জিন্নাতুন্নিসা : মিথ্যে ইতিহাসে চাপা পড়া এক মহীয়সী

লিখতে বসার আগে এক প্রস্থ হেসেছি। হায় রে নারী! মৃত্যুতেও মুক্তি নেই তোমার। মেধাবী বিদুষী এমন একজনকে মৃত্যুর প্রায় তিনশ বছর পরও এই বাংলায় ছাড় দেওয়া হচ্ছে না! বিশদে জানাব লেখার শেষটায়। ততক্ষণে চলুন আজিমুন্নেসা ওরফে জিন্নাতুন্নিসা সম্পর্কে কিছুটা জেনে আসি। 

নবাব মুর্শিদকুলির খাঁর একমাত্র কন্যা জিন্নাতুন্নিসা। মুর্শিদকুলি খাঁ যে সময় হায়দরাবাদের দেওয়ান পদে নিযুক্ত হন, সেই সময়ে তার কন্যা জিন্নাতুন্নিসার সঙ্গে দাক্ষিণাত্যবাসী সুজা খাঁর বিয়ে সম্পন্ন হয়। সুজা খোরাসানের অধিবাসী তুর্কজাতীয় ‘আফসার’ বংশোদ্ভূত। সুজার আরেক নাম মীর জা দখিনী। তার বাবার নাম নুরুদ্দীন। জিন্নাতুন্নিসাকে বিয়ে করে সুজা খাঁ নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর পরিবারের সঙ্গেই বাস করতে থাকেন। কিছুদিন পরে শ্বশুরের যত্ন ও চেষ্টায় তিনি উড়িষ্যার সুবেদার পদে অধিষ্ঠিত হন; কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তার সঙ্গে মুর্শিদকুলির শাসন সম্বন্ধে মতদ্বৈত হওয়ায় দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য তৈরি হয়। তখন সুজা শ্বশুরের আশ্রয় ত্যাগ করেন এবং উড়িষ্যায় গিয়ে নিজে শাসনকার্য পরিদর্শন করতে থাকেন। নানা সদগুণে ভূষিত সুজা একজন ন্যায়পরায়ণ শাসনকর্তা ছিলেন। কেউ কখনো তাকে ক্রোধের বশীভূত হতে দেখেনি; কিন্তু দুঃখের বিষয়, বিলাসিতা ও চরিত্রহীনতা তার যশকে ম্লান করে দিয়েছিল। স্বামীকে সৎপথে আনার জন্য জিন্নাতুন্নিসা প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগলেন। যখন বুঝিয়েও তাকে পাপপথ থেকে ফেরাতে পারলেন না, বিবাদ-বিসম্বাদ যখন প্রতিনিয়তই সংসারের শান্তিভঙ্গ করতে লাগল, তখন মনের দুঃখে জিন্নাতুন্নিসা পুত্র সরফরাজকে সঙ্গে নিয়ে পিত্রালয়েই জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন।

মুর্শিদকুলি নিজের মৃত্যু আসন্ন জেনে ও জামাতা সুজার প্রতি আগে থেকে বিরূপ থাকায় দৌহিত্র সরফরাজকে বাংলার নিজামতি প্রদানের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। এ কথা সুজার কর্ণগোচর হওয়ামাত্র তিনি আলিবর্দি খাঁ ও হাজী আহম্মদের সঙ্গে পরামর্শ করে বাংলা ও উড়িষ্যার নিজামতি পাওয়ার জন্য দিল্লির বাদশাহর কাছে নানারকম উপঢৌকন পাঠিয়ে দেন। এর কিছুদিন পরেই মহাপ্রতাপশালী নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ মারা যান। মৃত্যুর কয়েক দিন আগেই সুজা আলিবর্দিকে সঙ্গে নিয়ে মুর্শিদাবাদ যাত্রা করেছিলেন; পথিমধ্যেই তিনি দিল্লি­ থেকে পরোয়ানা পান এবং শ্বশুরের মৃত্যুসংবাদ শোনেন। উপযুক্ত সময় বিবেচনা করে তিনি সসৈন্যে মুর্শিদাবাদের পথে অগ্রসর হতে লাগলেন। রাজধানীতে উপস্থিত হওয়ামাত্রই তার ভাগ্যলক্ষ্মী প্রসন্ন হয়, সুজা খাঁ বাংলার নবাব হন। সময়টা ছিল ১৭২৫ খ্রিষ্টাব্দ। জিন্নাতুন্নিসা তখন সরফরাজের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ থেকে দুই মাইল দূরে অবস্থান করছিলেন। সরফরাজ বাবার আগমনবার্তা শুনে তার মসনদ অধিকারে বাধা দেওয়ার আয়োজন করতে লাগলেন; কিন্তু বুদ্ধিমতী ধর্মপরায়ণ জিন্নাতুন্নিসা পুত্রকে এ কাজ থেকে বিরত হওয়ার পরামর্শ দিলেন এবং বাবার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ যে মহাপাপ, এ কথাও বিশেষ করে বোঝালেন। সরফরাজ মাকে বিশেষ ভক্তি করতেন। তার কথায় তিনি পিতার প্রতি ক্রোধ প্রকাশ না করে সসম্মানে তাকে মুর্শিদাবাদে আনলেন। পিতাপুত্রে এভাবেই মিলন হলো। সুজাও স্ত্রীর কাছে বিগত জীবনের জন্য অনুশোচনা করে সামনে দাঁড়ালে ধর্মপরায়ণ ও বিচক্ষণ জিন্নাতুন্নিসা স্বামীর সব দোষ ক্ষমা করে তাকে গ্রহণ করেন। এভাবেই একজন প্রজ্ঞাবান নারী সন্তানের সাথে পিতার শুধু দূরত্বই ঘোচাননি বরং পিতাপুত্রের মধ্যকার কলঙ্কিত ও নিষ্ঠুরতম যুদ্ধ থামিয়ে ইতিহাসের এক ঘৃণিত অধ্যায় রচিত হতে দেননি। তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এই মিলন তার বাবার মৃত আত্মাকেও স্বর্গসুখ দেবে। 

গিরিয়ার যুদ্ধে (জানুয়ারি ১৭৪১) সরফরাজকে আলিবর্দি পরাস্ত করলেন এবং এই যুদ্ধে সরফরাজের মৃত্যু হয়। যুদ্ধের দুদিন পর আলিবর্দি বিশেষ সমারোহে প্রাসাদে প্রবেশ করে মসনদে বসবার আগে তিনি জিন্নাতুন্নিসার কাছে উপস্থিত হলেন ও সসম্ভ্রমে মাথা নত করে বেগম সাহেবার কাছে মসনদ ভিক্ষা চাইলেন। পরে বললেন, ‘অদৃষ্টে যা ছিল, তা হয়েছে এবং এই হতভাগ্য গোলামের অকৃতজ্ঞতা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় জাজ্বল্যমান হয়ে থাকবে; কিন্তু আমি শপথ করে বলছি যে, যত দিন জীবিত থাকব, তত দিন আপনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে ত্রুটি করব না। আশা করি, এই হতভাগ্য, বিনীত ও সন্তপ্ত গোলামের অপরাধ একসময় আপনার স্মৃতি থেকে মুছে যাবে।’

পুত্রশোকাতুরা জিন্নাতুন্নিসা এর কোনো উত্তর দেননি; কিন্তু কোনো অভিশাপ দেননি বা দুর্ব্যবহারও করেননি। সন্তানের হন্তারকদের সাথেও যিনি এমন ব্যবহার করতে পারেন তার বিচক্ষণতা নিয়ে প্রশ্ন করা নিতান্তই বালখিল্যতা। যদিও রাজঘরানায় বড় হয়েছেন তিনি তবু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, জিন্নাতুন্নিসার মতো জনদরদি, শিক্ষানুরাগী, সাহিত্যানুরাগী ও সমাজ সংস্কারক বিরল। ইসলামের পূর্ণ অনুশাসন মেনেও তিনি সাহিত্য চর্চা করতেন ও মানবিকতার চর্চা করতেন। কথিত আছে তার রাজমহলের বাইরে অসংখ্য দুস্থ ও অসহায় মানুষ তার অপেক্ষায় থাকত। ধর্ম বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে তিনি সবার প্রতি সম্মানজনক আচরণ করতেন। মানুষের মর্যাদা ছিল তার কাছে সবার উপরে। রাজকার্যে বাবাকে, ছেলেকে, স্বামীকে আড়ালে থেকে যেসব সিদ্ধান্ত বা পরামর্শ দিতেন তা এক বুদ্ধিদীপ্ত ও সুপরামর্শক মেধার পরিচয় বহন করে। 

এবার আসি আমার শুরুর বক্তব্যে। এমন একজন মহীয়সীকে নিয়ে কথা বলার শুরুটা কেন এত আক্ষেপ ও হতাশা নিয়ে। জিন্নাতুন্নিসাকে নিয়ে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের সবটুকুই বিভিন্ন বই ও গবেষক থেকে প্রাপ্ত। তবু বিজ্ঞানের জয়যাত্রাকে অস্বীকার করি কী করে? তাই লেখা শেষ করার আগে ভাবলাম একবার গুগল করি। তার সম্পর্কে আরও কিছু যদি জানা যায়। হায়! আমি নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! এত ভ্রান্ত তথ্য! এত মনগড়া ইতিহাস! কী অযৌক্তিক গল্পগাথা! আঙুলে আঙুলে হাওয়ায় ভাসছে। অথচ কোনো অকাট্য প্রমাণ নেই। কোনো রেফারেন্স নেই। নেই কোনো নির্ভুল গবেষণা। স্রেফ লোকমুখে প্রচলিত কিছু বীভৎস গল্প। বেশি আর রুচি হয়নি এগোবার, তবু চলুন লোকমুখে শোনা এইসব নিষ্ঠুর গল্পের কয়েকটির যুক্তি খণ্ডনের চেষ্টা করি। 

১ম প্রচলিত গল্প- আজিমুন্নেসাকে বলা হয় একজন নিষ্ঠুর নারী যে কিনা নিজের অসুখ সারাতে জ্যান্ত শিশুদের কলিজা খেতেন। আর এটা জানাজানি হওয়ার পর তার বাবা তাকে জ্যান্ত কবর দেন; ইতিহাস বলছে- জিন্নাতুন্নিসার বাবা মুর্শিদকুলি খাঁ মারা যান ১৭২৭ সালে আর জিন্নাতুন্নিসা মারা যান ১৭৩৪ সালে। বাবার মৃত্যুর সাত বছর পরে যে মানুষটি মারা গেল তিনি কীভাবে বেঁচে উঠে মেয়েকে জ্যান্ত কবর দিলেন? 

২য় প্রচলিত গল্প- আজিমুন্নেসা এক কঠিন রোগে হলে রাজবৈদ্য তাকে রোজ জ্যান্ত শিশুর কলিজা খেতে বলেন। এবং এটা খেতে খেতে তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেও তিনি জ্যান্ত শিশুর কলিজা খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন এবং এই অভ্যাস ছাড়তে পারেননি বলে রাজকর্মচারীদের মাধ্যমে রোজ শিশুদের চুরি করে আনতেন। প্রথমত এতটা আজগুবি গল্প রূপকথার ভ্যাম্পায়ারকেও হার মানায়। তবু যুক্তির মাধ্যমেই এই গল্পকে আজগুবি প্রমাণ করতে পারি আমরা। প্রথমত তৎকালীন কোনো স্বীকৃত চিকিৎসা সাময়িকীতে এ ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতির সন্ধান মেলে না। দ্বিতীয়ত বাবার মৃত্যুর পরও তিনি যত দিন বেঁচে ছিলেন, রাজ্যের পুরো শাসনভার ছিল তারই পুত্র হন্তারক আলিবর্দির হাতে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সেই আলিবর্দিও জিন্নাতুন্নিসাকে বিশেষ সমীহ করতেন ও তার পরামর্শ মানতেন। 

জিন্নাতুন্নিসার শেষ ইচ্ছানুযায়ী ভাগীরথীর তীরে তিনি যে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন, তার মূল ফটকের নিচে তাকে সমাহিত করা হয়েছিল। এই মসজিদের ভগ্নাবশেষ আজও বিদ্যমান থেকে তার স্মৃতির মৌন সাক্ষ্য প্রদান করছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //