রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটকে পরিবেশভাবনা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছেলেবেলায় প্রথমে জোর করেই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন; কিন্তু পরে তাকে স্কুলে পাঠানো মুশকিল হয়ে গিয়েছিল। তাঁর জীবনস্মৃতিতে সেই সময়কার অসহায় মুহূর্তের বর্ণনা পাওয়া যায়। যেন আনন্দহীন, প্রশান্তিহীন, খোলা প্রান্তরহীন এক বদ্ধ জীবন ছিল সেকালে কলকাতার। সে কারণে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে গড়ে তুলেছিলেন পরিবেশবান্ধব এক পাঠদান প্রক্রিয়া।

প্রকৃতির সাথে, ঋতুব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত না থাকলে মানুষের শিক্ষা পরিপূর্ণ শিক্ষা হয়ে উঠতে পারে না বলে তাঁর মত। শান্তিনিকেতনে একে একে মঞ্চস্থ করতে থাকলেন তাঁর বিখ্যাত ঋতুভিত্তিক নাটকগুলো। ঋতু পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা তৈরি ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিবেশ অনুভবের সূত্রগুলো উন্মোচিত করা ছিল রবীন্দ্রনাথের লক্ষ্য। বসন্ত থেকে বর্ষা এমনকি শীত ঋতু নিয়েও রবীন্দ্রনাথ নিশ্চুপ থাকেননি। সরাসরি পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা এসব নাটকে না থাকলেও নাটকগুলো বিশেষ ঋতুর রূপ, রস ও বৈচিত্র্য নিয়ে এমনভাবে উপস্থাপিত হয়েছে যে তা যে কোনো পরিবেশভাবুক মানুষের মনকে নাড়া দিতে সক্ষম। শারোদৎসব, ফাল্গুনী, বসন্ত, শেষ বর্ষণ, শ্রাবণগাথা এসব নাটকে রবীন্দ্রনাথ ঋতুপরিক্রমার প্রাকৃতিক সুরকে ধরতে চেয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে নিবিড় মায়ায় ধরতে চেয়েছেন তাঁর ঋতুনাট্যগুলোতে। ফলে পরিবেশভাবনা ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় উদ্বুদ্ধকরণে এই নাটকগুলো উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে আছে।

ডাকঘর (১৯১২) নাটকের প্রধান চরিত্র অমল। নাম যার অমল সে বিষণ্ণতায় ভরা, বিষাদ যেন তার চারপাশকে গ্রাস করে রেখেছে। শিশুর সারল্য আর উচ্ছলতা হারিয়ে গেছে ঘরের মধ্যে আটকা পড়ে। নাটকে কবিরাজ ও মাধব দত্ত একদিকে, অন্যদিকে ঠাকুরদা। ঠাকুরদা অমলকে বন্দি দশা থেকে মুক্ত করে প্রকৃতির মাঝে উন্মুক্ত করতে চান। অন্যদিকে অসুখ সারানোর নামে মাধব দত্ত ও কবিরাজ তার ঘরের সকল দরজা, জানালা বন্ধ করে রাখে। যে শিশুটি নাটকের শুরুতে জানালার ধারে বসে বসে বহু লোকের যাওয়া আসা দেখতে পায় সেই ছেলেটি নাটকের শেষ পর্যায়ে গিয়ে বসে থাকার শক্তিও হারিয়ে ফেলে। যদিও ঠাকুরদার আগমনে কল্পনাপ্রবণ শিশুমন প্রকৃতির মাঝে বিচরণ করতে থাকে। কখনো পাহাড়ে আবার কখনো ক্রৌঞ্চদ্বীপে। মুক্তির এই কল্পনাই খানিকটা সুস্থ করে তোলে অমলকে। অমলের বন্ধুত্ব অজানা দইওয়ালার সাথে। একজন শিশু আসলে চায় মুক্ত পরিবেশ। তাই অমল মনে করে পাঁচমুড়া পাহাড়ের তলায় শামলী নদীর ধারে বুড়ো বটগাছের তলা দিয়ে অমল দই বিক্রি করে বেড়াবে। অমল পণ্ডিত হতে চায় না। কেবল দেশ-বিদেশ সে ঘুরে বেড়াবে। কাকা মাধব দত্তের মতো শুষ্ক হিসেবি মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে চায় না। অমল শুধু দইওয়ালার সাথেই সখ্য গড়ে তোলে না বরং না-মানুষী জীবনকে সে নিজের করে ভাবতে চায়। পিসিমার যাঁতার কাছে কুটুস কুটুস করে কাঠবিড়ালির খাওয়া দেখে অমল কাঠবিড়ালি হতে চায়। সকল প্রাণীর আনন্দিত সত্তা অমল অনুভব করে। 

মুক্তধারা নাটকটি প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে। তত দিনে আমেরিকার কলোরাডো নদীতে হোমার ড্যাম নির্মাণের ধারণাও আসেনি মানুষের মাথায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন বাঁধ নির্মাণের ভয়াবহতা। আজকের ভারতে ছোট বড়ো দুহাজার বাঁধ দেখে রবীন্দ্রনাথ কী ভাবতেন তা আমরা সহজইে অনুধাবন করতে পারি। মুক্তধারা নাটকটিতে যদিও প্রাধান্য পেয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রসমূহের উগ্র আগ্রাসনের কথা। কিন্তু এর বাইরেও এই নাটকে নদীর গতিপথ ও বাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত পরিবেশগত সংকট গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়েছে। 

উত্তরকূট ও শিবতরাই এই দুটি রাজ্য নিয়ে মুক্তধারানাটকের ঘটনাপঞ্জি সংগঠিত হয়েছে। উত্তরকূটের রাজা রণজিৎ সর্বদা শিবতরাই রাজ্যকে নিজের সবক্ষেত্রে নিজের অধীনে রাখতে চান। যদিও শিবতরাই রাজা রণজিতেরই অধীন কিন্তু সেখানকার জনগণ সর্বদা রাজার নির্দেশ মান্য করে না। যে কারণে যুবরাজ অভিজিৎকে শিবতরাইয়ের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয় কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী রাজার শাসন ও শোষণ অভিজিৎ প্রজাদের ওপর করতে নারাজ। অভিজিৎ দীর্ঘদিনের পথের জট খুলে দেয়। যে নন্দিসংকটের রাস্তা পিতামহদের আমল থেকে শিবতরাইয়ের লোকের জন্য বন্ধ সে সেটি খুলে দেয়। এই পথে শিবতরাইয়ের লোকজন নিজেদের বাঁচার পথ খুঁজে পাবে। কিন্তু রাজা রণজিৎ একে ভালো চোখে দেখে না। কেননা রণজিৎ চায় পররাজ্য শোষণ করতে, ভয় দেখিয়ে, সংকট দেখিয়ে শিবতরাইয়ের লোকদের বশে রাখতে, অভিজিৎ চায় ঠিক উল্টো। 

নাটকে যন্ত্ররাজ বিভূতি মুক্তধারার ঝরনাকে বিশাল লৌহযন্ত্র দিয়ে বেঁধেছে। সকলে তার এই কীর্তিকে অসামান্য বলে আখ্যা দিচ্ছে। অন্যদিকে বিভূতির যন্ত্রকে কেউ কেউ মস্ত বড়ো লোহার ফড়িং বলছে। যে ফড়িংয়ের ঠ্যাং জল আটকে রেখেছে। আবার কুন্দনের চোখে বাঁধ ‘ভূতের মতো’, কখনো ‘যেন বিরাট চীৎকারের মতো’। দানবীয় বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ একে পরিবেশ ক্ষতির প্রতীক হিসেবে দেখছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রক্তকরবী নাটকটি ১৯২৬ সালে প্রকাশ পায়। যদিও এটি প্রথম দিকে ‘যক্ষপুরী’ এবং তারও পরে ‘নন্দিনী’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ রক্তকরবী নামে নাটকটি প্রকাশ করেন। পরিবেশ ভাবনায় ঋদ্ধ একটি নাটক রক্তকরবী। মানুষের দুর্নিবার লোভ ও প্রকৃতির বুক চিড়ে তুলে আনা সম্পদের অন্ধ মোহ কোন ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে আমাদের ধাবিত করছে রবীন্দ্রনাথ সেকথাই এই নাটকে বলেছেন। প্রকৃতির শ্যামল-ছায়া, ভূপৃষ্ঠের উপরিতলে সবুজের সমারোহ, ফুলের বিচিত্র রঙ ও রসকে পাশ কাটিয়ে মানুষ আজ কুবেরের ন্যায় ধন-সম্পদের পিছনে ছুটে চলছে। রক্তকরবীতে রবীন্দ্রনাথ এর নাম দিয়েছেন যক্ষপুরী। নাট্যপরিচয় অংশে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলছেন এই যক্ষপুরীর রাজা কুবেরের নাম নিয়ে সংশয় আছে। এর একটি ডাকনাম-মকররাজ। লক্ষ্মীর ধনের ন্যায় কুবেরের ধন মানবকল্যাণমুখী নয়। শুধু নিজের জন্য অর্জন আর সে অর্জন করতে গিয়ে প্রকৃতি-পরিবেশের যা ক্ষতিসাধন হোক কুবেরের তাতে কিছু আসে যায় না। মানুষের ক্ষতির কথা চিন্তা না করে সাময়িক লাভের আশায় বিজ্ঞানকে মানব সভ্যতার বিপরীতে প্রয়োগের ধারণাকে রবীন্দ্রনাথ মেনে নিতে পারেননি। যার কারণে রক্তকরবী নাটকের রাজা ও রাজার সর্দার, মোড়ল এদেরকে তিনি যন্ত্রদাস করে এঁকেছেন। 

এই শোষণভিত্তিক সম্প্রসারণবাদী রাজার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে আসে নন্দিনী। মকররাজের যে বেড়াজাল সেই বেড়াজালকে ছিন্ন করতে চায় নন্দিনী। রক্তকরবী নাটকের শ্রমিকদল মাটির তলা থেকে সোনা তুলে আনে তারা জানে না মাটির উপরিতলে প্রকৃতির কী অপরূপ খেলা চলছে! নাটকের শুরুতে কিশোর ও নন্দিনীর সংলাপে প্রকৃতি পরিবেশের সাথে লোভাতুর ধনবাদী সভ্যতার বিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সোনার বিপরীতে রক্তকরবী ফুল যেন আদরণীয় হয়ে উঠেছে। কিশোর প্রতিদিন নন্দিনীকে একটি ফুল এনে দিতে চায়। কেননা সারাদিন কেবল সোনার খনিতে কাজের ফাঁকে একটু সময় করে ফুল আনতে কিশোরের ভালো লাগে।

পরিবেশ ভাবনার অন্যতম কথা হলো প্রকৃতির সাথে বাঁচতে শেখা। প্রকৃতিকে সাথে নিয়ে যথাসম্ভব প্রকৃতির ওপর অত্যাচার না করে বাঁচা। সেই প্রকৃতিবান্ধব চরম কথাটি রবীন্দ্রনাথ নন্দিনীর মুখ দিয়ে বলান-‘নন্দিনী। পৃথিবী আপনার প্রাণের জিনিস আপনি খুশি হয়ে দেয়। কিন্তু যখন তার বুক চিরে মরা হাড়গুলোকে ঐশ্বর্য ব’লে ছিনিয়ে নিয়ে আস তখন অন্ধকার থেকে একটা কানা রাক্ষসের অভিসম্পাত নিয়ে আস। দেখছ না, এখানে সবাই যেন কেমন রেগে আছে, কিংবা সন্দেহ করছে, কিংবা ভয় পাচ্ছে?’

রবীন্দ্রনাথ শুধু গল্পে বা নাটকে তাঁর পরিবেশ ভাবনার স্বাক্ষর রাখেননি বরং তাঁর প্রবন্ধগুলো পরিবেশ চিন্তা দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত। রবীন্দ্রনাথ যখন লিখছেন সেসময় পরিবেশবাদী আন্দোলন, ভাবনা বা পরিবেশ বিপর্যয়ের পরিণতি সম্পর্কে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে আলোড়ন ওঠেনি। কবির অন্তরদৃষ্টি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন আমাদের পৃথিবী নামক গ্রহের পরিবেশ সমস্যা। অনেক ক্ষেত্রে তিনি নির্ভর করেছেন পুরনো অভিজ্ঞ কৃষকদের ওপর। 

শিলাইদহে থাকাকালে একসময় কৃষিবিভাগের উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথ আলুচাষের মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। যেখানে কৃষিবিভাগের মতে একশো মণ সার দরকার সেখানে অভিজ্ঞ কৃষকরা তাকে স্বল্প খরচে সমান আলু উৎপাদন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। এই রবীন্দ্রনাথ আমাদের আজও ভাবায়, ভবিষ্যতে আরও ভাবাবে। যেভাবে পুরাণ রচয়িতা কবিদের রচনা আমাদের নিত্যনতুন জ্ঞানের মুখোমুখি দাঁড় করায় তেমনি রবীন্দ্রনাথের রচনা আমাদেরকে নতুন জগতের সন্ধান দেয়।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //