প্রাসঙ্গিকতায় কবি আবুল হাসান

করুণ মায়া ধরে রাখা কবি আবুল হাসান তার জীবন যাপন ও লেখনীতে আধুনিক বাংলা কবিতার আলোর ইশকুল। এক উজ্জ্বল লাবণ্যের পাথর কিংবা নদী, উপগ্রহ অথবা কবিতার রাজা যে তার চোখে ধরে রাখে পৃথিবীর সমস্ত জল। সাহিত্যে যার আগমন ঘটে মধ্যষাটের দিকে যখন বাঙালির জাতীয় জীবনে দুঃসহ এক সময়।

৪ আগস্ট ১৯৪৭, দেশভাগের সময়টাতে জন্মগ্রহণ করেন কবি। অসুস্থতা ও জীবনের নানা সঙ্কটে বেঁচে ছিলেন মাত্র ২৯ বছর। জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয় ৩টি কবিতার বই : ‘রাজা যায় রাজা আসে’ (১৯৭২), ‘যে তুমি হরণ করো’ (১৯৭৪) ও ‘পৃথক পালঙ্ক’ (১৯৭৫)। কবির সময়ে যারা কবিতাচর্চা করতো তাদের অনেকেই হারিয়ে গেছেন কিন্তু তিনি আজও প্রাসঙ্গিক।

অভাবের এই ভূখণ্ডে শিল্পের মধ্য দিয়েই কবি খুঁজে ফিরেছেন সোনালি সুদিন। আকাঙ্ক্ষায় বুঁদ হয়ে তাকিয়ে থাকেন কবি প্রেমের প্রত্যাশায়। আর মানুষের প্রতি প্রেম মানুষকে ধাবিত করে বিপ্লবের পথে। প্রেম, বিষণ্ণতা, একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা আর দীর্ঘশ্বাসে ছেয়ে ছিল কবির যৌবন। তার তৃতীয় কবিতার বই ‘পৃথক পালঙ্ক’ কবিপ্রেম সুরাইয়া খানমকেই উৎসর্গ করা। জীবনের এই না পাওয়া, অতৃপ্তি, হতাশায় মুখ বুজে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন জীবনের বোধকে, ফলিয়েছেন লেখনিতে মুক্তা। ‘আজ তুমি, পরে নাও তোমার গহনা, দুল/তোমার আঙ্গুল হোক হেমন্তের ফুল,/আমি শুঁকি, শুঁকতে দাও!/বহুদিন পর যেনো শুঁকছি বকুল/বহুদিন তোমার ভিতরে যাইনা, বহুদিন বকুল ফুলের ঘ্রাণ/পাইনা এ মনে!’ [ক্লান্ত কিশোর তোমাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখায়]।

শিল্প দিয়ে যুদ্ধে কবির অস্ত্র কবিতা। কবি স্বীকৃতি চান। বেঁচে থাকা, ভালোবাসা, শ্যামল মেয়ে, নাভিমূলের অভিজ্ঞতা, অন্ধকার আর আলো হবার স্বীকৃতি। পৃথিবী জুড়ে চলছে আধিপত্যের খেলা। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীসহ অনেক দেশই শান্তির নামে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে করছে আধিপত্যের বিস্তার। এই আধিপত্যে মানুষ ও মনুষ্যত্ব গৌণ। মানুষ চাঁদে গেল, নতুন নতুন গ্রহ উপগ্রহ আবিষ্কার করল, নতুন নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে পৃথিবীকে আনল হাতের মুঠোয়। তবু কবির মতো কেউ রাত জেগে শুনল না নুলো ভিখিরীর গান, দেখল না দারিদ্র্যের এত অভিমান!

ক্ষমতা আর আধিপত্যের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় পৃথিবী আজ ক্লান্ত। তাই কবিতায় কবির বক্তব্য স্পষ্ট। মানবিক মূল্যবোধের কবি জানে না ভালোবাসা, দুঃখ, বেদনা, যুদ্ধ, নদী কিংবা নগ্নতার কী মাতৃভাষা। একটা নিবিড় বৃক্ষ কোন ভাষায় কথা বলে সেটাও কবির অজানা। শুধু জানে মানুষ! যার কবিতার আরাধ্য শুধু মানুষ : ‘শুধু আমি জানি আমি একটি মানুষ/আর পৃথিবীতে এখনও আমার মাতৃভাষা, ক্ষুধা!’ [মাতৃভাষা]। ক্ষুধাকে কেন্দ্র করেই প্রকৃতপক্ষে রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা আবর্তিত। এই ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অভাব, অনাদর, অবহেলা সর্বোপরি বৈষম্য যতদিন থাকবে পৃথিবীতে হাসানের কবিতার প্রাসঙ্গিকতা ঠিক ততদিন।

বর্তমান সময়ে থেকেও কবি সবকিছু থেকে এগিয়ে থাকেন যা প্রকাশিত হয় তার লেখায়। এজন্য কবিকে হতে হয় রাজনীতি সচেতন। হাসান রাজনৈতিকভাবে সচেতন কবি। তার কবিতার প্রকাশ অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য হলেও সুস্পষ্ট মতামতের আড়ালে নিহিত থাকে দেশজ ও বিশ্ববোধ। পৃথিবীর মানুষ আজও যুদ্ধ করছে বেঁচে থাকার। মানুষ মানবিক হলে, মানুষ মানুষের অধিকার পেলে কবি ফিরে যেতে চান গন্তব্যে। কিন্তু বাস্তবতা অন্য রকম।

কবিতার লাইনে প্রকাশ পায় তাই কবির আক্ষেপ : ‘আমি ভুলে গিয়েছিলাম পৃথিবীতে তিন চতুর্থাংশ লোক এখনো/ক্ষুধার্ত!/আমি ভুলে গিয়েছিলাম রাজনীতি একটি কালো হরিণের নাম!’ [ভ্রমণ যাত্রা]। হাসান কবিতায় খুঁজেছেন ক্ষুধা, পরাধীনতা ও অবক্ষয় থেকে মানুষের মুক্তি। চুয়াত্তরে দেশজুড়ে দুর্ভিক্ষ ও খরা, একাত্তরে সব হারানোর বেদনা ও  ব্যথায় এ দেশ হয়েছে উদিত দুঃখের দেশ। কবির লেখায় তা এখন ইতিহাস।

এসব ইতিহাসের শৈল্পিক দলিল হয়ে চিরপ্রাসঙ্গিক হাসানের কবিতা। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’-এর মতো আহ্বান করে কবি স্বপ্ন দেখেন, বুক বাঁধেন আশায় : ‘উদিত দুঃখের দেশ তাই বলে হে কবিতা, দুধভাত তুমি ফিরে এসো,/সূর্য হোক শিশিরের ভোর, মাতৃস্তন হোক শিশুর শহর!’ [উদিত দুঃখের দেশ]।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //