ডায়েরি

বলা নেই কওয়া নেই দুম করেই চলে গেল রিতু। সবুজ পৃথিবীটাকে এক ধাক্কায় বিবর্ণ করে দিল যেন। কোনো রকম বার্তা ছাড়া, সংকেত ছাড়া হঠাৎ করেই নিঃস্ব হয়ে যায় অংশু। আজ এতগুলো দিন ধরে অংশু শুধু ভেবে ভেবে ক্লান্ত হয়ে গেছে, কী কারণে কার কারণে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো তার জীবনটা এমন ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল।

কতকাল মরমে মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল তার, রিতু নামের মেয়েটার পাশে দাঁড়ালেই কুঁকড়ে যেত সে, তখন যেন আরও বেশি প্রকট হয়ে উঠত রিতুর মুখের আলোকিত শোভা। দেখতে গিয়েও মাঝে মাঝে নিজে থেকেই চোখ সরিয়ে নিত। রাস্তায় রিতুর সাথে হাঁটতে গিয়ে প্রায়ই চারপাশে চোরা চোখে তাকিয়ে দেখত, কেউ তাদের এই অসম জুটি নিয়ে কানাকানি করে কিনা।

আস্তে আস্তে অত্যন্ত রূপবতী মেয়েটি অংশুর অপ্রতিরোধ্য ভালোবাসায় হার মেনে গেল। অভ্যস্ত হলো তার পাশের অসুন্দর স্বামীর জন্য সুন্দর ভালোবাসার স্বর্গ গড়তে।

সুন্দর অসুন্দর, ভালো আর মন্দে জীবন তো কেটেই যাচ্ছিল, অনাগত ভবিষ্যতের স্বপ্নে। নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে যায় অংশুর।

ছোট্ট শিশুকন্যার মুখে মাছের কাঁটা ছাড়িয়ে ভাতের লোকমা তুলে দিতে গিয়ে থেমে যায়, শিশুটি অবাক হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, কারণ তার বাবার হাতে কোনো ভাত নেই, শুধু আঙুলগুলো মুখের সামনে ধরে আছে।

এতক্ষণ ধরে মুখে ভাত পুরে রেখেছিস কেন? আমি এই থালা নিয়ে কতক্ষণ বসে থাকব? নিজে নিজের হাতে ভাত মাখিয়ে খাওয়া শিখিয়ে যায়নি তোর মা? কিছুটা রাগত স্বরে মেয়েকে বকতে গিয়ে দেখে, তার হাতে মূলত কোনো ভাতই নেই। এমনকি প্লেটেও কোনো খাবার নেই। খাওয়া হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, তব্ওু অংশু শূন্য ভাতের থালার দিকে তাকিয়ে বারবার মেয়েকে বলেই যাচ্ছে, এক লোকমা শেষ করতে আর কত সময় নিবি রে মা? ছোট্ট এক রত্তি মেয়ে রুপা। সেও আজকাল বাবার এই অদ্ভুত আচরণে শঙ্কিত হয়। আর তার মা-ই বা কেমন মা, সেই কবে কাজের কথা বলে বের হলো, আর আজ অবধি ফিরে এলো না।

বাবা অফিস করে রুপাকে খাওয়ায়, স্কুলে নিয়ে যায়, ঘুম পাড়ায়, এগুলো কি বাবা কখনো করেছে?

অংশু মেয়েকে ঘুমাতে দিয়ে নিজে এসে ড্রইংরুমের ঢাউস চেয়ারে বসে পড়ে। এই চেয়ারটায় বসলেই রিতু খুব রেগে যেত, কারণটা অংশু আজও বোঝে না, অংশুর রিলাক্সের জায়গাটায়ই রিতুর কেন এত রাগ ছিল। অংশু আয়েশি জীবনে অভ্যস্ত। না ছাত্রজীবন থেকে নয়, কর্মজীবনে মূলত বিবাহিত জীবনের আরামই তাকে আয়েশি করে তোলে।

দশ বছরের বিবাহিত জীবনে কখনো রিতুর সাথে তার তেমন ঝগড়া হয়নি, কখনো তার গায়ে হাতও তোলেনি, সেই সাহস দেখাবার সাহসও তার নেই, এমনকি তাকে অপমান করে বা কটাক্ষ করেও কোনো কথা বলেনি, তবুও রিতু চলে গেল।

প্রায়ই মাঝ রাতে রিতুর কবর পর্যন্ত হেঁটে যায়, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, আর খুব মন দিয়ে চারপাশে তাকায় যদি ভুলেও একবার রিতু দেখা দেয়, তবে একটা প্রশ্ন করতে চাইত, কবে থেকে রিতু এই ভয়ঙ্কর ভাবনাটা লালন করে আসছিল? কেন একবারও অংশুকে জানতে দিল না, তার এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের কথা।

অংশু জানে না ঠিক, কী ভেবে রিতু অংশুকে ভালোবেসেছিল। বিয়ের আগে অংশু রিতুকে কী এমন এলেম দেখিয়েছিল যে রিতুর মতো আপাদমস্তক একটা সুন্দরী মেয়ে তার মতো সামান্য মানুষের প্রেমে পড়ল। রিতুকে পাওয়ার ইচ্ছাটা খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু অংশুকে চাওয়াটা শর্তের অধীন। আর এ কারণেই অংশু প্রায়ই রিতুর ভালোবাসায় সংশয় প্রকাশ করে।

অংশুর যুক্তি-বুদ্ধি চিরকালই কম, আর নান্দনিক শক্তির কথা নাইবা হলো। ছাত্রজীবনে নাক-কান বুজে পড়াশোনা করে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে ফেলে, আর সে সুবাদে একটা ভালো মানের চাকরিও পেয়ে যায়, ব্যস অংশুর জীবনের অর্জন এটুকুই, আর এই অর্জিত বিদ্যার কারণেই রিতুকে সে নিজের সংসারে বাঁধতে পেরেছিল। দর্শন নিয়ে পড়া রিতু প্রায়ই কঠিন কঠিন কথা বলে অংশুকে ঘাবড়ে দিত।

অংশু প্রথম প্রথম তার দার্শনিক কথায় মুগ্ধ হলেও পরে খুব বিরক্ত বোধ করত, কারণ কথাগুলো কখনোই তার সাদামাটা জীবনের সাথে যায় না।

কিন্তু এসব ভারী ভারী কথা নিয়ে তাদের মধ্যে কখনো মান অভিমান বা বিবাদসমো কিছুই হয়নি। অংশুর কাছে সংসার মানেই তিন বেলা পেট পুরে খাওয়া, দশটা পাঁচটা অফিস, আর রাত ভর নাক ডেকে পাশ বালিশের আলিসে ঘুমিয়ে থাকা। আর মাঝে মাঝে স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া।

সত্যিই তো এর বাইরে একটা মেয়ের আর কী চাওয়ার থাকতে পারে। অংশুমান যতই ভাবে ততই বিস্মিত হয়, কিছুতেই হিসাব মেলে না। অংশুর কোন ভুলে, কোন অপরাধে, কোন অভিযোগে অভিযুক্ত করে রিতু এমন হেলাফেলায় চলে গেল। গত একটা বছর অংশু শুধুই ভাবছে, রিতুর মনের কোন জায়গাটা অংশু ছুঁতে পারেনি। হাজারো প্রশ্নের জালে নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে, যেখানে সংসারের প্রতিটি ঘটি-বাটি রিতুকে জানে, শুধু অংশুই জানে না, কবে অংশু তাকে এত বড়ো আঘাত করে ফেলল। যাবার সময় একবার কি রুপার মুখটাও মনে আসেনি।

রুপাকে কী করে সে প্রতিনিয়ত বড়ো করে তুলবে, কী করে ঘুম পাড়ায়, খাওয়ায় পড়ায়, কী করে সম্ভব একা একা সন্তান পালন? সব কিছু না হয় বাদ দিল কিন্তু স্কুল থেকে রুপাকে নিয়ে আসার ঝক্কি কী করে সামলায়, আর স্কুলে রেডি করে নিয়ে যাওয়া, অংশু আর ভাবতে পারে না, কত দিন তাকে এই সংসারের মেয়েলি ঝামেলাগুলো বইতে হবে, আজকাল রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠছে।

হঠাৎই অংশু টের পেল, সে শুধু তার মেয়ে আর সংসার নিয়েই ভাবছে, কই একবারও ভাবছে না তো রিতুবিহীন তার জীবনটা কী করে কাটবে! রিতুর অনুপস্থিতি তাকে তো সেভাবে বিষণ্ণ করে তুলছে না। কবে কখন কেমন করে তার জীবনে রিতুর গুরুত্ব এমন ফিকে হয়ে গেল। তবে কি রিতু তার অমনোযোগিতা টের পেয়েছিল? আজকাল সে প্রায়ই রিতুকে খুব একটা লক্ষ করত না, রিতু এতটাই সুন্দর ছিল যে, বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে অংশু ভিতরে ভিতরে কুঁকড়ে যেত। অফিস থেকে ফিরে সে টিভি, মোবাইল বা খবরের কাগজটাই খুব মনোযোগ দিয়ে দেখত।

এমনও হয়েছে যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রিতু তার সামনে ঘোরাঘুরি করলেও অংশু রিতুর দিকে একবারও নজর দিয়ে দেখেনি। অথচ এই অংশুই বিয়ের আগে রিতুকে চোখের আড়াল হতে দিতে চাইত না। অংশুর কাছে এখন রিতু নয় সংসারটাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

তবে কি সে কারণেই রিতু এতটা কষ্ট পেয়েছে? রাতের পর রাত ঘুমের ঘোরে নাক ডেকে রিতুর ঘুম নষ্ট করেছে, কখনো জানতে চায়নি, রিতু রাতে ঠিকঠাক ঘুমায় কিনা, অথবা দুপুরে কী খেয়েছে, কখনো প্রেমিক পুরুষের মতো হাতে করে একটা গোলাপও নিয়ে আসেনি। বিয়ের পরেই অংশু ধরে নিয়েছে রিতু তার অর্জিত সম্পত্তি, তাকে যত্ন করে আলাদাভাবে মূল্যায়নের কীইবা দরকার। কিন্তু তাই বলে রিতু স্বেচ্ছায় মরে যাবে, ওর মতো পরিণত বয়সের মানুষের জন্য এটা কোনো লজিক হতে পারে?

কত দিন ধরে এই ঘুমের ওষুধগুলো জমিয়েছিল সে, কেন করেছিল এই কাজ, কী যে তার প্রেক্ষাপট, বুকের তলায় কোন ব্যথার কী ভার বয়ে চলেছে একটি বারও তাকে জানতে দিল না। কী অদ্ভুত মেয়েদের মন কী করে বুঝবে।

রাতে খাবারের পর দক্ষিণের বারান্দার দোলায়িত চেয়ারে এসে বসে অংশু। দশতলার দক্ষিণের এই বারান্দাটা অংশুর খুব প্রিয়। বিশেষ করে রাতে খাওয়ার পর মা মেয়ের চোখ আড়াল করে যখন একটা সিগারেট নিজের সুখী জীবনের দুই ঠোঁটের আগায় ধরে তখন রিতু বা রুপা কেউই আর তার জীবনে তেমন গুরুত্ব পায় না। ঝিরিঝিরি বাতাসে নিকোটিনের ধোঁয়া তার মধ্যে এক পরিপূর্ণ মানুষের অনুভূতিকে প্রশ্রয় দেয়। যে মানুষের সংসারে স্ত্রী সন্তানের কোনো দায় নেই, কোনো দৈনিক কার্যবিবরণীর প্রয়োজন নেই। শুধু একটা সিগারেট আর আরাম কেদারার দুলুনি, একটু পরেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে যায়। তারপর বিছানায় গা এলিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এর বেশি আর মানুষের কী চাওয়া থাকতে পারে, তাই অংশুমান ছিল একজন আদ্যোপান্ত সুখী মানুষ।

আজও অংশু দোল খেতে খেতে ঘুমিয়েই যাচ্ছিল, খুব ভালোভাবে বেঁচে আছে, তা ঠিক নয় তবে খুব মন্দও তো নেই। রিতু চলে যাবার পর কয়েকটি দিন বিপর্যস্ত কেটেছে বটে, কিন্তু এখনো তো তার দিব্যি ঘুম এসে যায়, রাতে পেট পুরে খেতেও কোনো অসুবিধা হয় না। তাহলে রিতুকে সে ভালোবাসল কোথায়? 

ভালোবাসা কাকে বলে, কত দিন রিতু তাকে এই প্রশ্ন করেছিল, অংশু বোকার মতো শুধুই হেসেছে, আর বলেছে তোমার জন্য আমার অনুভূতিকেই ভালোবাসা বলে। রিতু বলত, প্রমাণ করতে পারবে? রিতু এসব প্রশ্ন করলেই অংশু কেমন কোণঠাসা হয়ে যায়, সে বরাবরই মোটা বুদ্ধির লোক, তব্ওু বলত, আমাদের সন্তানই তার প্রমাণ। অংশু আর কথা বাড়ায় না। এরপর রিতু নিজের মনে হাজারো কথা বলে যেত, তার কোনোটা অংশু শুনত, কোনোটা শুনতে চাইত না। সেদিন খেয়াল করে রিতুর কথাগুলো না শোনার জন্য আজ অংশু সত্যিই নিজেকে অপরাধী ভাবছে। কী ক্ষতি হতো আরেকটু সময় নিয়ে ওর দিকে তাকালে, ওর অর্থহীন কথাগুলো না হয় ইচ্ছের বাইরেই মনোযোগ দিয়ে আরেকটু শুনত। না হয় ঘড়ির কাঁটা খানিকটা এগিয়ে গেলেই ঘুমাতে যেত, কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হতো? অংশুর চোখ ভিজে এলো।

একদিন পূর্ণিমার আলোয় রাত জেগে ছাদে হাঁটতে চেয়েছিল, বলেছিল গান শোনাবে। অংশু ঘুম রেখে ছাদে গিয়ে পূর্ণিমা দেখা বা গান শোনার মধ্যে কোনো মাহাত্ম্য খুঁজে পায়নি। বরং রেগে বলেছিল, সারাদিন অফিস করে একটা ফ্রেশ ঘুম দিতে না পারলে কাল আর কাজের শক্তি পাবে না, তার চেয়ে ঘরে রেকর্ড প্লেয়ারটা ছেড়ে ঘুমিয়ে যাও। আফসোস হচ্ছে সেদিন ওর গানটা শুনলেই হতো।

আজকাল মেঘ ডাকলে অথবা বিদ্যুৎ চমকালে খুব রিতুকে মনে পড়ে, বৃষ্টির ঝাপটায় অনেক ধুলো পরা স্মৃতি চকচকে হয়ে দৃষ্টিকে পুড়িয়ে দিয়ে যায়। কত দিন অংশুর হাত ধরে বর্ষায় ভিজতে চেয়েছে, অংশুর ঠান্ডার ধাত ছিল বলে ওসবের ধার-কাছ দিয়েই হাঁটেনি। ছোট ছোট অমীমাংসিত অপ্রাপ্তিই কি রিতুকে ক্রমান্বয়ে অসুখী করে তুলছিল? এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র না পাওয়া, এই খাপছাড়া অনুযোগ, অভিযোগ কি সত্যিই জীবনের এমন মহৎ মানেটাকে বদলে দিতে পারে?

অস্তিত্বহীন রিতুকে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই হয়তো অংশু নতুন করে আবার রিতুর প্রেমে পড়ে যায়। অংশু নিজেও তা বুঝতে পারেনি। যে রিতু চারপাশ জুড়ে ছিল, তকে যতটা দেখেছে তার চেয়ে অনেক বেশি দেখছে যার আর কোনো অস্তিত্ব নেই তাকে।

রিতু যে শুধু তার সংসারটা তছনছ করে গেছে তা নয়, ও তার সামাজিক অবস্থানটাকেও নড়বড়ে করে দিয়ে গেছে।

আজও কেউ কেউ সুযোগ পেলেই অফিসে রেস্তোরাঁয় দেখা হলে জানতে চায়, রিতু সম্পর্কে কোনো নতুন তথ্য জানা গেল কিনা? আরে কী অদ্ভুত কথা, রিতুর কী অজানা তথ্য থাকবে আবার!

তার কাছে রিতু জলের মতো স্বচ্ছ তেমনি রিতুর কাছেও সে। অংশুর অবহেলার ভার বইতে না পেরে রিতু চলে গেছে। এতে আর কোনো রহস্য নেই। আর কোনো কিন্তুর স্থান নেই, কোথাও কোনো কুয়াশা নেই, নেই কোনো প্রচ্ছন্নতা, রিতুর জীবনে কোনো আড়াল নেই। রিতু শুধু আজন্ম অভিমানে নিজের মনকে পাহাড় প্রমাণ জঞ্জাল স্বরূপ করে রেখেছিল, আর তারই ফলস্বরূপ এই অঘটন।

আজীবন নিজেকে গুরুত্ব দেওয়া মেয়ে, তার বুদ্ধি আর রূপের প্রশংসা শুনে শুনে ক্লান্ত হয়ে গেছে অংশুর কান। মাঝে মাঝেই মনে হতো, রিতুর পাশে অংশু বড্ড বেমানান। তাই অনেকটা ক্ষোভের কারণেই রিতুর মানসিক ভার নেওয়ার দায়িত্ব এড়িয়ে যায় অংশু, কিছুটা হীনমন্যতার কারণে কিছুটা অহংয়ে বাধার কারণে।

সেই কবে থেকে হাজার সমীকরণ করেই চলছে, তবুও হিসাব কি মিলছে আদৌ?

রিতু শুধু অংশুর ভালোবাসার পাগলামিটাই দেখছে আর দিনের পর দিন তাতেই থিতু হয়ে আছে। তাই হয়তো একটু একটু করে অংশুর বদলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেনি। অংশুর মনটা এবার হয়তো সত্যিই খুব ভারী হয়ে গেল, তাহলে কি সত্যিই রিতু তার ভালোবাসার কাঙাল ছিল, যা এই মোটা মাথার অংশু কখনো বুঝতেই পারেনি।

নিজেকে অংশুর এখন আর খুব তুচ্ছ মনে হচ্ছে না। কোথাও যেন খুব সূক্ষ্মভাবে নিজের প্রতি এক ধরনের আস্থা ফিরে পাচ্ছে, তবে কি শেষটায় অংশুই জিতে গেল! রিতুর রূপ গুণ কিছু দিয়েই অংশুকে বাঁধতে পারেনি। আর তাই অভিমানে নিজেকে সরিয়ে নিল। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, অংশু আর রাগ করছে না, বরং একটা স্বস্তিদায়ক পীড়া অনুভব হচ্ছে। নিজেকে একজন সফল পুরুষ বলেই কি বোধ হচ্ছে? যাকে ভীষণভাবে চাওয়া যায়, যার জন্য পাগল হয়ে, জীবন পর্যন্ত দেওয়া যায়।

কেন নিজেকে নিয়ে এভাবে ভাবা হলো না, মনের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে একটু হাসি ছড়িয়ে যায়, অন্যমনস্কভাবেই বেডরুমের ঢাউস আলমারির শেষ পাল্লাটায় টান দেয়, আর হুড়মুড় করে অনেকগুলো ভাঁজ করা শাড়ি নিচে ছড়িয়ে পড়ে, কী সুন্দর করেই না শাড়িগুলো সাজিয়ে রেখেছিল, এত সুন্দর করে নিজের হাতে সাজানো সংসার রেখে এমন ভয়ংকরভাবে কেউ কি চলে যেতে পারে? নিচু হয়ে শাড়িগুলো তুলতে গিয়েই শাড়ির ভাঁজ থেকে একটা ডায়েরি বেরিয়ে আসে।

একটা ছোট্ট নোটবুক, তড়িঘড়ি করে ডায়েরিটা নিয়ে পাতা উল্টায় অংশু। যাক, অবশেষে যদি অংশুর দেওয়া কোনো আঘাতের দাগ খুঁজে পায়, সেই আশায় চোখ দুটোকে মিথ্যেই ভারী করে ডায়েরির পাতা উল্টায়, রিতু কি কখনো ডায়েরি লিখত, কই কখনো তো চোখে পড়েনি। কিন্তু পাতা খুলেই কি হোঁচট খেলো অংশু? লেখাগুলো কেন বুঝতে পারছে না।

“শেষ পর্যন্ত এই খেলাঘর ভেঙে বেরিয়ে গেলাম, যা আমার নয় তা আমার করে পাওয়ার ইচ্ছে কখনোই হয়নি। প্রেমহীন ভালোবাসা দিয়ে সংসার সাজানো যায়, কিন্তু সংসার করা কঠিন। এই প্রেম, এই ঘর, এই বর, না কিছুতেই আজও আসক্তি জন্মেনি। জীবনের চাওয়াটাকে আজও ছুঁতে পারিনি, যা ছিল কোনো এককালে, যা হারাল কোনো এক ঝড়ে, সে ঝড় আজও থামেনি। যে ভুলে আবার নতুন ভুলের জন্ম সে ভুল থেকে আজ না হোক কাল বেরিয়ে আসতেই হতো। নিজের সংসারে নিজেকেই অনাহূত বোধ হয়। আমার চারপাশের কিছুই আমার নয়, আমার করার ইচ্ছেটাও আমার নয়। আমি কখনো তোমাদের কারো নই, কারো ছিলাম না।”

অংশু পাগলের মতো পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে, কই কোথাও একবারের জন্যও অংশুর নাম লেখেনি, কোথাও অংশুর সংসার জীবনের টুকটাক কথারও উল্লেখ নেই। রিতু লুকানো ডায়েরির কোনো একটা পাতার একটা কোণেও কি অংশুর ঠাঁই হয়নি? এমনকি তাদের ফুটফুটে একমাত্র সন্তান, তারও কোনো উল্লেখ নেই, এ কোন রিতুকে নিয়ে ভেবে ভেবে অংশু তার জীবনকে বিরহের উপন্যাস বানিয়ে ফেলল। এ কার রিতু, এই রিতুর জীবনে অংশু কোথায়? বজ্রাহতের মতো অংশু, শাড়ির স্তূপের মধ্যেই বসে থাকে, কত ঘণ্টা, কত ক্ষণ, মনে করতে পারে না। শুধু বহু দূর থেকে মাগরিবের আজান শুনে সংবিৎ ফিরে পায়, সন্ধ্যা হয়ে গেছে, চারপাশের দেয়ালগুলো কি ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে আসছে? খুব ইচ্ছে করছে দুই হাতে মাথাটা চেপে ধরে একটা চিৎকার করে, হঠাৎই অংশু গুমরে কেঁদে ওঠে, হৃদয়ের এত গভীর থেকে এই কান্না কি কখনো নিজের কানেও বেজেছিল, এই শব্দ কোন গহিনের শব্দ। যেদিন রিতু চলে গেল সেদিনই তো অংশুর জীবনটা শূন্য হয়ে গেল, কিন্তু আজ তো রিতু তাকে নিঃশেষ করে গেল। ঘোর লাগা চোখে ঘরের দরজায় তাকিয়ে দেখে, রুপা অদ্ভুত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। কী করে বলে রিতুর জীবনের কোথাও অংশুর অস্তিত্ব নেই, কখনো ছিল না, তাহলে রুপা কে? রিতুবিহীন জীবন ছিল শূন্য, কিন্তু এখন অংশু তো আর তার সারা জীবনের কোনো অর্থও খুঁজে পাচ্ছে না। কী নিয়ে বেঁচেছিল এতদিন, আজ কী নিয়ে বাঁচতে শিখবে, আবার কোথা থেকে শুরু করবে অংশু? এত বড়ো একটা দাঁড়ির পর আর কি কোনো লেখা থাক্বে!

অংশু ধীরে ধীরে এক বিশাল ‘না’-এর গণ্ডির মধ্যে এসে দাঁড়ায়, যার চারপাশে শুধু নেই আর নেই, কখনো কোথাও কিছু ছিল না। প্রেমহীন, আনন্দহীন, ব্যথাহীন এক শূন্য জীবন বোধ ক্রমাগত গ্রাস করতে থাকে তাকে, প্রতিটি দিন একটু একটু করে নিঃশব্দে নিঃশেষ হতে থাকে অংশু, আর উদ্ভট চোখে তাকায়, অপেক্ষা করে জীবনের শেষ মুহূর্তের জন্য।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //