবেগ আমাকে চেপে ধরল। কী এটা? কখন? কীভাবে? কেন এই কেশগুচ্ছ এই দেরাজে বন্দি হয়ে আছে? এই স্মৃতি কোন রোমাঞ্চ, কোন নাটককে লুকিয়ে রেখেছে?

কে একে কাটল? এক প্রেমিক, বিদায়লগ্নে? এক স্বামী, প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে? নাকি তিনি, যিনি এটিকে বহন করেছেন তার কপালে, তিনিই হতাশাগ্রস্ত হয়ে?

তা কি তখন ঘটল, ভাগ্যের এক ক্লস্টারের প্রবেশকালে, যখন প্রেমকে ভেতরে নিক্ষেপ করা হলো, যা ছিল পৃথিবীতে বাঁচার এক শর্ত? সে কি সেই মুহূর্তে ঘটল, যখন কবরে তার পেরেক ঠোকা হচ্ছিল, সেই তরুণী সুন্দরী নারীর, আর তা করছিল সেই, যে তাকে ভালোবাসত, যে তার মাথাকে অলঙ্কারাচ্ছাদিত করত, সেই সেটিকে সংরক্ষণ করেছিল, তার জীবন্ত শরীরের একমাত্র অংশ যেটি পচে যায় না, আর একমাত্র যেটিকে এখনো ভালোবাসা যায়, সোহাগ করা যায়, আর যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়েও চুমু দেওয়া যায়?

এ কি আশ্চর্যজনক নয় যে, এই চুল সেই আগের মতোই আছে যখন সেই শরীরের অস্তিত্ব আর নেই, যা থেকে তার জন্ম হয়েছিল?

সে আমার আঙুলের উপর দিয়ে গড়িয়েছে, আমার চামড়াকে একটি মাত্র পরশে আমোদিত করেছে, মৃত্যুর পরশ। আমি এত নরম হয়ে গেলাম যে প্রায় কেঁদে ফেললাম।

আমি অনেক অনেকক্ষণ ধরে তাকে মুঠোতে ধরেই রাখলাম। হঠাৎ অনুভব করলাম যে, সে আমার মুঠোতে নড়াচড়া করছে, যেন কোনো আত্মা তাতে লুকিয়ে আছে। আমি বিবর্ণ ওই মখমলে তাকে আবার ফিরিয়ে দিলাম, দেরাজটাও বন্ধ করে দিলাম, আর আসবাবটাকেও, আর তারপর বের হলাম রাস্তায় খোয়াব দেখতে। 

আমি নিজের সামনে দাঁড়ালাম এক বুক বেদনা নিয়ে, আর পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে, যে বিপর্যয় গেড়ে বসেছিল হৃদয়ে এক প্রেমচুম্বনের পর। আমার মনে হলো, আমি আগেও বেঁচেছিলাম, যখন এই নারীকে আমি অবশ্যই চিনতাম। 

আর ভিওঁ’র (২) পঙ্ক্তি ফোঁপানোর মতো করে আমার ঠোঁটে উঠে এলো:

বলো আমাকে কোথায় আছে সেই দেশ,

যেখানে পুষ্পদেবী (Flora) (৩)-সেই রোমীয় রূপসী,

আর্কিপিয়াদা (৪) বা থাইস (৫)। 

কে ছিল তার পিসতুতো ভাই,

ইকো (৬) কথারত থাকে, যখন কেউ করে হট্টগোল

নদী কিংবা পুকুরের ’পরে

কার আছে মানুষের চেয়েও বেশি সৌন্দর্য?

আর কোথায় গত বছরের সেই তুষারস্তূপ!

......................................................

শ্বেতরানি (৭) শাপলার মতোই,

যে কিন্নরীকণ্ঠে গান গেয়ে যায়;

বড় পায়ের পাতার রানি বার্থা (৮), বিয়াট্রিক্স (৯), এলিস (১০);

আর মাইন শাসনকারী এরেমবুর্গ (১১)

আর জোন (১২)-লরেনের সুকন্যা

যাকে ইংরেজরা রুঅঁ’তে পুড়িয়ে মারল:

কোথায় তারা, ও সার্বভৌম কুমারী (১৩)?

আর কোথায় গত বছরের সেই তুষারস্তূপ!

যখন আমি বাড়ি ফিরতাম, অনুভব করতাম এক অদম্য আকাক্সক্ষা আমার খুঁজে পাওয়া ওই অদ্ভুত জিনিসটি দেখতে। আমি তাকে আবার নিতাম, এবং তাকে অনুভব করতাম; আর যেইমাত্র তাকে স্পর্শ করতাম, এক দীর্ঘ শিহরণ আমার 

অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো বেয়ে নেমে যেত।

কিছুদিন আমি আমার স্বাভাবিক অবস্থাতেই ছিলাম, যদিও ওই কেশগুচ্ছের চিন্তা আমাকে এক মুহূর্তের জন্যও ছেড়ে যায়নি। 

যত শিগগিরই আমি বাড়ি ফিরতাম, আমাকে এটিকে স্ক্রু দিতে হতো, সেটির ব্যবস্থা আমাকে করতে হতো। আমি কাপবোর্ডে চাবি দিতাম, আর শিহরণ জাগত কেউ মাত্রই আমার প্রিয়তমার দরজা খুলেছিল; আর আমি আমার বিভ্রান্ত, একমাত্র, ক্রমাগত যৌনক্ষুধায় তাড়িত হাতগুলো ও হৃদয় সহকারে ওই মোহময়ী মৃত চুলের প্রবাহে আঙুল ডুবাতাম। 

যখনই আমার এই সোহাগের পালা শেষ হতো, আমি আসবাবের দরজা বন্ধ করতাম, আমার সর্বদাই মনে হতো, সে সেখানে আটকে আছে কোনো বন্দির মতোই; আমি তা অনুভব করতাম, তাকে আবার কামনা করতাম; আর প্রবলভাবে আক্রান্ত হতাম তাকে আবারো পাবার এক তাড়নায়; তাকে অনুভব করার জন্য, আর এই তীব্র শীতার্ত, পিচ্ছিল, বিরক্তিকর, পাগল করে দেওয়া পরিবেশ, যার কষ্ট আমাকে ক্রুদ্ধ করে, তার বাইরে থেকে হর্ষদায়ক স্পর্শ পাওয়ার জন্য। 

এইভাবে আমি এক কি দুমাস ছিলাম, তা আজ আমার মনে নেই। এটি আমাকে আচ্ছন্ন করল, তাড়িয়ে বেড়ালো। আমি আনন্দিত ও অত্যাচারিত দুই-ই হলাম; অপেক্ষারত ছিলাম ভালোবাসার জন্য, যে স্বীকারোক্তি আসে আলিঙ্গনের আগে।

আমি তাকে নিজের চামড়ায় অনুভব করতে, আমার ঠোঁট তাতে ডুবাতে, তাকে চুমু দিতে, তাকে কামড় দিতে নিজেকে একাকী আবদ্ধ করে ফেললাম। আমি সেটা দিয়ে আমার মুখটাকে মোড়াতাম, আমি তা পান করতাম, আমি সোনালি দিন দেখার তাড়নায় এর সোনালি প্রবাহে চোখ ডুবাতাম।

আমি তাকে ভালোবাসলাম! হ্যাঁ আমি তাকে ভালোবাসলাম। আমি তাকে ছাড়া থাকতে পারতাম না, এক মুহূর্তও কাটাতে পারতাম না তাকে না দেখে।

আর আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম, অপেক্ষা করতে 

থাকলাম ... কার জন্য? আমি জানতাম না। তার জন্য।

এক রাতে আমি হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠলাম এই অনুভূতি নিয়ে যে, আমি ঘরে একা নই। 

আমি অবশ্য ঘরে একাই থাকতাম। কিন্তু আর ঘুমাতে যেতে পারতাম না। আমি ইনসমনিয়া জ্বরে এতটাই প্রকম্পিত হতাম যে, আমি ওই চুল স্পর্শ করতে উঠে বসতাম। এটিকে আমার সচরাচর যে রকম লাগত তার চেয়ে আরও কোমল ও জীবন্ত মনে হতো। মৃতেরা কি ফিরে আসে? যে চুমু দিয়ে তাকে আমি উষ্ণ করতাম, তা আমাকে আনন্দে বেহুঁশ করে দিত। আর আমি তাকে বহন করে বিছানায় নিয়ে আসতাম, আমার পাশে শোয়াতাম, আমার ঠোঁট দিয়ে সজোরে চেপে ধরতাম, যেভাবে রক্ষিতাকে ধরা হয়। 

মৃতেরা ফিরে আসছে! সে ফিরে এলো। হ্যাঁ আমি তাকে দেখলাম, তাকে ধরলাম, তাকে গ্রহণ করলাম, সে যেন এককালে জীবিত ছিল, লম্বা, সোনালি চুলের অধিকারিণী, মোটা, সঙ্গে শীতল স্তন, লায়ারের আকৃতির নিতম্ব। আর আমি সোহাগের আতিশয্যে এই বাঁকগুলো ও স্বর্গীয় রেখাগুলো অতিক্রম করলাম গ্রীবা থেকে পা পর্যন্ত, সমস্ত মাংসের বাঁকগুলোতে গিয়ে। 

হ্যাঁ, আমি তাকে গ্রহণ করেছি প্রতিরাতে, প্রতিরাতে। সে ফিরে এসেছে, মৃতটা, সুন্দর মৃতটা, আরাধ্যা, রহস্যময়ী, অজ্ঞাতা, প্রতিরাতে।

আমার আনন্দ এত ব্যাপক হলো যে, আমি তা গোপন রাখতে পারলাম না। আমি তার নৈকট্যে এক অতিমানবীয় উল্লাস অনুভব করলাম, অধরাকে ধরবার গভীর অব্যাখ্যেয় আনন্দ, অদেখাকে দেখবার, মৃতটি! কোনো প্রেমিকই এর চেয়ে তীব্র, এর চেয়ে ভয়ানক উল্লাস পরখ করেনি। 

আমি জানতাম না, কীভাবে এই আনন্দকে গোপন করব। আমি তাকে এত ভালোবেসে ফেলেছিলাম যে, আমি তাকে ছাড়তে চাইলাম না। আমি সেটিকে সবসময়, সবজায়গায় সঙ্গে নিয়ে যেতাম। আমি শহরের রাস্তা দিয়ে আমার স্ত্রীর মতো তাকে সঙ্গে নিয়ে চলতাম, থিয়েটারের গ্রিল করা লজেও তাকে ঢুকাতাম, আমার রক্ষিতার মতোই... কিন্তু আমরা তাকে দেখলাম... আমরা অনুমান করলাম... এটিকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হলো... আর আমাকে কয়েদখানায় ছুড়ে ফেলা হলো কোনো অপরাধীর মতোই। তারা সেটাকে নিয়ে নিলো... আহ! দুভার্গ্য! ...

*

পাণ্ডুলিপি এখানেই শেষ। আর হঠাৎই গারদের ভেতর থেকে এক ভীষণ চিৎকারে, অসহায় এক ভয়ার্তের আর্তনাদে ও প্রবল কামনার উল্লম্ফনে ডাক্তারকে ভীত দেখলাম।

- শুনুন তাকে, ডাক্তার বললেন। এই জঘন্য পাগলকে অবশ্যই দিনে পাঁচবার গোসল করানো হবে। শুধু সার্জেন্ট বেরট্রঁই মৃতের প্রতি আসক্ত ছিলেন না।

আমি তোতলাতে লাগলাম, বিস্ময়, ভয় ও করুণায় শিহরিত হলাম :

- কিন্তু এই কেশের কি সত্যি অস্তিত্ব আছে?

ডাক্তার উঠলেন, কাচের জিনিসপত্র ও যন্ত্রপাতিতে বোঝাই একটি কাপবোর্ড খুললেন, জ্বলজ্বল করা একগুচ্ছ সোনালি চুল আমার দিকে ছুড়ে দিলেন, যা আমার দিকে একটি সোনালি পাখির মতো উড়ে এলো।

আমি আতঙ্কিত হলাম যেন আমার হাত দুটির উপর তার আদর ও মৃদু স্পর্শ অনুভব করলাম। আর আমি আমার হৃৎপিণ্ডের শব্দের মধ্যে ঘৃণা ও ঈর্ষা নিয়ে বসে রইলাম, সেই ঘৃণা নিয়ে যার কারণ কোনো বস্তু যা মানুষকে অপরাধে টেনে নেয়, সেই ঈর্ষা যা কাজ করে কোনো কুখ্যাত ও রহস্যময় জিনিসের প্রতি প্রলুব্ধ হতে।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে ডাক্তার বলে চললেন:

মানব মনের পক্ষে সবই সম্ভব। 

অনুবাদকের টীকা

১. নেক্রোফিলিয়া বা শবরথী হচ্ছে সেই যৌন বিকৃতি, যার ফলে বিকারগ্রস্ত ব্যক্তি শবদেহের সঙ্গে যৌনমিলনে আনন্দ পায়। 

২. ফ্রসোয়া ভিওঁ (François Villon, আনুমানিক ১৪৩১-১৪৬৩-এর পর) মধ্যযুগের শেষবেলার সবচেয়ে বিখ্যাত ফরাসি কবি। তবে তিনি অপরাধপ্রবণ ছিলেন বলে জানা যায়, যে কারণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে তার কয়েক দফা মোকাবিলা হয়েছে। তার কবিতাতেও তার প্রকাশ ঘটেছে। লো গ্রঁন টেস্টামোঁ (Le grand testament) দুই খণ্ডে প্রকাশিত তার কবিতার সংকলন। তার কবিতাতে মধ্যযুগের ইউরোপের সমাজ, ধর্ম ও ইতিহাসের প্রতি বিদ্রুপ ও ব্যঙ্গাত্মক রসের প্রকাশ দেখা যায়।

৩. এই পুষ্পদেবী বা Flora হচ্ছেন রোমক পুষ্পদেবী।

৪. আর্কিপিয়াদা বা আলকিবিয়াদিস (Alcibiades, খ্রি.পূ. আনুমানিক ৪৫০-৪০৪) ছিলেন একজন বিখ্যাত এথেনীয় রাষ্ট্রনায়ক, বক্তা ও সমরনায়ক। 

৫. থাইস ছিলেন গ্রিসের এক বিখ্যাত গণিকা বা Hetaira, যিনি আলেকজান্ডার দি গ্রেটের অভিযানসঙ্গী হতেন। 

৬. ইকোস বা ইকো (Echo) গ্রিক পুরাণে বর্ণিত একজন অরিয়াস (Ὀρειάς) বা অরিয়াড (Oread) অর্থাৎ পর্বত-অপ্সরা (mountain nymph) বিশেষ। তিনি দেবরাজ জিউসের প্রেমে পড়লে দেবরানী হেরা তাকে অভিশাপ দেন যে, তিনি কেবল তাকে বলা বাক্যের শেষ অংশটুকু বলতে পারবেন। এখান থেকে ইংরেজি ইকো বা প্রতিধ্বনি শব্দটি এসেছে। 

৭. ব্লাঙ্কা দে কাসটিয়া (Blanca de Castilla, ১১৮৮-১২৫২) স্পেনের এক অভিজাত নারী, জন্ম পালেন্সিয়াতে (Palencia)। ইনি অষ্টম লুইকে বিয়ে করে ফ্রান্সের রানী হন। ফরাসিতে তাকে ডাকা হয় ব্লঁশ দো কাসতিই (Blanche de Castille) নামে।

৮. বার্থা (Bertha ev Bertradade Laon ev Berthe de Laon, ৭২০-৭৮৩) ছিলেন একজন ফ্রাঙ্কীয় রানী। তিনি রাজা পিপিন ডের য়্যুঙ্গেরের (Pippin der Jüngere) রানী ছিলেন।

৯. বিয়াট্রিস পোর্টিনারি (Beatrice `Bice' di Folco Portinari, ১২৬৫-১২৯০) ছিলেন এক ইতালীয় নারী, যিনি ছিলেন কবি দান্তের ‘লা ভিটা নুওভা’ (La Vita Nuova) সৃষ্টির অনুপ্রেরণা। 

১০. এলিস (Adélaïde of Paris ev Aélis, ৮৫০/৮৫৩-৯০১) ছিলেন একজন ফ্রাঙ্কীয় রানী, যিনি ছিলেন রাজা লুই লো বেগের (Louis le Bègue) দ্বিতীয় স্ত্রী। 

১১. এরেমবুর্গ ছিলেন মাইনের একজন কাউন্টেস। জানা যায়, তার মৃত্যু হয় ১১২৬ সালে।

১২. জোন দার্ক (Jeanne d`Arc বা ইংরেজিতে Joan of Arc, আনুমানিক ১৪১২-১৪৩১) ফরাসি বীর নারী এবং ফ্রান্সের রক্ষাকর্ত্রী সাধ্বী (patron saint) হিসেবে খ্যাত। ইংরেজ ও ফ্রান্সের মধ্যে পরিচালিত শতবর্ষের যুদ্ধে তিনি প্রবল বিক্রম দেখান। ইংরেজদের হাতে ধরা পড়লে তাকে তারা পুড়িয়ে হত্যা করেন।

১৩. সার্বভৌম কুমারী বলতে কবি এখানে যিশুখ্রিষ্টের মাতা মেরীকে বোঝাচ্ছেন, যিনি ক্যাথলিক খ্রিষ্টধর্মে প্রবল পরাক্রমশালী এবং যিশুকে পাবার প্রধানতম মাধ্যম। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //