ভুলোমনা লেখকরা

এক সন্ধ্যায় প্রিন্সটনের ডিরেক্টরের বাড়িতে ফোন করে এক লোক আইনস্টাইনের বাড়ির নম্বর জানতে চাইলেন। আইনস্টাইনের বাড়ির নম্বর কাউকে জানানো যাবে না বলে ফোনটা নামিয়ে রাখলেন ডিরেক্টর। খানিক পরে আবার ফোন। ওপাশ থেকে শোনা গেল, ‘আমি আইনস্টাইন বলছি। বাড়ির নম্বর ও রাস্তা দুটোই ভুলে গেছি। দয়া করে যদি একটু বলে দেন।’ 

ভুলোমনা আইনস্টাইনের এই গল্প কে না জানে। আপেক্ষিক তত্ত্বের জনক বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানী কখনো বাড়ির নম্বর, কখনো বাসের টিকিট হারিয়ে বসতেন। এমনকি মেয়েকে বিয়ে দিতে চার্চে নেওয়ার সময় ৩০ মিনিটের জন্য আসছি বলে ৭ দিনের জন্য হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন। কী এমন হতো যে, অমন জ্ঞানী লোকটি বাড়িঘরের নম্বর ভুলে যেতেন? তবে কি তিনি স্মৃতিভ্রংশ রোগ বা ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন? 

স্মৃতি মাঝেমধ্যে বিশ্বাসঘাতকতা করে বটে। নিত্যকার ঘটনাগুলো আমরা প্রায় ভুলে যাই। স্মৃতির ওপর স্মৃতি এসে জমা হয়। পুরোনো স্মৃতি চাপা পড়ে নতুন স্মৃতির তলায়। খুব বড় ঘটনা ছাড়া দৈনন্দিনের স্মৃতি মুছে যেতে সময় লাগে না। বিজ্ঞান-গণিত নিয়ে এত আবেশ হয়ে থাকতেন বলেই হয়তো আইনস্টাইনের সংসার জীবনের সাধারণ জ্ঞান লোপ পেত। 

তবে বেশ কয়েকবার বাড়ির নম্বর হারানো চিন্তার বটে। ঘরে তালা দেওয়ার পরও বারবার পরীক্ষা করার বাতিক যেমন অনেকের থাকে তেমনি তালা না দিয়ে দিব্যি চিন্তাহীন ঘুরে বেড়ানোর লোকও জগৎ সংসারে কম নেই। দুটোই মানসিক রোগ বটে। স্কিৎজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ। অবশ্য আইনস্টাইন ছোটবেলা থেকে তো একটু ব্যতিক্রম। 

ইতিবাচক হোক বা নেতিবাচক অর্থে ‘ভুলোমনা’ শব্দটি বেশ যায় লেখকদের সঙ্গে। সংসারের নিত্যদিনের তেল-নুনের সংকট ভুলে লেখালেখি নিয়ে সারাদিন কী ছাইপাঁশ ভাবেন, একমাত্র তিনিই জানেন। 

কবিতায় কোন শব্দটি যথাযথ বসেনি বা সন্ধ্যায় অন্ধকার নামার দৃশ্য দেখতে দেখতে দোকানে পেঁয়াজ কিনতে গিয়ে সিগারেট নিয়ে ফেরত আসা কবির সঙ্গে গিন্নির দ্বন্দ্ব যে লাগবে তা তো স্বাভাবিক। এ ভুলোমনা স্বভাব বিখ্যাত ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেন আরও বেশি। ভিক্তর হুগোর কথাই ধরুন। এই বিখ্যাত ফরাসি লেখক একবার ট্রেন থেকে নেমে দেখেন চারদিকে উৎসবের আমেজ। লোকজন হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে অপেক্ষারত।

হুগো মনে করলেন, বিখ্যাত কারও জন্য হয়তো অপেক্ষা করছে সবাই। তিনি ভিড় এড়ানোর জন্য উল্টোদিকে নেমে স্টেশনের বাইরে চলে এলেন। এমন সময় দুই-তিনজন তাঁকে দেখে হৈহৈ করে এগিয়ে এসে বললেন, ‘আপনি এখানে! আর আমরা সবাই আপনার অপেক্ষা করছি।’ হুগোর তখন মনে পড়ে গেল এখানে এক সাহিত্যসভায় বক্তৃতা দিতে এসেছেন তিনি। তাঁর জন্যই সবার এত অপেক্ষা। বুঝুন অবস্থা! 

লেখকদের এমন ভুলোমনা গল্পের আরও দুয়েকখানা উদাহরণ দেওয়া যাবে দিব্যি। তবে কেবল কি লেখক, সাধারণ মানুষও মাঝেমধ্যে স্মৃতি প্রতারণার শিকার হন। প্রতিদিনের চেনা গলিও একদিন হুট করে অচেনা লাগতে পারে। দীর্ঘদিনের সহকর্মীর নামটি কয়েক দিনের ব্যবধানে ভুলে যেতে পারেন। 

বয়সকালে স্মৃতিবিভ্রমের শিকার হয়নি এমন কাউকে পাওয়া যাবে না বললেই চলে। সৃষ্টিশীল মানুষদের ক্ষেত্রে এ যেন এক পরিচিত রোগ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এর থেকে রেহাই পাননি। প্রমাণস্বরূপ কবি বিনয় মজুমদারের ‘আত্মপরিচয়’ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যাক, “রবীন্দ্রনাথ তাঁর একখানি বইয়ের জন্য কবিতা বাছাই ক’রে দিয়েছেন-সঙ্কলনগ্রন্থখানি ছাপাও হয়ে গেছে। তার পরে রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটারি বই হাতে রবীন্দ্রনাথকে বললেন, ‘গুরুদেব, আপনার বইতে এই যে-কবিতাটি ছেপেছেন এটা আসলে প্রিয়ম্বদা দেবীর লেখা কবিতা।’ রবীন্দ্রনাথ বললেন, প্রিয়ম্বদার কবিতা আমার কবিতা বলে ছেপেছি বলছো। তবে কবিতাটি বাদ দিয়ে আবার বই ছাপো।”

বিনয়ের যে কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই ঘটনার অবতারণা, তার কারণ তিনি নিজেও এই ভুলখানি করেছিলেন। কৌরব পত্রিকার সম্পাদক কমল চক্রবর্তী বিনয়কে অনুরোধ করেছিলেন নিজের লেখা গোটাকয়েক গান পাঠাতে। বিনয় গান পাঠিয়েছিলেন বটে। তবে তা রবীন্দ্রনাথের লেখা। পরে কমল চক্রবর্তী বিষয়টি জানান উনাকে। বিনয়ও বেশ পাগলাটে স্বভাবের কবি ছিলেন। করেন কী, ‘রবীন্দ্র বিনয় সংগীত’ নামে গোটা কয়েক গানই লিখে ছাপিয়ে নেন। এক্ষেত্রে তো উনার ভরসা রবীন্দ্রনাথ। ‘আত্মপরিচয়’ দিতে গিয়ে এসব কথা বেশ অকপটে জানিয়েছিলেন উনি। 

বন্ধুবর কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়েও বেশ মজার তথ্য দিয়েছেন বিনয়। ফের তাঁর ‘আত্মপরিচয়’ থেকেই উদ্ধৃতি দেওয়া যাক, “মারা যাবার আগে শক্তি শেষ যে-কবিতাটি লিখেছিল তাতে জীবনানন্দের ‘সুরঞ্জনা, ওইখানে যেও নাকো তুমি’ কবিতার পঙ্ক্তি রয়েছে। অর্থাৎ শক্তি ভেবেছিল যে জীবনানন্দের কবিতা আসলে শক্তিরই লেখা। ‘কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে! এইসব বাক্য শক্তির লেখা ব’লেই শক্তি ভেবেছিল। আমার দশাও তথৈবচ।”

আমাদের মতো সাধারণ লেখক হলে হয়তো শক্তি ও বিনয়কে প্লেজিয়ারিজম বা কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হতো। কথায় আছে, বড় লেখক চুরি করেন আর ছোট লেখক নকল করেন। এই নয় যে, লেখা চোরদের পক্ষে সাফাই গাচ্ছি। প্রসঙ্গক্রমে এসব বলা। অবশ্য সাহিত্যে চুরির তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। সে কথা আরেক দিন। স্মৃতিবিভ্রমের দিকে মন ফেরানো যাক।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচ্যুড’ উপন্যাসে দেখা যায়, মাকোন্দো গ্রামের পত্তনের পর উরসুলা ছাড়া  বুয়েন্দিয়া পরিবার কীভাবে অনিদ্রা, প্রেমহীনতা, স্মৃতিলোপ ও নিঃসঙ্গতায় ধীরে ধীরে শেষ পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াদের অবস্থা এমন দাঁড়ায়, প্রতিটি বস্তুর নাম কাগজে লিখে রাখতে হতো, যাতে বুঝতে পারেন। 

বড় ধরনের আঘাত পেলে স্মৃতিবিভ্রম হতে পারে। তবে অত্যধিক মানসিক চাপও এই রোগের অন্যতম কারণ। দুরারোগ্য পিক্স ডিজিজে আক্রান্ত হয়ে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম অল্প বয়সে কণ্ঠস্বর ও স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। এই রোগ ডিমেনশিয়া বা আলঝেইমারের খুব কাছাকাছি। আলঝেইমারের কথা যখন এলো, এ বিষয়ে একটু বলতে হয়। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান নভেম্বরকে ‘আলঝেইমার সচেতনতা মাস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। পরে তিনি নিজেই এই রোগে আক্রান্ত হন। ১০ বছর আলঝেইমারে ভুগে মারা যান তিনি।

অবশ্য এখনো আলঝেইমার সচেতনতা মাসের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। কেবল রিগ্যান নয়, এই রোগে অনেক বড় বড় সেলিব্রিটি আক্রান্ত হয়েছেন। বিখ্যাত অভিনেতা রবিন উইলিয়ামস, জেমস স্টুয়ার্ট, এডি আলবার্ট, চার্লস ব্রনসন, রিটা হেয়অর্থ, গায়ক গেøন ক্যাম্পবেল, পেরি কোমো, লেখক অ্যারন কপল্যান্ড, জেমস ডুহান, নরম্যান রকওয়েল, ই.বি. হোয়াইটতালিকাটা বেশ দীর্ঘ। 

ধন-সম্পদ যতই থাকুক না কেন, স্মৃতিই মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ। সে স্মৃতি মানুষ নিজে কিছু অর্জন করে এবং কিছু পায় উত্তরাধিকার সূত্রে। প্রাচীনকালে যখন লেখার উপকরণ ছিল না, মানুষ সমস্ত জ্ঞানভাণ্ডার ধারাবাহিকভাবে সংরক্ষণ করে রাখতেন স্মৃতিতে। তাদের বলা হতো স্মৃতিধর। আজকের দুনিয়ায় অবশ্য এত কষ্ট করতে হয় না। কম্পিউটার সবকিছু গুছিয়ে রাখছে। কিংবা মোবাইল থেকে গুগলে ঢুকলেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে সব তথ্য। অত্যধিক প্রযুক্তি নির্ভরতার কারণে বাড়ছে ‘গোল্ডফিশ মেমোরি’র মানুষের সংখ্যাও। 

যদি কখনো আপনার জন্য সব দ্বার বন্ধ হয়ে যায় তখনো স্মৃতিতে দেখা আকাশ ঠিকই আপনাকে প্রাণশক্তি জোগাবে। এক্ষেত্রে আমরা স্মরণ নিতে পারি কবি রাইনের মারিয়া রিলকের। তাঁর ‘দ্যুয়িনো এলিজি’ ছাড়াও বিখ্যাত হয়ে আছে ‘তরুণ কবির প্রতি চিঠি’ নামের বইখানি। এক তরুণ কবির সঙ্গে বেশ কয়েকটি পত্র দেওয়া নেওয়া হয়েছিল তাঁর। এক চিঠিতে রিলকে লেখেন, ‘এমনকি আপনি যদি কোনো কারাগারেও থাকেন যার দেয়াল জগতের কোনো শব্দকেই ঢুকতে দেয় না তখনো কি আপনার কাছে আপনার শৈশব নেই, সেই অমূল্য হীরা, আর স্মৃতির সেই রত্নভাণ্ডার? তাঁর প্রতি মনোযোগ দিন। অগাধ অতীতের ভেতর ডুবন্ত অনুভ‚তিগুলোকে জাগানোর চেষ্টা করুন।’ অনেক লেখক বয়স বাড়ায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু লেখা থামাননি। স্মৃতি থেকে তুলে আনতেন মণি-মুক্তোর ন্যায় উজ্জ্বল অক্ষর। হয়তো তার জন্য অন্যের সাহায্যের দরকার পড়েছে। তবে একেবারে অচল হয়ে যাননি। 

অতীতের স্মৃতি আদতে মুছে যায় না। যে কোনো সময় তা মনে পড়তে পারে। লাইব্রেরির তাকে রাখা বইগুলোর মতো স্মৃতি সংরক্ষণ করে রাখে আমাদের মগজ। তবে যত্ন না নিলে বইয়ের গায়ে যেমন ধুলো জমে তেমনি স্মৃতিতে ধরে শ্যাওলা। তখন অনেক পুরোনো স্মৃতি হাতড়িয়ে খুঁজে পাওয়া মুশকিলের ঠেকে। আর একটু বয়স বাড়লে স্মৃতিও প্রতারণা করতে শুরু করে। মাথা চুলকেও দেখবেন, সঠিক শব্দটি বলতে পারছেন না। তখন যদি অন্যের লেখাকে নিজের লেখা মনে হয়, বিনয় মজুমদারের মতো আমাদেরও ভরসাস্থল হতে পারেন রবীন্দ্রনাথ। 

স্মৃতি হারিয়ে ফেলা বা হারানো স্মৃতি ফিরে পাওয়া বিষয়ে সাহিত্যে-চলচ্চিত্রে অনেক কাজ হয়েছে। স্মৃতিহীনের অতীত বা ভবিষ্যৎ বলতে কিছুই থাকে না। বর্তমানটাও হয়ে দাঁড়ায় নিরর্থ। ডিমেনশিয়া সাধারণ রোগ নয়। বারবার স্মৃতিভ্রমের শিকার হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। কবে কোথায় জানি পড়েছিলাম, ফুলের ঘ্রাণে স্মৃতিশক্তি বাড়ে।

তবে যাদের জীবন খুব খারাপ স্মৃতিতে ভরপুর তাদের উচিত জীবনের সুন্দর দিকগুলোর দিকে তাকানো। সুন্দর স্মৃতি বারবার রোমন্থন করা। যে দুঃসহ স্মৃতি তিনি পেয়েছেন তা যেন অন্যকে উপহার হিসেবে না দেন। আমাদের ‘গোল্ডফিশ মেমোরি’ নিত্যদিনের ঘটনা মনে রাখে না ঠিকই। তবে খারাপ স্মৃতিগুলো যত্ন করে সাজিয়ে রাখে। আর সুন্দর স্মৃতিগুলো আমাদের দেয় বেঁচে থাকার প্রেরণা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //