সরদার শামসুল ইসলাম: শিল্পিত প্রকাশ

ছেলেবেলা থেকে নানা প্রতিবন্ধিকতা পেরিয়ে নিজের জীবনকে আপন আকাঙ্ক্ষায় গড়ে নেওয়া অনেক কৃতী মানুষের গল্প জানা যায়। সরদার শামসুল ইসলাম তেমন একজন কৃতী শিল্পী, যিনি তিল তিল করে নিজেকে গড়েছেন।

নদীমেখলা নিসর্গ-ঋদ্ধ বরিশালের ঝালকাঠিতে এক সাধারণ মুসলিম পরিবারে তার জন্ম ১৯৫৭ সালে। ছেলেবেলা থেকেই ছবি আঁকার দিকে তার ঝোঁক ছিল। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে শিল্পী হওয়ার এক দুর্নিবার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় তার আগমন ১৯৭৫ সালে। ভর্তি হলেন বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে-যেটি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। এখানকার শিল্পিত পরিবেশ পেয়ে তার শিল্পচর্চা গতি পায়।

গত আশির দশকের শুরুর দিকে চারুশিল্পের গ্রাফিক ডিজাইনে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর প্রথমে তিনি একজন গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে বাংলাদেশ টেলিভিশনে চুক্তিভিত্তিতে যোগ দেন। পরে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন কৃষি তথ্য সার্ভিসে।

এখানে দীর্ঘদিন তিনি অগ্রজ হিসেবে স্বনামধন্য শিল্পী ও মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রচার দপ্তরের কৃতী শিল্পী প্রাণেশ কুমার মণ্ডলের সাহচর্য পান। তার অবসর গ্রহণের পর কৃষি তথ্য সার্ভিসের প্রেস ম্যানেজারের দায়িত্বে আসেন সরদার শামসুল ইসলাম। এ সময় তার কার্যালয়ের গ্রাফিক নকশার কাজের পাশাপাশি ছবি আঁকায় মনোযোগী হন।

২০১৫ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে নতুন করে আবার আঁকতে শুরু করেন। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তিনি থিতু হন প্রকাশবাদী বিমূর্ত রীতির চিত্রকলায়। গত কয়েক বছর ধরেই দেখছিলাম নতুন যা আঁকছেন, সেগুলোর আলোকচিত্র সামাজিক প্রচার মাধ্যমে একের পর এক প্রকাশ করছেন। নিসর্গের রহস্যময়তা ও নান্দনিক সৌন্দর্যের গভীরতার ব্যাপ্তি প্রকাশে বিমূর্ততাকেই শ্রেষ্ঠ সমাধান বলে মনে করেন বরেণ্য নন্দনতত্ত্ববিদেরা।

এই নীতি মেনে অগ্রসর হয়েছেন সরদার শামসুল ইসলাম। আমি বিস্মিত হই তার কাজ দেখে! এখানে বিমূর্ত ছবি যারা নিয়মিত এঁকে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, সেই শিল্পীদের কাজের সঙ্গে সরদারের আঁকা চিত্রকর্ম তুলনীয়!

দৃষ্টিনন্দন সব বর্ণ প্রয়োগের কুশলতা, চিত্রপটে রঙ ফাটানোর কৌশল ও টেক্সচার সৃষ্টিতে তার ধ্যান, ছন্দময় রেখার গতায়াত আমাদের চোখে তুমুল মুগ্ধতা ছড়ায়! তার কতক কাজ মনে করায় এই ধারার গুণী ও খ্যাতিমান চিত্রকর মোহাম্মদ ইউনুসের চিত্র প্রকরণকে। চিত্রতলে একটি বর্ণের সঙ্গে আরেক বর্ণের মিশে যাওয়া আবার সেই মিশ্রবর্ণছোপ ভেদ করে অন্য আরেকটি বর্ণের বের হয়ে আসার আকুতি ও উঁকিঝুঁকি আমরা প্রত্যক্ষ করি শিল্পী সরদারের কাজগুলোয়।

পরিণত বয়সে এসে এমন অসাধারণ শুরু করলেন, ভাবলাম আরও অনেক দূর যাবেন তিনি! কিছুদিন আগে গ্যালারি চিত্রকেই দেখা হলো, জানালেন-তার আঁকা চিত্রকর্মের একটি প্রদর্শনী করবেন। বললেন, লেখার বিষয়ে তোমার সহযোগিতা চাই। শিল্পী মনিরুজ্জামানের সঙ্গে পরিকল্পনাও করলেন। কিন্তু গত ৭ মার্চ খবর পেলাম তিনি আর নেই!

শিল্পী সরদার শামসুল ইসলামের শিল্পী অস্তিত্বের অন্তিম স্বপ্নপূরণের দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে এসেছে তার সন্তান-সন্ততি ও শুভার্থীরা। সম্প্রতি তাঁর আঁকা ছবি নিয়ে গ্যালারি চিত্রকে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন বরেণ্যশিল্পী অধ্যাপক রফিকুন নবী। বিশেষ অতিথি ছিলেন শিল্পী শহিদ কবির। 

গ্যালারি চিত্রকে প্রয়াত এ শিল্পীর চিত্রকর্মের বিশেষ এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে আমরা শ্রদ্ধা জানাই তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে!

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //