ফররুখ আহমদ: মুসলিম রেনেসাঁর কবি

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি যিনি মুসলিম রেনেসাঁর কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত তিনি ফররুখ আহমদ। তার কবিতা তৎকালীন বাংলার মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণে নতুনভাবে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। হাতেম আলী, আইএ পাস করেই পুলিশ ইন্সপেক্টরের চাকরিতে যোগ দেন। সৎ মানুষ হিসেবে সুনাম ছিল তার। তার ছিল দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী ১৯২৪ সালে মারা যাওয়ার পর তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন।

প্রথম স্ত্রীর ঘরে পর পর তিনটি মেয়ে জন্মের পর ফররুখ আহমদের জন্ম হয়। কবি ফররুখ আহমদ ১৯১৮ সালের ১০ জুন মাগুরা জেলার মাঝআইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ হাতেম আলী। মাতা বেগম রওশন আখতার। রমজানের সময় ফররুখের জন্ম হয়েছিল বলে তার দাদি তখন আদর করে রমজান বলে ডাকতেন। ছয় বছর বয়সে মাতৃহারা হয়েছিলেন তিনি। এর পর দাদিই তাকে লালন পালন করেন।

শৈশবে দাদির কাছে ফররুখ শুনতেন পুঁথির কাহিনি, তাজকিরাতুল আউলিয়া এবং কাসাসুল আম্বিয়া। ধু-ধু মাঠে কিংবা মধুমতী নদী তীরে একা একা ঘুরে বেড়াতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। জ্যোৎস্না রাতে বাঁশঝাড়ের পাশে গিয়ে ডাহুকের ডাক শুনতেন চুপ করে। আর এসবই তার মধ্যে কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। তিনি স্কুলজীবন থেকেই লেখালেখি শুরু করেন এবং এদেশের বিশিষ্ট কবিদের কাতারে তার নাম উঠে আসে।

মাঝআইল গ্রামের পাঠশালায় ফররুখ কিছুদিন পড়েছিলেন। ফারসি-জানা এক মহিলা বাড়িতে এসে তাকে ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন। তারপর কলকাতায় গিয়ে মডেল এমই স্কুলে ভর্তি হন তিনি। এরপর কিছুদিন পড়েন বালিগঞ্জ হাই স্কুলে। 

বালিগঞ্জ হাই স্কুলে কবি গোলাম মোস্তফা তার শিক্ষক ছিলেন। বালিগঞ্জ স্কুলে পড়ার সময় তিনি দিলকুশা স্ট্রিটে থাকতেন এবং রোজ সন্ধ্যার পর দিলকুশা পাবলিক লাইব্রেরিতে বই পড়তে যেতেন। সমবয়সী, পরবর্তীকালের বিখ্যাত কথাশিল্পী আবু রুশদও ঐ লাইব্রেরিতে প্রায় প্রতিদিন যেতেন। কখনো লাইব্রেরিতে বসে, কখনো পার্ক সার্কাস ময়দানের কোনো নিরালা কোনায়, কখনোবা হেঁটে গড়িয়াহাট লেক পর্যন্ত যেতে যেতে তারা দুজনে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতেন। সেই সময় তিনি নিরালায় দরাজ গলায় আবৃত্তি করতেন শেলি, কীটস, নজরুলের কবিতা। এরপর ভর্তি হন খুলনা জেলা স্কুলে।

এই স্কুলে তার শিক্ষক ছিলেন সাহিত্যিক আবুল ফজল ও কবি আবুল হাশেম। এই স্কুলের ম্যাগাজিনে ফররুখ আহমদের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। এই স্কুল থেকেই ১৯৩৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন তিনি। কলকাতায় এসে রিপন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩৯ সালে রিপন কলেজ থেকে তৃতীয় বিভাগে আইএ পাস করার পর ঐ বছরই কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শনে অনার্স নিয়ে বিএতে ভর্তি হন।

এরপর ১৯৪১ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ ছেড়ে কলকাতা সিটি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স নিয়ে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। এ সময়ে তিনি অধ্যাপক হিসেবে পেয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, প্রমথনাথ বিশীসহ আরও অনেক গুণী মানুষের। স্কুল-কলেজে তার সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিকার সত্যজিৎ রায়, অভিনেতা ফতেহ লোহানী, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তবে শেষ পর্যন্ত বিএ পরীক্ষা দেননি তিনি।

কলকাতায় থাকাকালে ফররুখ আহমদ অনেকগুলো চাকরি করেছেন; কিন্তু সবগুলোই ছিল স্বল্পস্থায়ী। কারণ শুধু ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকা ছাড়া অন্যগুলোর কোনোটিই তার কবিমনের সঙ্গে খাপ খায়নি। ১৯৪৮ সালের শেষ দিকে তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা বেতারে প্রথমে অনিয়মিত হিসেবে এবং পরে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট বা নিজস্ব শিল্পী হিসেবে কাজ করতে থাকেন এবং আমৃত্যু ঢাকা বেতারে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

বেতারের প্রয়োজনে অসংখ্য গান, কথিকা, নাটিকা, শিশুতোষ রচনা, গীতিনাট্য, গীতিবিচিত্রা ইত্যাদি লিখেছেন। নিজের ও অন্যদের কবিতা আবৃত্তি করেছেন। পুঁথি পাঠও করেছেন মাঝে মাঝে। বিশেষ অনুষ্ঠানসমূহ প্রযোজনা করেছেন। বেতারে তার সহকর্মীদের মধ্যে ছিলেন কবি শাহাদাৎ হোসেন, কবি সৈয়দ আলী আহসান, কবি আবুল হোসেন, কবি সিকান্দার আবু জাফর, কবি শামসুর রাহমান, কবি হেমায়েত হোসেন, গীতিকার নাজির আহমদ, কথাশিল্পী আশরাফ-উজ-জামান খান, কথাশিল্পী নাজমুল আলম প্রমুখ। 

১৯৩৭ সালে ফররুখ আহমদ প্রথম সাহিত্য জগতে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৪৪ সালে ‘সাত সাগরের মাঝি’ প্রকাশিত হলে ‘সওগাত’, ‘মোহাম্মদী’ প্রভৃতি পত্রিকায় তার দীর্ঘ আলোচনা ছাপা হয়। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে ফররুখ আহমদ যেমন ‘লাশ’, ‘আউলাদ’ প্রভৃতি কবিতা লিখেছেন, ১৯৪৬ সালে তেমনি হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় আর্ত কবি লিখেছিলেন ‘বন্ধু’ , ‘নিজের রক্ত’ প্রভৃতি কবিতা। ১৯৪৮ সালে ফররুখ ঢাকায় চলে আসার পর মৃত্যুকাল পর্যন্ত ঢাকাই ছিল তার সাহিত্যক্ষেত্র।

১৯৪৮-৭৪ এই প্রায় তিন দশক তিনি নিয়মিত সাহিত্য চর্চা করেছেন। এই সময়ে তার চারটি কবিতাগ্রন্থ ও চারটি শিশুতোষ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ফররুখ কয়েকটি গদ্য ও কাব্যনাট্য লিখেছিলেন। এর মধ্যে ‘দরিয়ায় শেষ রাত্রি’, ‘তৈমুর’ ও ‘নৌফেল ও হাতেম’ রেডিওতে প্রচারিত হয়েছে। কবি ফররুখ আহমদ তার অমর সৃষ্টির জন্য সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক পেয়েছেন অনেক পুরস্কার ও স্বীকৃতি।

১৯৬০ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট পুরস্কার ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’ ও ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে ‘হাতেমতায়ী’ গ্রন্থটির জন্যে ‘আদমজী পুরস্কার’ এবং একই বছর তার ‘পাখীর বাসা’ গ্রন্থটির জন্য ‘ইউনেস্কো পুরস্কার’ পান। তিনি বরাবরই নিভৃতে সাহিত্যচর্চা করেছেন। কবি চরম দারিদ্র্যের মধ্যে চিকিৎসার অভাবে ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসের ১৯ তারিখে ছাপ্পান্ন বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //